উহ্ কী প্রচণ্ড বুক-কাঁপানো গোলার আওয়াজ। এক মুহূর্তও যদি গুলি গোলার বিরাম থাকে। শ্রাবণের বৃষ্টিধারাও তবু মাঝে মাঝে মন্থর হয়ে আসে, কিন্তু গোলাবৃষ্টির যে ক্ষান্তি নেই। হায় হায়, সব ধ্বংস হয়ে গেল।
কিন্তু এতো ধ্বংসের পর স্বাধীনতা যদি আসে। অবশ্যই যেন আসে। আমাদের ছেলেমেয়েরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হবে। বিশ্বের সর্বত্র বুক ফুলিয়ে। বলবে, আমরা জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের মানুষ। আমরা বাঙালি। আমনের। বুক ভরে ফুটল একটি কথার সূর্যমুখী—আমরা বাঙালি। স্বাধীনতা-সূর্যের দিকে উখ একটি ফুলের নাম আমরা বাঙালি। আমন অস্থিরভাবে পায়চারী শুরু করলেন তার ঘরের মেঝেয়। চীৎকার করে গেয়ে উঠলেন মুক্ত বেণীর গঙ্গা যেথায় মুক্তি বিতরে রঙ্গে/আমরা বাঙালি বাস করি সেই তীর্থ বরদ বঙ্গেীবাম। হাতে যার কমলার ফুল ডাহিনে মধুর মালা–না না না। এ কবিতা পড়ার অধিকার আমার নেই। তোমার বাম হাত ও ডান হাত আজ একই অঙ্গে তো। নেই মা। তোমার অধম সন্তানেরা তাকে কেটে দুটুকরো করেছে মা গো, এ পাপ ক্ষমা কর।
অস্থিরতায় অনুশোচনায় বিনিদ্র রজনী পোহাল। শুক্রবারও সারাদিন অবিশ্রান্তভাবে চারপাশ জুড়ে গোলা-গুলির আওয়াজ শোনা যেতে লাগল। আমনের বাসা একটা কানাগলির মধ্যে দুতালায়। সেখান থেকে বড়ো সদর। রাস্তাটা দেখা যায় না। অতএব রাস্তায় বেরুনো যায় কিনা বুঝা গেল না। কিন্তু সকাল হতেই রাস্তায় বের হওয়ার জন্য আমন ছটফট করতে লাগলেন। কোন মতেই বের হওয়া যায় না? ওরা দুটি মাত্র স্ত্রীলোক একা বাড়িতে ভয় পাচ্ছেন না? মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন, নানা আশঙ্কা। গুলির শব্দে মা মণি হয়ত ভয় পাচ্ছে, এবং কাঁদছে। সৈনিকরা আবার বাড়ি ঢুকবে না তো! নাহ ঐ আশঙ্কার কোনো মানে হয় না। কৈ, ভদ্রলোকের বাড়ি ঢুকে ওরা অত্যাচার করেছে, এমন তো কখনো শোনা যায়নি। তা ছাড়া, রোজির সেই ভাগনেটিও হয়ত বাসায় ফিরে থাকবে! আওয়ামী লিগের স্বেচ্ছাসেবক হয়ে রাতে পাড়া পাহারা দিতে যায়, ফেরে একেবারে শেষ রাতে। আজ নিশ্চয়ই আগেই ফিরে থাকবে। কিন্তু না ফিরে থাকে যদি। ওরা দুবোন ভয়েই মারা পড়বে হয়তো। তিনি যদি এখন কাছে থাকতেন! কিন্তু কি ভাবে থাকবেন? পথে বেরুনো যায়?
