জামান বিরক্ত স্বরে বলল, এখন ঘুমাও তো। কোন কথা শুনতে পারব না। কখাবার্তা যা সকালে বলব। দুপুর রাতের জন্যে জমা করে রাখবে না।
ঘুমুবে না?
কেন যন্ত্রণা করছ? তোমার ঘুম তুমি ঘুমাও।
টাকা হারানোয় খুব খারাপ লাগছে?
না, খারাপ লাগছে না। খুব আনন্দ পাচ্ছি।
জামান খবরের কাগজ ভাঁজ করে মেঝেতে খুঁড়ে ফেলল। এটি তার স্বজ্জাবের বাইরে। সে খুব গোছালো। এমন কাজ কখনো করবে না। ইলা বলি, বাতি নিভিয়ে দেব?
দাও।
ইলা বাতি নিভিয়ে দিল। অন্তু মিয়া কুঁ-কুঁ শব্দ করছে, জ্বর বোধহয় আরো বেড়েছে। জ্বর বাড়লে কি করতে হবে ডাক্তার কি তা বলেছে? ঘরে একটা থার্মোমিটার নেই। তাদের যাত্রাবাড়ির বাসায় থার্মোমিটার আছে। রুবার দখলে থাকে। রুবার একটা কাঠের বাক্স আছে। সেই বাক্সে শুধু যে থার্মোমিটার আছে তাই মা–ডেটল আছে, তুলা আছে, বার্নল আছে। বাক্সের গায়ে বড় বড় করে লেখা–আরোগ্য নিকেতন।
ইলা ক্ষীণ গলায় বলল, ঘুমুচ্ছ?
জামান জবাব দিল না। তবে সে যে এম্বনে ঘুমায় নি তা বোঝা যাচ্ছে।
ইলা আর কিছু বলল না। আর ঘুম আসছে। প্রায়ই তার এরকম হয়। জ্বের্গে ক্লেগে রাত পার করে দেয়। নানান কথা ভাবে। রাত জেগে ভাবতে তার বড় ভাল লাশে।
জামান বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। ইলা খুব সাবধানে বিছানা থেকে নামল। ফ্যানের নিচেও খুব গরম লাগছে। বারান্দায় এসে সে কিছুক্ষণ বসবে। এটও নতুন কিছু নয়। প্রায়ই বসে। অন্ধকারে একা একা বসে থাকার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ আছে।
ইলা বারান্দায় চেয়ারে বসতে বসতে ভাবল, মানিব্যাগটা ফিরিয়ে না দিলে কেমন হয়? সে নিজে বুঝতে পারছে, এটা খুবই অন্যায় চিন্তা। কিন্তু কিছুতেই মাথা থেকে দূর করতে পারছে না। এক বান্ডিল পাঁচশ টাকার নোট। এত টাকা এক সঙ্গে সে নিজে কখনো দেখে নি। টাকাটা কি সে নিজের জন্যে রেখে দিতে পারে না? যদি রাখে তাহলে কি খুব বড় পাপ হবে?
অন্তু আহ-উহ করছে। ইলা উঠে গিয়ে তার কপালে হাত রাখল। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। মাথায় পানি ঢালা দরকার। এত রাতে পানি ঢালাঢ়ালির ব্যবস্থা করলে জামানের ঘুম ভেঙে যাবে। সে খুব বিরক্ত হবে। ইলা অসহায় ভঙ্গিতে অন্তুর মাথার পাশে বসে রইল।
তার নিজের পানির পিপাসা হচ্ছে, কিন্তু উঠে যেতে ইচ্ছা করছে না। একজন কেউ যদি হাতের কাছে থাকত এবং বলা মাত্র গ্লাস ভর্তি বরফ শীতল পানি নিয়ে আসত তাহলে চমৎকার হত।
অন্তু!
উঁ!
তোর অসুখ সারলে তোকে আমি মার বাসায় রেখে আসব। সেখানে খুব আরামে থাকবি।
আচ্ছা।
এ বাড়িতে তোর কি ভয় লাগে?
