না, বেশি মারে নি। সংখ্যাটা হাজারের ঘরে ছাড়িয়ে লাখের ঘরে ওঠে নি। সেনাপতির আদেশ পুরোপুরি পালন করা ওদের সৈনিকদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। কী আদেশ ছিল ওদের প্রচন্ড সেনাপতির? সুদীপ্ত কিংবা ফিরোজ কেউই তা। জানেন না। কল্পনা করতে বললেও তাঁরা ফেল মারবেন। সেনাপতি টিক্কা খা। আদেশ দিয়েছিল বাঙালিদের তোমরা হত্যা কর, তাদের দোকানপাট লুট কর,। বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দাও, তাদের মেয়েদের ধর্ষণ কর। এই আদেশ দেবার আগে। ছোট একটি ভূমিকাও দিয়েছিল টিক্কা খা—জওয়ান ভাই সব, তোমাদের জন্য। প্রেসিডেন্ট স্বয়ং তোমাদের গর্ব বোধ করেন। তোমরা পাকিস্তানের গৌরব। পাকিস্তান ও ইসলামকে রক্ষার মহান দায়িত্ব তোমাদের উপর। এই যে সব বাঙালিদের দেখছো, এরা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ইসলামকে ভুলে গিয়ে সকলে হিন্দু হয়ে যাচ্ছে। অতএব এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সাধারণ যুদ্ধ হবে না, তা হবে পুরোপুরি জেহাদ।
জেহাদের সওয়াব-লাভে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাক-জওয়ানরা ঝাপিয়ে পড়েছিল। : বাঙালিদের উপর। কয়েক লক্ষ নিরস্ত্র বাঙালিকে মারতে বেরিয়েছিল আধুনিকতম মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত বীর পুরুষের দল পাকিস্তানি বীর পুরুষ।
চল যাই। আমিনা বোধহয় চিন্তিত হয়ে পড়বে।
সুদীপ্ত চলে যাইতে চাইলেন। আমিনার চিন্তা অবশ্যই আর একটা। কারণ। ওপরে নিচে সামনে চতুর্দিকে মৃতদেহ-মাঝখানে একা তিনটি শিশু সন্তান নিয়ে একটি মহিলা। দুশ্চিন্তা স্বাভাবিক, বৈ কি। কিন্তু তা ছাড়াও সুদীপ্তর নিজেরও এখন কেমন অস্বস্তি লাগছে।
ফিরোজ সুদীপ্তকে নিয়ে সোজা চলে এলেন নীলক্ষেতের তেইশ নম্বর বিল্ডিংয়ে। গাড়ি থেকে নামতে নামতেই ফিরোজ বললেন—
তুমি ওপরে চল। আমি একটু চট করে ইকবাল হলের ভেতরটা দেখে আসি। দেরী হবে না। তোমরা গোছগাছ করতে করতেই এসে পড়ব।
বলতে বলতেই ফিরোজ ইকবাল হলের দিকে লম্বা পা ফেলে হাঁটতে শুরু করে দিলেন। কিন্তু গাড়ি নিয়ে গেলেন না যে! ওরে বাবা ইকবাল হলের সামনে গাড়ি রেখে ভেতরে ঢোকা মানে তো বিজ্ঞাপন ঝুলিয়ে রেখে যাওয়া। সুদীপ্ত একবার ফিরোজের হেঁটে-যাওয়া দেখলেন। চার পাশে চেয়ে দেখলেন, নীলক্ষেত এলাকা তখন প্রায় ফাঁকা। তেইশ নম্বর বিল্ডিংকে দেখলেন। তার সারা অঙ্গে বসন্তের ক্ষতচিহ্নের মতো বুলেটের দাগ।
ইকবাল হলে ঢুকবার মুখে একজনের সঙ্গ পেলেন ফিরোজ। তাঁর পরিচিত এক সাংবাদিক। এই সাংবাদিক ভদ্রলোকের কাছেই ফিরোজ খবর পেলেন-The people নেই। সেই অকুতোভয় ইংরেজি দৈনিক The people তার সব কিছু সহ আগাগোড়া ভস্মীভূত। ইত্তেফাঁক ও সংবাদ-এর খবর আগেই পেয়েছিলেন। বর্বরদের যতো আক্রোশ যে শিক্ষায়তন ও প্রেসগুলির উপর। ওরা আমাদের চিন্তাবৃত্তির মেরুদন্ডটাই ভেঙে দিতে চায় নাকি। সাংবাদিক ভদ্রলোক নিজে থেকেই খবরটা দিলেন–
The people-এর কয়েকজন কর্মী ও সাংবাদিককেও গুলি করে হত্যা [ করেছে ওরা।
আবিদুর রহমান সাহেব?
