রুবা বলল, পাঁচ টাকা দিতে পারবে আপ? রিকশী ভাড়া।
দাঁড়া দিচ্ছি।
রুবা বসার ঘরে ঢুকে একটু হকচকিয়ে গেল। গম্ভীর মুখে জামান বসে আছে। জামানের সামনে সে কেন জানি সহজ হতে পারে না। রুবার ধারণা হল, দরজা আঁচড়ানোর ব্যাপারটায় দুলাভাই বিরক্ত হয়েছেন।
কেমন আছেন দুলাভাই?
ভাল। দরজা আঁচড়াচ্ছিলে কেন?
ঠাট্টা করছিলাম।
এরকম ঠাট্টা না করাই ভাল। সব বয়সে স ঠাট্টা ভাল না। আর শোন, রিকশা ভাড়া না নিয়ে রিকশায় উঠবে না। ধর, আমরা কেউ যদি বাসায় না থাকতাম তখন কি করতে?
এত ভোরে আপনারা যাবেন কোথায়? ঘরেই তো থাকবেন, তাই না? আমি আসছি দুলভাই। ভাড়াটা দিয়ে আসি।
রুবা একটু মন খারাপ করে রিকশা ভাড়া দিতে গেল। জামান ইলার দিকে তাকিয়ে অপ্রসন্ন গলায় বলল, তোমাদের সবারই কাণ্ডজ্ঞান একটু কম। একটু না, অনেকখানি কম। ইলা কিছু বলল না।
পকেটে টাকা-পয়সা না নিয়েই রিকশা ভাড়া করে চলে এসেছে। এর মানে কি? এইসব ব্যাপার আমার খুব না-পছন্দ।
আস্তে বল, ও এসে শুনবে।
শোনার জন্যেই তো বলা। শুনে যদি কিছু শেখে। তা তো শিখবে না। সবাই কাজ করবে তার নিজের মত।
রুবা বোধহয় কিছু শুনেছে। সে ঘরে ঢুকল মুখ কালো করে। লজ্জিত মুখে জামানের দিকে একবার তাকিয়েই নিচু গলায় বলল, আপা আরো দুটাকা দিতে হবে। পাঁচ টাকা ভাড়া ঠিক করে এসেছি। এখন চাহে সাত টাকা। আমার কাছে একটা পাঁচ টাকার সেটি আছে, ওটা নিতে চাচ্ছে না। একটু ছেঁড়া।
জামান বিশ্রী ভঙ্গিতে হাসল। লজ্জায় রুবার মরে যেতে ইচ্ছা করছে।
ইলা আরো টাকা এনে দিল। জামান ঠাণ্ডা গলায় বলল, এরকম কাজ আর করবে না রুবা।
জ্বি আচ্ছা।
রুবার চোখে প্রায় পানি এসে যাচ্ছিল। সে নিজেকে সামলে নিল। রিকশাওয়ালাকে বাড়তি দুটাকা দিল। দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। এই মুহূর্তেই আবার ঘরে ঢোকা ঠিক হবে না। চোখে পানি এসে যাবে। বরং কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলে নেয়া যাক। একবার ভাবল, ঘরে না গিয়ে কলেজের দিকে হাঁটা ধরবে। কিন্তু তাতে আপার মন খুব খারাপ হবে। ক্যাটক্যাট করে দুলাভাই নিশ্চয়ই আপাকে খুব কথা শুনাবে। কবা আবার ঘরে ঢুকল।
জামান বলল, কোন কাজে এসেছ, না এম্নি?
আপার কাছে এসেছিলাম।
তা তো বুঝতেই পারছি। সেটা কাজে না অকাজে?
অকাজে।
ইলা রুবার হাত ধরে তাকে রান্নাঘরে নিয়ে গেল। নিচু শালায় বলল, তোর দুলাভাইয়ের অনেকগুলি টাকা হারিয়ে গেছে। এই জন্যে যা খারাপ। যা মনে আসছে, বলছে। তুই কিছু মনে করিস না। লক্ষ্মী ময়না। কিছু মনে করবি না।
না মনে করব কি? আমার এত মনটন নেই।
মা ভাল আছে?
