গ্রামাঞ্চলের একটি বাজার এলাকায় পুনরায় সে পাক-জওয়ানদের কবলে পড়েছিল। ইতিপূর্বে দুবার বেঁচে এসেছে। না, এবার আর রক্ষা নেই। প্রাণের ভয়ে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। সেইখানে গিয়ে পাক-জওয়ানেরা পাকড়াও করে তাদের-প্রায় বিশ-তিরিশ জন। আশ্চর্য, জওয়ানরা তাদের নিয়ে গিয়ে বাজার লুঠ করার হুকুম দিল। বাজার লুঠ করে সকল মাল-মাত্তা মিলিটারি লরীতে তুলে দিতে হল। তারপর তাদের উপর হুকুম হল-বাজারে আগুন ধরিয়ে দাও। যারা ইতস্তত করছিল বুটের লাথি খেয়ে তাদের আক্কেল হল। প্রাণে বাঁচতে হলে ঐ কামই করতে হবে এখন। কিন্তু তবু কি প্রাণে বেঁচেছিল তারা? অন্ততঃ। একজন তো বেঁচেছিল। হাঁ, বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করার সাধ্য তোমাদের নেই। সেই কথাই যেন বলার জন্য বেঁচেছিল সেই জগন্নাথ হলের ছাত্রটি। তাদের সেই লুঠতরাজ ও অগ্নিসংযোগের সকল ঘটনা মুভিক্যামেরায় ধরে নিয়েছিল পাকিস্তানিদের একজন। তারপর দিয়েছিল পুরস্কার। লুঠতরাজ ও অগ্নিসংযোগের পুরস্কার স্বরূপ তাদেরকে খেতে দেওয়া হয়েছিল মেশিনগানের গুলি। কিন্তু হতভাগ্য ছাত্রটি তা খেতে পায় নি। তার আগেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। অলৌকিক ভাবে ঠিক সেই মুহূর্তে সে ভূমিস্মাৎ হয়েছিল যখন গুলিবিদ্ধ হচ্ছিলেন তার পাশের এক মৌলভি সাহেব। মৌলভী, কিন্তু। বাঙালি। অতএব সকলের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে তাকেও গুলি করা হয়েছিল। এবং থেকে গিয়েছিল তার অপকীর্তির সাক্ষ্য-জওয়ানদের মুভি ক্যামেরায়। ক্যামেরা সাক্ষ্য দেবে, জওয়ানদের অপরাধ ছিল না। তারা দুস্কৃতিকারীদের কবল থেকে দেশকে বাঁচানোর মহৎ উদ্দেশ্যে বাঙালি নিধন যজ্ঞে অবতীর্ণ হয়েছিল। হাঁ, শুধুই বাঙালি। বিহারি নয় কিন্তু। বিহারিরা খুব ভালো। এমন কি সে পকেটমার হলেও। তারা বঙ্গাল মুলুকে থাকলেও এই মুলুকের ভালো-মন্দ নিয়ে কোন কথা বলে না। তাদের কোনো অভিযোগ থাকলে তা আছে কেবল। এই নিমকহারাম কাফের বাঙালিদের বিরুদ্ধে। পশ্চিম পাকিস্তানে থাকে সব সাচ্চা মুসলমান। তোমরা বিহারিগণও সাচ্চা মুসলমান আছ। অতএব মুসলমান হয়ে মুসলমানের বিরুদ্ধে তোমাদের কি আর অভিযোগ থাকবে। বস্তুতঃ কোন অভিযোগ ছিলও না। অতএব বিহারিরা খুব ভালো।
কয়েক ঘণ্টা পর ছেলেটি জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখে, মৃত মৌলভির লাশ তার বুকের উপর। তখনি উঠে পালাবার পথ খোজে সে। এবং সে পালাতে গিয়ে। শেষ বারের মতো আবার একবার পাকিস্তানি জওয়ানদের খপ্পরে পড়ে। একটা বাসে চড়ে সে তখন যাচ্ছিল টাঙ্গাইলের দিকে। পথে এক জায়গায় বাস আটক করে পাকিস্তানিরা সকল যাত্রীকে নামতে বলল বাস থেকে। তারপর তাদের উপর হুকুম হল—
বাঙালি বিহারি আওর হিন্দু–তিন তিন আলাদা লাইন মে খাড়া হো যাও।
কিন্তু বিহারি যাত্রী বাসে একটিও ছিল না। সকলেই বাঙালি কেউ মুসলমান, কেউ হিন্দু। কিন্তু বাঙালি হিন্দু—এই দুটো ভাগে যাত্রীরা কি ভাবে নিজেদের বিভক্ত করবে সেটা কেউ বুঝতে না পেরে সকলেই একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। পাকিস্তানি জওয়ান এতে বিরক্ত হয়ে ভীষণ মুখ খিস্তি করে সকলকে গাল দিল একবার। তারপর নল উচিয়ে এগিয়ে এল তাদের পানে। প্রথমেই একজনকে শুধানো হল—
কিয়া নাম তুমহারা?
আব্দুল আজিজ।
কালেমা পড়বো।
আব্দুল আজিজ নিরক্ষর চাষী মুসলমান। কলেমা হয়ত জান্ত। কিন্তু ঘাবড়ে গিয়ে কিছু বলতে পারল না। তাকে এক পাশে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। দ্বিতীয় ব্যক্তি সেই জগন্নাথ হলের ছাত্র। মনে মনে একটি মুসলিম নাম সে ঠিক করে রেখেছিল। কিন্তু সেই মুসলিম নামেই সে কি বাঁচত?
তার বাঙালিত্ব সে লুকোতো কি দিয়ে? অতএব ভাগ্যক্রমে সঠিক মুহূর্তেই সে তার ভেবে-রাখা মুসলিম নামটি ভুলে গিয়েছিল। বলার সময় ভুল করে নিজের আসল নামটিই বেরিয়ে গিয়েছিল মুখ দিয়ে—
বিজনবিহারী–
বলতে বলতেই থেমে যায় ছেলেটি। নামের সেনগুপ্ত অংশটুকু বলার আগেই তার নিজের ভুল নিজের কাছে ধরা পড়ে গেছে। হায় হায়, এখন তবে উপায়? উপায় ছিল ভাগ্যের হাতে। পাকিস্তানি জওয়ানের আর বাকিটুকু শোনার। দরকার ছিল না। তার যেটুকু বোঝার তা বোঝা হয়ে গেছে। সে বলে ওঠে—
আপ বিহারি হ্যায়। ইধার মে।
তুমি যখন বিহারি তখন এদিকে দাঁড়াও। তাকে আর একপাশে দাড় করিয়ে দেওয়া হল। আব্দুল আজিজের কাছ থেকে অনেকখানি তফাতে; অন্য পাশে। এবার তৃতীয় ব্যক্তি। সে ছিল একজন খারেজিয়া মাদ্রাসার তালবিলিম। অতএব বিশুদ্ধ উচ্চারণে সে কলেমা পাঠ করল। জওয়ানটি তা শুনে কিছু বুঝল না বোধ হয়। তখন সে আশ্বস্ত হবার জন্য বিহারিকে শুধালে—
ইয়ে আদমী ঠিক বোলতা হ্যায়?
ঠিক বোলতা হ্যায় কি না আমি কি ভাবে জানব? বিজনবিহারী একটু শুধু মাথা নেড়ে জানাতে চাইল-কি করে বলব, আমি ওসব জানি নে। জওয়ানটি বিজনবিহারীর মাথা নাড়ার ভঙ্গি লক্ষ্য করে তালবিলিমকে আব্দুল আজিজের। পাশে দাড় করাল এইভাবে পরীক্ষা করে করে কয়েকজনকে বিজনবিহারীর কাছে এবং অধিকাংশকে দাঁড় করানো হল আব্দুল আজিজের পাশে। তারপর বিজনবিহারীদের ক্ষুদ্র দলটির উপর হুকুম হল—
আপ চলা যাইয়ে।
বিজনবিহারী ও সংগের কয়েকজন বাসে গিয়ে উঠল। জওয়ানদের ইঙ্গিতে বাস ছেড়ে দিল। আব্দুল আজিজসহ অন্যান্যের অদৃষ্টে কী ঘটল তা আর বিজনবিহারী জানে না। কেবল বাস ছেড়ে দেওয়ার কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে তারা পেছনে মেশিনগানের গর্জন শুনেছিল। বিজনবিহারীর বেঁচে যাওয়ার সেই সুদীর্ঘ দেবশোভন কাহিনী সুদীপ্ত শুনেছিলেন প্রায় পাঁচ সপ্তাহ পর। ততদিনে গঙ্গা-যমুনায় বহু জল গড়িয়ে গেছে। এবং মৃধা সাহেবের এমনকি তার নিজেরও, বেঁচে যাওয়াকে অন্যদের তুলনায় খুবই সামান্য একটি ঘটনা বলে