আজ রুবার ঘুম ভেঙেছে খুব ভোরে। বিছানা ছেড়ে ওঠে নি। অনেকক্ষণ গড়াগড়ি করেছে। আপার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় এই একটা লাভ তার হয়েছে। পুরোপুরি বিছানার দখল পাওয়া গেছে। এই গরমে কারো সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে শুতে হচ্ছে না। ঘুমের ঘোরে কেউ গায়ে পা তুলে দিচ্ছে না। পুরো রাজত্ব অর একার।
সুরমা যথানিয়মে তাকে ডাকতে এলেন। রুবা বলল, পা ধরে ঝাঁকুনি শুরু করবে না মা, আমি জেগে আছি।
উঠে আয়। হাতমুখ ধুয়ে তৈরি হ।
আজ কলেজে যা না মা। এরকম কড়া করে তাকালেও কোন লাভ হবে না।
হাতি দিয়ে টেনেও কেউ আজ আমাকে কলেজে নিতে পারবে না।
কেন?
আজ কলেজে গেলেই দেড়শ টাকা দিতে হবে। দেড়শ টাকা তুমি দিতে পারবে না। আমারও যাওয়া হবে না।
এখন কিসের দেড়শ টাকা। সেদিন না বেতন দিলি?
পিকনিক হচ্ছে মা।
চৈত্র মাসে কিসের পিকনিক?
পিকনিকের কোন চৈত্র-বৈশাখ নেই। যখন ইচ্ছা তখন করা যায়। আমাদের কলেজের কিছু বড়লোকের মেয়ে পিকনিক করছে চৈত্র মাসে। তারা একটা লঞ্চ ভাড়া করেছে। ঐ লঞ্চ ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ যাবে। আবার ফিরে আসবে। এর জন্যে চাঁদা হচ্ছে দেড়শ টাকা।
তুই ওদের সঙ্গে যাবি কেন?
যাব নাইবা কেন?
বড়লোকের মেয়েদের সঙ্গে তোর এত কিসের মাখামাখি? তুই তোর নিজের মত মেয়েগুলির সঙ্গে মিশবি।
গরীব মেয়েগুলিকে খুঁজে বের করব? জনে জনে জিজ্ঞেস করব–তুমি কি গরীব, তোমার বাবা কি মারা গেছেন? তোমার বড় ভাই কি খুব কষ্ট করে সংসার চালাচ্ছেন? তুমি কি রোজ বাসে করে স্কুলে অসি? পিকনিকে যাবার জন্যে সামান্য দেড়শ টাকা চাঁদা কি তুমি দিতে পার না? যদি না পার তাহলে আস, তুমি আমার বন্ধু।
চুপ কর তা রুবা। তুই এমন ফাজিল হচ্ছিস কিভাবে।
জানি না মা কিভাবে হচ্ছি। আমার ফজিলামি দেখে তুমি যেমন অবাক হচ্ছ আমি নিজে তার চেয়েও বেশি অবাক হচ্ছি। মনে হয় আমাকে জ্বীনে ধরেছে। সুন্দরী মেয়েদের জ্বীনে ধরে।
চুপ করবি?
আমাকে ধমক দিয়ে কোন লাচ্ছু হবে না মা। যে জীনটা আমাকে ধরেছে তাকে কড়া করে ধমক দিতে হবে। তাকে বলতে হবে–হে জ্বীন, তুমি আমার শান্ত ভালমানুষ মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে বড়লোকের কোন মেয়েকে ধর।
সুরমার কড়া দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপক্ষা করে রুবা হাই তুলল। আদুরে গলায় বলল, এখন কটা বাজে বলতে পারবে? সুরমা মেয়ের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বের হয়ে এলেন। রুবা বিছানা ছাড়ল। বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
বায়ান্দায় রুবার বড় ভাই আবু তার দিনের সবচে কঠিন কাজটি করছে। শুধুমাত্র একটা ব্লেড হাতে নিয়ে দাড়ি শেভ করার চেষ্টা করছে। সে বসেছে উবু হয়ে। তার সামনে চেয়ারের উপর ছোট্ট একটা আয়না। বাবুর সমস্ত চিন্তা-চেতনা আয়নায় নিবদ্ধ। রুবা বড় ভাইয়ের দাড়ি শেভ করার দৃশ্য শান্তমুখে খানিকক্ষণ দেখল। এই দৃশ্য তার কখনো ভাল লাগে না, গা শিরশির করে। একটা সামান্য বেজায় কিনতে কত টাকা লাগে? ভাইয়া তা কিনবে না। নিজের জন্যে একটা পয়সা খরচ করতেও তার গায়ে জ্বর আসে।
ভাইয়া।
হুঁ।
আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে নিশ্চয়ই কেউ নাপিত ছিল। নাপিত ছাড়া শুধুমাত্র ব্লেড দিয়ে এত সুন্দর শেভ কেউ করতে পারবে না।
বাবু হাসল। রুবা তার সামনে বসতে বসতে বলল, ভাইয়া, চৈত্র মাসের এই সুন্দর এই সকালে তোমার কাছে কি সামান্য এটা আবেদন রাখতে পারি?
অবশ্যই পারিস।
তুমি কি আমাকে দেড়শটা টাকা দিতে পার?
দেড়শ?
হ্যাঁ দেড়শ। ভাইয়া দেবে?
হ্যাঁ দেব।
রুবা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। ভাইয়ার স্বভাবই হচ্ছে–সব কিছুতেই হ্যাঁ বলবে। আজ পর্যন্তু সে কখনো ভাইয়াকে না বলতে শুনে নি। না বলে যে বাংলা অভিধানে একটা শব্দ আছে তা বোধহয় এই চমৎকার মানুষটা জানে না।
ভাইয়া, টাকাটা আজই দিতে হবে।
বাবু আয়না থেকে মুখ ফেরাল। রুবার দিকে তাকিয়ে লজ্জিত গলায় বলল, আজ তো দিতে পারব না রুবা। আজ হাত একেবারে খালি। একশটা টাকা আছে, বাজার খরচ। চাল কিনতে হবে। পাঁচ কেজি চাল কিনতেই সত্তুর টাকা চলে যাবে। তোরা তো আবার মোটা চাল খেতে পারিস না।
ভাইয়া এমনভাবে কথা বলছে যেন রুবা একটা বাচ্চা মেয়ে। সংসারের কোন সমস্যা সে বুঝতে পারে না। ব্যাপারটা ঠিক তার উল্টো। সংসারের অনেক সমস্যা সে সবার আগে বুঝে। খুব ভালই বুঝে।
কি ভাইয়া।
কিছু টাকা পাই এক জায়গায়। একটা বিল আটকে আছে। সপ্তাহখানিক পরে হলে তোর চলবে না?
চলবে। খুব চলবে। তুমি বরং সপ্তাহখানেক পরে দিও।
ভাইয়াকে খুশি করার জন্যে বলা। তার দরকার আজ। সপ্তাহখানিক পর সে টাকা দিয়ে কি করবে? পিকনিকের কথাটা যখন উঠল তখন যদি সে বলত ঝড়-বাদলের দিনে কিসের পিকনিক? আমি এর মধ্যে নেই। তাহলে আজ আর এই ঝামেলা হত না। তখন সেই সবচে বেশি লাফিয়েছে। কি কি খাওয়া হবে তার লিস্ট বানিয়েছে। সবাই শাড়ি পরে যাবে। হলুদ শাড়ি। এ রকম একটা প্রস্তাবও ছিল। সেই প্রস্তাব বাতিল হয়ে গেছে। বাতিল হয়েছে তার জন্যে। কারণ তার হলুদ শাড়ি নেই।
সুরমা লক্ষ্য করলেন, রুবা কলেজে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। কলেজে যাবার নাম করে অন্য কোথাও যাচ্ছে না তো? ইদানিং তার এ রকম সন্দেহ হচ্ছে। দিনকাল ভাল মা। ছেলেপুলেরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এদের রাখতে হয় চোখে চোখে। তার উপর বাপ নেই মেয়ে। গার্জেন ছাড়া মেয়ে হচ্ছে পাল-খাটানো নৌকার মত। যেদিকে বাতাস দিবে সেদিকে যাবে। আর বাবার সংসারের মেয়ে হল গুনটানা নৌকা। যে নৌকাকে বাবাই গুনের দড়ি ধরে টেনে নিয়ে যাবে। তার সংসারে গুন টানার মানুষ নেই। বাবু সাধ্যমত করছে। করলেও সে ভুল ভাই। বাবার কাজ কি ভাই দিয়ে হয়?