বেলা দশটার দিকে আমন জানলেন পথে বেরুনো যাবে না। রেডিওতে সামরিক কর্তৃপক্ষের কয়েকটি আদেশ শুনলেন। জানলেন, সারা শহরে এখন কারফিউ। এখন পথে বেরুলেই সৈন্যরা গুলি করবে। গুলি তো বেরাদরগণ সারা রাতই করেছ, কিন্তু কারফিউয়ের কথা বলছ এখন? এই বেলা দশটায়? কৈ সারারাত একবারও শোনা যায় নি যে, কারফিউ দেওয়া হয়েছে। কে জানে হয়ত রাত দুটোর সময় রেডিওতে কারফিউয়ের কথা প্রচারিত হয়েছল। দুটোর সময় কেউ রেডিও খোলে না। তাতে কি। আইন তো বাঁচানো গেল। বাঙালিকেও বুদ্ধ বানানো গেল।
বাঙালিকে বুদ্ধ বানিয়ে ইয়াহিয়া কাল রাতে ফিরে গেছে। ইয়াহিয়া এসেছিল আলোচনা করতে। কিসের আলোচনা? কেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের, ক্ষমতার রুটি নিয়ে তোমরা কাড়াকাড়ি করছিলে না? তোমরা মানে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান। অতএব মাঝখানে কোনো বাদরকে আসতেই হয়। এবং বাঁদরের স্বভাব অনুসারে ক্ষমতার রুটি নিজের গালেই পুরতে হয়। ইয়াহিয়া কি অযৌক্তিক কিছু করেছে?
কার সাধ্যি, সে কথা বলুক দেখি। সামরিক আইনে চৌদ্দ বছর জেল-মিনিমাম পানিশমেন্ট লঘু শাস্তি। কি কি অপরাধে এই লঘুশাস্তি দেওয়া হবে তার বিবরণ এখন রেডিওতে প্রচারিত হচ্ছে। তোমরা শোন এবং পালন কর। কথা বল না। না, কারো কোন কথা বলার অধিকার নেই। রাজনীতিবিদ, অধ্যাপক, শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী—কেউ না। তোমরা সব বিলকুল বুদ্ধ আছ। এবং বে-আদব। প্রেসিডেন্ট এসে প্রায় দু সপ্তাহ থেকে গেলেন ঢাকায়। বে-আদবীর চূড়ান্ত করেছে তখন। মনে নেই? প্রেসিডেন্ট আসল শহরে। আর সেই শহরে তোমরা মিছিল বের করেছ।
মিছিল কি অপরাধ? মিছিল মানে জানো? নিজেদের কোনো দাবীর কথা জানাতেই মানুষ মিছিল করে। দেশের মানুষ তাদের প্রেসিডেন্টের কাছে নিজেদের দাবীর কথা জানাবে না?
দাবী? কিসের দাবী? হুজুরের কাছে নিবেদন পর্যন্ত চলতে পারে। সে জন্য দরখাস্ত পেশ কর। মিছিল করে শ্লোগান দিয়ে বেড়ানো কেন?