আছে। মোটামুটি ভাল।
আর ভাইয়া?
সেও ভাল।
তার ব্যবসা কেমন চলছে রে?
ভাল না। লাভ এক পয়সাও হচ্ছে না। মাঝে মাঝে লোকসান। এখন মনে হচ্ছে সমান সমান যাচ্ছে। লাভও নেই, লো
কসান নেই।
নাসিম ভাই, নাসিম ভাই কেমন আছে?
রুবা চট করে এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। আপার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, জানি না কেমন। অনেক দিন আমাদের বাসায় আসে না।
ইলা অস্বস্তির সঙ্গে বলল, তুই এইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?
রুবা বলল, তোমাকে দেখছি। তুমি আরো সুন্দর হয়েছ। যত দিন যাচ্ছে তুমি তত সুন্দর হচ্ছ।
ইলা বলল, তুই দাড়া এখানে। আমি তোর দুলাভাইকে চা-টা দিয়ে আসি। তুই চা খাবি?
না। আমাকে ফ্রীজের ঠাণ্ডা পানি দাও আপা। ফ্রীজ ধরলে দুলাভাই আবার রাগ করবে না তো?
ইলা কিছু বলল না। চায়ের কাপ নিয়ে বসার ঘরে ঢুকল। জামান শর্টি গায়ে দিচ্ছে। আজ সে দাড়ি কামায়নি। গালে খোঁচা পেঁচা দাড়ি। বিশ্রী লাগছে দেখতে। থুতনির কাছের কিছু দাড়ি পাকা। একদিন দাড়ি না কামালে তাকে কেমন বুড়োটে দেখায়। জামান চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, রুবা কি জন্যে এসেছে?
এম্নি এসেছে। বেড়াতে। আবার কি জন্যে।
আমার তো মনে হয় টাকা-পয়সা চাইতে এসেছে। হাবভাবে তাই মনে হচ্ছে। পাঁচ দশ চাইল দিয়ে দিও। এর বেশি চাইলে না করবে।
আচ্ছা।
আমি যাচ্ছি জয়দেবপুর। ফিরতে রাত দশটার বেশি বাজবে। বাড়িওয়ালাকে বলবে গেটটা যেন খোলা রাখে। ব্যাটা ছোটলোক। সন্ধ্যাবেলা গেট বন্ধ করে দিবে। ইয়ারকি!
রোজ রোজ জয়দেবপুর যাচ্ছ কেন?
কাজ আছে, তাই যাচ্ছি। কাজ না থাকলে যেতাম না। তোমার অতিরিক্ত কৌতূহল আমার পছন্দ না। কৌতূহল যত কম খাকে তত ভাল।
ইলা কাতর গলায় বলল, তুমি যাবার আগে রুবাকে কিছু একটা বলে যাও। বেচার মন খারাপ করেছে।
কি বলে যাব?
চলে যাচ্ছ যে এটা বলবে।
ওকে তা বলার দরকার কি? চলে যাচ্ছি তার জন্য কি অনুমতি নিতে হবে?
জামান গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গেল। ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে খানিকটা রাগও দেখাল। সকাল থেকেই সে রেগে আছে।
ইলা রান্নাঘরে ফিরে এসে দেখে রুবা সত্যি কাঁদছে। ওড়নার এক প্রান্ত চোখে ধরে আছে। নিঃশব্দ কান্না। ইলা তখনি সন্দেহ করেছিল–এই কাণ্ড হবে।
কি হয়েছে রে?
রুবা ফিক করে হেসে ফেলে বলল, অভিনয় করছি। তুমি কি ভেবেছিলে সত্যি সত্যি কাঁদছি?
ইলা কাতর গলায় বলল, তুই যে তোর দুলাভাইয়ের উপর রাগ করে কাঁদছিস তা জানি। শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে হবে না। বললাম না ওর মনটা ভাল নেই। শরীরও খরিপ। কাল রাতে ঘুমাতে পারে নি। আয়, ফ্যানের নিচে বসি। ইস, গরমে ঘেমে কি হয়েছিল।
দুলাভাই চলে গেছেন?