ইলা স্যুটকেস বন্ধ করে উঠে গেল। চা বানাল। শপ্তি ভঙ্গিতে চা খেয়ে চিঠি লিখতে বসল। সে অনেক দিন ভেবেছে–নাসিম ভাইকে একটা চিঠি লিখবে। একটিই চিঠি। প্রথম এবং শেষ। সেই চিঠিটি আজই লেখা হোক।
ইলা নিজের স্যুটকেস খুলল। এখানে চিঠি লেখার জন্যে খুব দামী কাগজ আছে, খাম আছে। কলম আছে। কোনটাই কখনো ব্যবহার করা হয় নি। ইলা চিঠি শুরু করল খুব ঘরোয়া ভঙ্গিতে–
নাসিম ভাই,
আমার সালাম নিন। চিঠি দেখে নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন। জরুরী কারণে লিখতে বাধ্য হচ্ছি–। যে ছেলেটা চিঠি নিয়ে আপনার কাছে যাচ্ছে, সে খুব সমস্যায় আছে। আপনি তার কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন। এবং কোন একটা চাকরি বাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন। কিভাবে করবেন তা আমি জানি না। বুঝতে পারছি চিঠি এই পর্যন্ত পড়েই আপনি আমার উপর খুব রেগে গেছেন। চেঁচিয়ে বাবু ভাইকে বলছেন–ইলাটার যে মাখা খারাপ তা তো জানতাম না। আমার নিজের নেই ঠিক, আমি অন্যকে কি চাকরি দেব?
আমি জানি কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই। তাছাড়া শুনলাম–আপনারা ভাতের হোটেল দিচ্ছেন। সেখানেও তার একটা ব্যবস্থা হতে পারে। সে না হয় বাজার থেকে চাল কিনে আনবে–আপনারা দুই বন্ধু সেই চাল ফুটিয়ে ভতি করবেন–সেই ভাত বিক্রি হবে। আপনি নিশ্চয়ই রাগ করছেন। আমি ঠাট্টা করছি। আপনার সঙ্গে তে মুখোমুখি আমি কখনো ঠাট্টা করি না। আজ করলাম। তা ছাড়া–এম্নিতে আপনাকে আমি তুমি করে বলি–চিঠিতে আপনি লিখছি। প্রভেদটা কি আপনার চোখে পড়েছে?
নাসিম ভাই আজ আমার খুব কষ্টের একটা দিন। আমার বাসার কাজের ছেলেটা মারা গেছে। ওর নাম অন্তু মিয়া। একদিন ভিক্ষা করতে এসেছিল, আমি ভাত-তরকারী খেতে দিয়ে বললাম, কাজ করবি অন্তু? সে হাসতে হাসতে বলল, দ্ধে না। খেয়ে-দেয়ে চলে গেল। সন্ধ্যাবেলা একটা মাদুর নিয়ে উপস্থিত। সে থাকবে। ছেলেটা হাসপাতালে মারা গেছে। আমি তাকে দেখতেও যাই নি। আপনি হলে কি করতেন আমি জানি। হাসপাতালে ছোটাছুটি করে হৈ-চৈ করে একটা কাণ্ড ঘটাতেন। মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর–শব্দ করে কাঁদতে শুরু করতেন। চারপাশে লোক জমে যেত।
ভাইয়া একবার খাঁচা ভর্তি মুনিয়া পাখি কিনে আনল। কয়েকদিন যেতেই একটা পাখি অসুস্থ হয়ে গেল। সে অন্য পাখিগুলি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল। তার পালক ফুলে গেল। সে একা একা মৃত্যুর জন্য তৈরি হল। একটি পাখিও তাকে দেখতে আসে না। পাখিদের এই অদ্ভুত সাইকোলজিতে আমরা সবাই খুব মজা পেলাম। আপনাকে যখন বলা হল–আপনি মোটেই মজা পেলেন না। অসম্ভব দুঃখিত হলেন। অসুস্থ পাখিটাকে বাঁচাবার জন্যে আপনার সে কি চেষ্টা। দেশে পশু ডাক্তার আছে, পাখি ডাক্তার নেই বলে আপনার কি রাগারাগী। পাখিটা মারা গেল আপনার কোলে। আপনার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। রেগে অস্থির হয়ে ভাইয়াকে বললেন–গাধা তোকে কে পাখি কিনে আনতে বলেছে?
আপনি যে কি চমৎকার একজন মানুষ তা কি আপনি জানেন নাসিম ভাই? জানেন না। বাবু ভাইয়াও অসাধারণ একজন মানুষ। আপনাদের দুজনকে এক সঙ্গে দেখলে আমার কি যে ভাল লাগে।
আমি খুব সাধারণ একটি মেয়ে বলেই অসাধারণ মানুষদের অবাক হয়ে দেখি। আমি আপনাকে অবাক হয়ে দেখতাম। অসাধারণ মানুষদের স্বপ্নগুলিও খুব অসাধারণ হয়। কিন্তু আশ্চর্য আপনাদের দুজনের স্বপ্নগুলি খুবই সাধারণ। ভাতের হোটেল দেয়াতেই স্বপ্নের শেষ। অথচ আমি কত সাধারণ একটা মেয়ে, কিন্তু অসাধারণ আমার স্বপ্ন স্বপ্নটা কি আপনাকে বলি। আমি শহর থেকে অনেক দূরে বিরাট জায়গা জুড়ে একটা বাগান বাড়ি করব। সেই বাড়িতে থাকবে অসংখ্য ঘর। কিন্তু মানুষ মাত্র দুজন। বাড়ির চারদিকে ঘন বন। পেছনে বিশাল এক পুকুর। পুকুর ভর্তি জলপদ্ম। জানি না জলপদ্মের ধারণী হঠাৎ কি করে আমার মাথায় এল। এমন না যে আমি খুব কাব্যিক স্বভাবের মানুষ। হয়ত ছোটবেলায় কোন একটা গল্পের বইয়ে জলপদ্মের কথা পড়েছিলাম। কিংবা কে জানে হয়ত বাবার কাছে জলপদ্মের গল্প শুনেছি। সেটাই মাথায় ঢুকে গেছে।
আপনার কি মনে আছে, আমি একদিন আপনাকে বললাম, নাসিম ভাই আমাকে একদিন জলপদ্ম দেখিয়ে অনিবে? আপনি বিরক্ত হয়ে বললেন, জলপদ্ম আমি পাব কোথায়?
বলধা গার্ডেনের পুকুর আছে।
আমার খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই তোকে নিয়ে বলধা গার্ডেনে ঘুরে বেড়াব। যা ভাগ।
আমি কিন্তু ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকলাম। শেষ পর্যন্তু বিরক্ত হয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন। সেদিন বলধা গার্ডেন বন্ধ ছিল। আমরা ঢুকতে পারলাম না। আপনি বিরক্ত হয়ে বললেন, হল জলপদ্ম দেখা? চল এখন বাসায় ফিরি। দিনটা নষ্ট হল। এখন তো জায়গা চিনে গেলি। কাল একবার এসে দেখে যাস। ধর এই কুড়িটা টাকা রেখে দে–রিক্সা ভাড়া।
নাসিম ভাই জলপদ্ম আমার দেখা হয় নি। অলপদ্ম আমি আপনার সঙ্গে দেখতে চেয়েছিলাম। কিছু কিছু জিনিস আছে একা দেখা যায় না। দুজ্জনে মিলে দেখতে হয়।
আজ আপনাকে এসব লেখা অর্থহীন। তবু লিখলাম। যদি অন্যায় করে থাকি ক্ষমা করবেন। আমি আমার জীবনে বলতে গেলে কোন অন্যায়ই করি নি। একটা না হয় করলাম। তাতে ক্ষতি যদি কারো হয়–আপনার হবে। আপনার খানিকটা ক্ষতি হলে, হোক না।
আমার বিয়ের দিন আপনি যখন বরযাত্রী খাওয়ানো নিয়ে খুব ব্যস্ত তখন আমি রুবাকে দিয়ে আপনাকে ডেকে পাঠালাম। আমি সেজেগুজে খাটে বসে আছি। আপনি ঘরে ঢুকে আমাকে দেখে হকচকিয়ে গেলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ডেকেছিস কেন?