এ হেন মালেক সাহেব সেদিন প্রবন্ধ লিখছিলেন। সেই পঁচিশের রাতে। রাত নটার দিকে খাওয়া শেষ করে লিখতে বসেছিলেন। বিষয়-পূর্ব বাংলার আধুনিক কবিতা লিখতে বসেই কথাটা মালেক সাহেবের মনে হল। এক ঢিলে দুটি পাখি মারতে হবে। সকলেই কবি হিসাবে জনাব আব্দুল কাসেমকে বর্তমান পূর্ব বাংলার শ্রেষ্ঠ কবি বলে থাকেন। তাঁর চেয়েও বড়ো! অসহ্য। ছোকরা কটা দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে খালি ঘোরাফেরাই করেছিল। পাস করতে পেরেছিল একটা পরীক্ষায়? হতে পেরেছে তাঁর মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রীডার? মূখ দেশবাসীর কাছে মূর্খরাই সম্মান পাবে। কিন্তু হায়, ছোকরার কবিতার কোনো দোষ যে ধরা যায় না। তখন কবিতা রেখে দিয়ে তিনি চোখ বুজে চিন্তা করতে শুরু করলেন। এক হাতে কলম, সামনে খাতা খোলা, চোখ বন্ধ করে মালেক সাহেব চিন্তা করছেন। দৃশ্যটা দেখলে সেই সময় মালেক সাহেবকে ধ্যানী বুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছে না হয়ে যায় না। ধ্যানী মালেক সাহেব হঠাৎ ধ্যান ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন—ইউরেকা। আবুল কাসেমের কবিতায় যে সকল চিত্রকল্প ও প্রতীকের ব্যবহার আছে তা যথেষ্ট বঙ্গীয় নয়, বহুল পরিমাণে পাশ্চাত্য দেশীয়। কিন্তু আধুনিক বাংলা কবিতার মধ্যে কি এটা দোষের? তা ছাড়া, ছোকরার সব কবিতাই যে ঐ রকম তাও তো নয়। ধূত্তোর, এ দেশীয়। গবেট পাঠকেরা অতসব বুঝবে না। কথাটা যে তাঁর মাথায় এসেছে সেটা আল্লাহর রহমতের ফলেই। লাভ দুদিক থেকে সেটা বুঝতে পারছ না। প্রথমতঃ, আবুল কাসেমকে পাঠকের মন থেকে কিছুটা সরাতে পারলে যে ফাঁক সৃষ্টি হবে, সেই ফাঁকে কোনো মতে নিজেকে একটু গলিয়ে দিতে পারলে। আহ কী মজা। দ্বিতীয়তঃ, তিনি যে তাঁর চিন্তার সর্বস্তরে একজন বিশুদ্ধ বাঙালি এটাও প্রমাণিত হবে। অতএব চোখ খুললেন মালেক সাহেব। দ্রুত বেগে কলম চলতে শুরু করল। রাত প্রায় বারোটার দিকে মালেক সাহেবের হুশ হল— বাইরে গুলি-গোলা চলছে। ওরে, বাবা, কী প্রচন্ড আওয়াজ! বারান্দায় পা দিয়ে এ-পাশ ও-পাশের দৃশ্য দেখেই ব্যাপারটা তিনি বুঝে ফেললেন। তা হলে কি তার ছোট ভাইয়ের কথাই ঠিক হল। কদিন থেকে দুভাইয়ের মধ্যে মনোমা লিন্য চলছিল।
এখন থেকে পাকিস্তান, মুসলমান প্রভৃতি বুলি ভুলে গিয়ে বাংলা ও বাঙালির কথা বলতে হবে। নইলে আমাদের গোলামী ও দুর্গতি রোধ করা। যাবে না!–মালেক সাহেবের মত।
ছোট ভাই খালেক সাহেবের মত হচ্ছে—পাকিস্তানের সংহতি সকলের আগে। সেজন্য আছে আমাদের সেনাবাহিনী। এই সেনাবাহিনী আমাদের গৌরব ও গর্বের বস্তু। যে-কোনো মূল্যে তারা পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করবে। দেশকে তারা বিচ্ছিন্ন হতে কিছুতেই দেবে না।
কিন্তু সংহতি রক্ষা পাবে কিসে? ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে দুই অংশের শয্য সমতা রক্ষায়? না প্রবল গায়ের জোরে একটা অংশকে পদতলে রেখে শোষণ করায়?
শোষণ পদানত প্রভৃতি শব্দগুলি মালেক সাহেবের মুখে ইদানীং শোনা যাচ্ছিল। এতে মনে মনে খুব বিক্ষুব্ধ ছিলেন খালেক সাহেব। আপন ভ্রাতার এ হেন পদস্খলন তার কাছে গভীর মর্মপীড়ার কারণ ছিল। পাকিস্তান ও ইসল মিকে বাঁচাতে গিয়ে আমরা যদি কিছুটা শোষিত হয়েই থাকি সেটা সহ্য হবে না? আমাদের ঈমান এতোই দুর্বল? কিন্তু বড় ভাইকে কী আর বলবেন! নিজে তিনি বৈজ্ঞানিক মানুষ; হলের প্রভোষ্টগিরি, ব্যবসা ও রোটারী ক্লাব নিয়ে আছেন। রাজনীতি এমন কিছু তিনি বোঝেন না। অথচ তার বড় ভাই সরাসরি রাজনীতির ছাত্র। তবু তিনি বলবেন, বড়ো ভাইয়ের ওটা ভুল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে তার ধারণা নেই। একদিনে, হাঁ, মাত্র একদিনে আওয়ামী লীগের এই সব চ্যাংড়ামি সেনাবাহিনী ঘুচিয়ে দিতে পারে। দরকার হলে দেবে।
কিন্তু কত দিনে? গায়ের জোরে কতদিন অন্যকে পদানত রাখা সম্ভব?
ধরুন এক শো বছর।
এইটেই খালেক সাহেবের মত। ইসলামের স্বার্থে, পাকিস্তানের সংহতির স্বার্থে দরকার হলে আমাদের সেনাবাহিনী এক শশা বছর পূর্ব পাকিস্তানকে। পদানত রাখবে, দেশে সামরিক শাসন চালাবে। ইসলাম ও পাকিস্তানের স্বার্থে। তা হবে বিলকুল জায়েজ।
খালেকের সঙ্গে সেই সব বিতর্কের কথা মালেক সাহেব এখন স্মরণ করলেন। খালেকের ধারণাই তা হলে ঠিক। গায়ের জোরে দরকার হলে। বাংলাদেশকে পদানত রাখার অভিযান শুরু হয়েছে; মালেক সাহেব তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে লিখিত প্রবন্ধটাকে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেললেন। খুর বের করে গোঁফ চেঁছে নিলেন। অতঃপর চটপট ওজু করে মাথায় টুপি দিয়ে কোরান নিয়ে বসলেন।
কোরান শরীফের সামনেই পাওয়া গিয়েছিল মালেক সাহেবের লাশ। পাঁচ বছরের ছোট ছেলেটিকে পাওয়া গিয়েছিল বাপের পাশেই গুলিবিদ্ধ অবস্থায়। কিন্তু পাওয়া যায়নি দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে। অবশ্য মালেক সাহেব অভিনয়ে খুব একটা ভুল করেন নি। ওদের তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন—
আমরা খাটি মুসলমান। সেনাবাহিনীর সমর্থক। আওয়ামী লিগের দুশমন।
বেশ ঠিক আছে। আমাদেরকে তবে সাহায্যকর।
শোনা মাত্র মালেক সাহেব সাহায্যের জন্য তৎপর হয়েছিলেন।
নিশ্চয় আপনাদেরকে সাহায্য করব। এক শো বার করব। বলুন কী করতে I হবে। কোন দুশমনকে ধরিয়ে দিতে হবে। সব দুশমন আমার নখদর্পণে।
ও সব নেহি। দুশমনের সাথে মোকাবেলা আমরাই করতে পারব। তোম রুপেয় নিকালো।
সঙ্গে সঙ্গে মালেক সাহেব আলমারি খুলে টাকা যা ছিল, মাত্র পাঁচ শো ছিল, সব দিয়েছিলেন। মোটেই পাঁচ শো টাকা! জওয়ানরা খুশি হয় নি। নিজেরা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল সারা আলমারি। স্ত্রী কন্যাদের গহনা ছিল প্রায় চল্লিশ ভরি হবে। সেগুলো তারা হাতে নেওয়া মাত্র মালেক সাহেব বলে উঠেছিলেন—