হায় হায়, আস্ত মরদেহ আগুনে ঝলসে ব্রেষ্ট হয়ে আছে। এখনো আছে! কেবল সরিয়ে নিয়ে গেছে পথে পথে গুলি-করে মারা মানুষগুলিকে। ঘরে আগুন লাগলে মানুষ পথে বের হয়। বস্তির মানুষেরা পথে বেরিয়েছিল। আর পথে বেরিয়েই গুলি খেয়েছিল। ভারি সুন্দর রণকৌশল জানে পাক-ফৌজের দল। প্রথমে আগুন জ্বালিয়ে দাও, তারপর লোক পথে বেরুলে কারফিউ-ভঙ্গের অপরাধে গুলি কর। নরহত্যা হালাল হয়ে যাবে। বাঙালিরা সব কাফের হয়ে গেছে, অতএব তাদেরকে হত্যা করা হালাল। এই যুক্তিতে হাজার হাজার নরহত্যার প্রত্যেকটিই হালাল করে নিয়েছিল পাকিস্তানিরা। না করে উপায়ও ছিল না। তারা ইসলামের বড়াই করে থাকে না! এবং ইসলাম যদি শান্তির ধর্ম হয় তবে এতো অশান্তি সৃষ্টির এতো ধ্বংসলিলার একটা কারণ দেখাতে হবে তো।
অদ্ভুত কারণ দেখিয়েছিল সেই পাকিস্তানি সৈনিক। রেল লাইন অতিক্রম করে তাঁদের নীলক্ষেত আবাসিক এলাকার গেটের কাছে পৌঁছতেই একটা মি লিটারি জিপ এসে সুদীপ্তর সামনে দাঁড়াল। সুদীপ্ত একবার মনে মনে আল্লাহকে ডাকলেন, এবং মুহূর্তের মধ্যে সামনের সদ্য পাতা-গজাননা দেবদারু গাছটিতে চোখ বুলিয়ে নিলেন। চলে যাবার সময় যদি জীবনে এসেই থাকে তবে তৈরি। হয়ে নেওয়াই ভালো। মনকে তিনি তৈরি করে নিলেন। দেবদারুর সারা অঙ্গ ভরে বাংলার রূপ। এই রূপের পাথেয় নিয়ে পরকালের যাত্রাকে মধুময় করে নেওয়া যায় না? ঘরের মধ্যে রাতের অন্ধকারে ইদুরের মতো মরে পড়ে থাকাটা তিনি যে এড়াতে পেরেছেন সেই জন্যই তিনি নিয়তিকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। এখন এই উজ্জ্বল সকালে দেবদারু গাছের ছায়াতে মরে যেতে আর আপত্তি নেই।
ওহে জেন্টলম্যান, তোমার আপত্তি থাকলেই বা সে কথা শুনছে কে? ঐ যে রাইফেলের নলটা দেখছ। ঠিক তোমার বুকের দিকে তাক করে আছে। সুদীপ্ত একটা খাকি মূর্তিকে দেখলেন।
ইধার সে কাঁহা যাতা হ্যায়।
হামারা ঘর মে যানা চাহতে হ্যায়।
উত্তরটা চট করে বেরিয়ে গিয়েছিল সুদীপ্তর মুখ দিয়ে। কিন্তু ওদিক থেকে জবাব এসেছিল—
কুত্তাকা ঘার নেহি হ্যায়, চলো।
না বলেই সে খাকি মূর্তিটা রেল লাইনের দিকে তার রাইফেলের নল প্রসারিত করে দিল। অর্থাৎ রেল লাইনের ওদিকে শশানের মতো এলাকায় সুদীপ্তকে যেতে বলা হচ্ছে। তার মানে যে কি সেটা বুঝতে অসুবিধা ছিল না। যাওয়া আদৌ নিরাপদ নয়, না গেলেও বিপদ। বিপদের সময় বুদ্ধি কে জোগায় সুদীপ্তর জানা নেই। বুদ্ধিটা পেতে কোন চেষ্টাও তিনি করেন নি। তবু পেয়ে গেলেন
হাম কুত্তা নেহি হ্যায়, হাম মুসলমান হ্যায়।
তোম যে মুসলিম হ্যায় উ তো ভোল গিয়া।
তুমি যে মুসলিম সে তো ভুলে গিয়েছিলে বেরাদর। এ অভিযোগের উত্তর। কি হবে? সুদীপ্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ মেরে গেলেন। তবু এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহিন। খাকি মূর্তির আদেশ মোটামুটি ঠিকভাবেই তিনি পালন করেছিলেন—কলেমা পড়তে ভুল করেন নি। এবং নামটাও মিছে করে বলেছিলেন। তো, চাকরির জন্য যে নাম তিনি গ্রহণ করেছিলেন সেটা মিথ্যে বৈ কি। সর্বত্রই তিনি সেই সুদীপ্ত শাহীনই আছেন। কিন্তু পাকিস্তানে সর্বত্র সত্যবাদী হয়ে কি করে চলবেন তিনি? যখন কোনো বাঙালি নিজেকে পাকিস্তানি বলেন তখন সেইটেকেই একটা চরম মিথ্যা বলে মনে হয় সুদীপ্তর। পাকিস্তানের কোনখানে বাংলাদেশ আছে শুনি? প-এ পাঞ্জাব-পাঠান, ক-এ কাশ্মীর, স-এ সিন্ধু, স্তান-এ বেলুচিস্তান—এই তো “পাকিস্তান” শব্দের ব্যাখ্যা। তা হলে বাংলা স্থান পেল কোন্ অংশে? তবু এই বাংলাদেশ নাকি পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। শুনলেই গা জ্বালা করে সুদীপ্তর। তবুও শুনতে। হয়। কেন না তা শোনানোর মতো লোক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিস্তর না হলেও নেহাৎ। কম ছিল না। সুদীপ্ত সাধ্যমতো তাদেরকে এড়িয়ে চলতেই অভ্যস্ত। কি আশ্চর্য, মাঝে মাঝেই সুদীপ্তকে ভাবতে হয়, মধ্যযুগীয় মানসিকতা বিশ্ববিদ্যালয়েও এতো প্রশ্রয় পায়; মধ্যযুগীয় প্রভু-তোষণের মনোবৃত্তিটাকে সুদীপ্ত ঘৃণা করেন। অথচ অনেকে সেটাকে লালন করে খুশি, এবং লাভবানও। তাদের সান্নিধ্য সুদীপ্ত এড়িয়ে চলেন। তবু কি সব সময় এড়িয়ে চলা যায়? হাজার হলেও এক সাথে চাকরি করেন–কমনরুমে, ক্লাবে দেখা-সাক্ষাতটা তো আর এড়িয়ে চলা। যায় না। সেদিন একটা ছোট বিতর্ক সুদীপ্ত এড়াতে পারেননি। কতক্ষণ আর কথা না বলে দুটি মানুষ মুখোমুখি বসে চা খেয়ে যেতে পারে। অত্যন্ত সাবধানে সুদীপ্ত নিছক আবহাওয়ার কথা উত্থাপন করেছিলেন—
পূর্ব বাংলায় এবার বেশ অনাবৃষ্টির বছর যাবে বলে মনে হচ্ছে।
নিঃসন্দেহে তিনি খুব নিরাপদ প্রান্তরে বিচরণ করেছেন বলেই সুদীপ্তর ধারণা হয়েছিল। কিন্তু সুদীপ্তর দশা হয়েছিল সেই একচক্ষু হরিণের মতো।
একটা দিকে তিনি নজর রেখেছিলেন ঠিকই, কিন্তু আর একটি দিক তিনি দেখতে পাননি। তাঁর সহকর্মী সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছিলেন—
পূর্ব বাংলা নয়, বলুন পূর্ব পাকিস্তান।
সহসা সুদীপ্ত একটু উত্তেজিত হয়েছিলেন যেন। বলেছিলেন—
কেন? পূর্ব বাংলা বললে কি দোষ হয়?
একশো বার দোষ হয়। আমরা যে এক জাতি-পাকিস্তানি-সে কথাটা অস্বীকার করা হয় ওতে।
এই কথা শোনার পর আর কিছু বলা যায় না। বলা উচিত নয়। উচিত অনুচিতের এই বোধটুকু না থাকলে পাকিস্তানের অস্তিত্ব রক্ষা অসম্ভব। তবে একদিক থেকে তাঁর সহকর্মী অধ্যাপকটি মিথ্যা বলেননি। পরে ভেবে দেখেছিলেন সুদীপ্ত। সত্যিই তো পাকিস্তানের মধ্যে বাংলার স্থান কোথায়। প এ পাঞ্জাব-পাঠান, ক-এ কাশ্মীর, স-এ সিন্ধু, স্তান-এ বেলুচিস্তান কিন্তু বাংলা হবে কি দিয়ে? অতএব সোজা সমাধান-”বাংলা” শব্দটাকে বাদ দাও। বল “পূর্ব পাকিস্তান”। জাতীয় সংহতি রক্ষা পাবে।