হুঁ।
ইলা মনে মনে বলল, আমারো ভয় লাগে। পানির পিপাসা ক্রমেই বাড়ছে। উঠে যেতে ইচ্ছা করছে না। এখন যদি জামান ঘুমের ঘোরে বল, পানি দাও। সে পানি নিয়ে আসবে। অন্তু চাইলেও আনবে। অথচ নিজের জন্যে পানি আনতে যাবার সামান্য কষ্টটাও করবে না।
রুবা আটটার আগে ঘুম থেকে উঠে না
রুবা আটটার আগে ঘুম থেকে উঠে না। যত্ন সকাল সকালই ঘুমুতে যাক, উঠতে উঠতে সেই আটটা। তাও নিজ থেকে উঠবে না, কাউকে এসে ডাকতে হবে, পা ঘরে ধরে ঝাঁকুনি দিতে হবে। ইদানিং ঘুম ভেঙে প্রথম যে কথাটি সে বলছে তা হচ্ছে–আজ কলেজে যাব না, মা। শরীর ভাল না।
রুবার কথা শুনে তাঁর মা সুরমা এমন ভঙ্গিতে তাকাবেন যাতে মনে হবে তিনি এই মুহূর্তে মেয়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন। রুবা তখন বলবে–ঠিক আছে মা, যাচ্ছি। যদিও যাবার কোন কম তাড়া দেখা যাবে না। দীর্ঘ সময় নিয়ে দাঁত মাজবে। নাশতা খেতে দেরি করবে। কাপড় পরতে দেরি করবে; তারপর রিকশা ভাড়ার জন্যে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকবে। যদিও সে জানে রিকশা ভাড়া পাওয়া যাবে না। যেতে হবে বাসে। সময় নষ্ট করবার জন্যেই রিকশা ভাড়া নিয়ে হৈচৈ করা। শুরুর একটা বা দুটা পিরিয়ড রুবা কখনো ধরতে পারে না। এই নিয়ে তাঁর খুব মাধব্যথাও নেই। বন্ধু ঠিক করা আছে যার প্রক্সি দেবে। রুবার বন্ধুর ভাগ্য খুব ভাল। কলেজ চলাকালীন সময়ে তাকে দেখা যাবে ক্যান্টিনে আড্ডা দিতে। মজার মজার গল্প বলে বান্ধবীদের সে সারাক্ষণ হাসাতে পারে। কলেজের প্রতিটি আপার কথা বলা এবং হাঁটা নকল করতে পারে। রুবার এই প্রতিভা কলেজের আপাদের অজানা নয়। প্রিন্সিপ্যাল আপা একদিন তাকে ডেকে নিয়ে খুব ধমকালেন। কড়া গলায় বললেন, আবার যদি শুনি তুমি আপাদের নকল করছ তাহলে খুব খারাপ হবে। কলেজ থেকে বের করে দেব। কলেজ পড়াশোনার জায়গা, এটা নাট্যশালা নয়।
রুবা মাথা নিচু করে বলেছে, আর করব না অপী। তখন রুবাকে অবাক করে দিয়ে প্রিন্সিপ্যাল আপা বললেন–মিস মনোয়ারী কিভাবে হাঁটেন একটু দেখি।
সত্যি দেখাব?
হ্যাঁ, দেখাও। এটা হচ্ছে তোমার লাস্ট পারফরম্যান্স। মাইণ্ডা ইট। কলেজের ডিসিপ্লিনের ব্যাপারে আমি খুবই কড়া।
রুবা মনোয়ারা আপার কোমর দুলিয়ে হাঁটা এবং হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ার ভঙ্গির খানিকটা করল। প্রিন্সিপ্যাল আপা খুব চেষ্টা করলেন না হাসতে। শেষ পর্যন্তু পারলেন না। হাসলেন, কাশলেন এবং বিষম খেলেন। প্রিন্সিপ্যাল আপা বুঝতেও পারলেন না তার একই সঙ্গে হাসি, কাশি ও বিষম খাওয়ার দৃশ্যটি রুবা দশ মিনিটের ভেতরেই কমনরুমে দেখাবে এবং দৃশ্য দেখে তার বান্ধবীরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি যাবে।
রুবা এ রকম ছিল না। তার পরিবর্তনটা হয়েছে হঠাৎ। কলেজে ঢোকার কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল রুবা বদলে গেছে। আগে যে কোন তুচ্ছ কারণেও তার চোখে পানি এসে যেত। এখন হাসি এসে যায়। সে এরকম হল কেন সে নিজেও জানে না।