সুদীপ্ত ভাগ্যবান বৈ কি। সুদীপ্তর নিজেরও ধারণা, খুব সহজে বোধ হয়। মৃত্যুর মুখ তাঁকে দেখতে হবে না। তা হলে ঐ রাতেই সে কর্মটি সমাধা হতে। পারত। হয় নি যে সেটা এখন কোনো সৈনিকের মৃঢ়তা বা দূর্বলতা বলে তাঁর আর মনে হয় না। ওটা ভাগ্য। এই ভাগ্য প্রার্থনা করলেই মেলে এমন নয়। সে খামখেয়ালি, যার উপর ইচ্ছে প্রসন্ন হয়, তার অপ্রসন্নতাও কোন নিয়ম মেনে। আসে না। কোন কারণ ছিল না, অথচ গাড়িটা ঠিক ঐ সময়ই ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিল। আমনের মৃতদেহ যেন সুদীপ্তর বসন-প্রান্ত আঁকড়ে ধরে সুদীপ্তকে স্থবির করে দিয়েছিল। ঐ অবস্থায় আর কিছুক্ষণ কাটলেই মৃত্যু অবধারিত ছিল। কিন্তু ভাগ্য একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছিল। তখন কারফিউ শুরু হতে মাত্র দশ মিনিট বাকী—অন্তত গাড়ির চালকটি তাই জানত। অতএব অতি দ্রুত সে বাসায় ফিরছিল। জনহীন পথে একটি মানুষও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বলাকা বিল্ডিংয়ের পাশে তাই সুদীপ্ত খুব সহজেই তার চোখে পড়েছিলেন। এ কি! স্যার এখানে। নাজিম শুনেছিল, সুদীপ্ত স্যার মারা গেছেন। সুদীপ্তর ছাত্র নাজিম হুসেন চৌধুরী। বছর তিনেক আগে পাস করে বেরিয়ে গেছে। এখন সাংবাদিকতা করে। গাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে নাজিম তার স্যারের কদমবুসি করে প্রায় কেঁদেই ফেলল। আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠল–
স্যার, আপনি!
কিন্তু সুদীপ্ত কিছু বলার আগে চিত্রশিল্পী আমনের পানে চেয়ে নাজিম আকাশ থেকে পড়ল যেন–
এ কি স্যার। আমনদা এখানে। আমরা তো আজ সকালেই এঁকে হাসপাতালে দিয়েছিলাম।
স্যারের বৃত্তান্ত শুনল নাজিম। এবং নাজিমের কাছেই শিল্পী আব্দুল্লাহ্ মনসুরের আদ্যন্ত খবর পেয়েছিলেন অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহীন। গাড়িতে ছাত্রের সঙ্গে চলতে চলতে খবর পেয়েছিলেন, কিছু পেয়েছিলেন পরে—নাজিমের সঙ্গে পুনরায় দেখা হলে। আর পেয়েছিলেন তাঁর সহকর্মী মোসাদ্দেক হোসেন। ইউসুফ সাহেবের খবর।
আজ সকালে সাংবাদিকদের যে ক্ষুদ্র দলটি শিল্পী আমনকে হাসপাতালে। পৌঁছে দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে এই নাজিমও ছিল একজন। সকালে তারা সংজ্ঞাহীন দেহ হাসপাতালে দিয়েছিলেন, এখন এই প্রাণহীন দেহ নিয়ে করবেন কী? কাল থেকে কতো শবই তো দেখছেন! মৃতদেহ সম্পর্কে মন এখন অদ্ভুত রকমের অসাড়। খালি দেখো, কারা বেঁচে রইল। স্যার বেঁচে আছেন। স্যারকে নিয়ে নাজিম তার গাড়িতে স্টার্ট দিল।
