আপনারা কেবলই ঐ ঘুরে ফিরে একই কথা আলোচনা করছেন কেন বলুন তো?
সকলেই প্রায় সচকিত হলেন—তাই তো! ঘুরে ফিরে ঐ একটি বিষয়কে নিয়েই আমরা সকলে যে চিটে গুড়ে পিপড়ের মতো জড়িয়ে আছি দেখি। কিন্তু একটি পিপড়ের সেখান থেকে সরে আসার ক্ষমতা কতখানি? সুদীপ্ত বললেন—
শরীরে ক্ষত থাকলে হাত যে বারে বারে সেখানেই যেতে চায় ভাবী।
এবং তাতে হাতের অপরাধ হয় না। কোনো অপরাধ নেই, ভোলা গায়ে চলতি হাওয়ার স্পর্শ পেতে পেতে একটু যদি ঘুম আসে। কিন্তু হাওয়া বিষাক্ত হলে খোলা গায়ে থাকা বিপজ্জনক। সারা শরীর বিষে দগ্ধ হতে পারে। শহরের যা অবস্থা তাতে যে-কোন সময়ে যে-কোন বিষয় আলোচনার অপরাধে তাঁদের দগ্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে বৈ কি! মীনাক্ষী ভাবী ঠিকই বলেছেন—আমাদের আলোচনা কিছুটা সংযত হওয়া উচিত।
কিন্তু কিসের সংযম। সারা দেশে এখন বাঙালি জাতিকে অমোঘ ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তনের পালা চলছে। এ কি তোমার-আমার ব্যক্তি জীবনের কোন পছন্দ অপছন্দ নিয়ে কথা! যুক্তির সিংহদ্বারে এখনি যদি আমরা যথেষ্ট সক্রিয় হতে না পারি, আমাদের ভবিষ্যৎ-অস্তিত্বের চোহারাটা তা হলে। কেমন হবে? কেউ আমাদের ক্ষমা করবে?
মা ভৈ। কোন ভীতি-সঙ্কোচে আমরা যেন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে না পড়ি। আমাদের এখন মন্ত্র একটিই-আমরা নিজের কথা ভাবব না, আমাদের লক্ষ্য হবে দেশ। দেশের জন্য সংগ্রাম।
খাওয়া শেষ হলে হাসিম সেখ স্বদেশের জন্য তাঁদের সংগ্রামের কাহিনী শোনালেন। রাজারবাগ এলাকার পঁচিশ মার্চের সংগ্রাম। সাধারণ সেপাইরা সেনাবাহিনীর সাথে কী যুদ্ধে পারে? হাসিমরাও শেষ পর্যন্ত পারেন নি। কিন্তু। বিনা বাধায় পাকিস্তানিরা সারা ঢাকা শহরকে লন্ড-ভন্ড করে দেবে এমন কলঙ্ক। থেকে তারা জাতিকে রক্ষা করেছেন। এবং তাঁদেরকে রক্ষা করেছেন আশে পাশের অধিবাসীরা। আশ্রয়-আহার তো দিয়েছেনই, ছদ্মবেশ ধারণের বস্তু-খন্ডটুকুও দান করেছেন। তাতে বিপদ ছিল না? যদি পাকস্তানিরা টের পেত? হাঁ, মরতে হত। কিন্তু মৃত্যুকে কেউ ভয় করছে নাকি? ছেলে যদি মৃত্যু বয়ে নিয়ে ঘরে ফেরে মা কি সেই মৃত্যু ভয়ে ছেলেকে দুয়ার থেকে ফিরিয়ে দেন?
সেই অষ্টাদশী জননী হাসিম সেখকে ফিরিয়ে দেন নি। ট্যাঙ্ক থেকে কামানের মুহুর্মুহঃ গোলাবর্ষণে অতিষ্ঠ হয়েই তাদেরকে ভাবতে হয়েছিল–চল, সরে পড়ি। সরে পড়াই তো বুদ্ধিমানের কাজ তখন। ভয়-ভীতির কথা নয়। মরে লাভ কি? তখনই মরব যখন ওদের কাউকে মারার ক্ষমতা হাতে থাকবে। ওই শালাদের মতো কামান চালাতে শিখে তখন সামনে আসব। এবং দেখব, শালাদের যুদ্ধের কলো সখ। এখন এখানে থাকলে সেরেফ মরতে হবে। ভেবে চিন্তে ঠিক সময়েই তাঁরা পালিয়েছিলেন। কিন্তু ছদ্মবেশ দরকার ততা। পুলিশের পোশাকে তো মাথা বাঁচিয়ে পালানো যাবে না। তাছাড়া ভোর হয়ে আসছে, দিনের বেলাটা কোথাও লুকিয়ে কাটাতে হয়। অতএব যে যেখানে পেয়েছিলেন আশেপাশের বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলেন। বেশি কিছু ভাবনা-চিন্তার। সময় কারো ছিল না। সামনে যেখানে সুবিধা পাও ঢুকে পড়। হাসিম একটা গলির মধ্যে একটি একতলা বাড়ির দরজায় কড়া নেড়েছিলেন খুব জোরে জোরে। কারো সাড়া নেই। অনেকক্ষণ পর সাড়া মিলল। জানলার একটি কপাট একটু ফাঁক হল। একটি রমণী কন্ঠের প্রশ্ন শোনা গেল–
কে?
আমি রাজারবাগ পুলিশের লোক মা, একটু আশ্রয় দেবেন?
আশ্রয় দেওয়া মোমেনার পক্ষে ভারি শক্ত ছিল। ঘরে তিনি একা। রমণী-একটি শিশু কন্যা বুকে নিয়ে পড়ে আছেন। স্বামী কাজ করেন সংবাদপত্র অফিসে। রাত দশটার দিকে ঘরে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু ফেরেন নি। সেই এক দুশ্চিন্তা। তাঁর উপর এই কেয়ামত-রাত্রি। কে কোন্ উদ্দেশ্য। নিয়ে আসে তা কি বলা যায়! কিন্তু লোকটি তাকে মা বলেছে।
পাকিস্তানিরা আমাদের মেরে ফেলবে মা। বাঁচান।
মোমেনা আর থাকতে পারেন নি। দোর খুলে দিয়েছিলেন। আশ্রয় পেয়েছিলেন রাজারবাগ পুলিশের হাসিম সেখ। বাড়িতে এই রমণী শুধু একা!
হাসিম সঙ্কুচিত হয়েছিলেন। একা একজন যুবতী স্ত্রীলোকের বাড়িতে আর কোনো বেগানা পুরুষের স্থান হবে কি করে? না, তা হওয়া উচিত? তার স্বামী। কিংবা কোনো আত্মীয় জানতে পারলে? হাসিম তাই চলে আসতে চেয়েছিলেন—
আপনার বোধহয় অসুবিধা হবে মা। আমি না হয় যাই।
মা ডেকেছে না। তার পরও যদি অসুবিধার কথা ভাবতে পেরে থাক তবে তোমার যাওয়াই তো উচিত বাছা।
তাইতো। বাড়িতে ছেলে থাকবে, তাতে মায়ের আবার সুবিধা-অসুবিধা কী? ঐ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলাই তো লজ্জার কথা। হাসিম একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন।
মেয়েদের বয়সটাই কি সব? ভদ্রমহিলা তার চেয়ে কয়েক বছরের ছোটই হয়ত হবেন। কী স্বাচ্ছন্দে তবু মায়ের আসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিঞ্চিৎ বিস্ময়ে এবং প্রবল ভক্তিতে অভিভূত হয়েছিলেন হাসিম সেখ। হাসিম তার জীবনের কাহিনী এই নতুন মাকে শুনিয়েছিলেন। এবং তাঁকে গ্রামের বাড়িতে তাঁর জন্মদাত্রী জননীর কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ঢাকা শহরের এই অবস্থায় কারো কি আর এখানে থাকা উচিত? তা উচিত নয়। এবং স্বামীকে ফেলে মোমেনাও নিরাপত্তা-সন্ধানে সরে যাওয়া উচিত বিবেচনা করেন নি। মোমেনা বার বার বলে দিয়েছেন–
তুমি বাছা The people অফিসে তোমার আব্বার খোঁজ নিয়ে আমাকে জানিয়ে যাবে। কোথায় যে গেলেন তিনি! আল্লাহ্!