খবিশগুলো গাড়িখানা পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে গেছে।
ওসমান সাহেব মাত্র সপ্তাহ খানেক হল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় বাড়ি পেয়েছিলেন। কিন্তু গাড়ি রাখার গ্যারেজ খালি ছিল না বলে বাইরেই তা ফেলে রাখতে হচ্ছিল। তাঁদের আবাসিক এলাকার দারোয়ানকে বখশিস দিয়ে গাড়ি পাহারার ব্যবস্থাও করেছিলেন ওসমান সাহেব। অতএব স্বাভাবিক অবস্থায় ভয়ের কিছু ছিল না কিন্তু সেই কালো রাতের হানাদারগুলো ওসমান সাহেবের ভাষায় খবিশগুলো, গাড়িখানা পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কত জনের কখানা গাড়ি গেছে কে জানে! সুদীপ্তর গাড়ি ছিল না। অতএব ঐ নিয়ে কোন দুশ্চিন্তার অবকাশও তাঁর ছিল না। আজ। ওসমান সাহেবকে দেখে তাঁর মনে হল, মানুষের গাড়ি না থাকাটাই বোধহয় ভালো। দীর্ঘকাল গাড়ি নিয়ে বেড়ানোর পর হাঁটতে হলে কেমন লাগে? অন্ততঃ অন্যের যে খারাপ লাগে সেটা ওসমান সাহেবকে দেখে অনুভব করলেন সুদীপ্ত। ওসমান সাহেবের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীও হাঁটছিলেন, হেঁটে হেঁটেই তাঁরা চলছিলেন ধানমন্ডির দিকে।
ভাবী, ভালো আছেন?—কথাটা শুধোতে গিয়ে সুদীপ্তর গলায় আটকে গেল। প্রশ্নটা ব্যাঙ্গাত্মক শোনাবে না? সদ্য গাড়ি হারিয়েছেন, তদুপরি রিক্সায় না চেপে হাঁটছেন-এমন অবস্থায় ভালো আছেন কি না শুধোলে কেউই সে প্রশ্ন প্রসন্নভাবে নিতে পারেন না। কিন্তু ওসমান সাহেবের স্ত্রী নিজেই কথাটা তুললেন–
আপনারা কোথায় উঠেছেন? ভালো আছেন তো?
কোন মানুষের পক্ষেই তখন ভালো থাকার কথা নয়। সুদীপ্তর স্ত্রীও ভালো ছিলেন না। গত দুদিন ভালো করে কিছু খান নি; তা নিয়ে মীনাক্ষী ভাবী অভিযোগও করেছেন। সেই প্রগলভা মিনা এখন কথাও বলেন খুবই কম। ছেলেমেয়েরা কাছে গেলে বিরক্তি বোধ করেন। তবু সুদীপ্ত বললেন–
ভালোই আছি। আপনারা?
ওদের কাছ থেকে চলে আসার সময় সুদীপ্ত বললেন—
কাল আপনারা আমাদের ওখানে আসুন না। আপনার ভাবী তো ভয়ানক ঘাবড়ে গেছেন।
হ্যাঁ আসব। আপনারাও আসবেন।
বলেই ওরা এগিয়ে গেলেন। সুদীপ্তও চলা শুরু করলেন কিন্তু কেউ কারো ঠিকানা শুধালেন না। বরং মাত্র দুএগিয়ে সুদীপ্ত যখন পাশের মরা কুকুরটাকে এক মনে দেখছিলেন তখন ওসমান সাহেব খুব আস্তে স্ত্রীকে শুধাচ্ছিলেন—
একটা রিকসা করব? মানে তোমার কষ্ট হচ্ছে তো।
খুব গম্ভীরভাবে স্ত্রী বললেন—
না।
বলে তিনি চলতে শুরু করলেন। ওসমান সাহেবও স্ত্রীর সঙ্গে হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার পেলেন না। স্ত্রীর ব্যবহারে অস্বাভাবিকতাও লক্ষ্য করলেন না। কেননা সেটাও লক্ষ্য করেতে হয়। মন দিয়ে কিছু লক্ষ্য করার অবস্থা তখন ওসমানের ছিল না। গতকাল বাসা ছেড়ে বেরুনোর সময় স্ত্রী শুধু বলেছিলেন–
মাত্র এই একান্ন টাকা পুঁজি। তখন বললাম, কিছু টাকা উঠিয়ে রাখ।
