আচ্ছা ডঃ খালেক, মেয়েদের আপনি ভোলান কি করে?
কথা দিয়ে। সেরেফ কথার কায়দা।
বুঝতে পারলাম না? একটু নমুনা শুনিয়ে দিন।
বুঝলেন না। তবে একদিনের ঘটনা বলি শুনুন। একদিন একজনকে। বললাম, বাসায় আজকাল একা আছি। আজ বিকেলে এসো বেড়াতে।
বললেন এ কথা! মেয়েটি চটল না।
চটতে পারত। কিন্তু চটে নি। আর চটলেই বা কী? বুঝতাম এখানে সুবিধা হবে না। অন্য মেয়ের খোঁজ করতাম। আরে সাহেব, এ সব ব্যাপারে সেন্টিমেন্টাল হতে নেই, বুঝলেন। রাস্তার পাশে বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। দেখলেন, বাসটা খালি নেই। সে জন্য তখন মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে। যাবেন নাকি! পরবর্তী বাসের জন্য একটু অপেক্ষা করুন। শিগগিরই পেয়ে। যাবেন।
এ তো হক কথা! আচ্ছা তারপর? মেয়েটি কি বলেছিল?
হাঁ, সেই মেয়েটি। মেয়েটি আমার কথা শুনে কী রকম একটা ভঙ্গি। করেছিল চোখ মুখের। তা বর্ণনার অসাধ্য। অনুকরণ করে দেখাতেও পারব না, মেয়েরাই পারে ঐ রকম করে চোখ মুখ বাঁকাতে। বাঁকা চোখে আমার পানে। তাকিয়ে সে বলেছিল— বলছেন যেতে গেলে কী হবে টা শুনি?-আচ্ছা এবার বলুন তো, এ কথার উত্তরে আপনি হলে কী বলতেন?
কী বলা যায় এ ক্ষেত্রে? সুদীপ্ত যেন ভেবে পেলেন না। তবু বললেন–আমি হলে বলতাম কী আর হবে, গেলে ভালো লাগবে।
রাবিশ! আপনি নাকি কবিতা লেখেন। ঐ কথা বললে সঙ্গে সঙ্গে সে রেগে সরে যেত আপনার কাছ থেকে। আমি কী বলেছিলাম জানেন?সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছিলাম–তুমি গেলে আমার সাইবেরিয়ার শীতে একহাঁটু ফাল্গুনের উদয় হবে।
এই হচ্ছেন ডঃ খালেক। নিজেকে তিনি বৈজ্ঞানিক বলে প্রচার করে। থাকেন। প্রায়ই কথায় কথায় বলে থাকেন–
আমরা পলিটিক্সের কি বুঝি! আর সাহিত্যেরই বা কি বুঝি! আমরা। কাঠখোটা বৈজ্ঞানিক মানুষ ….ইত্যাদি।
ঠিকই তো। এম, এস-সি, ক্লাসে যখন বিজ্ঞান পড়ান তখন বৈজ্ঞানিক বৈ কি। এই বৈজ্ঞানিক সাহেব সাহিত্য কিংবা পলিটিক্স বোঝেন না।
কিন্তু একটি জিনিস বোঝেন, অন্ততঃ বোঝেন বলে দাবী করেন। সেটা ইসলাম। ইসলামের খেদমতের জন্য পাকিস্তান হয়েছে। আর পাকিস্তান বানিয়েছেন কায়েদে আযম, এবং পাকিস্তানের রক্ষক হচ্ছে সেনাবাহিনী। অতএব ইসলাম কায়েদে আযম, পাকিস্তান ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এদেরকে বিনা বিতর্কে মেনে নিতে হবে। ঈমানদার হতে হবে। খালেক সাহেবের মতে–
পাকিস্তানী মুসলমানের ঈমানের পাঁচ স্তম্ভ হচ্ছে-আল্লাহ, আল্লাহর রসুল, কায়েদে আযম, পাকিস্তান আর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী।
এই পাঁচের উপর অগাধ আস্থা স্থাপন করে খালেক সাহেব খাঁটি মুসল মান। অবশ্যই পাকিস্তানি মুসলমান। এই পাঁচের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা, খালেক সাহেবের মতে, বিলকুল হারাম। সুদীপ্ত প্রথম দিকে এতো জানতেন না। তাই, প্রথম পরিচয়ের দিনই বেধেছিল একটা গন্ডগোল। তার আগের দিন একটি কান্ড ঘটে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। জামাতে ইসলামের এক দল ছাত্র অন্য একটি ছত্র-প্রতিষ্ঠানের আয়োজিত একটি সভা পন্ড করতে গিয়ে মারামারি বাধিয়েছিল। সেই মারামারিতে মারা গেছে জামাতে ইসলামেরই একটি ছাত্র। জামাতে ইসলামের ছাত্র মারা গেছে। পাকিস্তানের পাক মাটিতে ইসলামের এতো অপমান! ডঃ খালেক যে কি পরিমাণ ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন বেচারা সুদীপ্ত সেটা জানতেন না। অতএব আপন অজ্ঞাতেই সুদীপ্ত একটি গুনা করে ফেলেছিলেন, ডঃ খালেকের একটি উক্তির প্রতিবাদ করেছিলেন। ডঃ খালেকের বক্তব্য ছিল–
শহীদের রক্ত যেখানে পড়েছে সেখানে মসজিদ বানাতে হবে।
ছেলেরা তো নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরল! ঐ ভাবে কেউ মরলে তাকে শহীদ বলা যায় নাকি! শহীদ মানে তো…..।
কথা শেষ করতে পারেন নি সুদীপ্ত। কথার মাঝখানে খালেক সাহেব বলে। উঠেছিলেন–
আলবাৎ শহীদ বলা যায়। পাকিস্তানের সংহতি যারা নষ্ট করতে চায় তাদেরকে রুখতে গিয়েই তো মরতে হল ছেলেটাকে। তা হলে সে শহীদ হবে।
তাও হবে না। সূদীপ্ত তর্ক তুললেন, তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে বিপক্ষ দল পাকিস্তানকে দুটুকরো করতে যাচ্ছিল, তা হলেও সে শহীদ হয় না। কেননা শহীদ মানে…
আপনার মানে রাখুন। পাকিস্তান মানেই ইসলাম, ইসলাম মানেই পাকিস্তান। অতএব যে ছেলে ইসলামের সংহতি বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে। সে শহীদ।
না, এগোনো আর ঠিক নয়। সুদীপ্ত দেখলেন, অনেক অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ এসে যাচ্ছে। সেটাকে এড়াবার জন্যই তিনি এবার উঃ খালেকের কথায় সায়। দিয়ে বললেন–
হাঁ, ঐ ভাবে ভাবলে ছেলেটি অবশ্যই শহীদ হয়েছে। ওখানে এখন। আপনারা আর একটা শহীদ মিনার তুলতে পারেন।
ইতিপূর্বেই যে ডঃ খালেক সেখানে মসজিদ বানাবার কথা তুলেছেন সেটা তখন আর সুদীপ্তর মনে ছিল না। বেচারা সুদীপ্ত! বিতর্কের বদ্ধ ডােবাটাকে এড়াবার জন্য যেদিকে পা বাড়ালেন সেদিকেই ছিল সেই গর্ত। গর্তে পড়ে গেলেন সুদীপ্ত। ডঃ খালেক চিৎকার করে উঠলেন
শহীদ মিনার? আমরা বানানো শহীদ মিনার! এতোই মালাউন ভাবলেন আমাদের? জেনে রাখুন, তেমন দিন এলে আপনাদের ঐ শহীদ মিনারকে ভাঙ্গ আমরা।
শহীদ মিনার ভেঙ্গে দেবেন!–বিস্ময় প্রকাশ করেন সুদীপ্ত।
এক শো বার ভাঙব। আপনারা সেখানে কুফরী কাম করবেন, শেরেক করবেন, আর সেটা আমরা ভাঙব না। ভেঙ্গে সেখানে বানাব মসজিদ।
সুদীপ্ত আর নিজেকে সামলাতে পারেননি। আপনিই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।