আমনদা নাজিমের বহুকালের পরিচিত, এবং আত্মীয় না হয়েও আত্মীয়ের মতো আসা-যাওয়া ছিল তার আমনদার বাড়িতে। কিন্তু আমনদা এখানে কোথায়!—গতকাল রোজিদের বাড়িতে আমনদাকে দেখে প্রথমে বিস্মিত। হয়েছিল নাজিম। পরে তার গুলিবিদ্ধ পুত্রকন্যাদের দেখে, এবং কোথাও ভারী সাহেবাকে না দেখে, ব্যাপারটা কিছু কিছু সে অনুমান করেছিল। হাসপাতালে আমনদাকে দিয়ে সে গিয়েছিল ভাবী সাহেবার খোঁজে তাদের বাড়িতে। এবং যথারীতি ভাবী সাহেবাকে কোথাও পাওয়া যায় নি। তবে কি সেই কানাঘুষোটা সত্য? সাংবাদিক মহলে সে কানাঘুষো শুনেছিল শহরের সম্ভ্রান্ত মহিলাদের ধরে নিয়ে গিয়ে ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে সামরিক অফিসারদের জন্য একটি গণিকালয় স্থাপন করা হয়েছে। সংবাদটা যে সত্য তার প্রমাণ পরে নাজিম হাতে হাতেই পেয়েছিল। দিনের বেলা দাসীবৃত্তি এবং রাতে গণিকাবৃত্তি—এই দুই কর্মে নিযুক্ত করা হয়েছে শহরের বহু সম্রান্ত পরিবারের মেয়েকে। সেখানে তাদেরকে শাড়ি পরতে দেওয়া হয় না, কেবল সায়া পরে থাকতে হয়। পাছে কেউ গলায় ফাঁস পরে আত্মহত্যা করে সেই জন্যই এই ব্যবস্থা। কিন্তু সেই ব্যবস্থার মধ্যেও পলি ভাবী তার মুক্তির পথ করে নিয়েছিলেন। কলেজে পড়ার সময় এককালে নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি। তখন কি তিনি জানতেন যে, সংসার জীবনেও এমনি অভিনয়ের প্রয়োজন কখনো হবে। হাঁ, পলির অভিনয় নিখুঁত হয়েছিল। একটি পাঞ্জাবী অফিসারের সাথে প্রেমের অভিনয় করেছিলেন তিনি। কেন? বাঁচবার জন্য কি? বাঁচার সাধ আর পলির ছিল না। তার বুক থেকে তিন বছরের শিশু কন্যাকে ছিনিয়ে নিয়ে চোখের সামনে পাষণ্ডরা যখন গুলি করে হত্যা করল সেই মুহূর্তেই পাষাণ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। পলির পাথর-কঠিন প্রাণে একটি দীপ্ত শপথের পাপড়ি বিকশিত হয়েছিল। তিনি প্রেমের অভিনয়। করেছিলেন শুধু সেই প্রতিজ্ঞা পালনার্থে। বাঁচার চিন্তাটা তার মনের ত্রিসীমানার মধ্যে কোথাও ছিল না। তার মনে ছিল, অন্ততঃ একটি পাঞ্জাবী অফিসারকে মারতে হবে। অতঃপর সম্ভব হলে আরো কিছু। সেই দৃপ্ত ইচ্ছার তাড়না তাকে পথ দেখিয়েছিল। গায়ের জোরে না পারি ছলনার আশ্রয় নেব। ইয়াহিয়া নেয়নি। ছলনার আশ্রয়। আপোস আলোচনার নাম করে সামরিক প্রস্তুতির জন্য সময় সংগ্রহের নাম ছলনা নয়? পলিও ছলনা-জাল বিস্তার করেছিলেন।
বাঙালি-নিধন শুরু করার প্রস্তুতি-পর্বে পাঞ্জাবিরা তাদের স্ত্রীদের দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন নারীবর্জিত জীবনে পলির ফাদে সহজেই ধরা দিল সেই তরুণ পাঞ্জাবী অফিসারটি। পলিকে সে-ই উদ্ধার করে ক্যান্টনমেন্টের গণিকালয় থেকে, এবং শহরের মধ্যে একটি বাড়িতে এনে রাখে। কিন্তু এ কোন বাড়ি? এ বাড়ি তো পলির অপরিচিত নয়। এখানে সেই হালিমার থাকত না? হালিমার স্বামী একজন খুবই স্বনামখ্যাত স্বদেশকর্মী, এবং ধনা। হালিমা পলির স্কুল জীবনের বান্ধবী। রূপ থাকার জন্য রুপেয়াওয়ালার ঘরে বিয়ে হয়েছিল। পলি কয়েকবারই এসেছেন তার বান্ধবীর বাড়ি। হাঁ এই তো সেই বাড়ি। কিন্তু হালিমারা কোথায়? সুন্দরী হালিমা যদি ওদের চোখে পড়ে থাকে! হায় সেই পাষণ্ডরা এমনি কতো সংসার ধ্বংস করেছে গো! বাংলাদেশের কছু আর থাকল না।