ব্যাংক থেকে টাকা ওঠানোর কথা স্ত্রী বলেছিলেন বটে। কিন্তু দুজনেই তারা জানতেন ব্যাংকে তেমন কিছু নেই যা ওঠানো চলে। কিন্তু নেই কেন? এমনি একটা প্রশ্নের চারা মনে গজাতে দিয়ে গতকাল থেকে কেবল তার উপরেই পানি ঢালছেন ওসমান সাহেবের স্ত্রী। বাইরে কিছু বলছেন না। এই দুঃসময়ে সেটা বলা অসভ্যতা। হাজার হলেও রিটায়ার্ড ডি. আই. জি. সাহেবের কন্যা তিনি। আর ওসমান? তার বংশের কেউ কখনো সামান্য দারোগা হয়েছে এমন দেখাও দেখি। কেবল পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছিল, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছ, তার বেশি তো না। ফ্রিজ. টি. ভি. সোফা সবি তো আমার বাপ দিয়েছে, নিজে কেবল কিনেছ একখানা গাড়ি, তাতেই এমন। ফকিরী দশা! মহিলার ক্ষুদ্ধ হওয়ার এক গাদা কারণ ছিল। সামান্য একখানা গাড়ি কিনতে গিয়ে সব গচ্ছিত টাকা নিঃশেষিত হয়েছে। বেশ কিছু ঋণও হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। সেই ঋণ এখন মাসে মাসে কিস্তিতে শোধ করতে হচ্ছে। ফলে এখন প্রতি মাসে যে পরিমাণ টাকা হাতে আসে তা দিয়ে কোনো মতে মাসই চলে না। এই অবস্থায় কোনো মাসে মাইনে না পেলে? তেমনি একটা অবস্থার সম্মুখিন হয়েছেন ওসমান সাহেব। মার্চের মাইনে মিলবে কি না কে জানে!
ওসমান সাহেবের মতো দূরবস্থা সুদীপ্তর ছিল না। গাড়ি নয়, একটি বাড়ির। মোহ ছিল সুদীপ্তর। নিজের একটি ছোট্ট বাড়ি থাকবে, চারপাশে থাকবে। অনেকখানি খোলা জায়গা। তাতে নিজের হাতে ফুলের গাছ লাগাবেন। ইচ্ছে মতো ব্যবহার করবেন বিপুলা পৃথিবীর কয়েক কাঠা জায়গা। অতএব কিছু কিছু তিনি জমাতে চেষ্টা করতেন। কয়েক হাজার টাকা জমিয়েছেনও। কিন্তু সে আর কতো? একটা বাড়ির জন্যে যা প্রয়োজন তার এক চতুর্থাংশও তো হবে না। তা না হোক। এই দুর্দিনে কিছুকাল মাইনে না পেলে খেয়ে তো বাঁচবেন। হাঁ, ঐটেই এখন দরকার। কোনো মতে বেঁচে থাকা। কেবল বেঁচে থাকা এবং দেখে যাওয়া।
কিন্তু এতো দেখা যায় না! হায় হায়, বর্বরের দল বস্তিগুলো সব পুড়িয়ে দিয়েছে গো। গতকাল পালিয়ে আসার সময় এ সব তো চোখে পড়েনি। হয়ত গাড়িতে আসার জন্যেই চোখে পড়েনি। নীলক্ষেতের পরিত্যক্ত রেল লাইনের দুপাশে বাস করত হাজার হাজার গরীব মানুষ। নানা সময়ে ঝড়ে-বন্যায় গ্রাম বাংলার লক্ষ লক্ষ বাস্তুহারা শহরে এসেছে-তারাই এখানে এসে হয়েছে বস্তিবাসী। সেই গরীব মানুষের বস্তি পুড়িয়ে অশেষ বীরত্ব দেখিয়ে গেছে পাক ফৌজ। আর পুড়িয়েছেও ঠিক বীর পুরুষের মতোই। কই তুমি আগুন দিয়ে এমন করে পোড়াও দেখি। টিনও যে এমন হয়ে পুড়ে গলে যায় সেটা নিজে না দেখলে সুদীপ্ত কখনো বিশ্বাস করতেন না। একটা টিনের কৌটাও কোথাও পড়ে নেই, তার ফাঁপা কোটরে বাতাসের হাহাকারও নেই। শ্মশানেও তো কিছু থাকে পোড়া বাঁশ-কাঠ, আধ পোড়া কাঁথা-বালীশ কতো কি থাকে। একটা দীর্ঘশ্বাসকে, একটা মর্মবেদনাকে জানান দেয় তারা। এখানে পোড়া ইটের গায়ে জমা হয়ে আছে বৃক্ষের তীব্র ক্ষত, দুচোখের প্রচন্ড ক্রোধ। হাতের কাছে আর কিছু না থাকে ঐ পোড়া ইট ছুঁড়ে মার শত্রুর মুখে।