আহা, ঘর-দোর ঠিক তেমনি সাজানো আছে। এইটে ওদের লাউঞ্জ ছিল না! আহা, এই তো সেই হালিমার খোকার দোলনাটা। তারা বড়ো লোক না। হলেও এমনি সুন্দর একটি দোলনা কিনে দিয়েছিলেন তার মেয়ের জন্য। মেঝেতে এটা? একখণ্ড কাপড়। পলি তুলে দেখেন, ছোট বাচ্চাদের জাঙিয়া। নিশ্চয় হালিমার খোকার। আধুরে, তোকেও ওরা মেরেছে নাকি। জাঙিয়াটা বুকে চেপে ধরে পলি হু-হু করে কেঁদে ওঠেন। ওরে আমার সোনামণিরা, মা। হয়ে তোদের বাঁচাতে পারি নি। কিন্তু শোধ এর নেব, নেবই নেব।
ওরে হাড়-হাভাতে পাষণ্ডরা। বাংলার এমন কতো সাজানো সংসার তোরা। নষ্ট করেছিস? বল কত? আহা কী সুন্দর সংসার ছিল হালিমার! সইয়ের সেই। পবিত্র সংসারকে ওরা আজ পণ্যাঙ্গনাবৃত্তির ক্ষেত্র করতে চায়। তার সাজা তোদের পেতে হবে। পড়েছিস পলির হাতে। প্রথম রাতেই পলি হত্যা করেন সেই পাঞ্জাবি অফিসারটিকে। মদ খেয়ে অফিসারটি যখন নিস্তেজ হয়ে বিছানায় পড়েছিল ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণে হেঁসেল ঘর থেকে বঁটি এনে প্রাণপণ শক্তিতে পাঞ্জাবির গলায় চেপে ধরেন পলি। হারামখোর মিনসের গায়ে এতো রক্তও ছিল। বিছানা ভিজে রক্তের ধারা গড়িয়ে মেঝেয় পড়েছিল। আশ্চর্য, পলি ভাবী একটুও অপ্রকৃতিস্থ হন নি।
কী বিপর্যয় ঘটে গেছে পলির উপর দিয়ে। তাতেই তো পাগল হয়ে যাবার কথা। ছোট বোন রোজি পাগল হয়ে গেছে, তাকে ওরা বের করে দিয়েছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে। অতঃপর সে যে কোথায় গেছে কেউ জানে না। রোজির মতো অমনি পাগল হলে ওই হারামির পোলাগুলোর তাতে কী আসে যায়। আবার কোনো ভদ্রঘরের মেয়ে ধরে এনে শূন্যস্থান পূর্ণ করবে। ওতে প্রতিশোধ নেওয়া হবে কি করে? মরেছিই যখন, তখন যে করে থোক একজনকে মারবই।—পলি ভাবী তার এই প্রতিজ্ঞা-পালনে ব্যর্থ হন নি। এবং কেবল প্রতিজ্ঞা পালন করেই খুশি হন নি। পাঞ্জাবি অফিসারটিকে হত্যার পর বেরিয়ে একটা রিক্সা করে সোজা এসেছিলেন নাজিম হুসেনের কাছে।
ভাই, একটা মাইন জোগাড় করে দিতে পার।
হয়ত নাজিম হুসেন চেষ্টা করলে তা পারে। কিন্তু ঐটেই এখন বলার কথা নাকি! কয়দিন অদৃশ্য হয়ে থাকার পর সহসা উদিত হয়ে এখন তিনি বলছেন, আমাকে একটা মাইন জোগাড় করে দিতে পার। তার আগে তো শুধাবার ও শুধিয়ে জেনে নেবার জন্য এক ঝুড়ি প্রশ্ন ও কৌতূহল মনে জমা হয়ে আছে। হা, সব প্রশ্নের উত্তর পলি ভাবী দিয়েছিলেন। আদ্যন্ত ঘটনা সব শোনার পর। নাজিম হুসেন কী বলবেন ভেবে পান নি। শুধাতে ইচ্ছে হয়েছিল—কই, আমনদার কথা কিছু তো শুধালেন না ভাবী? না না, ঐ কথা না ভোলাই ভালো। প্রচ্ছন্ন ক্ষত-মুখে খোঁচা মারা হবে না সেটা। অতএব সে কথা সে আর তুলল না। তাদের বাড়ি তখন খালি। মেয়েদের সব গ্রামাঞ্চলে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা কয়েকজন পুরুষ কেবল থাকে সেখানে। স্বাভাবিক অবস্থায় পলি। সেখানে থাকতে পারতেন? এখন কিন্তু কোনো অসুবিধা হল না। স্বচ্ছন্দে। সেখানেই কয়েক দিন কাটিয়ে পলি ভাবী একদিন অদৃশ্য হলেন। কেবলি সেই বাড়িটা থেকেই নয়। একেবারে সংসার থেকেই। হাঁ অদৃশ্য বৈ কি। সহসা। একটা মিলিটারি-ভরতি ট্রাকের নীচে পলি ভাবী অদৃশ্যই তো হয়েছিলেন। নাজিম হুসেনের সংগ্রহ করে-দেওয়া মাইন-বুকে বেঁধে সেই ট্রাকের সামনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন পলি ভাবী। একটি মুহূর্ত, একটি প্রচণ্ড শব্দ—তার পরের দৃশ্য। হচ্ছে, রাস্তার একাংশ জুড়ে ইতস্তত ছিটকে পড়া একটি প্রকাণ্ড ট্রাকের ভগ্নাংশ। আর অমন বিশ-পঁচিশটা শক্ত সেনার লাশ। আর? হ, আরো ছিল। লালপেড়ে। শাড়ির ছিন্ন অংশ, ভগ্ন বিক্ষিপ্ত ট্রাকের গায়ে ও রাস্তায় লেপটে-যাওয়া কাঁচা থেতলানো মাংস আর রক্ত। ওই গুলোই পলি ভাবী। জ্বালামুখি রোশেনার পথ। বেছে নিয়ে দেহের অসম্মানকে ধূলোয় ছুঁড়ে দিয়ে তিনি চলে গেলেন। রোশেনা। কি শুধুই একটি নাম? সে একটি আদর্শ। সুদীপ্তদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী রোশেনা। বাঙালি-হত্যার শোধ নিতে শরীরে মাইন জড়িয়ে শত্রু সেনার ট্যাঙ্কের নীচে আত্মাহুতি দিয়েছিল সেই বীরদর্পিণী বঙ্গললনা। রোশেনা তাই বাঙালির ঘরে একটি রূপকথার নাম। বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিটি নবাগত শিশুর কাছে রূপকথার মতোই সমাদৃত হবে রোশেনার কাহিনী—সেই সঙ্গে পলি। ভাবীরও।
নাজিমের পলি ভাবীর এই পরিণতি অবশ্যই কয়েক দিন পরের ঘটনা। পরে একসময় নাজিমের সঙ্গে দেখা হলে তার কাছে সব শুনেছিলেন সুদীপ্ত। কিন্তু এখন শুনলেন তাঁর সহকর্মী মোসাদ্দেক সাহেবের কথা। মোসাদ্দেক ছিলেন এস. এম. হলের হাউস টিউটর। আশ্চর্য, গতকাল থেকে একবারও সুদীপ্তর মধ্যে এস, এম, হলের চিন্তাটা আসেনি। ঐ হলের উত্তর ও পূর্ব দিকের রাস্তা দিয়েই গতকাল তিনি হেঁটেছেন, অথচ হলে যে তাঁদের ছাত্ররা ছিল, তার কয়েকজন সহকর্মী ছিলেন, তাঁদের কথা তার মনে হয়নি। ইকবাল হলের চিত্র তাকে আচ্ছন্ন করেছিল—হল ক্যান্টিনের কাছে মৃত মানুষের স্তূপটাকে ঘিরে ঘিরে কেবলি এক রাশ প্রশ্ন সৃষ্টি হচ্ছিল তার মনে। মানুষ মেরে হত্যাকারী তা লুকাবার চেষ্টা করে, কিন্তু এরা তা কি সকলকে দেখাতে চায়? নিশ্চয়ই না। বোধহয় এতো বেশি মেরেছে যে, তার সবটুকু লুকানো এখন ওদের আয়ত্তের বাইরে। নাকি ওরা এখন সর্বপ্রকার লজ্জা শরমের অতীত? ইস কী মর্মান্তিক সেই দৃশ্য। ইত্যাদি নানা কথা ভাবতে ভাবতে এবং নানা দৃশ্যের যন্ত্রণায় বার বার আক্রান্ত অভিভূত হতে হতে এস. এম. হলের পাশ দিয়ে কখন চলে গেছেন এবং ফিরেছেন ফিরোজের গাড়িতে। অতএব এস. এম. হল সম্পর্কে কোনো ধারণা এখন তিনি অন্যকে দিতে পারেন না। মোসাদ্দেক সাহেবের ওখান থেকে তিনি কি খুব দূরে ছিলেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে তো একেবারে পাশাপাশি ঘরে তারা বসে থাকেন। স্থানের দূরত্ব কোথাও বেশি নয়। কিন্তু মনের দুরত্ব? হাঁ, ওটাও একটা কারণ হতে পারে যে, নাজিমের কাছে শোনার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সুদীপ্তর মনে মোসাদ্দেক সাহেব সম্পর্কে কোনো কৌতূহল ছিল। না, কোনো বিরূপতাও নয়। ভদ্রলোককে কেমন যেন সুদীপ্তর পছন্দ হয়। সকলকেই সকলে পছন্দ করতে পারে? বিশেষত দুজনের বাস যদি দুই জগতে হয়! মোসাদ্দেক সাহেব ছিলেন প্রাচীন আচারের বালুরাশি-আচ্ছন্ন দ্বীপের। অধিবাসী।