মধ্যযুগে শোনা যায় মুসলমানেরা মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ বানাত, সেটা তা হলে মিথ্যা নয়।
হোয়াট? মুসলমানের নামে কাফের-প্রদত্ত এই কলঙ্কে বিশ্বাস করতে আপনার রুচিতে বাধল না?
আপনি তা বলে চটবেন না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা নয়। কথা হচ্ছে ঢাকা শহরে এতো মসজিদ। সেখানে আবার মসজিদ বানালে…….
আলবৎ মসজিদ বানাতে হবে। দরকার হলে সারা ঢাকা শহরকেই আমরা। মসজিদ বানিয়ে ছাড়বো।
সেটা অবশ্য একটা কীর্তি হবে।–খুব আস্তে বলেছিলেন সুদীপ্ত। এবং মৃদু হেসেছিলেন।
কীর্তি? আপনি ঠাট্টা করছেন?
একটুও না। সারা ঢাকা শহর যদি একটা মসজিদ হয় তা হলে বিশ্বের। মধ্যে সেটা কীর্তি হবে না! কী যে বলেন।
সহসা কি ভেবে ডঃ খালেক উত্তেজনা দমন করে নিয়েছিলেন। তা দেখে অবাক হয়েছিলেন সুদীপ্ত। কী ঘটল আবার! নাকি ইচ্ছে করে রঙ বদলাচ্ছেন! ক্ষণে ক্ষণে এমন করে যারা পালটাতে পারে তারা কী ধরনের মানুষ? না, মানুষ তারা নয়। হয় শয়তান, না হয় ফেরেশতা। ডঃ খালেক কোনটা? হয়ত শেষেরটাই হবেন। ডঃ খালেক সম্পর্কে ভালো ধারণাই মনে পোষণ করতে। চেষ্টা করলেন সুদীপ্ত। বালেক সাহেব খুব খাটো গলায় বলে উঠলেন—
যাক, এ নিয়ে আমি আর তর্ক করব না আপনার সাথে। কেউই আমরা। পরস্পরকে এখনো ভালোভাবে জানি নে। তবে বন্ধুভাবে একটা উপদেশ আপনাকে দিতে পারি। হিন্দুস্থান থেকে তাড়া খেয়ে এসেছেন কেন?-এ প্রশ্নটা। কখনো যেন মুছে দেবেন না মন থেকে।
কিন্তু মুছতেই হবে যে। দূরের একটা মানুষ সম্পর্কে মনে বিরূপতা পোষণ করে হয়ত বাঁচা যায়। কিন্তু প্রতিবেশী সম্পর্কে একেবারে বেঁচে থাকার স্বার্থেই পারস্পরিক সম্প্রীতি ও বোঝাপড়া গড়ে তুলতেই হবে। সুদীপ্ত একথা অকপট ভাবেই বিশ্বাস করেন। তা ছাড়াও একটা প্রশ্নকে তিনি কখনো এড়াতে পারেন না। মানুষের সাথে কি অন্তরঙ্গতা জমে ওঠে কেবলি ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে? প্রশ্নটাকে তিনি মনেই চেপে রেখে সেদিনের মতো খালেক সাহেবের সঙ্গে আলোচনায় ইতি টেনে দিলেন।
কিন্তু খালেক সাহেবকে কোন দিনই আর প্রসন্ন মনে মেনে নিতে পারেন নি সুদীপ্ত। বিশেষতঃ হিন্দু হলেই তাকে মুসলমানের শত্রু মনে করতে হবে–এটা কি ধরনের মানসিকতা? সেখানে বিনয়দারা ছিলেন না? এখানে প্রফেসর দেবকে এরা দেখতে পায় না। একদিন প্রফেসর দেবকে সুদীপ্ত দেখেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে। মসজিদে হজরত মোহাম্মদের জন্মদিন উপলক্ষে অনুষ্ঠান হচ্ছিল। বিশ্বের একজন মহামানবের জন্ম দিন। তাতে যোগ দেবার অধিকার সকলেরই আছে না? সেখানে হজরত মোহাম্মদের জীবনী আলোচনা হল, মিলাদ হল–সবেই যোগ দিলেন ডঃ দেব। সুদীপ্ত দেখলেন। এবং ডঃ খালেকের পেড়াপীড়িতে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসার জন্য মনে মনে যে। জােভটা ছিল তা ভুলে গেলেন। এই ধরনের অনুষ্ঠানে সুদীপ্ত কখনো যান না। এবং নামাযের জন্য কবনো মসজিদে না গেলেও এ ধরনের অনুষ্ঠানে খালেক সাহেব সর্বদাই যোগ দিয়ে থাকেন। আজ তিনি একা নিজে আসেন নি, সুদীপ্তকেও ডেকে এনেছেন। অগত্যা সুদীপ্ত এসেছেন। এবং এসেই উঃ দেবকে দেখে প্রথমে বিস্মিত হয়েছেন, পরে ভক্তিতে শ্রদ্ধায় আপ্লুত হয়েছেন। হাঁ সত্যিকার একজন দার্শনিকের পক্ষেই এ পোড়া দেশে এমন উদার মানসিকতাকে পালন করা সম্ভব। কিন্তু ডঃ দেবের এই উদার মানসিকতাকে ডঃ খালেকেরা কী দৃষ্টিতে গ্রহণ করেছিলেন?
ফেরবার পথে ডঃ খালেকই তুলালেন কথাটা–
মালাউনের কান্ডটা দেখলেন, কেমন করে মসজিদের ইজ্জত নষ্ট করে দিলে।
সুদীপ্তর সমস্ত চিত্ত ঘৃণায় রি-রি করে উঠল। মনে মনে ঠিক করে ফেললেন,এই লোকটার সাথে কখনো আর মেশা হবে না। গাড়িতে না হলে এই মুহূর্তেই লোকটাকে এড়িয়ে উলটো পথে হাটা শুরু করতেন। আপাততঃ এড়াবার পথ না পেয়ে, এবং এক সাথে চলতে বাধ্য হয়ে সুদীপ্ত বললেন—
আমার তো মনে হল মসজিদের ইজ্জত আরো বেড়ে গেল।
কিভাবে? আমাকে বুঝান।—কী ভেবে যেন ডঃ খালেক আজ চটলেন। হয়ত তিনি জানেন গাড়ি চালাবার সময় চটতে নেই, কোনো বিপত্তি ঘটতে পারে। হয়ত বা অন্য কোন কারণ ছিল। যাই হোক, এদিকে সুদীপ্তও কিন্তু বাঁকা পথ ধরলেন। খালেকের কথার সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে বললেন–
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসাবে আপনিই তো অন্যকে বোঝাবেন। অন্যে আপনাকে বোঝাবে এটা হয় কি করে?
ও সব চুটকি কথা দিয়ে আমাদের ভোলাতে পারবেন না সাহেব। ফাজলামো করে আসল কথাটা এড়াতে চাইছেন তো! কিন্তু আমাদের কাছে সোজা কথাটা শুনুন। ঐ ডঃ দেব পাকিস্তানের একটা দুশমন।
নাহ, এখানে আর কোনো কথা বলাই উচিত নয়। সুদীপ্ত চুপ করে গেলেন। কিন্তু খালেক সাহেব বোধ হয় চুপ থাকতে জানেন না। তিনি চেপে ধরলেন সুদীপ্তকে
এ কথা আপনি স্বীকার করেন?
হাঁ, এবার কিছু একটা বলতেই হয়। খুবই গম্ভীর স্বরে সুদীপ্ত বললেন—
ড: দেব সম্পর্কে যখন অন্য কিছু জানিনে তখন–
তখন? থামলেন কেন, বলুন।
বলছি। আজকে যে উদরতা তার মধ্যে দেখলাম সেটা….
সেটা পাকিস্তানের পক্ষে বিপজ্জনক, সুদীপ্তকে বাক্য শেষ করতে না দিয়েই বলে উঠলেন ডঃ খালেক, ধর্মের জগাখিচুড়ি পাকিস্তানে চলবে না। বিশুদ্ধ ইসলামের থেকে এক ইঞ্চি সরে গেলেই পাকিস্তান মারা পরবে—এই আপনাদের আমি বলে থুলাম।
ডঃ খালেকের গাড়ি ততক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাব-প্রাঙ্গণে এসে ঢুকেছে। গাড়ি থেকে নামতে নামতেই সুদীপ্ত প্রশ্ন করলেন–