আমনের পাঁচ বছরের ছেলের বুকে গুলির চিহ্ন দুটি, তিন বছরের মেয়ের বুকে একটি এবং রোজির ভাগনেটির গায়ে গুলির দাগ ছিল তিনটি দুটি বুকে একটি পাঁজরে। যুবক ও শিশুদের মেরে যুবতীদের ধরে নিয়ে গেছে। আর লুটপাট করে নিয়ে গেছে যা নেওয়া যায়। কাঠের আসবাবপত্র নেওয়া যায় না। সেইগুলি পড়ে আছে।
–সর্বত্রই হানাদারদের কার্যক্রমের মধ্যে এই একটা মিল ছিল ভারি সুন্দর। যা পার লুটে পুটে নাও, যুবতীদের হরণ কর, অন্যদের হত্যা কর। না, সব ঘরেই তারা ঢেকে নি। কিন্তু যেখানেই ঢুকেছে এই কার্যধারায় কোন ব্যতিক্রম ঘটে নি। ব্যতিক্রম শুধু ঘটেছিল সুদীপ্তর ঘরে। সেখানে হরণের জন্য নারী পায়। নি, লুটপাটের যোগ্য কোনো বস্তুও পায় নি। কেননা যেদিকে তারা তাকিয়েছিল শুধু দেখেছিল বই। আর বই। ধুত্তোর বই। বই নিয়ে হবেটা কি শুনি। কাগজের বুকে হিবিজিবি আঁক কাটা যতো সব আবর্জনা। ওই আবর্জনায় হাত দিয়ে পাক-সৈন্যরা না-পাক হতে চায় নি। হাত যেখানে-সেখানেই দেওয়া যায়। না কি। হাত দেওয়া যায় রোটি ও রাইফেলে। আর আওরাতের গায়ে। দুনিয়ার সেরা চিজ আওরাত, আওর রাইফেল। রোটি খেয়ে গায়ের তাকাত বাড়াও, রাইফেল ধরে প্রতিপক্ষকে খতম কর, তারপর আওরাত নিয়ে ফূর্তি কর। ব্যাহ, এহি জিন্দেগী হ্যায়। এই তো জীবন। জীবন সম্পর্কে এই ধারণায় আমনের। আস্থা নেই, কোনো বাঙালিরই নেই। আমন যতক্ষণ পারলেন প্রাণপণে প্রচণ্ড আর্ত-হাহাকারকে বহন করলেন। বিলাপ করে করে বেদনাকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলেন। মরে যাওয়া পুত্রকন্যাদের বুকে জড়িয়ে কাঁদলেন। অবশেষে এক সময় সংজ্ঞা হারিয়ে সন্তানদের বুকে জড়িয়ে পড়ে রইলেন।
রবিবার সকালে গোপনে কয়েকজন সাংবাদিক সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে শহরের অবস্থা দেখতে বেরিয়েছিলেন। তারাই শিল্পী আমনকে উদ্ধার করেন। অতঃপর হাসপাতাল কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সংজ্ঞা ফিরেছে, কিন্তু মনের স্বাভাবিকতা ফেরেনি। এক সময় কখন তিনি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসেছেন কেউ তা টের পায় নি। এখন তিনি পথে পথে মাঝে মাঝেই চীকর করে উঠছেন—হাম গোলি করে গা, গালি খায়ে গা।
আমার ছেলে-মেয়েদের গুলি করেছ, আমিও তোমাদের গুলি করব, আমার ছেলে মেয়েরা গুলি খেয়েছে, আমিও গুলি খাব, আমাকেও তোমরা গুলি কর, এ সব কথা কি পাগলের কথা! তবু এখন শিল্পী আমনকে সকলেই পাগল ঠাওরাচ্ছে, এবং এড়িয়ে চলছে।
অবশ্যই আমনের সব ইতিবৃত্ত সুদীপ্ত জানতেন না। কেবল তাঁর মনে হচ্ছিল, সত্যই একটা সাংঘাতিক কিছু ভদ্রলোকের জীবনে ঘটেছে যে কারণে তিনি এমন ভারসাম্য হারিয়েছেন আজ। কী সেটা? যাই হোক, সে নিয়ে কিছু ভাববার সময় এখন নেই। এখন কিছু করতে হয়। কিন্তু কী করা যায়! সঙ্গে করে বাসায় নিয়ে যাওয়া যায়। বাসায় তিনি এখন যেখানে আছেন সেখানে? সেখানে পথের পাগল নিয়ে উঠাবেন? কেন উঠাবেন না। আমনের মতো চিত্রশিল্পী কি কোনো দেশে দলে দলে গজায়? তা ছাড়াও তিনি একজন মানুষ তো। বিপদের সময় মানুষের জন্য তো মানুষকেই এগোতে হয়। সুদীপ্ত আমনের একখানি হাত ধরলেন–
আপনি চলুন আমার সাথে। আমি আপনাকে দেব গুলি খেতে।
তোম উল্লু হ্যায়। তোমহারা সাথ মে গুলি নেহি হ্যায়।
গুলি যাদের সঙ্গে থাকে শহরে তখন তাদের অভাব ছিল না। চারদিকে নল উচিয়ে কত গাড়িই তো যাচ্ছে। ঠিক সেই সময়ই একটা যাচ্ছিল পাশের পথ। দিয়ে। সহসা আমন সুদীপ্তকে এক ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন এবং দুহাত তুলে। চীকার করে উঠলেন–
হাম গোলি করে গা। গোলি খায়ে গা।
ফুটপাতের পাশে লোহার রেলিঙের কাছে দৌড়ে গিয়ে আমন তার প্রাণপণ শক্তিতে হাতের আধখানা ইট ছুঁড়ে মারতে চাইলেন। কিন্তু তার আগেই সৈনিকদের গুলি খেয়ে তিনি লুটিয়ে পড়লেন রেলিঙের পাশে। তাঁর হাতের আধখানা ইট ছিটকে পড়ল তারই নাকের কাছে।
সত্য সত্যই ওরা গুলি করল আমনকে? বিকৃত মস্তিষ্ক আমনকে? আমনকে অসুস্থ পাগল বলে চিনতে কি ভুল হবার কথা? পাকিস্তানের বীর সৈনিক অতসব বোঝে না। অতসব বুঝতে গেলে ভালো সৈনিক হওয়া যায় না। সৈনিকের কাজ কোনো কিছু বিচার করা নয়, কেবলি গুলি চালানো। হাঁ, পাকিস্তানিরা গুলি চালাতে জানে। রাইফেল-মেশিনগানের লোহার গুলি, রেডিও-টিভিতে গাঁজা-গুলি। গোটা পাকিস্তানটাই একটা গাজা-গুলি বলাকা বিল্ডিংয়ের বারান্দায় পড়ে থেকেই কথাটা মনে হয়েছিল সুদীপ্তর। ভাগ্যিস আমন তাকে ধাক্কাটা বেশ জোরেই দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একেবারে ধূলিশায়ী। হয়েছিলেন এবং সেই জন্যই বোধ হয় পাকিস্তানিরা তাকে দেখতে পায় নি। কিংবা দেখে থাকলেও মৃত ভেবেছিল। সুদীপ্ত কিন্তু সবই দেখলেন। চিত্রশিল্পী আমনের দেহ লুটিয়ে পড়ে আছে রক্তের ধারা গড়িয়ে যাচ্ছে-পথের উপর।
ওরা মেরে চলে গেছে। সুদীপ্ত উঠে দাঁড়িয়েছেন। আশ্চর্য! একটুও ভয় পাচ্ছেন না তিনি। একদৃষ্টিতে দেখছেন নিস্পন্দ একটা মানবদেহকে। এই দেহ। আশ্রয় করে যিনি ছিলেন তিনিই সেই প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী আমন? এই তো ছিলেন। কোথায় গেলেন তবে? তিনি গেছেন সেই জনতার পথে, যারা প্রতিজ্ঞা নিচ্ছে—আমরা এর প্রতিশোধ নেব। সকাল বেলার হাসিম শেখের কথা মনে পড়ল—খোদার কসম, আমার মায়ের কসম, আমাদের রক্তের কসম আমরা এর শোধ নেবই নেব। প্রতিশোধ গ্রহণের দুর্বার শপথ ছড়িয়ে গেল চারপাশের বাতাসে, পথের ধূলোয়, আশে-পাশের প্রতিটি দেওয়ালে, প্রতিটি বাতায়নে, এমন কি আমনের হাতের সেই আধখানা ইটেও। সুদীপ্তর চোখের সামনে সেই ইটের টুকরো হয়ে উঠল আস্ত কামানের গোলা। সে এখন ওঁৎ পেতে শত্রুর মুখ খুঁজছে। যেন বলছে মাগো সন্তানের রক্তে তোমার বুক ভেসেছে, শক্রর রক্তে। তোমার পা ধোয়াব। কথাগুলি আমনের। শিল্পী আমনের একটি ছবির নীচে এই শপথ বাক্য খোদিত ছিল–মা গো, সন্তানের রক্তে তোমার বুক ভেসেছে, শক্রর রক্তে তোমার পা ধোয়াব।—