কদিন থেকেই মোসাদ্দেক সাহেব কেমন যেন স্বস্তিতে ছিলেন না। বিশে মার্চের রাতে কাকের ডাক শুনেই তিনি বুঝেছিলেন সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। ইস্ কী ব্যাকুল হয়ে কাকটা ডেকেছিল সে রাতে। আবার দেখ, ঠিক পরের রাতে সেই স্বপ্ন। স্বপ্নে একটা বিশাল বাক্স দেখলেন মোসাদ্দেক সাহেব। এবং ঘুম থেকে জেগেই স্ত্রীকে ডেকে বললেন, এ বাড়ি থেকে চলে যাবার আদেশ হয়েছে। কিন্তু স্বপ্নে তো বিছানা দেখেননি, কেবলি বাক্স দেখেছেন। অতএব বাক্স-বিছানা গুটিয়ে একেবারে চলে যাবার নির্দেশ এ নয়। বাক্স বোঝাই করে যা পার সরিয়ে ফেল। বাইশে মার্চেই মোসাদ্দেক সাহেব বয়স্ক পুত্র-কন্যাদের দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সঙ্গে যতোটা সম্ভব টাকা-কড়ি ও গহনাপত্রও সুরিয়েছিলেন। বাসায় ছিলেন কেবল তারা স্বামী-স্ত্রী এবং কোলের একটি শিশু কন্যা। অতএব খুবই স্বাভাবিক যে, পাক-জওয়ানরা মোসাদ্দেক সাহেবের বাসায় ঢুকে আদৌ খুশি হয় নি। এ কেমন বাড়ি? রেডিও কৈ? সেলায়ের কল, টি, ভি, কিছুই যে নেই। মাত্র দুজন বুড়ো-বুড়ি। ছুকরী আওরাত কাঁহা? ধুত্তোর, এ সালা লোগ কো লে যাও, গোলি কর। শিশু-কন্যাকে বুকে নিয়ে ওরা স্বামী-স্ত্রী আগে পিছনে দুজন জওয়ানের সাথে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। মানে, বেরুতে হল। হলের আঙ্গিনায় যেতেই মোসাদ্দেক সাহেবকে দেখে হাউমাউ করে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। একটি ছাত্র। তাঁরই হলের ছাত্র। হলে ছাত্র সামান্যই ছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে ওরা ধরতে পারে নি। কেউ পালিয়ে বেঁচেছে, কেউ লুকিয়ে। ধরা পড়েছে জন পাচেক। তাদেরই একজন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল মোসাদ্দেক সাহেবকে।
বাঁচান স্যার। আমাকে বাঁচান। আমার বিধবা মায়ের আমি একমাত্র ছেলে। আমাকে বাঁচান।
মোসাদ্দেক সাহেবের মনে হল, এ তার নিজেরই সেই ক্ষুদ্র শিশু পুত্রটি। ভয় পেয়ে এসে বুকে আশ্রয় নিয়েছে। এমনি করেই ছোট শিশুরা রাতের আঁধারে ভয় পেয়ে বাপের কোলে মুখ লুকোয়। কিন্তু হায়, বক্ষের সকল অভয়বাণী যে শুকিয়ে গেছে। মুখে কোনো কথা জোগাল না। দুহাত দিয়ে বুকে চেপে ধরলেন ভয় পাওয়া সন্তানকে। কিন্তু কেবলি তো স্নেহ দিয়ে যমের কবল থেকে সন্তানকে রক্ষা করা যায় না। সেই মুহূর্তে মোসাদ্দেক সাহেব প্রবল যমের সম্মুখে ভীত অসহায় একটি জননীর প্রতীক হয়ে উঠলেন। আর যমের দোসর একটি জওয়ান এসে ছেলেটির মাথার চুল ধরে তাকে টানতে টানতে। নিয়ে গেল, মোসাদ্দেক সাহেব কি পাষাণ হয়ে গিয়েছিলেন? তাঁর স্ত্রী কিন্তু সম্পূর্ণ বোধটুকু হারান নি। তিনি চীৎকার করে উঠলেন—
খোদার কসম লাগে, এই বিধবা মায়ের ছেলেটিকে তোরা–
ভদ্রমহিলার কথার শেষটুকু আর গুলির শব্দে শোনা গেল না। ছেলেটি মাটির বুকে লুটিয়ে পড়ল। তারপর? বাকি ছাত্রগুলিকে ওরা হুকুম করল–
বোলো জয় বাংলা।
ছেলেরা কি বলবে। ভয়ে সকলের গলা শুকিয়ে গেছে। তা শুকোতে। পারে। তবু কথা বলবে না এ কেমন বে-আদবি! দেখাচ্ছি মজা। একটি সৈনিক। ছুটে গিয়ে একটি ছাত্রের তলপেটে মারল একটা জোর-লাথি। ভারি বুটের লাথি। একটা কাতর শব্দ করে পড়ে গেল ছেলেটি। কিন্তু রেহাই মিলল না। মিলল বেয়নেটের খোঁচা। আর সঙ্গে সঙ্গে ভীতস্বরে বাকি ছেলেগুলি বলে উঠল জয় বাংলা।
হাঁ, এই তো পাওয়া গেছে। হে বঙ্গ সন্তান, এবার তোমাদেরকে হত্যা। করার হেতু পাওয়া গেছে। মুহূর্তেই তিনটি শব হয়ে ছাত্র তিনটি লুটিয়ে পড়ল। মায়ের বুকে। অধ্যাপক মোসাদ্দেক হোসেন যেন দেখলেন, জননী শাহেরবানুর কোলে এলিয়ে পড়ল তাঁর তীরবিদ্ধ সন্তান—এজিদের সৈনিকরা জল চাওয়ার অপরাধে তীরবিদ্ধ করেছে শাহেরবানুর দুধের শিশুকে। জলেরই অন্য নাম জীবন। এ ছেলেরা সেই জীবনকে চেয়েছিল স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকের জীবন। তার পরিবর্তে ভাগ্যে জুটেছে গুলি।
অতঃপর মোসাদ্দেক সাহেবদের পালা। তিনি কলেমা পড়ে তৈরি হলেন। মরবার জন্য। সৈনিকটিও রাইফেল তাক করে দাঁড়াল। হাঁ, ঠিক এমনি একটা অবস্থার মুখেও তিনি বেঁচেছেন। এবং বেঁচে আছেন। মোসাদ্দেক সাহেবের স্ত্রী। উর্দু জানতেন। তিনি সেই মুহূর্তে ছুটে এসে স্বামীকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং সৈনিকটিকে ‘বেটা!’ সম্বোধন করে পরিস্কার উর্দুতে বলেছিলেন–তোমার পিতাজীর প্রাণ ভিক্ষা চাই বেটা! এ কথায় কাজ হয়েছিল? বহু ক্ষেত্রেই হয়নি। বাপ ডেকেই সর্বত্র কি দুবৃত্ত লম্পটের হাত থেকে মেয়েদের রেহাই মেলে? কিন্তু কচিৎ কোন-ক্ষেত্রে মিলতেও পারে। অন্ততঃ মোসাদ্দেক সাহেব রেহাই পেয়েছিলেন। এই প্রৌঢ় দম্পতি-যুগলের মুখের পানে চেয়ে সামান্য একটি পাঠান সৈনিকের মনে কি ভাবের উদয় হয়েছিল তা এ ক্ষেত্রে অনুমান করা যায়নি। হয়ত তার মন বলে থাকবে—আমি কি করব মা, আমি তো হুকুমের গোলাম। কোনো-কিছু করা না করার ব্যাপারে সাধারণ একটি সৈনিকের স্বাধীনতা কতটুকু? সেটা মোসাদ্দেক সাহেব বা তার স্ত্রী বা তার ছাত্র নাজিম হুসেন কেউই জানেন না। কেবল কয়েক ঘণ্টা পর একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে মোসাদ্দেক সাহেব দেখেন, নিজের বাসাতেই শয়নকক্ষে তারা বসে আছেন— তিনি তাঁর স্ত্রী, আর ছোট মেয়েটি। আল্লাহ তোমার কৃপাতেই এ যাত্রা। বাঁচলাম। মনে মনে আল্লাহ্র প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায় মোসাদ্দেক সাহেব টইটম্বর হয়ে ওঠেন। কিন্তু কেমন করে যেন পরক্ষণেই ভাবনাটা। আসে—আবার কেউ আসবে না তো! হায়, সেই আশঙ্কাই সত্য হল কয়েক ঘণ্টা পর। দুপুর বেলায় নামায পড়বেন বলে ওজু করতে গেছেন মোসাদ্দেক সাহেব। মনে সেই আফসোসটা ছিলই। আজ শুক্রবার। শুক্রবারে আজ জুমার নামাযের জামাত হবে না। অগত্যা জোহরের জন্য ওজু করতে ঢুকলেন বাথরুমে। সহসা কন্যার চীৎকারে সেখান থেকে বেরিয়ে দেখেন, দুটি যমদূত। দুজন পাকিস্তানি জওয়ান ঘরের মধ্যে। তাদের একজন মোসাদ্দেককে দেখেই তার বুকের কাছে রাইফেলের নল তুলে ধরে দাবি জানাল—রুপেয়া নিকালো।