মাদুর বিছাতে গিয়ে ইলা দেখল, মেঝেতে কার্পেটের উপর জামানের মানিব্যাগ। পেটমোটা কালো রঙের মানিব্যাগ। যখন চেয়ারে বসেছিল ভুখন নিশ্চয়ই পকেট থেকে পড়ে গেছে। মানিব্যাগ পকেট থেকে পরে যাবে, জামান টের পাবে না, এরকম হবার কথা না। টাকা-পয়সার ব্যাপারে সে খুব সাবধানী। মানিব্যাগে বেশ কিন্তু পাঁচ শ টাকার নোট রাবার বেল্ড দিয়ে বাঁধা। কতগুলি নোট? গুনে দেখতে ইচ্ছে করছে।
জামান নিশ্চয়ই খুব দুশ্চিন্তা করছে। এতগুলি টাকা। দুশ্চিন্তা করারই কথা। সে কি বুঝতে পেরেছে মানিব্যাগ হারিয়েছে? নিশ্চয়ই খুব ঝামেলা হয়েছে। রিকশা থেকে নেমে রিকশা ভাড়া দিতে গিয়ে হঠাৎ দেখল মানিব্যাগ নেই। এইসব ক্ষেত্রে রিকশাওয়ালারা বিশ্বাস করতে চায় না যে মানিব্যাগ হারিয়েছে। তারা খুব যন্ত্রণা করে। ইলা, নিজে একবার এ রকম যন্ত্রণার মধ্যে পড়েছিল। যাত্রাবাড়ি থেকে বার টাকা রিকশা ভাড়া ঠিক করে সে আর রুবা এসেছে বায়তুল মুকাররমে। কিছু কেনার নেই–এম্নি ঘুরার জন্যে আসা। রিকশা থেকে নেমে ব্যাগ খুলে দেখে পুরানো ছেঁড়াখোঁড়া একটা এক টাকার নোট ছাড়া কোন টাকা নেই। কি বিশ্রী কাণ্ড! রিকশাওয়ালার সরল সরল মুখ, কিন্তু সে এমন হৈচৈ শুরু করল যে তাদের চারদিকে লোক জমে গেল। লোকগুলি ভাবল, ইচ্ছা করেই ইলা রিকশাওয়ালাকে টাকা দিচ্ছে না। রুবা অসন্তু ভীতু। সে ইলার বাঁ হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল–এখন কি হবে আপা? এখন কি হবে? ইলা রিকশাওয়ালাকে বলল, আপনি আমাদের সঙ্গে যাত্রাবাড়ি চলুন। আপনাকে চব্বিশ টাকা দেয়। রিকশাওয়ালা থু করে থুথু ফেলে বলল, যাত্রাবাড়ি যামু ক্যান? আমার কি ঠেকা?
আপনার কোন ঠেকা না, আমাদের ঠেকা। প্লীজ চলুন।
ইলার আবেদনে কোন লাভ হল না বরং রিকশাওয়ালাটা আরো প্রশ্রয় পেয়ে গেল। সে আরো কিছু রিকশাওয়ালা জুটিয়ে ফেলল এবং সরল সরল মুগ্ধ করে মিথ্যা কথা বলা শুরু করল–এই মাইয়া দুইটা আমারে ভাড়া দেয় না। আবার উল্টা গালি দিতাছে। আমারে বলে তুই ছোটলোকের বাচ্চা।
রুবা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আপা ব্যাগে তোমার যে কলমটা আছে ঐ কলমটা ওকে দিয়ে দাও। কলম নিয়ে চলে যাক।
কলম দিয়া আমি করমু কি? কলম ধুইয়া খামু? কলম খাইলে ফেড ভরব?
আর ঠিক তখন মাঝবয়েসী এক ভদ্রলোক এসে গম্ভীর গলায় বললেন–কত হয়েছে ভাড়া?
রুবা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, বার টাকা।
ভদ্রলোক একটা বিশ টাকার নোট বাড়িয়ে বললেন, এটা রাখ। সঙ্গে কলম আছে? আমার ঠিকানা লিখে রাখ। এক সময় ফেরত দিয়ে যেও।
তাদের চারপাশের ভিড় তুলুও কমে না। যেন নাটকের শেষ দৃশ্যটি এখনো বাকি আছে। এর শেষটা না দেখে যাবে না। ইলা ঠিকানা লিখছে–ভদ্রলোক বলছেন–লেখ বি. করিম। এগার বাই এফ, কলাবাজার। দোতলা।
ভিড়ের মধ্যে একজন বলল, টাকা ফেরত দিতে হবে না। টাকার বদলে অন্য কিছু দিলে আরো ভাল হয়।
একসঙ্গে সবাই হেসে উঠল। রুবার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। একজন সঙ্গে সঙ্গে বলল, আবার দেহি কান্দে।
আবারো সবাই হেসে উঠল। সময় সময় কোন কারণ ছাড়াই মানুষ খুব নির্মম হয়। মধ্যবয়স্ক ঐ ভদ্রলোক চলে গেলেন না। ভিড় থেকে তাদের বের করে আনলেন। রুবার দিকে তাকিয়ে বললেন–নাম কি?
রুবা। দিলরুবা খানম।
শোন দিলরুবা খানম–কাঁদছ কেন? কাঁদার মত ঘটনা কি ঘটল? টাকাপয়সা সঙ্গে না নিয়ে বাড়ি থেকে বের হও কেন? যাও, বাড়ি যাও।
ভদ্রলেঞ্চ লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেলেন। একবার পেছনে ফিরে তাকালেনও না। মোটা মোটা ভারিক্কি ধরনের এই মানুষটাকে ধন্যবাদ পর্যন্ত দেয়া হল না।
হাসান নিঃশব্দে এসে পর্দার ওপাশে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে নিজের পায়ের নখের দিকে। গভীর মনোযোগে নখের শোভা দেখছে হয়ত। ইলা নিজ থেকে কিছু না বললে সে চুপ করেই থাকবে। কিছুই বলবে না। অদ্ভুত ছেলে!
হাসান, তুমি অন্তুকে একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে? দেখ না ওর ঠোঁটের অবস্থা।
হাসান এক পলকের জন্যে তাকাল। তার কোন ভাবান্তুর হল না। তবে কথা বলল। মেঝের দিকে তাকিয়েই বলল, ভাবী, মনে হচ্ছে সেলাই লাগবে। আর এটি এস দিবে। কিছু হলেই ওরা এটিএস দেয়।
দাঁড়াও, তোমাকে টাকা দিয়ে দি। কত লাগবে বল তো?
বুঝতে পারছি না ভাবী, গোটা ত্রিশেক দিন।
আশ্চর্যের ব্যাপার, ভাংতি টকি ধরে নেই। কি করা যায়! ভাংতি কেন, কোন টাকাই নেই। জামানের মানিব্যাগ থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট কি দিয়ে দেবে? জামান জানতে পারলে খুব রাগ করবে। আর জানতে যে পারবে তাও নিশ্চিত। টাকা না শুনেই সে বলে দিতে পারবে–পাঁচশ টাকার একটা নোট কম।
ইলা অস্বস্তির সঙ্গে বলল, একটা পাঁচশ টাকার নোট দেব?
দিন। আমি ভাঙিয়ে নেব।
তুমি মাটির দিকে তাকিয়ে কী বলছ কেন হাসান?
হাসান জবাব দিল না। চোখ তুলে তাকালও না। ইলা তাকে পাঁচশ টাকার একটা নোট দিল। অন্তু ছোট ছোট পা ফেলে যাচ্ছে। অন্তুর পা দুটি শরীরের তুলনায় ছোট। কেমন হেলেদুলে হাঁটে, মনে হয় পড়ে যাবে।
পাঁচশ টাকার নোট মোট কতগুলি আছে? ইলার গুনে দেখতে ইচ্ছা করছে। টাকা দেখলেই সব মানুষেরই বোধহয় গুনতে ইচ্ছা করে। ইলার যা ভাগ্য, গুনার সময়ই হয়ত জামান এসে উপস্থিত হবে। থাক, গোনার দরকার নেই। আন্দাজে মনে হচ্ছে একশটার মত হবে। তার মানে পঞ্চাশ হাজার টাকা। কি সর্বনাশ! গা ঝিম ঝিম করে। এতগুলি টাকা একটা মানুষ পকেটে নিয়ে ঘুরে? যদি সত্যি সত্যি হারিয়ে যেত। ইলা টাকা গুনতে বসল। একশ বারটা পাঁচশ টাকার নোট। তার মানে ছাপান্ন হাজার। কি সর্বনাশ!