তোমাকে আমি সকালে টাকাটা দিয়ে দেব।
জ্বি আচ্ছা।
বস একটু, টা খাও।
আমি চা খাই না।
চা না খেলে শরবত খাও। আমি লেবু দিয়ে শরবত বানিয়ে দি। ভাল লাগবে।
কিছু লাগবে না ভাবী।
তুমি বস তো দেখি।
হাসান জড়সড় হয়ে সোফায় চেয়ারে বসল। এখনো মুখ তুলে তাকানা। কার্পেটের ডিজাইন দেখছে। পুরুষ মানুষ এমন হয় কখনো? কি বিশ্রী মেয়েলী স্বভাব!
কি পড় তুমি?
বি, এ পড়ি। এ বহুর পরীক্ষা দেব।
তাই নাকি? কখন পড়? আমি তো সব সময় তোমাকে বারান্দায় বসে খুঁকিতে দেখি।
নাইট সেকশনে পড়ি। জন্নাথ কলেজে। ও আচ্ছা।
ডে সেকশনে ভর্তি হতাম। চান্স পেয়েছিলাম। চাচা নিষেধ করলেন। চাচা বললেন–দিনে অনেক কাজকর্ম আচ্ছে। তাই…
চাচা কে? আমাদের বাড়িওয়ালা?
জ্বি। আমি শুনেছিলাম তিনি তোমার মামা।
জ্বি-না, চাচা। বাবার ফুপাতো ভাই।
দিনের বেলায় কি কাজ কর?
বাজার করি। তারপর প্রেসে যাই। চাচার একটা প্রেম আছে মগবাজারে। কম্পোজ সেকশন।
ও, তাই নাকি?
জ্বি।
তুমি আমার অনেক উপকার করলে ভাই, নাও, শরবত খাও। ঘরে আর কিছু নেই।
হাসান এক নিঃশ্বাসে শরবতের গ্লাস শেষ করেই উঠে পড়ল। ইলার মনে হল শরবতের বদলে চা দিলে গরম চ-ও হয়ত সে এভাবে এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেলত।
ভাবী যাই?
তুমি আরেকদিন এসে আমাদের সঙ্গে চারটা ডাল-ভাত খাবে। আর শোন, তুমি আমাকে এত লজ্জা পাচ্ছি কেন? মুগ্ধ তুলে তাকাও। রাস্তায় কখনো দেখা হলে আমি তোমাকে চিনতে পারব না। এখনো আমি ভালমত তোমার মুখ দেখি নি।
হাসান মুখ তুলে তাকাল। এই প্রথম সে হাসল। লাজুক ধরনের সুন্দর একটা ছেলে। কচি মুখ। সে আবার বলল, ভাবী যাই?
আচ্ছা যাও।
আর শোন, তুমি আমাকে ভাবী ডাকবে না। আপা ডাকবে। ভাবী ডাকটা শুনতে ভাল লাগে না।
জ্বি আচ্ছা।
আজ রাতে গেটটা একটু খোলা রাখতে হবে। এর ফিরতে দেরি হয়ে। এগারটা যারটা বেজে যাবে।
জ্বি আচ্ছা।
অন্তুর জ্বর এসেছে। বেশ ভাল জ্বর। রাতে সে কিছুই খেল না। ইলা বসার ঘরে মাদুর পেতে অন্তুকে শুইয়ে দিল। বেচারা মরার মত শুয়ে আছে। গালে মশা বসেছে, সেই মশা তাড়াবারও চেষ্টা করছে না। ছেলেটার জন্যে একটা মশারি কিনতে হবে। জামানকে বলে দেখলে হয়। রাজি হতেও তো পারে। মশারি কোন অপ্রয়ােজনীয় জিনিস নয়। প্রয়োজনের জিনিস।
ইলা অন্তুর হাতে একটা পাঁচ টাকার নোট দিল। সে টাকা পেয়ে খুব খুশি। হাসার চেষ্টা করছে। ইলা বলল, খবর্দার, হাসবি না। হাসলে ঠোঁটে টান পড়বে। ব্যথা পাবি।
অন্তু ব্যথা পাচ্ছে। তবু হাসছে। এরা কন্তু অল্পতে খুশি! ঠোঁটের ব্যথার কথা এখন আর তার মনে নেই। মনে থাকলেও ব্যথা অগ্রাহ্য করে সে ঘুমুবে। ভোরবেলা ওঠে কাজকর্ম করবে। টাকাটা লুকানো থাকবে গোপন কোন জায়গায়। বারবার কাজ ফেলে দেখে অসবে নোটটা ঠিকমত আছে কি না।
অন্তু। দুধ খাবি? এক কাপ দুধ এনে দেই?
দুধ গন্ধ করে।
থাক তুহিলে। গন্ধ করলে খেতে হবে না। ঘুমিয়ে পড়।
বাধ্য ছেলের মত অন্তু চোখ বন্ধ করল। ঘুমিয়ে পড়ল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে।
ছেলেটার বাবা-মা কোথায় আছে ইলা জানে না। অন্তু নিজেও জানে না। জানলে খবর দিত।
জামান রাত এগারটায় ফিরল। কোন কথা না বলে গম্ভীর মুখে তোয়ালে হাতে বাথরুমে ঢুকল। সেখান থেকেই চেঁচিয়ে বলল, খেয়ে এসেছি। এক কাপ চা করে দাও।
আশ্চর্যের ব্যাপার! হারানো মানিব্যাগের কথা সে কিছুই বলছে না। ইলা ভেবেছিল ঘরে ঢুকে সে জিজ্ঞেস করবে, মানিব্যাগ পেয়েছ? এতলি টাকা মানিব্যাগে। জিজ্ঞেস করাই তো স্বাভাবিক। যে কোন মানুষ করবে। জামানের মত সাবধানী মানুষ আরো বেশি করবে। জিজ্ঞেস করছে না কেন?
খালি গায়ে বারান্দায় বসে ড্রামান চা খাচ্ছে। বারান্দায় বাতি নেভানো। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। তবু সে যে খুব চিন্তিত, এটা বোঝা যাচ্ছে। কেমন কুঁজো হয়ে বসেছে। একটু পরপর শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলছে। ইলা ঠিক করল, রাতে শোবার সময় সে বলবে মানিব্যাগ ঘরে পাওয়া গেছে। তুমি ফেলে গিয়েছিলে। এত চিন্তা করার কিছু নেই।
ইলা চায়ের কাপ জামানের দিকে বাড়িয়ে ধরল। জামান শান্ত গলায় বলল, বিরাট একটা লোকসান হয়েছে।
কি লোকসান?
পকেট মার হয়েছে।
বল কি?
হারামজাদা মানিব্যাগ নিয়ে গেছে।
সত্যি নিয়েছে?
এটা আবার কি রকম কথা? সত্যি না তো কি? আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা-ফাজলেমি করছি?
ইলা কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। জামান চায়ের কাপ নামিয়ে উঠে দাঁড়াল। নিজের মনেই বলল, কোত্থেকে নিয়েছে তাও জানি। কলাবাগানে রিক্সা থেকে নামলাম। ঠিক তখন একটা লোক ঘাড়ে পড়ে গেল। মানিব্যাগ যে তখনি পাচার হয়ে গেছে আমি বুঝতে পারি নি। রিকশা ভাড়া দিতে গিয়ে বুঝলাম। এর মধ্যে হারামজাদা হাওয়া।
মানিব্যাগ পকেটে ছিল?
মানিব্যাগ পকেটে থাকবে না তো কোথায় থাকবে? অনাবশ্যক কথা বল কেন? কি বিশ্রী অভ্যাস।
কত টাকা ছিল?
ছিল কিছু। ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দাও, আর পানি দাও। দেশটা চোরে ভর্তি হয়ে গেছে।
জামান ঘুমুতে এল খবরের কাগজ হাতে। বিছানায় বসে মানুষটা ভুরু কুঁচকে কাগজ পড়ছে। ইলা বুঝতে পারছে জামান আসলে কাগজ পড়ছে না। নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে। ইলা শুয়ে আছে। তাকিয়ে আছে জামানের দিকে। বড় মায়া লাগছে।
ইলার ঠিক মাথার নিচেই প্রায় একশ বারটা পঁচিশ টাকার নোট বোঝাই মানিব্যাগ। না একশ বার না, তের। হাসানের ফেরত দেয়া নোটটাও সে রেখে দিয়েছে। সে এক সময় ক্ষীণ স্বরে বলল, এই, একটা কথা শোন।