- বইয়ের নামঃ রাইফেল, রোটি, আওরাত
- লেখকের নামঃ আনোয়ার পাশা
- প্রকাশনাঃ স্টুডেন্ট ওয়েজ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. বাংলাদেশে নামল ভোর
ভূমিকা
মানুষ এবং পশুর মধ্যে বড় একটা পার্থক্য হচ্ছে, পশু একমাত্র বর্তমানকেই দেখে, মানুষ দেখে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে এক সঙ্গে বিচেনা করে। যখন কোন ব্যক্তি এবং সমাজ একমাত্র বর্তমানের মধ্যেই আবর্তিত হতে থাকে তখন সর্বনাশের ইশারা প্রকট হতে থাকে।
বাঙালির সুদীর্ঘ ইতিহাসের বোধ করি সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় হচ্ছে তার সংগ্রামের কালগুলো। এবং এক্ষেত্রে উজ্জ্বলতম ঘটনা হচ্ছে, ১৯৭১-এ পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অসাধারণ লড়াই। এ ছিল সমগ্র জাতির একতাবদ্ধ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সংগ্রাম। আমাদের পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য, আমাদের বর্তমানের গৌরব এবং আমাদের ভবিষ্যতের প্রেরণা বাঙালির এ সংগ্রামের ইতিহাস।
অত্যন্ত শঙ্কিত চিত্তে লক্ষ্য করার মত ব্যাপার হচ্ছে, আমরা এটাকে যেন ভুলে যেতে বসেছি। যেসব লক্ষ্য নিয়ে আমাদের লড়াই তাকে বাস্তবে রূপায়িত করার ব্যর্থতা থেকেই। এ বিস্মৃতির সূত্রপাত হচ্ছে। কিন্তু ব্যর্থ বর্তমান তো কোন জাতিরই চিরকালের সত্য ইতিহাস নয়, সত্য অনুভূতিও নয়। যে আবেগ এবং অনুভূতি চক্রান্তের ধূর্তচক্রে আচ্ছন্ন হচ্ছে, তাকে উজ্জীবিত করার জন্যই দরকার সংগ্রামের কালের মানুষের মহান ত্যাগ এবং নিষ্ঠাকে বারংবার স্মরণ করা। তার থেকেই আসবে কুশায়াকে দূর করার উজ্জ্বল সম্ভাবনা। আমাদের চিত্তের পবিত্রতা রক্ষা পাবে।
সেকালের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের মধ্যে বসে লেখা আমাদের সমগ্র ইতিহাসে একটি মাত্র উপন্যাসই পাওয়া যায়—এ উপন্যাসই হচ্ছে “রাইফেল রোটি আওরাত”। ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাস এর রচনাকাল। লেখক শহীদ আনোয়ার পাশা নিহত হলেন ১৯৭১ সালেরই ১৪ই ডিসেম্বর। স্বাধীনতা লাভের মাত্র দুদিন আগে তিনি যে অমর কাহিনী। উপন্যাসে বিধৃত করেছেন নিজেই হয়ে গেলেন তারই অঙ্গ চিরকালের জন্য।
আনোয়ার পাশার উপন্যাসটি একদিক দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে বসে একজনের প্রতিটি মুহূর্তের কাহিনী। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে সৃষ্ট এ শিল্পকর্ম কতটা সত্যনিষ্ঠা লেখকের জীবনের পরিণতিই তার মহান সাক্ষ্য হয়ে থাকবে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন–জীবনে জীবন যোগ করা
না হলে, কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা।
আনোয়ার পাশার উপন্যাস, তাঁর শেষ উচ্চারণ : নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভা। সে আর কতো দূরে। বেশি দূর হতে পারে না। মাত্র এই রাতটুকু তো। মা ভৈঃ। কেটে যাবে।” তার এবং আমাদের সকলের কামনা ও প্রত্যাশারই অভিব্যক্তি। শিল্পী তার জীবনকে আমাদের জীবনের মধ্যে পরিব্যাপ্ত করে দিয়েছেন। রাইফেল রোটি আওরাত আনোয়ার পাশার শহীদ আত্মার আকাঙ্ক্ষাকেই যেন আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করে চলেছে নিরন্তর এবং অম্লান।
কাজী আবদুল মান্নান
বৈশাখ, ১৩৯৪
রাজশাহী।
পরিচিতি
এ গ্রন্থের লেখক আনোয়ার পাশা আজ আমাদের মধ্যে নেই, হারিয়ে গেছেন তিনি। চিরকালের জন্য। অসহ্য এক বেদনার ভার বুকে নিয়ে তার নামের আগে এখন কিনা যোগ করতে হচ্ছে শহীদ কথাটা। আনোয়ার পাশাত শহীদ হতে চাননি, অমন পবিত্র শব্দাবলীর প্রতি তার বিন্দু মাত্রও লোভ ছিল না। জীবনকে তিনি ভালোবাসতেন, তার সমস্ত ভালোবাসা নিবেদিত ছিল জীবন আর শিল্পের প্রতি। তিনি ছিলেন সর্বতোভাবে জীবন প্রেমিক শিল্পী। জীবনকে ভালোবাসা ছাড়া শিল্পী হওয়া যায় না এ তিনি জানতেন, মানতেনও। চেয়েছিলেন জীবনকে সুন্দর করে গড়তে এবং সে সঙ্গে শিল্পোত্তীর্ণ করে প্রকাশ করতে—এ ছিল তার জীবনের ব্রত। আনোয়ার পাশা বাঁচতে চেয়েছিলেন শিল্পী হিসেবে। জীবনের সে দুর পিপাসা, তার আকুল ব্যাকুলতা তার এ অন্তিম বচনায়ও ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র।
মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে এ অসামান্য বইটি তিনি লিখে রেখে গেছেন আমরা যারা বেঁচে আছি তাদের জন্য। মৃত্যুর মাঝখানে দাড়িয়ে মৃত্যু-বিভীষিকার এমন ছবি আঁকা সত্যই দুঃসাধ্য। আনোয়ার পাশা তেমন এক দুঃসাধ্য কাজ করে গেছেন। তাঁর শিল্পী-প্রতিভার এ এক নিঃসন্দেহ প্রমাণ। বাংলাদেশের মাটিতে আগামীতে যারা জন্মগ্রহণ করবে, তারা এ দেশের ইতিহাসের এক দুঃসহ ও নৃশংসতম অধ্যায়ের এ নির্ভেজাল দলিল পাঠ করে নিঃসন্দেহে শিউরে উঠবে। অবশ্য সে সঙ্গে আত্মত্যাগ আর দেশপ্রেমের নজীরহীন দৃষ্টান্তে সগৌরব আনন্সও যে তারা বোধ করবে তাতেও সন্দেহ নেই। নিজের দেশ আর দেশের মানুষের সম্বন্ধে তাদের আস্থা, এ বই পড়ার পর দৃঢ়তর না হয়ে পারে না।
এ শুধু একাত্তরের বাংলাদেশের হাহাকারের চিত্র নয়, তার দীপ্ত যৌবনেরও এ এক প্রতিচ্ছবি। এ গ্রন্থের নায়ক সুদীপ্ত শাহিন বাংলাদেশ আর বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষা, সংকল্প প্রত্যয় আর স্বপ্ন-কল্পনারই যেন প্রতীক। একাত্তরের মার্চের সে ভয়াবহ কটা দিন আর এপ্রিলের প্রথমার্ধের কালো দিনগুলির মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার সংকীর্ণ পরিধিটুকুতেই এ বই-র ঘটনাপ্রবাহ সীমিত, কিন্তু এর আবেদন আর দিগন্ত এ সময়-সীমার আগে ও পরে বহু দূর বিস্তৃত। বাঙালির দুঃখ-বেদনা আর আশা-এষণার এ এমন এক শিল্পরূপ যা সব সময় সীমাকে ডিঙিয়ে এক দীর্ঘস্থায়ী অপরূপ সাহিত্য-কর্ম হয়ে উঠেছে।