কোথায় যাচ্ছিস রুবা?
কোথায় আবার? কলেজে। রিকশা ভাড়া দাও মা।
রোজ রোজ রিকশা ভাড়া–কি শুরু করেছিস তুই?
আচ্ছা বেশ। না দিলে না দেবে। চেঁচিও না। সকাল বেলাতেই চেঁচামেচি শুনতে ভাল লাগে না।
সত্যি করে বল তো কোথায় যাচ্ছিস?
প্রথমে যাব আপার কাছে। দেড়শ টাকা ধার চাই। যদি পাই তাহলে যাব কলেজে, আর যদি না পাই তাহলে যাব সদরঘাট।
হুঁ। সদরঘাট থেকে বুড়িগংগায় ঝাঁপ দেব। সলিল সমাধি।
তোর কথাবার্তার কোন মা-বাপ নেই।
না নেই। আমি ঠাট্টা করছি না মা। সত্যি সত্যি বুড়িগংগায় ঝাঁপ দেব। ঝপাং একটা শব্দ; তারপর সব শেষ। বুড়িগংগায় যে চীন মৈত্রী সেতু আছে–ঐ সেতু থেকে ঝাঁপ দেব।
সুরমা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। এই মেয়ে কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাচ্ছে। একে খুব তড়িতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেয়া দরকার। কোন সম্বন্ধ আসছে না। একটা ছেলে পাওয়া গেছে। কিন্তু তার কথা বলতেও সাহসে কুলুচ্ছে না। ছেলের আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। সেই পক্ষের একটা ছেলে আছে। তাতে তো আর জগৎ-সংসার অশুদ্ধ হয়ে যায় না। পাত্র হিসেবে বরং এইসব ছেলেই ভাল হয়। আর সঙ্গে একবার কথা বলতে হবে।
বাবু রুবার সঙ্গে সঙ্গে আসছে। তাকে বাসে তুলে দিয়ে সে বাজার করবে। সেই বাজারে রাম্না হবে। অতি দ্রুত খেয়ে ছুটবে অফিসে। অফিস হচ্ছে মালিবাগে তিনতলায় আট ফুট বাই দুফুট একটা ঘর। ঘরের বাইরে সাইনবোর্ড–বন এন্টারপ্রাইজ। বাবুর ব এবং নাসিমের ন দিয়ে বন। দুই বন্ধুর পার্টনারশীপ বিজনেস।
আমাকে বাসে তুলে দিতে হবে না, ভাইয়া। তুমি তোমার কাজে যাও।
আহ্ চল না। গল্প করতে করতে যাই।
তুমি আবার গল্পও জান নাকি?
আমি জানি না। তুই তো জানিস। তুই বল আমি শুনি।
আমি যেসব গল্প জানি সেসব তোমার ভাল লাগবে না।
কি করে বুঝলি?
আমি বুঝতে পারি। আমি অনেক কিছুই বুঝতে পারি যা তোমরা বুঝতে পার না।
বাসে উঠা খুবই মুশকিল। ভোরবেলা চাপের সময় কোন কাটার মহিলা যাত্রী নিতে চায় না। একজন মহিলা একাই পাঁচজনের জায়গা দখল করে। গায়ে গা লেগে গেলে ছ্যাঁৎ করে উঠে। কি দরকার ঝামেলার।
রুবা বলল, শেয়ারে টেম্পোতে করে চলে যাই, ভাইয়া? গুলিস্তানে নামব। এক টাকা মাত্র ভাড়া।
আরে, টেম্পোতে মেয়েরা যায় নাকি?
বাসে যেতে পারলে টেম্পোতে যাওয়া যায়। অনেক মেয়ে কিন্তু যাচ্ছে।
যাচ্ছে নাকি?
হুঁ। আমি নিজেও দুদিন গেলাম।
সে কি?
গুলিস্তানে নামলে আমার সুবিধাও হবে। প্রথমে যাব আপার কাছে।
ইলার কাছে গেলে বলিস তো খুব সাবধানে থাকতে। পত্রিকায় দেখলাম, ঝিকাতলার এক বাসায় দিনে-দুপুরে ডাকাতি হয়েছে। টিভি নিয়ে গেছে। খবরটা শুনেই বুকে ছ্যাঁৎ করে উঠল। ভাবলাম ওর বাসাতেই ডাকাতি হল কিনা।
আপাদের পাশের বাসায় হয়েছে। তুই জানলি কিভাবে?
