তাঁর মনে হয়েছে।
এবং খুবই সামান্য ঘটনা এটি যে, এখন একজন ভদ্রলোক তাঁদের এলাকার আর-একজন ভদ্রলোকের সন্ধান নিতে এসে তাঁকে কথা বলেছেন কয়েকটি। সেই কথাতেই সুদীপ্ত বাঁচলেন। বিপুল একাকীত্বের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ থেকে মুক্তি মিলল। যেন সহসা আবার তার সাবেক পৃথিবীর মাটি পেলেন। পায়ের নীচে। মানুষের সান্নিধ্য মনের জন্য এতো স্বাস্থ্যপ্রদ! কিন্তু রাস্তায় মানুষ কৈ? মোটেই তো সাড়ে এগারোটা এখন। কারফিউ নেই! তবে?
কী বেকুবের মতো ভাবছেন তিনি। কারফিউ নেই, অতএব মানুষ স্বাভাবিক ভাবে পথে বেরুবে? হাট-বাজার করবে? খুব ভালো কথা। কিন্তু ভালো কথা শোনার লোক এখন পাকিস্তানে আছে নাকি! ইয়াহিয়া খান থেকে একটা ক্ষুদে সৈনিক পর্যন্ত কোন লোকটা এখানে কোন নিয়মটা মানে শুনি?
যুদ্ধেরও কতগুলো নিয়ম-কানুন থাকে। থাকে না? কোনো দেশ আক্রমণ করতে হলে আগে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয়। পাকিস্তান সরকার গায়ের জোরে একটা অঘোষিত যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের মানুষের উপর। অকস্মাৎ যাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে তারা নিরস্ত্র। কেউ কখনো নিরস্ত্রকে আক্রমণ করে?
করে না? প্রেমে ও রণে কিছুই অন্যায় নয়।
একটা বিরাট জালিয়াতি আছে কথাটার ভিতর। প্রেমে যদি কিছু অন্যায় না। হয়, তবে যুদ্ধে সবি অন্যায়। যুদ্ধটাই অন্যায়। যুদ্ধ ও প্রেম বিপরীতার্থক। তাদের সামান্য লক্ষণ সন্ধান মূর্থের কর্ম।
কিন্তু কথাটার উদ্ভাবক মূর্খ ছিলেন না।
নিশ্চয়ই না। মূখতার একটা লক্ষণ হিসেবেই কথাটাকে তিনি তৈরি করেছিলেন। এবং বর্তমানের মূর্খরা ক্ষেত্রবিশেষে নরপিশাচেরা, এটাকে তাদের শয়তানীর কৈফিয়ৎ হিসাবে ব্যবহার করছে।
না না, তা নয়। মানে এ ঠিক যুদ্ধ তো নয়। এ হল যথার্থতঃ বিদ্রোহ-দুমন। কোনো দেশের কতকগুলো মানুষ বিদ্রোহ করলে তাকে শায়েস্তা। তো করতেই হয়। সেখানে যুদ্ধ-ঘোষণার কথা ওঠে না।
তা হলে অন্য কথা ওঠে। বিদ্রোহ কাকে বলবে? দেশে নির্বাচন হয়েছে। সারা বিশ্বের স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সরকার গঠন করবেন। এই স্বাভাবিক নিয়মের বিরুদ্ধাচারণ যারা করল বিদ্রোহী বললে তো তাদেরকেই বলতে হয়।
কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একটা অংশ যদি দেশকে দ্বিখণ্ডিত করতে চায়?
করতে চাইলে তা হবে নাকি! পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পেতে হবে না? এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যদি কোনো অযৌক্তিক অপকর্ম করতেই চায় তখন প্রেসিডেন্ট তো আছেনই, পার্লামেন্ট বাতিল করে দিয়ে আবার নির্বাচন দিতে পারেন তিনি। জনগণের রায় কোন দিকে তার যাচাই হবে।
জনগণও যদি সেই অপকর্মকে সমর্থন করে?
তা হলে সেইটেই হবে। অধিকাংশের ইচ্ছাকে কোনো নীতিধর্মের দোহাই পেড়ে বাধা দেবার অধিকার কোনো একটি ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া যায় না। সারাদেশ যদি বঙ্গোপসাগরে ডুবতে চায়, সে অধিকার তাদের থাকতে হবে। কেবলি একজনের হাতে অমৃত পরিবেশনের ভার থাকার নাম স্বাধীনতা নয়।
এমনি নানা তর্কই তো মনে জাগে। কিন্তু তর্কযুক্তি এ সব তো শিক্ষিত লোকের অস্ত্র। কেবল সভ্য লোকের সাথেই তর্ক চলে। যুক্তির কথা তিনিই মানবেন যিনি বিবেকবান। শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন—কেউ যদি যুক্তির কথা বলেন এবং তিনি যদি সংখ্যায় একজনও হন, আমরা তার কথা মানব।—এই তো বিবেকবান সভ্য মানুষের কথা। এবং চিরন্তন কথা। গণতন্ত্র এই কথাতেই বাঁচে। গণতন্ত্র মানে কি সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে অপকর্ম করে যাওয়া? এক শশা বার তা নয়। গণতন্ত্রে আস্থাবান মানুষের মনের কথাই হবে, কেউ যদি যুক্তির কথা বলেন এবং তিনি যদি সংখ্যায় একজনও হন, আমরা তার কথা মানব।
কিন্তু যুক্তির কথা কাকে শুনাবেন শেখ মুজিবুর রহমান? যারা কেবলি দৈহিক শক্তিতে আস্থাবান তাদেরকে? ননসেন্স। অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহিন ননসেন্স কথাটাই উচ্চারণ করলেন মনে মনে। রেল লাইন পেরিয়ে তিনি ততক্ষণে উত্তর দিকের ফুটপাথ ধরে এগিয়ে চলেছেন। হায় আল্লাহ্ তিনি। যাবার সময়ও তো দু একজন লোক দেখে গেছেন এই পথে। এরই মধ্যে। কোন যাদুমন্ত্রে তারা সব অদৃশা হয়ে গেল! একটিও দোকান যদি খোলা থাকত।
কতকাল এই পথে তিনি হেঁটেছেন। সকালে মাছের বাজারে গেছেন। বিকেলে বইয়ের দোকানে, কখনো বা অন্য কিছুর! হায় রে, তখন কত ক্রুদ্ধ হয়েছেন মনে মনে। তাঁর দেশবাসী এতো নোংরা। ছী, ছি, একি স্বভাব তার দেশের মানুষের? এই সকালে কাজের সময় শক্ত সমর্থ জোয়ান পুরুষগুলো ফুটপাথের ছায়াতে ক্যারাম খেলে। এবং তা ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর। দিন। এ জাতির ভাগ্য যদি ঘুমিয়ে না থাকবে তবে তা থাকবে কার? আর যদি বা খেলবেই তো ঘরে গিয়ে খেল গে না। মানুষের হাঁটবার পথ জুড়ে তুমি খেলবে ক্যারাম আর একজন পাতবে দোকান…..মানুষ তবে হাঁটবে কোন দিক দিয়ে শুনি? এইখানে তো আবার প্রকাণ্ড চুলো পেতে ফুটপাথের প্রায় সবটাই রান্নাঘর বানিয়ে রাখত সেই বিশাল বপু দোকানদারটা। আহা, আজ তার সেই চুলোতে যদি তেমনি গরম জিলিপি ভাজা হত। আর তেমনি মানুষের ভীড় থাকত। সুদীপ্ত কোনোদিন ফুটপাথের দোকানে কোনো খাবার কিনেন না। আজো কিনবেন না। তাও ঠিক। তবু আজ সারা চিত্ত জুড়ে হাহাকারটা জাগল। সবখানি ফুটপাথ জুড়েও যদি লোকেরা দোকান পেতে রাখে তিনি তাতে রাগ করবেন না। কেনই বা রাগবেন? একই