ভাই বসুন।
কিন্তু বসতে ইচ্ছে করল না। ফিরোজ ঘুরে ঘুরে ফ্ল্যাটটা দেখলেন। রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন ইকবাল হলের দিকে। ইকবালের স্বরে পাকিস্তানে বাংলাদেশের স্থান ছিল না। অথচ সেই বাঙালিই তাদের দেশে ইকবালের নামে হল বানিয়েছে। না না, এর্কে উদারতা বলে না। নিরেট বোকামি এটা। বোকামি করলেই তার খেসারত দিতে হয়। কিন্তু আর না।
ভাই চা খান একটু।
ফিরোজের চা শেষ হতে হতেই সুদীপ্ত খাওয়া শেষ করলেন। তেইশ নম্বরে এই বোধ হয় তাঁর শেষ খাওয়া। গত পরশু পঁচিশে মার্চের রাতের খাওয়াটাই তাঁর জীবনের শেষ খাওয়া হতে পারত। হয় নি যে সেটা সত্যই একটা—কী? দৈব ঘটনা? নাকি অর্থহীন ঘটনা? অদ্ভুতভাবে ঘটে যাওয়া অর্থহীন আকস্মিক ঘটনার উপর দৈব ঘটনার উপর নির্ভরশীল হয়ে যে জীবনকে। রক্ষা পেতে হয় তার মূল্য কতটুকু? না না, ঐ জন্যই তার মূল্য অপরিসীম। কিভাবে কতখানি কতদূর-বিস্তৃত অধিকার জীবনের উপর আমার আছে আমি তা জানিনে বলেই তো তার মূল্য আমার কাছে অনেক। সুদীপ্তর জীবনের প্রতি ভালোবাসা সহসা যেন শতধামুখি শ্রাবণের মেঘ হয়ে উঠল। নতুন মাটির বুকে জীবনের নবান্ধুর প্রত্যাশায় তাঁর চিত্ত উচ্চারিত হল। বেরিয়ে পড়। ছত্রিশ ঘণ্টার বেশি উপোস থাকার পর বিনা স্নানে দুটো ভাত গিলে নিয়ে বেরুবার জন্য তৈরী হতে পাঁচমিনিট লাগল না সুদীপ্তর। আর আমিনা? তিনি তো তৈরী হয়েই ছিলেন। তাঁর সামনে প্রশ্ন ছিল কেবলি তো পালিয়ে বাঁচার। কেবলি যেখানে পালানোর প্রশ্ন সেখানে আবার প্রস্তুতির ঘটা! একটা সুটকেসে জামা কাপড় টাকা-কড়ি ও গয়না এবং একটা ব্যাগে গুঁড়ো দুধের টিন, চিনি ও বিস্কুট। এ ছাড়া আর একটা সাইড ব্যাগে ছেঁড়া কাপড়ে জড়ানো কয়েক জোড়া স্যান্ডেল, চিরুনী, দাঁতের মাজন ইত্যাদি কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস, আর ছোট ট্রানজিস্টার সেট। আমিনার ক্যারাভান প্রস্তুত। প্রস্তুত? মাত্র এই নিয়ে যদি চলে তবে এতো কিছু নিয়ে এতদিন কি ছেলেখেলা করেছেন।
বেরুবার মুখে সুদীপ্ত একবার ড্রয়ইংরুমে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ছবিখানার দিকে তাকালেন। বইয়ের আলমারির কাছে একবার দাঁড়ালেন। সহসা মনে পড়ল বারান্দার টবে ফুল গাছগুলির কথা। আমি তখন ঘরে তালা দিয়ে ফেলেছেন। চাবি চেয়ে নিয়ে ছুটলেন বাথরুমে। পরপর কয়েক বালতি জল এনে ঢাললেন গাছগুলির গোড়ায়। কতোদিন আর ফেরা হবে না ঘরে! ততদিন। এরা কে কেমন থাকবে—এই গাছগুলি? আলমারিতে ওই বইগুলি? বইগুলির দিকে শেষবারের মত একবার তাকালেন সুদীপ্ত। একজন করুণ রিক্ত ভিখেরীর দৃষ্টি তাঁর চোখে। এদের কাউকে সঙ্গে নেওয়া যায় না? কিছুই সঙ্গে নেওয়া গেল না। আমিনার তাড়া খেয়ে আবার ছুটলেন উত্তরের বারান্দায়। আর একবার গাছগুলিকে দেখলেন। এতো বিভীষিকার মধ্যেও কী সুন্দর একটি গোলাপ ফুটেছে। বন্ধুর শেষ দান গোলাপটিকে তুলে নিয়ে সুদীপ্ত বুকে ঠেকালেন। কেউ দেখল না তো! পেছন ফিরে দেখেন বেলা এসে দাঁড়িয়েছে তার কাছে।
