ফিরোজ শুধালেন, তারপর? খোঁজ পেয়েছ সে ভদ্রলোকের।
পেয়েছি মামা! তিনি বেঁচে নেই! কিন্তু কী করে এখন সে খবর নিয়ে মায়ের কাছে যাব?
দেখা গেল বলতে বলতে হাসিমের চোখে জল এসেছে। তিনি জামার প্রান্ত দিয়ে চোখ মুছে নিলেন। অনেকক্ষণ কোনো কথা জোগালো না কারো। মুখে। হাসিমই একটু পরে বললেন—
আমরা যদি ঐ রাজারবাগেই হানাদারদের খতম করতে পারতাম তা হলে মাকে এই দুঃখ থেকে বাঁচাতে পারতাম।
তা হয়ত পারতেন। কিন্তু মা তো ঐ একটিই নয়। এবং সবার উপরে। স্বদেশ-মাতা, হ্যাঁ, সবাই মিলে এ মাকে বাঁচাতে হবে। ভিক্ষা করে নয়, যুদ্ধ করে। তারপর কর্মে একনিষ্ঠ হয়ে। সেটা সব বয়সেই হওয়া যায়। কিন্তু যুদ্ধ! হায়, যুদ্ধের বয়স কি আছে! অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহিন তাঁর বয়সের হিসেব করলেন। হাঁ, চল্লিশ পেরিয়ে গেছে। তবু তো রক্তে অস্ত্রধারণের চঞ্চলতা সুদীপ্ত অনুভব করলেন। মেঘের তমসা কেটে সূর্যের দীপ্তি পেল তাঁর চিন্তার কিশলয়গুলি। মনে হল জীবনের যদি কোন মূল্য থাকেই তবে মৃত্যুরও মূল্য আছে। তা না হলে দুটোই সমান অর্থহীন। বেঁচে থাকার জন্য মৃত্যুকে এড়াতে চাইলে সে মৃত্যু একদিন নিঃশব্দে তোমার জীবনের বিপুল ব্যর্থতাকেই শুধু ঘোষণা করতে আসবে। কিন্তু কথা কি শুধু ঐটুকুই! এতো মৃত্যুর মুখে বাঁচতে চাঁওয়াটাই তো একটা প্রহসন। এ প্রহসন অসহ্য। মরবার ভার অন্যকে দিয়ে নিজে নেব কেবল বেঁচে থাকার দায়িত্ব এমন ভাঁড়ামি থেকে নিজের পবিত্র আত্মাকে যেন রক্ষা করতে পারি। একটা প্রতিজ্ঞা সুদীপ্তর মধ্যে প্রার্থনার পবিত্রতা পেল।
ফিরোজ তখন শুধাচ্ছিলেন, তোমরা অনুমান কতক্ষণ লড়েছিলে?
হবে তিন চার ঘণ্টা। প্রথমে ওরা কয়েকজন এসেছিল সাধারণ অস্ত্র নিয়ে। আমরা তখন তাদের প্রায় সকলকে সাবাড় করে ফেলি। বাকি কয়েকজন প্রাণভয়ে পালিয়ে যায়। পরে যখন আসে ট্যাঙ্ক ও কামান নিয়ে তখনি তো শুধু হার মেনে পালাতে হল আমাদের। খালি রাইফেল হাতে ট্যাঙ্ক ও কামানের সামনে আমরা দাঁড়াই কি করে বলুন।
তা ঠিক। সেজন্য দেশবাসী ওদেরকে কাপুরুষ বলবে না। বরং চিরদিন ওদের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। ফিরোজ শুধালেন–
এখন তুমি করবে কী? এইভাবে লুকিয়ে বাঁচবে কতকাল?
না। এখানে তিনি লুকোতে আসেন নি। এসেছেন কিছু টাকার জন্য। শেখ সাহেব বলেছিলেন, আটাশ তারিখে মাইনে পাওয়া যাবে। কিন্তু তার তো বিপর্যয় ঘটে গেল। বিধবা মা পথ চেয়ে আছেন—ছেলে টাকা পাঠাবে।…হ নিশ্চয়ই তা সে পাঠাবে।
আপনার কাছে মামা, কিছু টাকার জন্য এসেছি। মায়ের হাতে সেই টাকাটা দিয়ে আমি তারপর দেখব, কোনখানে গেলে ঐ পাকিস্তানিদের সাথে। যুদ্ধ করার জো পাওয়া যাবে।
এর পরেও তোমার যুদ্ধ করার সখ আছে বাবা?
কেন থাকবে না? আমি ভয় পেয়েছি মনে করেন? আমাদের কত ভাই বন্ধুকে ওরা মেরে ফেলল, মা-বোনের ইজ্জত নিল–আমরা তার শোধ নেব। না? খোদার কসম, আমার মায়ের কসম আমাদের রক্তের কসম, আমরা এর। শশাধ নেবই নেব।
বাহ্ ভারি সুন্দর তো। কত সরল অথচ সঠিকভাবেই এরা সমস্যাটাকে বুঝেছেন! আর তা সমাধানের জন্য মানোবল কত দৃঢ়! কিন্তু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী হলে? ইতিমধ্যেই সে ধরনের বুদ্ধিজীবীদের কিছু পরিচয় সুদীপ্ত পেয়েছেন। কী ভয়াবহ মানসিকতা।
আমাদের ভেবে দেখতে হবে, কেন এই অবস্থার সৃষ্টি হল? কোনো একটা অবস্থার সৃষ্টি হয় কেন? কে এর জন্য দায়ী?…
যতো শয়তান ঐ কমিউনিস্টরা। ওদের প্ররোচনাতে লোক সব ক্ষেপে গেল। তা না হলে ওদের সাথে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে একটা সমঝোতায় পৌঁছানো যেতো।..–শেখ সাহেব তাঁর দাবি কিছু ছেড়ে দিয়ে একটা আপোস করলে আখেরে ভালো হত। যা ভুল তিনি করেছেন।
ইত্যাদি কত মন্তব্যই তো গত দুদিনে সুদীপ্তর কানে গেছে। আর কানে আঙুল দিয়ে পালাতে ইচ্ছে করেছে। সেই পন্ডিতন্যদের পাশে এই হাসিম সেখকে এখন তো বন্ধু বলে বুকে জড়িয়ে ধরতে হয়। আমাদের ভাই-বন্ধুদের ওরা মেরেছে, মা-বোনের ইজ্জত নিয়েছে, আমরা তার শশাধ নেব। হ্যাঁ, ঠিক এইটেই তো এখনকার উপযুক্ত কথা।
শেখ সাহেব কেন আপোস করলেন না?
এ প্রশ্নকে নিয়ে মনে মনে নেড়ে-চেড়ে এক ধরণের বিলাসিতাই চলে। সেরেফ বিলাসিতা। কেননা ঐ প্রশ্নের বাস্তব ভিত্তি একেবারে নড়বড়ে। প্রথমত শেখ সাহেবের সঙ্গে ইয়াহিয়ার কি আলোচনা হয়েছে কেউ তোমরা তা জান না। কেবল তোমরা ইয়াহিয়ার মুখে ঝাল খেয়ে বলছ—শেখ সাহেব একেবারে কঠিনভাবে গোঁ ধরে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানকে অসম্ভব করে তুলেছিলেন।
শেখ সাহেব বড়োই অনমনীয় হয়েছিলেন? কথাটা যদি মেনে নিই তবু তো। প্রশ্ন থাকে। গত তেইশ-চব্বিশ বছরে নমনীয় হয়ে থেকে বাংলাদেশের কী লা ভুটা হয়েছে শুনি! যথেষ্ট আপোস করা গেছে, যথেষ্ট সমঝোতার মনোভাব দেখানো হয়েছে—তার পরিবর্তে তোমরা কী পেয়েছ? পেয়েছ বিরামহীন শোষণ চালু রাখার উপযোগী একটা শাসন-কাঠামো।
শেখ সাহেব কেন আপস করলেন না?–মনে মনে এই প্রশ্ন তুলে এক ধরনের বুদ্ধিজীবী এখন তড়পাচ্ছেন। আর হাসিম সেখ কর্তব্যে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। এই ভেবে—কেন আমাদের মা-বোনের সর্বনাশ করবে ওরা? খোদার কসম, আমার মায়ের কসম, আমাদের রক্তের কসম, এর প্রতিশোধ নেব।
০৬. সুদীপ্ত বেরিয়ে পড়লেন
সুদীপ্ত বেরিয়ে পড়লেন।
না কোথায় যাবেন? এমনই পথে পথে ঘুরবেন কিছুক্ষণ? ওরে বাবা, তার সাধ্যি কি! দলে দলে মিলিটারি টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে রাস্তায়-তাদের দিকে চাওয়া যায় না। প্রবল চেষ্টায় সুদীপ্ত একবার শুধু তাকিয়েছিলেন একটা দলের পানে। ওদের গাড়িটা তখন নিউ মার্কেট থেকে এলিফ্যান্ট রোডের দিকে মোড় নিচ্ছিল। গাড়িতে ওরা ছিল বোধহয় পাঁচ ছয় জন হবে, প্রত্যেকের হাতে একটা করে মারণাস্ত্র, সেগুলোর কোনটার কি নাম সুদীপ্ত জানেন না। কোনো ভদ্রলোকেরই বোধহয় তা জানার কথা নয়। মানুষ মারার জন্য কত রকমের কল বানানো হয়েছে তার হিসেব রাখবে কে? আরেক জন মানুষ? হাঁ, তা রাখতেও পারে। কিন্তু সুদীপ্ত তাদের দলে নন। অতএব তিনি কেবল। কতকগুলো নল দেখলেন, হিংস্র পশুর মতো কয়েকটি চোখ দেখলেন, আর মাথায় লোহার টুপি। দেখলেন, ইস্পাতের নলগুলো প্রত্যেকটি তাক করা। রাস্তার মানুষের পানে। সাধারণ অবস্থায় এ দেখে একটু তো শিউরে ওঠার। কথা। কিন্তু শিউরে ওঠার সময় কারো নেই। এমনিতে কোনো ব্যস্ততাও নেই, উদ্বেগটাও বাইরে থেকে চেনা যায় না। কিন্তু একটা অদ্ভুত অসাড়তায় সকলে। আচ্ছন্ন। কতকগুলো যেন কলের পুতুল–হাসি নেই, কথা নেই, ভীতিও বোধহয় বিদায় নিয়েছে। মানুষের ভয় পাওয়ারও একটা সীমা আছে না! সুদীপ্ত ভয় পান নি—যদিও স্পষ্ট দেখেছিলেন এক জোড়া চোখ তার দিকে থাবা প্রসারিত করে যেন ল্যাজ নাড়ছে। কিন্তু গাড়ি সরে গেল, সুদীপ্তও সরে এলেন—তাদের ব্যবধানটা ক্রমেই প্রসারিত হতে থাকল। সুদীপ্তর দেখা হয়ে। গেল ওসমান সাহেবের সঙ্গে। ওসমান সাহেব হাঁটছেন? গাড়ি গেল কোথায়?