আব্বা ভাইয়া ওরা সব এখানে শুয়েছে কেন আম্মা?
সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে ছেলেকে বুকে নিয়ে হু হু করে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছিলেন বেগম মনিরুজ্জামান। বাপ রে তোর জন্যই আমাকে বাঁচতে হবে। মনে মনে বলেছিলেন। এবং তখনো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হন নি।
দুর্বৃত্তরা স্বামী-সন্তানকে এই রাতে নিচে নিয়ে গেল কি মারবার জন্য?
নিজের ফ্ল্যাটে কিছুক্ষণ বড়ো অস্থির হয়ে এ-ঘর ও-ঘর করেছিলেন। তারপর একাই নিচে নেমে এসেছিলেন তাদের তিন তলার ফ্ল্যাট থেকে এক তলায়। তখনি কখন মায়ের সঙ্গে পিছে পিছে এসেছিল চার বছরের সেই শিশুপুত্র।
নিচে সেই দৃশ্য দেখে একটুও অবাক হন নি বেগম মনিরুজ্জামান। তাঁরা। পাঁচজন পড়ে আছেন। প্রবেশপথের রক্তধৌত প্রশস্ত চাতালে পড়ে দুএকজন তখনও কাতরাচ্ছেন। কারা তারা?-এ প্রশ্ন মনে না তুলে সেই মুহূর্তেই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন উপরে। এক বোতল পানি ও চামচ নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর। বুকের মানিক বড়ো ছেলেটি তাকাচ্ছে তখনও। মাকে দেখে চোখ দুটো একটু বড়ো-বড়ো হল শুধু। তার পরেই সে যে চোখ বন্ধ করল আর তা খোলে নি কখনো। মা তাড়াতাড়ি এক চামচ পানি দিয়েছিলেন মুখে। কিন্তু খেতে পারে। নি। গাল বেয়ে গড়িয়ে গিয়েছিল। বুকের স্তন্য দানে যাকে মানুষ করেছিলেন মৃত্যুকালে একটু পানি পর্যন্ত তাকে খাওয়ানোর সুযোগ পেলেন না ছেলে। চলে গেল। কিন্তু ওই ভদ্রলোক তো বেঁচে আছেন—নিচের তলার সেই হিন্দু অধ্যাপকটি জল চাইছেন। পর্দানশীন মহিলা। কখনো সামনে যান নি। কিন্তু এখন তাকে কতো কালের চেনা ভাইয়ের মতো মনে হল। কাছে গিয়ে চামচ দিয়ে জল দিলেন মুখে। কয়েক চামচ খাওয়ানোর পরই মনে হল এখনো তো এঁর বাঁচার সম্ভাবনা আছে। তখনি গিয়ে কপাটে ধাক্কা দিলেন–
দিদি, বের হন। আপনার সাহেবকে ঘরে নিন। আমার সাহেব মারা। গেছেন। আপনার সাহেব এখনও বেঁচে আছেন।
কথাগুলি বাসন্তী দি কখনও ভোলেন নি। সেই দুর্যোগের রাতে স্বামীকে ধরে নিয়ে গেলে একমাত্র কিশোরী কন্যাকে বুকে নিয়ে বাসন্তী দি যখন অতি মাত্রায় অসহায় বোধ করেছিলেন ঠিক তখনই যেন তাঁর বোনের ছদ্মবেশে কোন দেবী এসে তাঁকে ডাক দিলেন—দিদি বের হন, আপনার সাহেব এখনো বেঁচে আছেন। কিন্তু আরো কি একটা কথা বলল যেন আমার সাহেব মারা গেছেন। বোন আমার, এ তুই কী শোনালি। হু-হু করে কেঁদে উঠেছিল বাসন্তী দির বুকের ভিতরটা।
বাসন্তী দি কয়েকবার ডাক দিতেই তাঁর গাড়ির ড্রাইভার সাহস করে বেরিয়ে এসেছিল। গ্যারেজের উপর তলার একটি কামরায় সে থাকত। তার সাহায্যে মা ও মেয়েতে মিলে স্বামীকে ঘরে তুলেছিলেন তাঁরা।
অতঃপর কিছুক্ষণের মধ্যে আবার জওয়ানরা এসেছিল। ধরে এনেছিল বাওর কয়েকজন লোক। লাশগুলি টেনে নিয়ে যাবার হুকুম হয়েছিল তাদের পর। হায় হায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক একটি বিভাগের প্রধান তাঁর ঠ্যাং ধরে এমনি করে টানতে টানতে নিয়ে গেল। তিনি জানলা দিয়ে দেখলেন। বস্তিবাসীদের দোষ ছিল না। তারা ধরাধরি করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল; কিন্তু চাওয়ার তাদের কোন মূল্য আছে? বর্বরদের গুঁতোর চোটে তাদেরকেও বর্বর কাম করতে হয়েছিল। তবু শেষ রক্ষা হয় নি। তাঁরা বাঁচেনি একজনও।
জগন্নাথ হলের মাঠে আরো অনেকগুলি বস্তিবাসী বিভিন্ন দিক থেকে মৃত দেহ কুড়িয়ে এনে একত্রে জড়ো করছিল। তাদের পিছে পিছে সঙ্গিন উচিয়ে এসেছিল জওয়ানেরা। অতঃপর হুকুম হয়েছিল গর্ত কর। ঝুড়ি কোদাল কোথা থেকে জওয়ানেরাই দিয়েছিল, এবং সে জওয়ানদেরকে খুবই কষ্ট করে কয়েক ঘণ্টা অনবরত প্রবল গালি ও বুটের লাথি চালাতে হয়েছিল। তবেই না শেষ পর্যন্ত মনমত হয়েছিল গর্তটা। তখনও কাতরাচ্ছে এমন কিছু আহত ব্যক্তিকেও অনেক শবের সঙ্গে সেই গর্তে ফেলে দেওয়ার পর এসেছিল বস্তিবাসীদের পালা। লম্বা গর্তটার পাশে তাদেরকে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে বলে জওয়ানরা চাঁদমারি অভ্যাস করেছিল। একটি একটি করে সব কটি বস্তিবাসী গর্তে পড়ে গেলে বাকি কাজটুকু করতে হয়েছিল জওয়ানদের। পাশের স্তুপীকৃত মাটি ঠেলে দিয়ে জায়গাটা ভরাট করতে হয়েছিল তাদেরকে।
জায়গাটা সুদীপ্ত ও ফিরোজ দেখলেন। চৌত্রিশ নম্বর থেকে বেরিয়ে এখানে নই এলেন তারা। একটু আগেই ফিরোজ এ স্থানের কথা শুনে এসেছেন এবং স্বচক্ষে জায়গাটা দেখবেন বলে মন ঠিক করেই এদিকে এসেছেন। না, এখানে তো সেই ভয়টা নেই।
কিন্তু চৌত্রিশ নম্বরের সিঁড়ির কাছে অত ভয় পেয়েছিলেন কেন তাঁরা! এক খন্ড ভয়ের পাথর কে যেন বুকের উপর ঝুলিয়ে দিয়েছিল। শরীর-ভারী হয়ে আসছিল। যন্ত্রণার অতলে ইহজীবনটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে না-কি। হায়, রাস্তায় তবু মানুষ দেখা যাচ্ছিলো। ওখানে একটা মশাও নেই। শহীদ মিনারের এতো কাছে এতো নির্জনতম এ স্থান ঢাকা শহরে ছিল! মনে হচ্ছিলো যেন কোনো রাক্ষসপুরীতে এসেছেন তারা! যেসব হতভাগা রাক্ষসের মুখের গ্রাস হয়েছেন ঐ সব রক্ত বোধ হয় তাদের। একটা অস্বাভাবিক ভীতিকবলিত অবস্থায় তাড়াতাড়ি তাঁরা বেরিয়ে এসেছিলেন সেখান থেকে। অবস্থাটা ছিল সহ্যের অতীত।
মরহুম আবদুল হাইয়ের ছেলে-মেয়েরা ঐ দালানেই থাকতেন। ডঃ গুহঠাকুরতার বিপরীত ফ্ল্যাটটাতে! তাঁরাই বা সব গেছেন কোথায়! বেঁচে আছেন তো! কেনো নিরাপদ এলাকায় তাঁরা চলে যেতে পেরেছেন তো! আহা, বেঁচে থাকুন তাঁরা! প্রফেসর হাইয়ের মৃত্যুর দিনটি মনে হলে সুদীপ্ত এখনো। শিউরে উঠেন। এমন দুর্ভাগ্যও মানুষের হয়! মৃত্যু নির্মম কিন্তু তা যে কখনো অতি বীভৎসও হতে পারে সে কথা সেদিন সেই রেল লাইনের ধারে প্রফেসর হাইয়ের দুর্ঘটনা কবলিত লাশ দেখার পূর্বে সুদীপ্তর ধারণাতীত ছিল। হলই বা তার নাম মৃত্যু, এতো হৃদয়হীন হতে হবে তাকে! সেই লাশ যেন ছিল। জীবনের প্রতি একটি নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ।–সমস্ত জীবনটাকেই একটা তীব্র বিদ্রুপ বলে সুদীপ্তর মনে হল যখন তিনি জগন্নাথ হলের মাঠে সদ্য পুঁতে দেওয়া নারী-পুরুষের কারো হাতের আঙ্গুল, কারো পায়ের কিয়দংশ মাটি-কুঁড়ে বেরুনো বৃক্ষ-শিশুর মতো মাথা তুলে থাকতে দেখলেন! কতো শব এইখানে পুঁতেছে ওরা? এবং এমনি কতো স্থানে? তবু এখনো ঘরে-বাইরে এতো! মেরেছে তাহলে কতো! ঢাকা শহরে কতো মানুষ মেরেছে ওই জানোয়ারের দল?-প্রশ্নটা একটা হাতবোমার মতো এসে ফেটে পড়ল ফিরোজের চিন্তার মধ্যে।