এই উল্লু, কেতনা বাজতা হ্যায়?
লোকটা উর্দু ভাষী বলে নিজেকে জাহির করতে চাইল। কিন্তু তার উচ্চারণেই ধরা পড়ল, সে বাঙালি। সহসা কথাটা সুদীপ্তর মনে পড়ল। এই সময় নিজেকে অবাঙালি বলে প্রমাণ করতে পারলে ভারি সুবিধে। গতকাল থেকে বহু বঙ্গ-সন্তানই উর্দু ভাষা রপ্ত করতে লেগেছে। এবং সেই সঙ্গে ঘৃণী। উর্দুকে এতো ঘৃণা বাঙালিরা আর কখনো করে নি। তারা বাংলা চেয়েছে, কিন্তু মনে কোনো উর্দু বিদ্বেষ পোষণ করে নি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় সুদীপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তখন উর্দুকে বয়কট করার একটা প্রবণতা ছিল, কিন্তু এমন ঘৃণা ছিল কোথায়। আজ তারা, বাঙালিরা পথে বেরিয়ে উর্দু বলে। অন্তত বলতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেই সাথে ঘৃণাও করে—বিজাতীয় ঘৃণা। একেবারেই পছন্দ নয় এমন মেয়ের সাথেও মানুষের বিয়ে হয়। অন্য দেশে হয় কিনা জানা নেই—আমাদের দেশে তো হয়। অবস্থার ঠেলায় পড়ে এমন অবাঞ্ছিত মেয়ের সাথেও যদি ঘর করতে হয়? তাকে ভালোবাসার কোন প্রশ্ন ওঠে নাকি। না। বরং ঠিক উল্টোটি হয়। তালাক দিতে পারলে তবু যা। হোক সহানুভূতিটা থাকে—প্রীতি না থাক, শুভেচ্ছার অভাব হয়ত হয় না। অন্যথায় সারা জীবন ঘৃণা করে যেতে হয় সে মেয়েকে। বাঙালির ভাগ্যে এমনি। অপছন্দ অবাঞ্ছিত স্ত্রীর মতো উর্দুর উদয় হয়েছে নাকি?
অন্ততঃ সুদীপ্তর সামনে একজন অদ্র লোকের উদয় যে হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। এই উল্লু-কোনো অপরিচিত ভদ্রলোককে সম্বোধনের ভাষা এইটে নাকি?
উল্লু? কাকে উল্লু বলছ তুমি।
তুমি উল্লু হ্যায়। সারা বাঙালি আদিম সব বিলকুল উল্লু হ্যায়।
বলতে বলতে হো হো করে হেসে উঠল সেই অপরিচিত অভদ্র মানুষটি। সহসা সুদীপ্ত যেন মনে করতে পারলেন, লোকটিকে তিনি চেনেন। ইনি সেই প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী আবদুল্লা মনসুর না? ঠিক তাই। আবদুল্লাহ মনসুর —ওরফে আমন। আমনকে তিনি চেনেন। না চিনে উপায় কি? পশ্চিম পাকিস্তান কিভাবে বাঙলাকে শোষণ করে যাচ্ছে সে কাহিনীকে ছবিতে এঁকে ইদানীং শহরে বিপুল সাড়া জাগিয়েছেন চিত্রশিল্পী আমন। আমনের আঁকা বঙ্গ-জননীর একখানি তৈলচিত্র পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে এই তো কয়েক দিন মাত্র আগে। সেই আমন এখানে? এমন বেশে? সুদীপ্ত বললেন–
আপনি এখানে কি করছেন?
তুমি উল্লু এখানে কিয়া করতা হ্যায়? জানতা নেহি যে বারো বাজে তো। ফের কারফিউ হো যায়ে গা।
বারো বাজলে আবার কারফিউ শুরু হবে? কে বললে? সে জন্যই লোক নেই নাকি! বারো বাজতে বেশি দেরিও তো নেই। তা হলে উপায়? উপায় অতি দ্রুত হেঁটে চলে যাওয়া। হয়তো বাসায় পৌঁছানো যেতেও পারে। কিন্তু ইনি?
আপনি যাবেন না বাসায়?
নেহি। হাম গোলি করে গা, গোলি খায়ে গা।
মানে? গুলি খাবেন? খাদ্য হিসেবে গুলিটা কেমন বস্তু সে কৌতূহল একজন শিল্পীর থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তা হলেও সহসা গুলি খেতে চাওয়াটা কি স্বাভাবিক কর্ম? আর গুলি যে করবেন সেটা কি দিয়ে?
কয়েকটি জিজ্ঞাসা নিয়ে অধ্যাপক তাকালেন শিল্পীর দিকে। শিল্পীর হাতে আধখানা ভাঙা ইট ছিল।
শিল্পী আবদুল্লাহ মনসুর পঁচিশে মার্চের দিবাগত রাত্রে বাসায় একা ছিলেন। আজকাল মাঝে মাঝে এমন একা থাকতে তিনি ভালোবাসতেন। একা একা অনেক রাত জেগে বেশ কাজ করা যায়। শুধু কাজ? কলহ নেই? কলহ তাদের সুদীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে ছিল বৈ কি। তবে ততটুকু ছিল যতটুকু সংসারের জন্য স্বাস্থ্যপ্রদ। এবং কলহ করে স্ত্রী কোনোদিন বাপের বাড়ি যাননি। সেদিন। গিয়েছিলেন ছোট বোনের বাড়ি। রাতে বোন আর তাকে ফিরতে দেয় নি। ব্যবসায়ী ভগ্নিপতি ব্যবসা উপলক্ষে গিয়েছিলেন চট্টগ্রাম। অতএব বোনের কাছে। বোনেকে থাকতে হয়েছিল। আত্মীয় স্বজনের মধ্যে এমনটি তো হতেই পারে। পূর্বেও হয়েছে। এক ছেলে এবং এক মেয়ে নিয়ে আমনের স্ত্রী বোনের কাছে থেকে গিয়েছিলেন। আমন বলেছিলেন—
আমি কিন্তু ফিরে যাব। ছবিটা আজ শেষ করার কথা।
একটা ছবি আজ তিনি শেষ করবেন। অতএব বাসায় ফিরছিলেন। এবং ফেরার সময় তার ছেলে-মেয়েদের আদর করেছিলেন। ছোট মেয়েকে কোলে। নিয়ে চুমু দিয়ে বলেছিলেন–
মা মণি, এখন তবে যাই। কাল সকালে এসে তোমাকে নিয়ে যাব। কেমন।
আব্ব, খালা?
হাঁ, ঠিক বলেছ তো আম্মু, এবার তোমার খালাকেই নিয়ে যেতে হবে। তোমার মা পুরোনো হয়ে গেছে। অতঃপর আমন তাঁর ছোট শ্যালিকার পানে। তাকিয়ে বলেছিলেন–
দেখলি রোজি, আমার মেয়ে কিন্তু তার মাকে চায় না। তার জায়গায় চায় তোকে?
এমনি খানিক হাস্য-পরিহাসের মধ্য দিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন চিত্রশিল্পী আমন। কত রাত হবে তখন? না, খুব বেশি রাত হয় নি। কাজের তাড়া ছিল। বলে নটার মধ্যেই তিনি বাসায় ফিরেছিলেন। এবং ফেরার সময় সহসা ঢাকা শহরকে বড়ো বেশি নির্জন মনে হয়েছিল সেদিন। মাত্র নটার মধ্যেই শহর এমন ঝিমিয়ে পড়ে নাকি? আগে কখনো এমন দেখেননি তো। শিল্পী আমনের বুকে নিঃঝুম ঢাকা শহরের একটি ছবি গাঁথা হয়ে গেল। এই নিঃঝুমতা কি ক্লান্তির? ঢাকা নগরী এমনি স্থবির হয়ে গেছে? নাকি অন্য কিছু। এ যদি ঝড়ের পূর্বাভাস হয়। ভাবতে ভাবতেই আমন ঘরে ফিরেছিলেন।
ছবি নিয়ে একান্তভাবে মগ্ন ছিলেন। বাইরের ছোট-খাট শব্দ সহসা পাবার। কথা নয়। অতএব সন্দেহ নেই যে, শব্দটা বেশ বৃহৎ আকারের ছিল। একটা প্রবল শব্দে আমনের হাতের তুলি কেঁপে উঠল। পরে পরেই আর একটা শপ, তার সঙ্গেই আর একটা—এমনি চলতেই থাকল। প্রচণ্ড শব্দের আর গজনের বিরাম নেই। আর শব্দ কি এক রকমের? শব্দের যে এতো বৈচিত্র্য থাকে তা কি আমন কখনো জানতেন। শব্দকে তুলি দিয়ে আঁকা যায় না?—চিত্রশিল্পীর। মনে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন সৃষ্টি হল। তিনি বাইরে এসে বারান্দায় দাঁড়ালেন। এ কি! আগুন যে। সারা ঢাকা শহরই জ্বলছে নাকি? চারপাশে আগুন, ধোয়া আর গন্ধ। বারুদের গন্ধ। কী শুরু হল ঢাকা শহরে? যুদ্ধ? যুদ্ধ কেমন করে হয়। আমনের জানা নেই। রণাঙ্গনের দৃশ্য তিনি দেখেননি। ধোয়া, আগুন, বারুদের গন্ধ, বিচিত্র বিকট শব্দ সবটা মিলিয়ে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এরি নাম যুদ্ধ? কিন্তু কার সঙ্গে যুদ্ধ? কারা যুদ্ধ করছে? আমন কিছুই ভাবতে পারলেন না। ভাবনারা ভয়ে মূক হয়ে গেছে। তাকিয়ে বুঝলেন, আগুনের শিখাটা নীলক্ষেতের দিকেই বেশি। সারা নীলক্ষেত জুড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়—বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হল, কলাভবন ও শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা। ওই সবই ওরা জ্বালিয়ে দিয়েছে নাকি! প্রচণ্ড শব্দগুলিও বেশির ভাগ আসছে ঐ দিক থেকেই। তা হলে কি ছাত্রদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর যুদ্ধ বেধে গেছে? তা কি করে হবে। অবশ্য কয়েক দিন থেকেই শহরে সংগ্রামের কথা চলছিল—আমাদের সংগ্রাম, চলবেই চলবে—বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর ইত্যাদি শ্লোগান দিয়ে দিয়ে মিছিল চলছিল শহরে। কিন্তু সবাই তারা ছাত্র তা তো নয়। সব স্তরের মানুষই তাদের মনের অনুভূতিকে ব্যক্ত করতে চাইছিল ঔ সব মিছিলে শ্লোগান দিয়ে। কিন্তু সত্যিই তারা কি অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল? কৈ, তিনি তো জানতেন না। তবে তিনি না জানলেই তা মিথ্যা হবে? সত্য হওয়াই তো ভালো। আহা, কথাটা সত্য হোক। বাঙালির গোপন প্রস্তুতি সত্য হোক, তার অস্ত্র ধারণ সত্য হোক। বীর বিক্রমে বাঙালি যুদ্ধ করছে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সাথে-কল্পনাটা শিল্পী আমনের মধ্যে খুব উজ্জ্বল সুখের অনুভূতি এনে দিল। বাঙালি গোপনে এত অস্ত্র জমিয়েছিল? এতো অস্ত্রের ব্যবহার শিখেছিল? নিশ্চয়ই নীলক্ষেত এলাকায় ছাত্রদের সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যদের যুদ্ধ চলছে। নাকি পাকিস্তানিরাই এক তরফা ছুঁড়ছে এতো গুলি-গোলা। হাঁ পাকিস্তানিরা তা পারে। সেরেফ না-কে হাঁ করতে পাকিস্তানের জুড়ি মেলা ভার। অকারণেই অতিরিক্ত পরিমাণে গুলি-গোলা ছুঁড়ে তারা প্রমাণ করবে—ছাত্রদের সাথে লড়াই হয়েছে আমাদের এবং ছাত্র-শিক্ষক যা আমরা মেরেছি তা ঐ লড়াইয়ের মধ্যে। হায় হায়, কী ধূর্ত ওই হারামজাদা! আমাদের নিরস্ত্র ছাত্র-শিক্ষকদের ওরা মারবে, তারপর বলবে-ওরা মরেছে আমাদের সাথে লড়াই করতে এসে। ওগো আল্লাহ তবে সেইটেই সত্য হোক। আমার ছাত্রবন্ধুরা লড়াই করে মেরে তারপর যেন মরে। আমাদের অধ্যাপকরা এক-একটি দুর্জয় সেনাপতি হতে পারেন যেন। শিল্পী আমনের সারা বুক ভরে। প্রাথনা উচ্চারিত হল। সব কথার শেষ কথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা।