যদি কিছু মনে না করেন তা হলে এগুলো আমি আপনাদেরকে সামান্য উপহার হিসেবে দিতে চাই।
বহুত শুকরিয়া! আগার জেওয়ার তো মিলা, লেকিন আওরাত কাঁহা?
গয়না তো দোস্ত দিলে, কিন্তু গয়না যে পরবে সে মেয়ে মানুষ কোথায়?
আওরাত কাঁহা?–প্রচন্ডভাবে ধমক দিয়ে উঠল একটি জওয়ান।
পাশেই বাথরুমে মেয়েরা লুকিয়েছিল। তাদের বের করা কঠিন ছিল না। দুবার জোরে লাথি মারতেই কপাট খুলে গেল। পাওয়া গেল দুই মেয়ে, এক। মা! মায়ের বয়স চল্লিশ, কিন্তু ভারি মজবুত দেহের গড়ন। এখনো স্বচ্ছন্দে তিরিশ বলে চালিয়ে দেওয়া যায়, মেয়ে দুটির একটি উনিশ, একটি সতেরো। জওয়ানরা ভারি খুশি। এই বাড়িটাতে ঢােকা তোদের খুবই সার্থক হয়েছে। তিন তিনটে খুবসুরৎ আওরাত, চল্লিশ ভরি জেওয়ার, পাঞ্চ শো রুপেয়া। এ সবি মালে গণিমাৎ, অতএব হালাল।
তুমি বলেছ, তুমি আমাদের দোস্ত আদমী আছ। তবে এখন দোস্তের কাম কর। এই আওরাত তিনটাকে আমাদের দরকার। আমরা নিয়ে যাব। লেকিন কুচ ঘাবড়াও মাৎ, তিন দিন বাদে রেখে যাব।
এতোটা সহ্য করার ক্ষমতা মালেক সাহেবের ছিল না। তিনি আর্তনাদ করে উঠলেন—
ইয়া আল্লাহ, এই জালেমের হাত থেকে বাচাও। লা ইলাহা….
আর বলতে পারেন নি মালেক সাহেব। বলতে চেয়েছিলেন লা ইলাহা ইল্লা আনতা…..। লা ইলাহা অর্থাৎ আল্লাহ নেই পর্যন্ত বলতে পেরেছিলেন, বাকি অংশ ইল্লা আন্তা অর্থাৎ তুমি ছাড়া আর বলা হয়নি। এমন সময় খটা খট খটা খট——স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের কাজ শুরু। অতএব মালেক সাহেবের জীবনের শেষ কথা হলো——আল্লা নেই। আল্লা নেই বলতে বলতেই ভুলষ্ঠিত হল মালেক সাহেবের নশ্বর দেহ। তাঁর পাশে লুটিয়ে পড়ল পাঁচ বছরের ছোট। ছেলেটি।
মালেক সাহেবের এই পরিণতির কথা সুদীপ্ত জেনেছিলেন পরে। প্রায় দিন দশেক পরে। সকল কথা ডঃ খালেকের কাছে শুনে আঁতকে উঠেছিলেন সুদীপ্ত।
ইস কী বর্বর নর পিচাশের দল।
না না, ঐ সব বলবেন না। যে-কোনো দেশের সৈনিকদের তুলনায় আমাদের পাকিস্তানি সৈন্যদের নীতিবোধ অনেক উন্নত। ঐ একটা কাজ তারা বাই চান্স করে ফেলেছে। তাও দেখুন না, ঐ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে আমার কাছে চিঠি দিয়েছে ওরা। এবং ক্ষমা চেয়েছে।
তাই নাকি!–সামান্য একটু ফোড়ন কেটে থেমে গিয়েছিলেন সুদীপ্ত। এবং এই খালেকের সঙ্গে কখনো যে তার পরিচয় হয়েছিল সে কথা মনে হয়ে গভীর ঘূণার সঞ্চার হয়েছিল তার মনে! কী অবাক! সংবাদটা দেবার সময় তাঁর। একটু লজ্জাও কি হয় নি! ছী-ছী! অবলীলাক্রমে মরহুম আব্দুল মালেকের ভাই। ডঃ আব্দুল খালেক বলে গেলেন।
আর্মির জেনারসিটি দেখুন, মেয়েদের ফেরৎ পাঠাবার সময় চিকিৎসার জন্য তিন শো টাকাও দিয়েছে। দে আর কোয়াইট সেন্সিবল ফেলো।
তা বটে। মনে মনে পরে সান্তনা পেতে চেষ্টা করেছিলেন সুদীপ্ত। গণি মাতের মাল তো ফেরত দেবার কথা নয়। কিন্তু ওরা দিয়েছে। সেই সঙ্গে তিন শো টাকাও ও দিয়েছে। এই বদান্যতার কি তুলনা আছে। হাজার হলেও মিঃ মালেক ও ডঃ খালেক তাদের নিজেদের লোক। সাধারণ জওয়ান চিনতে না। পেরে একজনকে না হয় মেরেই ফেলেছে এবং তাঁর স্ত্রী-কন্যাদের সাথে কিছুটা খারাপ কাম করেই ফেলেছে, তা বলে, কি ব্যাপারটাকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে না? রাষ্ট্রবিপ্লবের সময় এ ধরনের দু চারটে দুষ্কর্ম তো ঘটেই থাকে। তা বলে কি রাগ করে থাকলে চলে। ডঃ খালেক সেনাবাহিনীর উপর রাগ করেন নি। ভাবী ও ভাইঝিদের নিজের বাসায় এনে তাদের প্রত্যেককে এক বোতল করে ভাইব্রোনা কিনে দিয়েছিলেন।
না এ হেন ডঃ খালেক এক দিন ডঃ গোবিন্দ চন্দ্র দেবকে পাকিস্তান-বিরোধী বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন।
০৪. সে প্রায় এক বছর আগের ঘটনা
সে প্রায় এক বছর আগের ঘটনা। তখন ডঃ খালেকের সাথে সুদীপ্তর পরিচয়ের সবে সূত্রপাত। সুদীপ্ত তখনও জানতেন না যে, ডঃ খালেক আধুনিক পাকিস্তানি মুসলমান। সে জন্য কথায় কথায় ভারত-বিদ্বেষ প্রচার করে থাকেন। কখনো নামাজ-রোজা করেন না। তার বিনিময়ে হিন্দুদের মালাউন বলেন। এবং একাধিক রমণী-সংসর্গকে জায়েজ বিবেচনা করেন। এমনিতে লোকের সাথে মেশেন কম। কিন্তু মেয়েদের সাথে অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়েও গল্প করতে পারেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সে ক্ষেত্রে তিনি পরম অসাম্প্রদায়িক। মেয়েদের জাতি-ধর্ম নিয়ে কোনো প্রশ্ন কখনো তাঁর মনে জাগে না। এবং কেবলি যে মেয়েদের সাথে তিনি গল্পই করেন এমন নয়। সেই সঙ্গে কুমারীত্ব মোচনের পটুত্বের নাহি তার সীমা।
একাধিক রমণী-সম্ভোগ কোন্ নবী করেন নি শুনি?–ডঃ খালেক তর্ক করে থাকেন, তাঁরা তৎকালিন যুগের রীতি অনুসারে একাধিক বিবাহ করতেন অথবা একাধিক ক্রীতদাসী রাখতেন। এখনকার সমাজে ঐ সব অচল। অতএব এখন যেটা জায়েজ আমরা তাই করবো। গোপনে প্রেম করবো আমরা।
এ সব কথা অসার যতোই হোক, শুনতে ভালো লাগে। এবং সেই ভালো। লাগার জন্যই সুদীপ্ত কখনো তর্ক করেন না। কেবল শুনেন। কথা বলে লাভ কী? ডঃ খালেকের মেজাজটাকে সুদীপ্ত ক্রমে ক্রমে চিনেছিলেন।
অতএব তিনি বেশি কিছু না বলে মাঝে মাঝে কেবল নিরীহ প্রশ্ন তুলে তার কথা বলার ধরাটাকে অক্ষুন্ন রাখতে সহায়তা করেন। সুদীপ্ত যে তাকে কেবলি তাতিয়ে তুলে কিছু কথা বলিয়ে নিতে চান এটা ডঃ খালেক টের পান না। বরং সুদীপ্তর মধ্যে তার একজন অনুরক্ত ভক্তকে লক্ষ্য করে পুলকিত হন। আর সুদীপ্ত প্রশ্নও করেন ভারী চমৎকার। ঐ প্রশ্ন কানে শুনেও সুখ আছে।