কারণ ঐটেই আধুনিক গণতন্ত্রসম্মত পন্থা।
তোমাদের ঔ সব কেতাবীগণতন্ত্র মাগরেবী মুল্লুকে চলতে পারে। আমাদের পাক-মুলুকে তা অচল।
তোমাদের মধ্য যুগীয় আবেদন-নিবেদন আমাদের বাংলাদেশে অচল। আমরা কোনো হুজুরে বিশ্বাস করিনে। এবং সেই কারণেই দেখতে পাচ্ছ। তোমাদের সঙ্গে আমাদের মিল হবে না। তোমরা তোমরা, আমরা আমরা।
নেহি। মুসলিম সব ভাই ভাই। কখনো তোমাদেরকে আমরা পৃথক হতে দিতে পারিনে। আমরা মুসলমান।
আমরা বাঙালি, তোমরা পাঞ্জাবী-পাঠান-সিন্ধী-বালুচ। তোমরা আমরা। পৃথক হয়েই আছি।
বটে? তা হলে তোমাদের জন্য এই রইল কামান-মেশিনগান-রাইফেল।
শুক্রবার সারাদিন চলল কামান-মেশিনগান-রাইফেলের বিচিত্র কারবার। আবার রাত এল। সেই রাতেও মাঝে মাঝে শোনা যেতে লাগল গুলির আওয়াজ। আমন সারা রাত একা ঘরে তার ছেলে-মেয়ের জন্য কেবলি ছটফট করলেন। পরদিন শনিবার অর্থাৎ গতকাল বেলা দশটার দিকে কারফিউ ওঠে। গেলে পথে লোক বেরুল। আমনও বের হলেন। সেই গতকালের বেলা দশটা থেকে আজ রবিবারের বেলা প্রায় বারটা-প্রায় ছাব্বিশ ঘণ্টা। এই ছাব্বিশ ঘণ্টার হিসাব আর আমন জানেন না। সেই যে বাসা থেকে পথে বেরিয়েছেন। আর ঘরে ঢুকেন নি। কেন, রোজিদের, ঘরে? রোজিদের ঘরে তার স্ত্রী ও পুত্র-কন্যারা ছিলেন সেখানে তিনি যান নি? হাঁ গিয়েছিলেন। কিন্তু। ঘরে নয়। তাকে ঘর বলে না। অবাধে পথের কুকুরটাও তখন সেখানে প্রবেশ করতে পারে। যেখানে কুকুর-শেয়ালেরও অবাধ যাতায়াত থাকে তাকে ঘর বলে নাকি। রোজিদের ঘর খোলাই পড়ে ছিল। খোলা শুধু নয়, ভাঙা দরজার কপাট ভেঙ্গে দুর্বৃত্তরা ঢুকেছিল। তারপর? আমন গিয়ে দেখলেন, কেউ নেই। ডাকলেন—রোজি। সাড়া নেই। স্ত্রীকে ডাকলেন পলি। পলিও নেই নাকি। ছেলে-মেয়েরা? শোবার ঘরে গিয়ে দেখলেন, মেঝের উপর দুটি ভাইবোন পড়ে আছে পাশাপাশি। রক্তে ভিজে গেছে অনেকখানি মেঝে। রবিবার সকালে দেখা গেল দুটি ছেলে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে মেঝের উপর পড়ে আছেন চিত্রশিল্পী আমন। সারাক্ষণই এমনি পড়ে ছিলেন? না। যতক্ষণ ক্ষমতা ছিল বিলাপ করেছেন। চীৎকার করে কেঁদেছেন। এমন কচি শিশুদের যারা মারতে পারে তাদের জন্য আল্লাহর অভিশাপ প্রার্থনা করেছেন। তাদের উপর গজব নাজিল কর খোদা, এখনি তোমার গজব নাজিল কর। স্ত্রীর কথা মনে হয়েছে—চী কার করে কতবার ডেকেছেন স্ত্রীকে। রোজিকে ডেকেছেন। যেন ডাকলেই এখনি ওরা এসে দেখা দেবে। রোজির কলেজে পড়া ভাগনেটিকেও পাওয়া গেল। বাচবার জন্য ঘরে ফিরেছিল বারোটার দিকে। এবং তার ফলে বাঁচতে পেরেছিল মাত্র ঘণ্টা পাচেক। ভোর পাঁচটার দিকে পাক-হানাদার বাহিনীর গুলিতে সে নিহত হয়। পাশের ঘরে তার লাশ পাওয়া গেল কিন্তু পালি ও রোজি। কোথাও নেই। আর নেই সেলাইয়ের কল, ট্রানজিসটার, টি. ভি. সেট এবং হয়ত আরো কিছু যা আমন জানেন না। মূল্যবান গয়না-পত্র টাকা-কড়ি কোথায় থাকত সেটা, শ্যালিকার বাড়ি হলেও আমনের জানার কথা নয়। তিনি কেবল দেখলেন আইরন-সেফ খোলা। ভেতরটা শূন্য।