অত্যন্ত কৃত্রিম ছিল সেই সম্পর্ক যাকে সত্য বলে মনে করে অবাঙালি মুসলমানকে একটা আত্মীয় বলে বুকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছিলেন বাঙালি মুসলমান। এই তো এই ফ্ল্যাটে আলি ইমাম জৌনপুরিকে দেখ না। বাংলাদেশে এসছেন বিশ বছর আগে। দাঙ্গায় আত্মীয়-স্বজন সকলকে হারিয়ে কোনো মতে নিজের প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। কিন্তু বেছে বেছে মিশেছেন অবাঙালি। মুসলমানের সঙ্গে এবং আজো সেই ট্র্যাডিশন বজায় রেখেছেন।
কিন্তু কথা তো খালি ঐটুকু নয়। এক ভাষার মানুষ অন্য ভাষার মানুষের সাথে সহজে মিশতে পারে না। সেটা কি অপরাধ? কিন্তু অপরাধ ঐখানে যেখানে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে হাত মিলিয়ে বাঙালিদের স্বার্থের বিরোধি চক্রান্তকে সফল হতে দিচ্ছে। বাধা তো দূরের কথা, বরং তারা। বাঙালি শোষণের কাজে সহায়তা করেছে পশ্চিম পাকিস্তানিদেরকে। ঐখানে বাঙালিরা কাউকে ক্ষমা করতে রাজি নয়। কাউকে না, আপন আত্মীয় হলেও না।
একটা ভাবনার মধ্যে সুদীপ্ত ক্ষণিক আনমনা হয়েছিলেন। এবং আনমনা হয়েই একে একে অতিক্রম করেন বাকি পথটুকু, পৌঁছলেন শেষ প্রান্তের তেইশ। নম্বর বিল্ডিংয়ে। সারা এলাকায় কোনো একটি মানুষের সাথে দেখা হল না। এতো নির্জনতা। প্রথম দিবালোকে এই এলাকায় এতো নির্জনতা অনন্ত কালের। ইতিহাসে কখনো বোধহয় নামেনি। রাতের নির্জনতা নিয়ে কথা ওঠেনা। সবাই। জানে, মানুষ তখন ঘুমোয়। ঘরে ঘরে ঘুমন্ত মানুষগুলিও এক ধরণের সঙ্গ। দিতে পারে মনকে। একটা অনুভূতি—ওরা আছে। হাঁ, ঘুমিয়ে আছে। তবু আছে। কিন্তু প্রাক-মধ্যাহ্নের উজ্জ্বল রৌদ্রালোকে একটি মানুষেরও দেখা যদি না মেলে? না, রাত্রির জনহীনতার সঙ্গে এর তুলনা হয় না। কেউ না থাকলে তখন নিশাচর প্রাণীরা থাকে। আর এখন? আশ্চর্য, পথে আজ সেই কুকুরটাও নেই। নীলক্ষেত এলাকার সেই লা-ওয়ারিশ কুকুরটা। কেউই ওটাকে পোষেনি। আস্তাকুঁড়ের এটোকার্টা খেয়ে বড়ো হয়েছিল। মিউনিসিপ্যালিটির কুকুর নিধন অভিযানের সময় রক্ষা পেয়েছিল নিছক নিজের বুদ্ধিতেই। কোনো মানুষের সহায়তা সে পায় নি। তবু সে মানুষকে মেনে নিয়েছিল বন্ধু বলে। সে ছিল নীলক্ষেত এলাকার সকল মানুষের। এই আবাসিক এলাকার প্রত্যেকটি মানুষকে সে চিনত, কিন্তু রাত্রে চোরের মতো অচেনা কেউ আসুক দেখি! প্রবল ঘেউ ঘেউ চীৎকারে পাড়া মুখর করে তুলত। ঐ রাতেও একবার তার ঘেউ ঘেউ চীৎকার সুদীপ্ত শুনেছেন। তারপরই চুপ। বীর পুরুষেরা ঠিক ওটাকে গুলি করে মেরেছে। আর মেরেছে এ দেশের মানুষ। মানুষ-কুকুরে পার্থক্য নেই! আছে। কিন্তু তা আছে মানুষের দৃষ্টিতে। জানোয়ারের কাছে নেই। মানুষের চামড়া গায়ে সবাই কি মানুষ?
তেইশ নম্বরে প্রবেশ করলেন সুদীপ্ত। অভ্যাস মত সারি সারি চিঠির বাক্সগুলির দিকে তাকালেন। কোনো চিঠি আছে? থাকে যদি? না, থাকবে না। “কে আর লিখবে চিঠি”-এই দীর্ঘশ্বাস অবশ্য সুদীপ্তর জীবনে নেই। তাঁকে চিঠি লেখার মানুষ অনেক-আত্মীয়-স্বজন সামান্যই, কিন্তু বন্ধু-বান্ধব বিস্তর। অতএব চিঠি তাঁর থাকতেই হবে। কিন্তু চিঠি আসার পথ কৈ? সেই আগুনে কতো বাড়ি-ঘর পুড়েছে, কতো মানুষ পুড়েছে, আর চিঠির কাগজ পুড়বে না? অতএব তিনি আর চিঠির বাক্স খুললেন না।
কিন্তু এগোতেও পারলেন না। সিঁড়িতে রক্তের দাগ। হাঁ, এ দাগ তো থাকারই কথা। এতোক্ষণ যেন কথাটা ভুলে ছিলেন সুদীপ্ত। তাঁর ঘরে যেতে হলে এই রক্ত মাড়িয়ে যেতে হবে। মানুষের রক্ত মাড়াতে হবে! আরেকটা মানুষের গায়ে পা ঠেকালে মানুষ কতো অপ্রস্তুত হয়। সালাম দিয়ে ক্ষমা চেয়ে তবে স্বস্তি পায়। আর এ তো রক্ত। শরীরের অভ্যন্তরে তা আরো পবিত্র, আরো। অন্তরতম। তাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে যাওয়া! হাঁ, এই রক্তই গতকাল পা দিয়ে মাড়িয়েছেন। না মাড়িয়ে উপায় কি ছিল? ঘর থেকে বেরুতে হলে রক্ত না মাড়িয়ে উপায় ছিল না। পাকিস্তানি জল্লাদদের খুন করার কায়দাটা ভারি চম কার। ঠিক ঘর থেকে বেরুবার মুখে দাঁড় করিয়ে গুলি করেছে। যেন তার রক্ত অন্যদের শুধু নয়,আত্মীয়দেরও পায়ে পায়ে দলিত হয়। বুক ফেটে কান্না এল সুদীপ্তর। না, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। দুহাতে চোখ ঢেকে সিঁড়িতেই বসে পড়লেন অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহিন। কয়েক বছরই তো এই সিঁড়ি দিয়ে। ওঠা-নামা করেছেন, কখনো এর উপর বসার কথাটা সুদীপ্তর মনে হয়নি। সম্পর্কটা ছিল কেবল পায়ের সঙ্গে।
সুদীপ্ত প্রায় শিশুর মতো কিছুক্ষণ কাঁদলেন। শিশুর মতই দুচোখ দিয়ে পানি ঝরল, কেবল কণ্ঠ দিয়ে কোনো চিৎকার বেরুল না। বেরুলেই বোধ হয়। তিনি বাঁচতেন। একটিও কষ্ঠের কোনো শব্দ যেখানে নেই সেখানে মানুষ বাঁচে? মনে হচ্ছিল, একটা প্রবল নিঃশব্দতা বিশাল দৈত্যের মতো বাহু বিস্তার করে সুদীপ্তর গলা টিপে ধরেছে। আঙ্গুলের চাপ ক্রমেই তীব্র হচ্ছে তাঁর গলার উপর। নিশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। আর কি তবে বাঁচবেন না? না, বাঁচতেই হবে। সব গেলেও বাঁচার ইচ্ছেটা এখনো যায় নি।
অবশেষে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সুদীপ্ত, এবং সঙ্গে সঙ্গেই বেড়িয়ে পড়লেন তেইশ নম্বর বিল্ডিং থেকে। এই তো সবে। গতকাল এই দালান ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন তারা। তখন কি মনে হয়েছিল। আর কখনোই এখানে ঢুকতে পারবেন না! কখনোই ঢোকা যাবে না এখানে? তাই তো মনে হচ্ছে এখন সুদীপ্তর। তাঁর জীবনের বেশ কয়েকটি বছরের স্মৃতি এই বাড়িটার সাথে জড়িত। কতো ক্লান্তির কতো আনন্দের কতো ইচ্ছা ও আশায় পাখিরা এর রেলিঙে বসেছে, কার্নিশ ছুঁয়ে আকাশে উধাও হয়ে গেছে, রক্তের শস্যকণায় ফিরে এসেছে বার বার। মানুষ এমনি করেই বাঁচে।