দেশের মানুষ না তারা? দেশের মানুষের একটু-আধটু অত্যাচার তো দেশের মানুষেই সহ্য করে। আহা, মানুষের মতো কিছু আছে নাকি পৃথিবীতে। এককালে বাংলাদেশে কত মানুষ ছিল? ধর সেই কালের কথা যখন সারা বাংলায় মানুষ ছিল বর্তমানের সাত ভাগের এক ভাগ। আর মানুষ কম থাকলে যা হয়—পড়ে থাকত সুবিস্তৃত অনাবাদী প্রান্তর। হাঁ, সেই প্রান্তরে বিশাল অরণ্য ছিল। পর্যাপ্ত রৌদ্র বৃষ্টির বাংলায় অরণ্য তো থাকবেই। বিপুল অরণ্য, বিস্তীর্ণ জলাভূমি—নদী, হাওড়, খাল-বিল-এরই মাঝে দু-একখানি গ্রাম নিয়ে এক-একটি জনবসতি এলাকা। এক এলাকা থেকে আরেক এলাকার দূরত্ব কত? অনুমান কর দশ-বিশ ক্রোশ। সুদীপ্ত এখন যেন তেমনি কোনো দশ-বিশ ক্রোশের জনবসতিবিহীন এলাকা অতিক্রম করছেন পাশে প্রাচীন গৌড় নগরীর পরিত্যক্ত বাড়ি-ঘর। মানুষ বিদায় নিয়েছে। আছে প্রেতাত্মারা আর শেয়ালনেকড়েরা। ঐ তো ঘরগুলির জানলা-কপাট সব ভাঙ্গা-ওর কোটরে কোনো নেকড়ে থাকতে পারে না? সুদীপ্তর মনে হতে লাগল, এখন ওখান থেকে নেকড়ে ঝাপিয়ে পড়বে তার উপর। সেকালের মানুষের এক এলাকা থেকে আরেক এলাকা গমনের অভিজ্ঞতা যেন সুদীপ্তকে স্পর্শ করল। এই মুহূর্তে কোনো মানুষের জন্য তার বলতে ইচ্ছে করছে। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। সবার উপরে মানুষ সত্য? কথাটা কদিন আগেও বলতে দ্বিধা ছিল সুদীপ্তর। ঠিক এই পথেই প্রতিদিন চলতে গিয়ে পদে পদে তিনি মানুষের ঠোক্কর খেতে খেতে কত কি ভাবতেন। না, এতো মানুষের ভীড়ে বসে কবি ঐ কথা বলতেই পারতেন না। নিশ্চয়ই কবি কোনোদিন পথে চলতে ক্রোশের পর ক্রোশ হেঁটে কোনো মানুষের দেখা পাননি। এবং তখনি তাঁর মনে হয়েছিল ঐ কথা সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। হাঁ, সুদীপ্তও স্বচ্ছন্দে এখন ঐ সুরে সুর মিলাতে। পারেন। এ জন্য অবশ্য তাঁকে ক্রোশের পর ক্রোশ হাঁটতে হয়নি। নীলক্ষেতের রেলক্রসিং থেকে বলাকা সিনেমা কতখানি পথ হবে? আধ মাইলও নয়। কিন্তু সুদীপ্তর মনে হল যেন পেরিয়ে এলেন অন্তহীন পথ। অন্তবিহীন পথ পেরিয়ে একজন লোকের দেখা পেলেন সুদীপ্ত।
০৯. বলাকা সিনেমার কাছে
বলাকা সিনেমার কাছে বাটার জুতোর দোকানের সামনে বারান্দায় লোক টাকে সুদীপ্ত দেখতে পেলেন। হাঁ, একটি মাত্র লোক। তবু একটি মানুষ তো। আহ্, একটি মানুষের দেখা পাওয়া গেল। সেই নীলক্ষেত আবাসিক এলাকার রেলগেটের কাছে ভক্সওয়াগণের ভদ্রলোকটিকে দেখেছিলেন—অতঃপর দেখলেন এই বলাকা বিল্ডিংয়ের বারান্দায় একটি অদ্র লোককে। মানুষ এমনি অভদ্র হয় নাকি! খোঁচা খোঁচা গোঁফ দাড়িতে সারা মুখমন্ডল ভরতি। বোধ হয় চার পাঁচ দিন ওতে খুর পড়ে নি। রুক্ষ চুল। ময়লা শার্ট। ফুল প্যান্টের কোনো শ্রী নেই। জুতো নোংরা সুদীপ্তকে দেখেই লোকটা খেঁকিয়ে উঠল–