ইলা দরজা বন্ধ করে আলনার দিকে গেল। ঘরে পরার একটা শাড়ি নেবে। বাথরুমে গিয়ে গা ধুবে। প্রচণ্ড গরম লাগছে। গা কুটকুট করছে। বাথরুমে গিয়ে হয়ত দেখা যাবে পানি নেই। বিকেলের দিকে এ বাড়িতে পানি থাকে না। জামানকে একটা বড় বালতি কিনতে বলেছিল। জামান বিরক্ত হয়ে বলেছে–খামোকা একটা বড় বালতি কেনার দরকার কি? দুজন মাত্র মানুষ–বালতি-ফালতি কিনে বাড়ি ভর্তি করার জাস্টিফিকেশন নেই। শুধু ঝামেলা। কি কিনতে হবে, কি কিনতে হবে না-–তা আমাকে বলার দরকার নেই। আমার চোখ-কান খোলা, আমি জানি কি দরকার–কি দরকার নী। শখন যা দরকার হবে, আমি ঠিকই কিনব।
কি অদ্ভুত মানুষ! টাকা আছে, অর্থ খরচ করবে না। বিয়ের প্রথম এক মাস ইলা কিছু বুঝতে পারে নি। সে ভেবেছিল, মানুষটার আর্থিক অবস্থা বোধহয় তাদের মতই। টাকা-পয়সা নেই। যদিও থাকছে সুন্দর একটা ফ্ল্যাটে। বসার ঘরে কাপেট আছে, সোফা আছে, টিভি, ফ্রী আছে। তবে হাতে হয় নগদ টাকা নেই। বিয়ে উপলক্ষে জিনিসপত্র কিনেই সব শেষ করে ফেলেছে। লোকটার উপর খুব মায়া হয়েছিল। মায়া হয়েছিল বলেই বিয়ের তিন দিনের দিন সে বলেছিল–আমার কাছে সাতশ টাকা আছে। তোমার যদি দরকার হয় তুমি নিতে পার।
কোথায় পেলে সাতশ টাকা।
ভাইয়া আমাকে এক হাজার টাকা দিয়েছিল। বিয়েতে কিছু দিতে পারে নি এই জন্যে এক হাজার টাকা দিল। আমি নিতে চাই নি …।
এক হাজার থেকে সাতশ আছে, বাকি তিনশ কি করলে?
ইলা বিস্মিত হয়ে বলল, খরচ করেছি।
গরীব ঘরের মেয়ে। খরচের এই হাত তো ভুলি না। দেখি, এই সাতশ টাকা। আমাকে দিয়ে দাও। কোন কিছুর প্রয়োজন হলে বলবে। একটা কথা মন দিয়ে শোন–ইলা এই জীবনে অনেক কিছুই কিনতে ইচ্ছা করবে। কিনতে ইচ্ছা করলেই কিনতে নেই। টাকা-পয়সা অনেকেরই থাকে–খুব কম মানুষই থাকে যারা টাকা জমাতে পারে। হাতের ফাঁক দিয়ে টাকা বের হয়ে যায়। বুঝতে পারে না। বুঝতে পারছ?
ইলা শুকনো গলায় বলল, পারছি। তার মনটা বেশ খারাপ হল। মানুষটা তাহলে কৃপণ। বেশ ভাল কৃপণ। ইলা লক্ষ্য করল মানুষটা শুধু কৃপণ না, মন ছোট। কৃপণ মানুষের মন এম্নিতেই ছোট থাকে–তুবে তারা গোপন রাখতে চেষ্টা করে। এই লোকটা তা করে না। বরং চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
বিয়ের পরপর রুবা এসেছে, বড় বোনের সঙ্গে কয়েকদিন থাকবে। জামান হাসিমুখে গল্পটল্প করছে, তবু এক ধরনের গম্ভীর গভীর ভাব। সারাক্ষণ ভুরু কুঁচকানো। মিলি এমন কমছে কেন ইলা কিছুতেই অতে পারে না। তৃতীয় দিনের দিন রাতে ঘুমুতে যাবার সময় জামান হাই তুলতে তুলতে বুলল, রুবা কদিন থাকবে?
ইলা হাসিমুখে বলল, এস. এস. সি, পরীক্ষা হয়ে গেছে। এখন তো ছুটি। চলে যেতে চেয়েছিল, আমি জোর করে রেখে দিয়েছি।
জামান গম্ভীর গলায় বলল, জোর করে রাখার দরকার কি? জোর জবরদস্তি ভাল না। হয়ত এখানে থাকতে ভাল লাগছে না।
ভাল লাগছে না কে বলল। ভাল লাগছে–দেখ না ক হাসিখুশি।
সারাক্ষণ দেখি টিভির নব টেপাটেপি করছে। এইসব সেনসিটিভ ইনস্টমেন্ট। হুট করে নষ্ট করে দেবে।
ইলা হতভম্ব হয়ে গেল। কি বলছে এই মানুষটা? জামান সহজ স্বাভাবিক ভুলিতে স্বলল, ঐ দিন দেখি ফ্রীজের দরজা ধড়াম করে বন্ধ করল। ট্রাকের দরজাও এমন করে কেউ বন্ধ করে না। ফ্রীজের দরজা নিয়ে কুস্তি করার দরকার কি?
ইলা বলল, আচ্ছা, কাল সকালে ওকে যাত্রাবাড়িতে রেখে এস।
সকালে পারব না, কাজ আছে। দেখি বিকেলে না হয় রেখে আসব।
না সকালেই রেখে আস।
রাগ কর না-কি? ফালতু ব্যাপার নিয়ে আমার সঙ্গে রাগারাগি করবে না। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে বেশি মাখামাখি কচলাকচলি আমার পছন্দ না। তারা থাকবে তাদের মত। আমরা থাকব আমাদের মত। বুঝতে পারছ?
পারছি।
বিয়ের পর সুখী হবার একমাত্র উপায় হচ্ছে বাপের বাড়ি দ্রুত ভূলে যাওয়া। ভুলে যাবার চেষ্টা কর।
চেষ্টা করব।
জামান সত্যি সত্যি সকালে রুবাকে নিয়ে যেতে চাইবে, ইলা ভাবে নি। অমনি তাই কয়ল। ইলার চেয়ে অবাক হল রুবা। রুবা বলল, দুলাভাই, আমার তো আরো তিনদিন থাকার কথা। আমি যাব কেন?
থাকতে চাইলে তিনদিন খাক, অসুবিধা কি! তোমার আপা বলে রেখে আসতে।
রুবা গেল ইলার কাছে। বিস্মিত হয়ে বলল, দুলাভাই আমাকে যাত্রাবাড়িতে রেখে আসতে চাচ্ছে–ব্যাপার কি?
ব্যাপার কিছু না।
তোমাদের মধ্যে ঝগড়া-টগড়া হয়েছে?
না।
এমন গম্ভীর মুখে না বলছ কেন? আচ্ছা শোন, মা যদি শুনে তোমাদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে–মা খুব মন খারাপ করবে।
আমাদের মধ্যে কোন ঝগড়া হয় নি। আমার প্রচণ্ড মাথাধরা। এই জন্যেই বোধহয় গম্ভীর হয়ে আছি। তোর থাকতে ইচ্ছা হলে থাক।
না আপা, এখন যাই। দুলাভাই বলছিলেন তিনি ভিসিআর কিনবেন। কেনা হোক, তখন এসে অনেকদিন থাকব। রোঞ্জ পাঁচটা করে ছবি দেখব। তোমরা টেলিফান করে নিবে আপা? এত সুন্দর বাড়ি–টেলিফোন ছাড়া মানায় না।
টেলিফোনের অনন্য অ্যাপ্লিাই করেছে। এসে যাবে শিগগির।
দুলাভাইয়ের কি অনেক টাকা আপা?
জানি না।
ইলা আসলেই জানে না। মানুষটা সম্পর্কে জানে না। তবু তরি সঙ্গে সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জীবন যাপন করে।
অন্তুর পেছনে মাত্র উনিশ টাকা খরচ হয়েছে। হাসান বাসে করে তাকে মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেছে। ডাক্তার দুটি স্টিট দিয়েছেন। এসিএস এবং কমবায়োটিক ইনজেকশন শুধু কিনতে হয়েছে। হসান পাঁচশ টাকার নোটটা ভাঙায়নি। ফেরত এনেছে। ইলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মানিব্যাগে রেখে দিলেই হবে। জামান কিছুই জানতে পারবে না।