আমার মন বলছে।
রুবা হাসতে লাগল। বাবু তাকে টেম্পোতে তুলে দিল। অন্য যাত্রীরা সরু চোখে তাকাচ্ছে। ব্যাপারটা তারা পছন্দ করছে না। টেম্পোর ছোকরা দাঁত বের করে হুসছে। নতুন ধরনের যাত্রী, তার মনে হয় ভালই লাগছে।
রুবার পাশে একটি অল্পবয়সী ছেলে। খুব সম্ভব মফস্বল থেকে এসেছে। সে অস্বস্তি বোধ করছে। অনেকখানি জায়গা রুবাকে ছেড়ে দিয়ে নিজেকে এমন করে গুটিয়েছে যে রুবার একটু মন খারাপ হল। সে নরম স্বরে বলল, আপনার এত কষ্ট করার দরকার নেই। আপনি আরাম করে বসুন। গায়ে গা লাগলে আমার গা পড়ে যাবে না।
অসুবিধা নাই। আমার কোন অসুবিধা নাই।
ছেলেটি আরো গুটিয়ে গেল। অস্বস্তিতে বেচারা যেন মারা যাচ্ছে। রুবা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ভাবল, জীবন গল্প-উপন্যাসের মত হলে বেশ হত। উপন্যাসে এই জায়গায় ছেলেটা কৃতজ্ঞ চোখে তাকাবে। ভাড়া দেবার সময় দেখা যায় ছেলেটা মানিব্যাগ ফেলে এসেছে। মেয়েটা তখন ভাড়া দিয়ে দেবে। ছেলেটা বলবে, আপনাকে কি বলে যে থ্যাংকস্ জানাব। মেয়েটা বলবে, একদিন আসুন না আমাদের বাসায়। ছেলেটা আসবে। এসে দেখে কি অদ্ভুত কাণ্ড! চারতলা বিরাট এক বাড়ি। এই মেয়ে এই বাড়ির মেয়ে। বাবা-মার একমাত্র সন্তান। ঐদিন মেয়েটি টেম্পোতে উঠেছিল নিতান্তই শখের কারণে। ছেলেটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলবে। কারণ সে খুব গরীব। টিউশানি করে অনেক কষ্টে সংসার চালায়।
রুবাদের টেম্পোর পেছনে অনেকক্ষণ থেকে একটা লাল রঙের টয়োটা আসছে। হর্ন দিচ্ছে। সাইড পাচ্ছে না বলে যেতে পারছে না। টয়োটাটা চালাচ্ছে সুন্দরী একটা মেয়ে। সে কৌতূহলী চোখে মাঝে মাঝে রুবাকে দেখছে। এই মেয়েটি জীবনে হয়ত কোন দিন টেম্পোতে চড়ে নি। ভবিষ্যতেও চড়বে না। মাঝে মাঝে টেম্পোর মহিলা যাত্রীদের দিকে তাকাবে বিস্ময় নিয়ে। রুবার খুব ইচ্ছা করছে মেয়েটাকে একটা ভেংচি কাটতে। ভেংচি খেয়ে টয়োটা গাড়ির রূপবতী ড্রাইভারটির মুখের ভাব কেমন হয় দেখতে ইচ্ছা করছে। রুবা ভেংচি কাটার মানসিক প্রস্তুতি নেবার আগেই টয়োটাটা তাদের ওভারটেক করে গেল। রুবার মন খারাপ হয়ে গেল।
নখ দিয়ে দরজা আঁচড়াচ্ছে
কে যেন নখ দিয়ে দরজা আঁচড়াচ্ছে।
কি অদ্ভুত কাণ্ড। কলিং বেল আছে, দরজার কড়া আছে। বেল টিপবে কিংবা কড়া নাড়বে। দরজা নখ দিয়ে আঁচড়াবে কেন? পাগল-টাগল না তো! ইলার বুক ছ্যাঁৎ করে উঠল। ভাগ্যিস সে একা নেই। জামান আছে।
কে?
চাঁপা হাসির শব্দ। আবার দরজায় আঁচড়। ইলা সাহস করে দরজা খুলল। যা ভেবেছিল তাই। রুবা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে।