বিয়ে হয়ে চলে যাচ্ছি–আর তো দেখা হবে না। সালাম করবার জন্যে ডাকলাম।
আমি আপনার পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। ঘর ভর্তি লোকজন। আপনি অপ্রস্তুত মুখে হাসছেন। আমি বললাম, নাসিম ভাই, তুমি এমন কাঠের মত দাঁড়িয়ে আছ কেন? মাথায় হাত দিয়ে দোয়া কর। নাকি আমি এতই খারাপ মেয়ে যে আমার মাথায় যুক্তি দেয়া যাবে না?
আপনি আমার মাথায় হাত দিলেন। কি দোয়া করেছিলেন আপনি? প্রিয়জনদের দেয়া কখনো ব্যর্থ হয় না। এই পৃথিবীতে আপনার চেয়ে প্রিয়জন আমার কে আছে? আপনার দোয়া ব্যর্থ হল কেন বলুন তো?
দরজায় শব্দ হচ্ছে। ইলা দরজা খুলল। হাসন দাঁড়িয়ে আছে।
চিঠিটা কি শেষ হয়েছে ভাবী?
হ্যাঁ।
তাহলে খামের উপর ঠিকানা লিখে দিন। আমি নিয়ে যাই।
ইলা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, চিঠি দেব না। আমি মুখেই বলব। তুমি। চিন্তা করে না। একটা ব্যবস্থা হবেই।
জ্বি আচ্ছা ভাবী।
আরেকটা কথা হাসান–আমাদের পেছনের বাড়ির ফ্ল্যাটে যে ছেলে তিনটা ঢুকেছিল–তাদের তুমি দেখেছ–তাই না?
জ্বি।
তাদের তুমি চেন। অন্তত একজনকে খুব ভাল করে চেন। চেন না?
জ্বি।
পুলিশকে বল নি কেন?
সাহস নাই ভাবী।
ইলা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তোমাকে একটা মজার কথা বলি। ছেলে তিনটাকে আমিও দেখেছি। ঐদিন আমি পেছনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওরাও আমাকে দেখেছে। ওরা ঐ বাড়ি থেকে কিছু নিয়ে যায় নি। ওদের সঙ্গে টেলিভিশন সেট ছিল না।
জ্বি ভাবী আমি জানি।
আচ্ছা ঠিক আছে হাসান। তুমি যাও। আমার মাথা ধরেছে–আমি শুয়ে থাকব।
আপনার কি শরীর খারাপ ভাবী?
একটু বোধহয় খারাপ।
ডাক্তার ডেকে আনব?
না ডাক্তার লাগবে না।
ইলা দরজা বন্ধ করে চিঠির কাছে ফিরে এল। কয়েকটা লাইন বাকি আছে। সেই বাকি লাইনগুলি লিখতে ইচ্ছা করছে না। তার খুব খারাপ লাগছে। চিঠি কুচি কুচি করে ছিড়ল। ছোঁড়া টুকরোগুলি নিজের স্যুটকেসে রেখে ঘুমুতে গেল।
দুপুরে রান্না হয় নি। রান্না করতে ইচ্ছা করছে না। জামান বলে গেছে–আজ দুপুরে বাসায় খাবে তৃবু রান্নাঘরে যেতে ইচ্ছা করছে না। শরীরটা এত খারাপ লাগছে
ইলার ঘুম ভাঙল কলিং বেলের শব্দে। একটানা বেল বেজেই যাচ্ছে। বেজেই যাচ্ছে। ইলা উঠে গিয়ে দরজা খুলল–জামান দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ কঠিন। সে ইলার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে।
অনেকক্ষণ ধরে বেল বাজাচ্ছি। কি করছিলে?
ঘুমুচ্ছিলাম।
দুপুর বেলা ঘুমুচ্ছ?
আমার শরীরটা ভাল না। আমি আজ কিছু আঁখি নি। তুমি হোটেল থেকে কিছু খেয়ে এস।
তোমার ভাই এসেছিল আমার কাচ্ছে। আমার অফিসে।
ও।
কি জন্যে এসেছি জিজ্ঞেস করলে না?
কি জন্যে?
দুহাজার টাকার জন্যে এসেছিল–পুলিশকে মা-কি ঘুষ দিতে হবে। তার যে বন্ধু আছে নাসিম। বিজনেস পার্টনার। ওকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। এখন আছে লালবাগ থানা হাজতে। টাকা আমি তাকে দেই নি, কারণ আমার ধারণা তার কাছে টাকা আছে। না থাকলে কিছুদিন পরপর বোনকে টাকা দেয় কি করে? ঠিক না ইলা?
হ্যাঁ ঠিক।
নিটে হাসানের সঙ্গে দেখা হল। গায়ে নতুন শার্ট। আমাকে দেখে খুব খুশি হয়ে বলল–তুমি কিনে দিয়েছ। শার্টটার কত দাম পড়ল?
তিন শ একুশ।
এরকমই হবার কথা, বিদেশী জিনিস। ইলা, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
বল।
এখন না। এখন আমি বেরুব। জয়দেবপুর যাব। রাত এগারটার দিকে ফিরব। তখন কথা হবে।
আচ্ছা আমি হাসানকে বলব গেট খোলা রাখতে।
তুমি আমাকে বোকা ভাবলে কেন ইলা?
আমি কাউকে বোকা ভাবি না।
আমাকে ভেবেছ। তুমি ভেবেছ মানিব্যাগ চুরির ব্যাপারটা আমি কখনো ধরতে পারব না।
দুজন তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। এক সময় জামান উঠে দাঁড়াল। ইলা বলল, আজ আমি যাত্রাবাড়িতে আমার মার কাছে যাব। আজ আমার বাবার মৃত্যু বার্ষিকী। আমি ফিরে আসব। রাত এগারটার আগে অবশ্যই ফিরে আসব।
জামান বিচিত্র ভঙ্গিতে হসিল। জামানকে অবাক করে দিয়ে ইলাও তার দিকে তাকিয়ে হাসল। কেন জানি এই মানুষটাকে তার এখন আর ভয় করছে না।
হাসান গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল
হাসান গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। ইলাকে দেখে বলল, কোথায় যাচ্ছেন ভাবী?
ইলা হাসল। হাসান বলল, রিকশা ডেকে দেই?
দাও। টিটায় তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে হাসান। খুব মানিয়েছে।
হাসনি মাটির দিকে তাকিয়ে হাসল। ইলা বলল, তুমি সব সময় এমন ছোট হয়ে থাক কেন?
ছোট মানুষ ভাবী। এই জন্যেই ছোট হয়ে থাকি।
বড় মানুষ হত্যার চেষ্টা করলে কেমন হয়?
কিভাবে হব?
চেষ্টা করলেই পারবে। তোমার মত চমৎকার একটা ছেলে সারাজীবন মাথা নিচু করে থাকবে ভাবতেও খারাপ লাগে।
পরের আশ্রয়ে থাকি।
তা ঠিক। এই আমাকেই দেখ। পরের আশুয়ে আছি বলেই আমার নিজেরা মাথাটা নিচু। সারাক্ষণ ভয়ংকর আতংকের মধ্যে থাকি। সাহস গেছে নষ্ট হয়ে। এত বড় একটা ঘটনা আমি দেখলাম। ছেলে তিনটাকে বেরুতে দেখলাম–অথচ কাউকে কিছু বললাম না। ঠিক তোমার মত অবস্থ। ঠিক না হাসান?
হাসান কিছু বলল না। ইলা বলল, এই জায়গাটা কোন থানার আন্ডারে তুমি জান?
মোহাম্মদপুর থানা।
তুমি আমাকে একটা রিকশা ঠিক করে দাও। আমি প্রথম যাব মোহম্মদপুর থানায়। আমি যা জানি ওদের বলব।
এতে লাভ কিছু হবে না ভাবী।
লাভ হোক না হোক আমি বলব। অন্যের লাভের ব্যাপার না–আমার লাভ হবে। আমার সাহস নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বলার সঙ্গে সঙ্গে সাহস ফিরে পাব। তুমি বোধহয় জান না হাসান, আমি সব সময় খুব সাহসী মেয়ে ছিলাম।