আব্ব, আমি নেব।
হ্যাঁ মা, তোমার জন্যই তো।
বেলার এক হাতে ফুল দিয়ে অন্য হাতখানি ধরে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলেন সুদীপ্ত। আর আমিনা? তাঁর এতো সবের বালাই নেই। তার রান্নাঘরে এখনো পাঁচটা মাগুর মাছ জিয়ানো আছে হাঁড়িতে—আছে শজনে খাড়া, বেগুন,টমেটো, বিবিধ মশলাপাতি আর চাল-ডাল তো বটেই। একবারও কোন কিছুর কথা তিনি ভাবলেন না। একটা সাইড ব্যাগ ঘাড়ে ঝুলিয়ে সুটকেসটা হাতে নিলেন এবং অন্য ব্যাগটা নিতে বললেন বড় ছেলে অনন্তকে। বোধহয় মনে মনে সুদীপ্তর কান্ডজ্ঞানহীনতায় ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন। এই অভিশপ্ত বাড়িতে এখনি কখন কি ঘটে তার ঠিক আছে! আর উনি এখন গাছে পানি ঢালতে বসলেন। ফুল নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার এইটে সময় নাকি! বেশ তো ফুল নিয়েই। তোমরা থাক, বাক্সপেটরা আমিই বইব।
ফিরোজ হয়ত ব্যাপারটা কিছু আঁচ করে থাকবেন। তিনি আমিনার হাত থেকে সুটকেসটা এক রকম ছিনিয়ে নিলেন—
আমাকেও আপনাদের কিছু কাজে লাগতে দিন। এতে অকর্মণ্য ভাবছেন কেন।
তাঁরা নিচে নেমে এলেন। নিচে দুজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন। দাঁড়িয়ে। ছিল একটা এ্যাম্বুলেন্স এবং আরও একটা গাড়ি। ডঃ ফজলুর রহমানকে তাঁর আত্মীয়রা নিতে এসেছেন। সহসা নিজেকে অত্যন্ত অপরাধী মনে হল সুদীপ্তর। ডঃ রহমানের আত্মীয়দের কাছে কেবলি খবর পাঠিয়েই তাঁরা কর্তব্য সমাধা করেছিলেন। আর কিছুই কৃত্য ছিল নাকি? সারা নীলক্ষেত এলাকার সকলের অপরাধ নিজের ঘাড়ে নিয়ে নীরবে মাথা নত করলেন সুদীপ্ত।
উপস্থিত আগন্তুকদ্বয়ের একজন ফিরোজকে চিনতেন। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করলেন… আপনি! এখনো আছেন ঢাকায়?
ইয়াহিয়ার গত সন্ধ্যার বেতার বক্তৃতার পর সত্যিই আওয়ামী লীগের কোনো সক্রিয় সদস্যের পক্ষেই আর পাক-কবলিত এলাকা নিরাপদ নয়। কিন্তু এই মুহূর্তেই ফিরোজ নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবছিলেন না। দেশের এতো মানুষ ওরা মারল। এর কোনো একটা প্রতিশোধ গ্রহণ করা কি এতোই অসম্ভব? কাকে ওরা ছেড়ে কথা বলেছে? বস্তির সাধারণ মানুষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অবধি সর্বশ্রেণীর মানুষের প্রতি ওদের সমান। আক্রোশ। অতএব কেবলি আওয়ামী লীগার বলে বিশেষ করে কোনো বিপদ অনুভব করার কারণ তো এখনো তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি বললেন—