আবিদুর রহমান সাহেবের খবর আমরা এখনো কেউ জানি নে। তবে পঁচিশ তারিখে রাত দশটার দিকে কোনো কাজে তিনি বাইরে গিয়েছিলেন।
আল্লাহ, তিনি যেন বেঁচে থাকেন। মনে মনে তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করলেন। ফিরোজ। কতজনের দীর্ঘজীবনই তো গতকাল থেকে তিনি কামনা করেছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে কয়জনেরই বা খোঁজ পেয়েছেন। বা খোঁজ নিতে পেরেছেন। একদিন সব হিসেব নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। তখন কি শামসুর রাহমানের সেই কবিতার চরণটাই সত্য হবে—সারা বাংলাটাই তখন শহীদ মিনার হয়ে যাবে।
তাঁরা দুজনেই কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে হলটা দেখলেন। কিন্তু দেখবার কিছু ছিল না। এই দিনটিতে ঠিক যেমনটি দেখবেন বলে প্রস্তুত হয়ে আছেন সারা। ইকবাল হল হয়ে আছে ঠিক তেমনি। কোনো ব্যতিক্রম নেই। ঘরে-বারান্দায় ইতস্তত পড়ে আছে কয়েকটি শব। কিন্তু সে নেই। হয়ত বেঁচে গেছে। মীনাক্ষীর এক খালাতো ভাই। চব্বিশে মার্চেও হলে ছিল ছেলেটি। তাঁর খোজেই বিশেষ করে হলে ঢুকেছেন ফিরোজ। মীনাক্ষী যা হোক একটা সত্য সান্ত্বনা পাবে এখন। সে যে হলের মধ্যেই মারা পড়ে নি সে কথা এখন সত্য। বলেই মনে হচ্ছে। অন্ততঃ মীনাক্ষীর শোকাহত চিত্তকে কিছুটা সান্ত্বনা দেওয়া তো যাবে। ছাদের উপর থেকে শুরু করে একেবারে নিচের তলার ঘরগুলি পর্যন্ত সবটাই যতোটা সম্ভব দেখে নেবার চেষ্টা করলেন ফিরোজ। অবশ্য দ্রুত এবং কিছুটা সন্ত্রস্তভাবে। হাঁ বেশ ভয় করছে। স্ত্রীর ভাইয়ের ব্যাপার না হলে এখানে তিনি ঢুকতেন না। কী করেছে খবিশগুলো হলটাকে। মাঝে মাঝে দু একটা ঘরে বই কাগজ, বিছানা-বালিশ সব কিছু পুড়িয়ে দেওয়া ছাই ছড়িয়ে আছে। বহু-ঘরের জানলা-দরজা ভাঙ্গা। দেয়ালের গায়ে-কামানের গোলায় তৈরী বিরাট ছিদ্রগুলি তাঁরা দেখলেন। দেখলেন, হল অফিসের আসবাব-পত্র খাতা-কাগজ ফাইল কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। তার পরিবর্তে গাদাগাদা ছাই শুধু। সমস্ত মনকেই এমনি ছাই করে সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন ফিরোজ।–সুদীপ্তর ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখেন, তিনি খাচ্ছেন এবং ছোট মেয়ে বেলাকে খাওয়াচ্ছেন। কী আশ্চর্য! এখানে বসে সুদীপ্ত খাচ্ছে! ইকবাল হলের মসজিদের ছাদে পড়ে থাকা শবগুলি এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। একটা কাক এসে বসেছে শবের উপর। এই দৃশ্য সামনে রেখে খাওয়া যায়। কিন্তু ফিরোজ জানতেন না যে, সুদীপ্তর ঠিক মাথার উপরে ছাদে অমন বিশ তিরিশটা শব পড়ে আছে। নিচে মরে পড়ে আছেন ডঃ ফজলুর রহমান ও তার ভাগ্নে কাঞ্চন। সুদীপ্ত সবি। জানেন। সবি তাঁর চোখের সামনে ভাসছে। আর তিনি খেয়ে যাচ্ছেন। গত সন্ধ্যায় কিন্তু খেতে পারেননি। সামনের মাঠে অচেনা লাশগুলি তাঁর ক্ষিধে নষ্ট করেছিলো। অমনি আরো অনেক লাশ আজ তিনি দেখেছেন একেবারে কাছে থেকে। এবং দেখতে দেখতেই কি ক্ষিধে ফিরে পেয়েছেন? মানুষ কতখানি বিধ্বস্ত হয়ে গেলে এটা সম্ভব! ফিরোজ ভাবলেন। আমিনার সাথে স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকটুকুও করলেন না। আর আমিনাও কেবলি একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললেন–