না, ঐ পানে আর চেয়ে থাকা যায় না। এক সময় সুদীপ্ত চঞ্চল হয়ে উঠলেন। মানুষের শব কত আর দেখা যায়। গত বিশ-পঁচিশ দিন ধরে কত রক্ত, কত লাশ তিনি দেখেছেন, কিন্তু কান্না শোনা যায়নি। এই তো এই মার্চেরই মাঝামাঝিতে সেই দিনগুলি! সেদিন গত রাতের কয়েকটি শব এনে ছেলেরা বিশ্ববিদ্যালয়-প্রাঙ্গণের বটতলায় জড়ো করেছিল। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা সেই শব ঘিরে শ্লোগান দিচ্ছিল—”বাঙালি ভাই, ভাই-রে-বাঙালি ভাইয়ের রক্ত দেখ।” সকলে সেই রক্ত দেখেছিলেন। এ তো লাল পলাশের রঙ নয়। রক্তের রঙ এতো কালোও হয়? যেন কয়েকটি কৃষ্ণচূড়া আক্ষরিক অর্থেই কৃষ্ণ হয়েছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের সারথি হয়ে তাকে ন্যায় সমরে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এই কৃষ্ণ শহীদ ভাইয়েরা তেমনি ন্যায়ের সংগ্রামে গত রাতে দ্বারে দ্বারে ডাক দিয়েছিল-জয় বাংলা। বাংলাকে জয়যুক্ত করার সংগ্রামে তোমরা বীর বাঙালি বেরিয়ে এস। মানি না মানি না, কারফিউ মানি না।
গতরাতে শহরে কারফিউ দেওয়া হলে ওরা তা মানে নি। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাংলাদেশের দাবি আদায়ের সামকে টুটি টিপে মারার জন্য দিয়েছিল কারফিউ। সে কারফিউ নীরবে মেনে নেওয়ার মধ্যে ছিল। স্বদেশের অপমান। সেই অপমান ঘোচাতে ওরা বেরিয়েছিল পথে। শ্লোগান দিয়েছিল–জয় বাংলা। “জয় বাংলা” শ্লোগানে যেন বিছুতির জ্বালা। ওদের সর্বাঙ্গ জ্বলে যায়! কভি নেহি বরদাস্ত করেগা। যে মুখের কথায় এতো জ্বালা গুলি মার সেই মুখে—একটা বর্বর ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ইয়াহিয়ার সৈনিক নামধারী দস্যুরা। বাংলা শব্দটা উচ্চারণের সময় মুখ প্রসারিত হলে ঠিক সেই যথালগ্নে ওদের মুখ লক্ষ্য করে গুলি করে আর তার ফলে, দেখ, মুখের তালু ভেদ করে সারা মুখ খানা কী বিকৃত হয়ে গেছে। কিন্তু মুখের সেই বিকৃতি যেন, সুদীপ্তর মনে হয়েছিল, সারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক বিরাট ব্যঙ্গ। ওরা যেন যাবার আগে একটা মুখ ভেঙচি দিয়ে গেছে ইয়াহিয়াদের পাকিস্তানকে। না, ওদের সঙ্গে আর নয়। সেই লাশগুলি সেদিন যারাই দেখতে এসেছিলেন তাঁদেরই মনে জন্ম নিয়েছিল কথাগুলি-না, ওদের সঙ্গে আর নয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের সেই প্রাচীন বটবৃক্ষ তার সাক্ষী। ওগো প্রাচীন বটবৃক্ষ, সাক্ষী থেকো। তুমি—ওদের সঙ্গে আর নয়। ছাত্রদের প্রতিটি আন্দোলনের সাক্ষী সেই প্রাচীন বটবৃক্ষ। উনসত্তরের আয়ুব-বিতাড়নের আন্দোলনে এই বটতলা থেকেই ছাত্রেরা যুদ্ধ করেছিল মোনায়েম খানের পুলিশ বাহিনীর সাথে। না, পুলিশেরা রাইফেল মেশিনগান নিয়ে আসেনি। এসেছিল লাঠি ও টিয়ার গ্যাস নিয়ে। লাঠির। মোকাবিলা করতে ছেলেরা সক্ষম ছিল, কিন্তু টিয়ার গ্যাস? সুদীপ্ত নিজে না দেখলে তা কি বিশ্বাস করতেন? টিয়ার গ্যাসের শেলগুলো এসে পড়তেই ভেজা চট হাতে জড়িয়ে সেগুলো ধরে ফেলছিল তারা, এবং ছুঁড়ে মারছিল রাস্তার পুলিশের দিকে তখন পুলিশেরাই তার ফলে টিয়ার গ্যাসের জ্বালায় অস্থির। সে এক আশ্চর্য যুদ্ধ! তার পরেই তো ঘটে গেল পর পর দুটি মৃত্যু ঢাকায় মারা। পড়লেন ছাত্র নেতা আসাদ, রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রপ্রিয় অধ্যাপক শামসুজ্জোহা। শামসুজ্জোহার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সময় আন্দোলন এমনিই ভয়াবহরূপে ব্যাপকতা পেল যে আয়ুবশাহী আর টিকল না। তখন মুখোশ পরে এল ইয়াহিয়া। মুখোশধারী ইয়াহিয়া প্রথম দিকে অভিনয় ভালোই করেছিল। ধূলো দিতে পেরেছিল বাঙালির চোখে। কিন্তু সব মুখোশ আর খুলে গেল গত পয়লা মার্চ তারিখে। জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে বাঙালি যে এমন একটা কাণ্ড করবে তা কেউ ভেবেছিল নাকি! আয়ুব খান উপদেশ ইয়াহিয়াকে ঠিকই দিয়েছিলেন—দেখ হে, তুমি সোলজার মানুষ। ঐ সব ডেমোক্র্যাসি তুমি হজম করতে পারবে না। সকলের পেটেই কি ঘি হজম হয়?
হুজুর, সে কথা আমিও জানি। এ কেবল একটা ধাপ্পা। পরিষদে ইনশাআল্লাহ দেখবেন কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। তারা তখন ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু করবে। আর সেই সুযোগে–
কিন্তু সুযোগ পেলে তো হে। ধর, বঙ্গাল মুলুকের সকলেই একটা মাত্র দলকেই ভোট দিল। তখন? হুজুরের কথায় ইয়াহিয়া তখন মুখ টিপে হেসেছিল। হুজুর এই জন্যই আপনি তখৃত হারালেন। বাঙালি চরিত্রকে আপনি চিনেন না। ঝগড়ার ভয়ে যাদের দুজনকে একসাথে কবর পর্যন্ত দেওয়া যায় না তারাই মিলে মিশে একটা মাত্র দলকে ভোট দিয়ে জয়ী করাবে। এও বিশ্বাস করতে বলেন হুজুর! আপনি যে হাসালেন দেখি।
কিন্তু সত্যকার হাসবার দিন ইয়াহিয়া পায় নি। নির্বাচনের ফল বেরুলে সব হাসি তার মিলিয়ে গেল। এবার? হায় হায় দালালি করতে পারে এমন যে নামগুলি নোটবুকে টোকা ছিল তারা সব যে হেরে গেল। এখন যে আর চিন্তা করেও কোনো কুল মেলে না। ধুত্তোর চিন্তা। শারাব লে আও। মদের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিল ইয়াহিয়া এবং কিছু চিন্তা না করে হুকুমজারি করল জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ। কিন্তু কেন? এবং কতো দিনের জন্য? এ সব প্রশ্নের জবাব দেওয়া হল গুলিতে। ইয়াহিয়া তার দেশ শাসনের ব্যাপারটাকে সরল ও সনাতন একটি সূত্রের উপর স্থাপন করল।—তেরে মেরে ডাণ্ডা, করে দেব ঠান্ডা। বেশ, তবে তাই হোক। ডাভার জোরই পরীক্ষা হয়ে যাক। বাঙালির কাঁদবার দিন আর নেই। এবার অস্ত্রের উত্তর অস্ত্রের ভাষায়। বাঙালির কান্নার দিন। শেষ হয়েছে। এই যে সারা মার্চ মাস ধরেই বাংলাদেশে ইতস্তত নরহত্যা চলল এ জন্য বসে বসে কাঁদলে কি বাঙালি বাঁচত। আশ্চর্য, ওরা যত মেরেছে ততই দৃঢ় শপথে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাঙালি। পালটা মার দেবার শপথ নিয়েছে দুর্জয়। শপথ। কিন্তু গত পঁচিশের রাতের সেই মার? তার বিরুদ্ধেও দাঁড়াবার সাহস তার হবে? এক শো বার হবে। হতেই হবে। পালটা মার দিতে না পারলে বাঙালির দশা এখন কি হবে বলতে পার? দাস্যবৃত্তি আর গণিকাবৃত্তি। তার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে!