কিন্তু এ কেমন বাঁচা! আকাশে পাখি ওড়ে না, পথে কোন প্রাণীর পদসঞ্চার। নেই, বাতাসে কোন কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয় না কেবল একটা শূন্যতার, একটা ভয়ংকর অনিশ্চয়তার দ্বীপে তারা বন্দী। এর নাম বেঁচে থাকা? প্রাণপণ শক্তিতে একবার বলতে চেষ্টা করলেন–
যে করেই হোক, আমাকে বাঁচতে হবে—বাঁচতেই হবে।
তোমাকে বাঁচতে হবে? তোমার জীবন খুব মূল্যবান? যারা মরে গেলেন তাঁদের চেয়ে তোমার নিজের জীবনটাকে বেশি মূল্যবান মনে করছ কেন অধ্যাপক?
অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহিন দার্শনিক নন। কবি। জীবন নিয়ে কোনো। দার্শনিকতা তিনি জানেন না। জীবনকে কেবলই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে তাঁর। ঠিক মায়ের মতো। সুদীপ্তর কাছে জীবনকে তাঁর সন্তানের মতো মনে হয়। সন্তানের কাছে বাপ-মায়ের কোনো প্রত্যাশা থাকে? অন্ততঃ সজ্ঞানে থাকে না। তাকে সাজাতে ইচ্ছে করে, ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। পরম অভাজন সন্তানও কি মায়ের স্নেহ উদ্ৰিক্ত করে নি। নাহ্, জীবনের কোনো অর্থ আছে কি নেই-এমন প্রশ্ন অর্থহীন। ঐ সব প্রশ্ন তাঁর মনে জাগে না, ও নিয়ে কিছু ভাবতেও ভালো লাগে না। কিন্তু কোনো সকালে নিজের বাগানের এক গুচ্ছ ফুল এনে টেবিলে সাজিয়ে দিতে পারলে? সারাদিন সেই ফুলের হাসির কাছে বার বার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে।
০৮. সুদীপ্ত প্রায় রেল-গেটের কাছে
সুদীপ্ত প্রায় রেল-গেটের কাছে এসে পৌঁছতেই একটা ভক্সওয়াগন গাড়ির মুখোমুখি হলেন। ভয়ের কিছু ছিল না। সাধারণ নাগরিকের গাড়ি। কিন্তু চেনা মানুষ কেউ নেই গাড়িতে। এবং আশ্চর্য এই যে গাড়িটা তাদের আবাসিক এলাকার ভেতরেই ঢুকছে। তাকে দেখেই হয়ত হবে, গাড়িটা থেমে গেল। এক ভদ্রলোক গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে শুধালেন—
তেইশ নম্বর বিল্ডিংটা কোনদিকে বলতে পারেন।
তেইশ নম্বর? এরা তেইশ নম্বরে যাবে? কারা এরা? কার খোঁজে যাচ্ছেন?-প্রশ্ন তো এমনি অনেক কটি ছিল। এবং মনে হচ্ছে, প্রশ্নগুলি তাঁর ভয়াবহ একাকীত্বকে বিদ্ধ করে বোমার ভেতরকার এক-একটি লৌহ-শলাকার মতো তার মনের প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে গেল। ভালোই তো হল। এতে একাকীত্বের ভার এতক্ষণ কী করে তিনি বহন করে চলেছিলেন। ভদ্রলোকের সঙ্গে দুটো কথা বলে সুদীপ্ত যেন প্রাণ ফিরে পেলেন। ভদ্রলোক যাচ্ছেন মৃধা সাহেবের খোঁজে।
হাঁ, ভালোই আছেন তিনি। গতকাল তিনি সপরিবারে ফরিদপুর যাবেন বলে বেরিয়ে গেছেন।
না তা বলতে পারি নে। আপনি লঞ্চঘাটে খোঁজ নিলে বোধ হয় জানতে পারবেন। গতকাল যদি ফরিদপুরের কোন লঞ্চ ছেড়ে থাকে, নিশ্চয় তা হলে চলে গেছেন তারা। নইলে যেতে পারেন নি।…
হাঁ, ঠিকই শুনেছেন। ওটা মৃধা সাহেবের ঠিক পাশের ফ্ল্যাটের ঘটনা। তেইশ-এর এফ-এ সকলেই মারা গেছেন। মৃধা সাহেব থাকতেন তেইশ-এর ই-তে।…
জি, আল্লাহ্ বাঁচিয়েছেন। মৃধা সাহেবের বেঁচে যাওয়াটা একটা মিরাকল।
মৃধা সাহেবের মুখে তার বাঁচার কাহিনী সুদীপ্তর মিরাকলই মনে হয়েছিল গতকাল। কিন্তু পরবর্তীকালে? অমন যে কত ঘটনার কথা কানে এসেছে যা। বিশ্বের যাবতীয় মিরাকলকে হার মানাবে। মৃধা সাহেবের স্ত্রী অনর্গল উর্দু বলতে পারেন। অতএব তাদের বেঁচে যাওয়ার একটা ক্ষীণ কার্যকারণ সূত্র সুদীপ্ত খুঁজে পেয়েছিলেন। উর্দুভাষীকে নয়, কেবল বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যার আদেশ ছিল টিক্কা খার। সেই অবস্থায়, একটুও উর্দু জানে না—এমন বাঙালি হিন্দুর পক্ষে পাকিস্তানি জওয়ানদের কবল থেকে বেঁচে আসাটা কোন পর্যায়ে পড়ে?
জগন্নাথ হলের সেই ছাত্রটির কথাই ধরা যাক। পঁচিশের রাত দশটা থেকে সাতাশের বেলা দশটা পর্যন্ত ছেলেটি তাদের হলের পাশে স্যাভেজ রোডের সবচেয়ে উঁচু গাছটার উচ্চতম ডালে কাটিয়েছিল। এই ছত্রিশ ঘণ্টার মধ্যে না কিছু সে খেয়েছে, না ঘুমিয়েছে। সাতাশ তারিখে গাছ থেকে নামবার সময় মাটির কাছাকাছি পৌঁছতেই সামনে পড়ে একটা মিলিটারি গাড়ি। যাচ্ছিল পুরোনো ঢাকার দিকে। তাকে গাছ থেকে নামতে দেখে ধরে ফেলে তারা, এবং গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। হায় হায়, ছত্রিশ ঘণ্টা এতো কষ্ট করে নিজেকে সে বাঁচিয়েছিল কি শেষ পর্যন্ত এইভাবে বেঘোরে প্রাণ হারাবার জন্য! এখন তাকে নিয়ে কি করবে এরা! কি করতে পারে। নিঃসন্দেহে কোথাও নামিয়ে এক্ষুণি মেরে ফেলবে। মৃত্যুর প্রহর গুণতে থাকে ছেলেটি হঠাৎ গাড়িটা একটা বাজারের মোড়ে এসে থেমে যায়। বাজার লুঠ হচ্ছে। তা দেখে গাড়ির চারটে জওয়ানের তখন মাথা। ঠিক থাকার কথা নয়। লড়াই করে তারা ঢাকা শহর জয় করেছে! সারা শহরের সকল সম্পদ এখন গণিমতের মাল। যেখানে যা পাও লুটে-পুটে নাও। কাফের বাঙালিদের দোকান-পাট লুট করা নেকির কাম। হুজুর টিক্কা ফতোয়া দিয়েছে। অতএব নেকি হাসিল করার কামে ঝাপিয়ে পড়ল জওয়ানেরা। ছেলেটি তখন খালি গাড়িতে বসে তার জওয়ান ভাইদের জন্য প্রতীক্ষা করবে নাকি! একদিকে নেমে এক ফাঁকে সে পালাল। কিন্তু এখানেই তার কাহিনী শেষ হয়। এ নি। প্রায় পাঁচ সপ্তাহ পর তার বেঁচে থাকার বৃত্তান্ত সুদীপ্ত শুনেছিলেন। কাহিনীটা সেকালের হলে একালের মানুষ তাকে বলত রীতিমত নভেল।
আরো তিনবার সে সামরিক জওয়ানদের কবলে পড়ে। দ্বিতীয়বার নদীতে নৌকায় নদী পার হবার সময় পাকিস্তানি বীরপুরুষেরা নৌকা লক্ষ্য করে গুলি। চালাতে শুরু করলে কিভাবে সে বেঁচেছিল? সে কি কম অলৌকিক? অধিকাংশই মারা গেল। কেউ গুলি খেয়ে, কেউ নদীর জলে খাবি খেয়ে। কিন্তু সে নিজে সাঁতার না শিখেও বাঁচল কিভাবে? গুলিতে ছিন্নভিন্ন নৌকার ভগ্নাংশ আশ্রয় করে এক সময় ছেলেটি কুল পেয়েছিল। মৃত্যুর তীর থেকে এসে জীবনের কূলে ভিড়েছিল। এবং তারপর?