এতোক্ষণে তাদের খেয়াল হল, আলমারিতে কিছু টাকা ছিল বটে। এবং এতক্ষণে তাদের নজরে পড়ল, আলমারি খোলা। আগে যারা প্রথম ঘরে ঢুকেছিল তারাই সব লুটে নিয়ে গেছে। এখন তবে এদেরকে দেওয়া যাবে কী? মোসাদ্দেক সাহেবের স্ত্রী উর্দুতে বোঝালেন, যা ছিল সব তো তোমরা আগেই নিয়ে গেছ বাবা, এখন তোমাদেরকে আবার কী দেব?
তবে রে ……… বিশ্রী একটা গাল দিয়ে খেঁকিয়ে উঠল একটা জওয়ান। এবং আর একজন তার কর্ম শুরু করল। গুলি নয়, প্রহার। বুটের লাথি ও রাইফেলের বাট দিয়ে সে কী মার! মোসাদ্দেক সাহেবের স্ত্রীও রেহাই পেলেন না। পাঁচ বছরের কন্যাটি ভয়ে খাটের নীচে লুকিয়েছিল। লুকোতে দেখেও ছিল। তারা। কিন্তু তাকে আর টেনে বের করে কী লাভ! ঐকুট এক রত্তি মেয়ে। মারতে গেলে হয়ত মরেই যাবে। তা মারতে আপত্তি নেই। কিন্তু মেরে লাভ? তার চেয়ে থাক। বড়ো হোক একটু। আমরা তো থাকবই এদেশে। আমাদেরই কোনো বেরাদারের কাজে লাগবে তখন। অতএব বুড়ো-বুড়ি দুটোকে মেরে অজ্ঞান করে তার বদলে কচি মেয়েটিকে অব্যাহতি দিল তারা। গতকাল কারফিউ উঠলে সেই রক্তসিক্ত জামা-কাপড়েই তাদেরকে পথে বেরোতে হয়েছিল। অন্য জামা-কাপড় আর ছিল কোথায় যে, তা বদলে নেবার সুযোগ পাবেন তারা। তাদের সঙ্গেই হল থেকে বেরিয়েছিল একটি ছাত্র—মাসুম সিরাজ।
মাসুম সিরাজ বেরিয়ে হল-প্রাঙ্গণেই পেয়েছিল তার বড়ভাই মাসুদ সিরাজের লাশ। সেই লাশ জড়িয়ে ধরে তার সে কী কান্না! সেই লাশ থেকে তাকে ছাড়িয়ে আনা কি যায়! মোসাদ্দেক সাহেব তাকে অনেক বুঝিয়ে নিতে দুর্দশার কাহিনী শুনিয়ে কোনো মতে সঙ্গে করে চলে গেছেন। কোথায়, বুড়ীগঙ্গার ওপারে, জিঞ্জিরার দিকে—সেখানে মোসাদ্দেক সাহেবের এক আত্মীয় থাকেন। কোনো গাড়ি না পেয়ে অগত্যা তারা হেঁটেই চলছিলেন ধীরে ধীরে। ঐ অবস্থায় দেখা হয়েছিল নাজিম হুসেনের সঙ্গে। মোসাদ্দেক সাহেবের প্রাক্তন ছাত্র নাজিম হুসেন তার স্যারকে নিজের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে সদরঘাটে পৌঁছে দিয়েছিল।
মাসুম সিরাজ?
সেও গেছে স্যারের সঙ্গে। মাসুম সিরাজ সুদীপ্তর টিউটোরিয়াল গ্রুপের ছাত্র খুবই ভালো ছাত্র। এস. এস. সি. এইচ. এস. সি-দুটো পরীক্ষাতেই সে। প্রথমে দশজনের মধ্যে ছিল। কিন্তু বড় ভাই মাসুদ ছিল মূলত পড়ুয়া নয়, খেলোয়াড়। ক্রিকেটের গোলা ছুঁড়তে তার জুড়ি মেলা ভার। সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়-একাদশে তার স্থান ছিল অনড়। এই দুটি ভাই কেউই কখনো রাজনীতির ধার কাছেও ঘেঁষত না। অবশ্যই তা নিয়ে কোনো যে গর্ববোধ তাদের মনে ছিল তাও নয়। ওদের দুই ভাইয়েরই মত হচ্ছে, সব কাজ সকলে পারে না। অতএব নীরবে নিরীহ নির্বিরোধ ছাত্রের ভূমিকা নিয়ে হলের এক কোণে তারা পড়ে থাকত। সেই রাতের প্রলয়কাণ্ড শুরু হতেই মাসুদ তার ছোট ভাইকে চৌকির নীচে পাঠিয়ে বিছানাপত্র চটপট গুটিয়ে বেঁধে ফেলেছিল। বিছানার পুলিন্দা চৌকির উপর রেখে ভাইকে উপদেশ দিয়েছিল—এক কোণে চুপচাপ বসে থাকবি, কখনো গলা বাড়াবি নে। অতঃপর বাইরে এস ঘরে তালা দিয়ে কোথায় যে সে লুকিয়েছিল ছোট ভাই তা জানে না! খালি যাবার সময় বলেছিল—
আমার জন্য ভয় করিস নে। আমি কোথাও ঠিক ম্যানেজ করে নেব। কিন্তু হায় সেই ম্যানেজ আর সম্ভব হয় নি। তবে তার বুদ্ধিবলে ছোট ভাই বেঁচে গিয়েছিল ঠিকই। হাঁ, মাসুদের বুদ্ধিতেই মাসুম বেঁচেছিল। তালা দেওয়াকে দুবৃত্তরা বিশ্বাস করে নি। দারোয়ান ছাত্রদের তালা দিয়ে রেখে যেতে পারে না? অতএব প্রত্যেকটি তালা ভেঙ্গে তারা ঘরে ঢুকেছিল মাসুমের ঘরে একেবারে চৌকির পাশে গিয়ে বিছানার স্তুপে বেয়নেটের খোঁচা দিয়ে দেখেছিল। সেই সময়ে চৌকির নীচে মাসুম অস্পষ্টভাবে কেবল দেখেছিল পাশাপাশি দুটি ক্ষুদ্র থামের মতো এক জোড়া পা। একেবারে হাতের নাগালে? ধরে এক টান দিলে কেমন হয়। হাঁ, নিশ্চয় তা সে দেবে। গুড়ি মেরে চৌকির নীচে নজর দেখা চেষ্টা করলে সে আর খাতির করবে না। তখন মরতে এমনিতে হবে। অতএব মরবার আগে একটাকে মারবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে হবে। মেঝের উপরে ফেলে দিয়ে গলা টিপে ধরতে পারলে কেল্লা ফতে। কিন্তু কেল্লা জয় কি অতই সোজা মাসুম! জওয়ানেরা কখনো একা থাকে দেখেছ? একটাকে তুমি কুস্তির প্যাঁচ কষে ফেলতে যদিও পার সঙ্গে সঙ্গে অন্য জওয়ানের গুলি খেতে হবে না তোমাকে? ঐ তো আর একটা জওয়ান একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এবং কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকেই সঙ্গীকে নিয়ে সে বেরিয়ে গিয়েছিল। অতএব মাসুম বেঁচে গেছে। এবং মাসুম কাদছে। এখন সে বড়ো ভাইয়ের খবর নিয়ে। কী করে বাপ মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। এক সাথে দুটি ভাই তারা বরিশালের একটি গ্রামে একত্রে খেলা করে ঝগড়া করে ঈর্ষা ভালোবাসার জোয়ার-ভাটার দোল খেয়ে মানুষ জীবনে কখনো এই দিনটির কথা কি মাসুম চিন্তা করেছিল! তার ভাইয়ের কি দাফন-কাফনও হবে না? ঐখানে পড়ে গলে পচে কাক শকুনের খাদ্য হবে? মাসুম তার স্যারের সঙ্গে হাঁটছিল, আর দুই গাল বেয়ে জল ঝরছিল। এখন ফিরে যাওয়া যায় না? ভাইয়ের কাছে বসে কোরান পাঠ………
মাসুম, ওঠ বাবা, আর তো কিছু করার নেই।
তাই তো, একটা গাড়ি পাওয়া গেছে। স্যার উঠে গেছেন এবং মাসুমকে উঠতে বলছেন। আর যে হাঁটতে হবে না, সেই কথাটা একবার চট করে মনে। পড়ে গেল মাসুমের, এবং উঠে বসল নাজিমের ঝকঝকে মরিস মাইনরে।
১০. সুদীপ্ত বাসায় পৌঁছলেন
সুদীপ্ত বাসায় পৌঁছলেন সাড়ে বারটার দিকে। পৌঁছেই বুঝলেন তাঁকে ঘিরে একটা উৎকণ্ঠার নিম্নচাপ তীব্র আশঙ্কার ঝড়ে রূপ নিচ্ছিল। আমিনাকে সামলাতে মীনাক্ষী হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন।