আয়ুব খানের আমলে অনেকেই জাতীয়-সংহতি রক্ষার দালালি নিয়ে বেশ দুপয়সা করে খেয়েছে। পথে-ঘাটে, ক্লাবে-রেস্তোরায় যত্রতত্র তারা এই জাতীয়-সংহতির সবক বিতরণ করত। তা নিতে না চাইলেও কানে শুনতে হত সকলকেই। সুদীপ্তও সেদিন তা নীরবে শুনেছিলেন, শুনতে হয়েছিল। আজ তেমনি তাকে শুনতে হল ধর্মের কথা। তাকে ইসলাম ধর্মের সবক নিতে হল। পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিকের কাছ থেকে। তাঁরা যে মুসলিম এটা নাকি বাঙালিরা ভুলে গিয়েছিলেন, তাই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী রাতের অন্ধকারে কামান-মেশিনগান-রাইফেল নিয়ে ঘরে ঘরে এসে বাঙালিকে মনে করিয়ে দিয়ে গেছে–তোমরা যে মুসলমান এটা মনে রেখো বেরাদরগণ।
মনে না রাখলে।
তোমাদের হত্যা করা হবে। মুসলমানদের আবাসভূমি পাকিস্তান। সেই পাকিস্তানে বাস করে তুমি ইসলামকে ভুলে যাবে? তা হলে তোমাকে হত্যা করা আমাদের জন্য ফরজ কাম।
অতএব পাক-সৈন্যদের সেই রাতের তাণ্ডবলিলা না-যায়েজ হয়নি।
কিন্তু তবু প্রশ্নটা মন থেকে তাড়ানো যায় না। মুসলমানরা না হয় হিন্দু হয়ে যাচ্ছিল বলে তাদের মেরে বেড়ালে। কিন্তু হিন্দুরা? তারা কি সব মুসলমান হয়ে যাচ্ছিল। তাদের মারার কারণ কি?
ওরে বাবা, তারা যে হিন্দু। পাকিস্তানে হিন্দু থাকতে দেওয়া যায় নাকি?
কেন? তোমাদের বাপ কায়েদে আজম যে বলে গেছেন, পাকিস্তানে কোনো মুসলমান মুসলমান হবে না, কোনো হিন্দু হিন্দু হবে না। তারা সবাই মিলে হবে একটি জাতি-পাকিস্তানি। তা হলে আবার কিভাবে তোমরা এখানে হিন্দু মুসলমানের ভেদাভেদ সৃষ্টি করছ বুঝিনে।
বুঝলে না? হিন্দু মাত্রই ধরে নিতে হবে পাকিস্তানের দুশমন। আর দুশমন দেখলে তাদেরকে গুলি করা সামরিক বিধানে বিলকুল জায়েজ।
এইভাবে বস্তির দরিদ্র মানুষ, ভদ্রলোক মুসলমান, ভদ্রলোক হিন্দু প্রত্যেককে, হত্যা করার উপযুক্ত কারণ পাকিস্তানিরা বের করেছিল। আহা, একজন মুসলমান তো আর অকারণে নরহত্যা করতে পারে না।
০৭. খাকি মূর্তিটার হাত থেকে
খাকি মূর্তিটার হাত থেকে রেহাই পেয়ে সুদীপ্ত তাঁদের আবাসিক এলাকায় ঢুকলেন। ঠিক যন্ত্রচালিতের মতো। ঢুকেই অনুভব করলেন সেই ক্লান্তিটাকে। যেন সদ্য সাত ক্রোশ অতিক্রম করে এখানে এসে পৌঁছলেন। পা পড়ে না, হৃৎপিন্ড যেন অবশ হয়ে আসছে—পাশের পাঁচিলে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। এই তাঁদের সেই আবাসিক এলাকা যেন তিনি মধ্যযুগীয় কোনো দুর্গে প্রবেশ করেছেন। মাত্র একদিনেই সারা এলাকা। হয়ে গেছে শত্রু-বিধ্বস্ত পরিত্যক্ত দুর্গ। সুদীপ্ত যেন। এক রজনীর নিদ্রা-শেষে দুশো বছর পরের পৃথিবীতে জেগে উঠেছেন। আসহাব কাঁহাফের অভিজ্ঞতার প্রান্ত ছুঁয়ে চারপাশে একবার তাকালেন। একটিও মানুষ নেই। যেখানে মানুষ থাকে না সেখানে কি আসতে আছে? এ তুমি করেছ কি সুদীপ্ত? স্ত্রী, নিষেধ কুরেছিলেন। সুদীপ্ত শোনেন নি। এমনিতেই মেয়েরা যথেষ্ট বুদ্ধি-চালিত নয়, তদুপরি বিপদের দিনে? পুরোপুরি তখন তারা হৃদয়বৃত্তির নির্দেশে চলে। তখন তাদের কথায় গুরুত্ব নেই। সুদীপ্তর এই ধারণা আজ সকালেও বেশ সজীব ছিল। এবং নিজের বুদ্ধিবৃত্তির স্বাস্থ্য সম্পর্কে কোন সন্দেহই মনের মধ্যে ছিল না। কিন্তু এখন? মনে হচ্ছে, বুদ্ধি যেন ঠিকমতো কাজ করছে না, কোন জীবাণু প্রবেশ করে তাকে ধূলিশায়ী করতে চাইছে। মনে হচ্ছে, স্ত্রীর কথায় কান দিলেই তিনি ভালো করতেন। এখন কি আর কান দেবার সময় আছে? এখনো যেন সুদীপ্ত শুনতে পাচ্ছে….
না, বাইরে যেতে হবে না। তুমি যেতে পারবে না।
তুমি কিছু ভেবো না। কোনো ভয় নেই। এই যাব আর আসব। ফিরোজ। তো গেল বাইরে। ভাবী তো কই বাধা দিল না।
ভাবী অর্থাৎ ফিরোজের স্ত্রী। মীনাক্ষী নাজমা। মীনাক্ষী বাধা দেয় নি।
আমিনা কি তার চেয়ে কোন অংশে খাটো যে বাধা দিতে যাবে। একটা ক্ষেত্রে হতো আমিনার পরাজয় হয়েই আছে। সেটা নামে। তার নাম সুদীপ্তর পছন্দ নয়। কিন্তু কবি সুদীপ্ত খুবই পছন্দ করেন মীনাক্ষী শব্দটাকে। নাম কি কারো গায়ে লেগে থাকে নাকি—এই বলে স্বামীর পছন্দটাকে একটা থাপ্পড় কষে দিয়ে নিজেও মনে মনে সান্ত্বনা পেতে চেয়েছিলেন আমিনা। আজ অতএব মীনাক্ষী প্রসঙ্গ উঠতেই আমিনাকে তাঁর ফণা একটু গুটাতেই হল–
কোথায় যাবে?
আমাদের ফ্ল্যাটে।
কোনো কথা না বলে আমিনা স্বামীর চোখের দিকে তাকালেন। সুদীপ্ত সুস্পষ্টভাবে বুঝলেন, উপযুক্ত কৈফিয়ৎ না দিয়ে বেরুনো যাবে না। প্রায় অনুনয়ের সুরে তাঁকে বলতে হল…
দেখ, খাতা-কলম কিছু আনা হয় নি। দু-একটা লাইন কিছু লিখলে মনের অবস্থাটা অন্ততঃ রক্ষা পাবে।
স্ত্রী গম্ভীর হয়ে গেলেন। ভাবখানা এই—তোমার যা খুশি করো গে, আমি কিচ্ছু জানি নে। সুদীপ্তও আর কিছু জানানোর দরকার মনে করলেন না। নীরবে জামা-জুতো পরে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু বেরিয়ে তিনি ভুল করেছেন বৈ কি। এক শো বার ভুল করেছেন। তা হলেও বাসার এত কাছে এসে আর ফিরে যেতেও চান না। এতে শুরু করলেন।
এই ফ্ল্যাটগুলোতে থাকতেন কারা? তারা সেই দুশতাব্দীর পূর্বের ফেলে-আসা পৃথিবীর মানুষ। তারা এখন ইতিহাস। এইখানে থাকতেন। বিশ্ববিদ্যালয়-অফিসের একজন হিন্দু কর্মচারি, বাড়ি নোয়াখালি। আর তাঁর সামনেই ঐ ফ্ল্যাটে যিনি ছিলেন তাঁর আদি নিবাস বিহার। নোয়াখালিতে ছেচল্লিশের দাঙ্গায় শ্রীগোপালচন্দ্র ভৌমিক তাঁর বাবাকে হারিয়েছিলেন। নিজে তিনি তখন মায়ের সঙ্গে ছিলেন মামা বাড়িতে, চাঁদপুর। অতএব নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে তিনি ও তাঁর মা সেবার বেঁচে গেছেন। তারপর মামা বাড়িতে থেকেই বি. এ. পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছেন। ভারতে যান। নি। মুসলমান বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। ক্রমেই তিনি ভুলে গেছেন, তিনি হিন্দু না মুসলমান। তাঁর সহকর্মী বন্ধু হুমায়ুন তাঁকে হিন্দুত্ব ভুলিয়ে ছেড়েছে। হাঁ, ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপরাটা গোপালদের বাড়িতে ছিল বৈ কি। কিন্তু হুমায়ুনটাকে বাগ মানানো যায় না কিছুতেই। তুমি মুসলমান, তোমার না হয় ছোঁয়াছুয়িতে জাত যায় না। আমাদের ব্যাপারটা একটু ভাববে। তো! না। তা ভাবতে রাজি নয় হুমায়ুন। কোনো যুক্তিই তাঁকে স্পর্শ করে না। তাঁর যুক্তি একটাই——ধর্মভেদ জাতিভেদ বর্ণভেদ সব ঝুটা হ্যায়। বাবা, মানুষ। হতে শেখো। নইলে সবাই মরবে। শেষ পর্যন্ত বৌদিকে অর্থাৎ গোপালের স্ত্রীকেও নেমন্তন্ন রক্ষা করতে হয়েছে হুমায়ুনদের বাড়িতে—একেবারে ভাত খাওয়ার নেমন্তন্ন। কিন্তু কৈ, কিছু তো মনে হয় নি। বরং হিন্দুর বাড়ি মুসলমানের বাড়ি বলে যে ভেদটাকে তিনি নিজের মধ্যে এতকাল লালন করে। এসেছেন সেটাকে তাঁর মনে হয়েছে কৃত্রিম।