নাসিম মুখ ভর্তি করে ধোঁয়া ছাড়ল। মধুর ভঙ্গিতে হেসে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কয়েকবার শিস দেবারও চেষ্টা করল। পেছন থেকে কেউ কোন শব্দ করল না।
নাসিম বলেছিল নিচে তার দলবল আছে। দলবল বলতে বাবু একা। সে রাস্তার পাশের চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চিন্তিত মুখে চা খাচ্ছিল, নাসিমকে দেখে চায়ের কাপ রেখে এগিয়ে এল।
কিছু হয়েছে?
না। ভয় দেখিয়ে এসেছি।
সে কি–কি ভয় দেখালি?
কোন টেকনিকই যখন কাজ করছে না–ভয় টেকনিকটা ট্রাই করলাম।
বাবু চিন্তিত মুখে বলল, আমার মনে হচ্ছে তুই একটা ঝামেলা বাঁধিয়েছিস। টাকা উদ্ধারের আমি কোন আশা দেখছি না।
টাকা ঠিকই উদ্ধার হবে, যে অসুখের যে অষুধ। বুধবারের আগেই দেখবি টাকা-পয়সা সব দিয়ে গেছে।
বুধবার কেন?
বুধবার পর্যন্ত ওদের সময় দিয়েছি। ফোর্টি এইট আওয়ার টাইম। ধর, সিগারেট নে। তুই মুখ এমন শুকনো করে রেখেছিস কেন? ভয় পাচ্ছিস না-কি? ভয়ের কিছু নেই।
আমার তো মনে হচ্ছে ভয়ের অনেক কিছুই আছে।
তোর মত ভিতুর ডিম নিয়ে কাজ করা মুশকিল। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে ভিতুদের কোন স্থান নেই। বর্তমান কালটা হচ্ছে শরে। যে অন্যকে ভয় দেখাতে পারবে সেই টিকে থাকবে। অন্যরা পারবে না। তাদের স্থান হবে নর্দমায়।
কি বলে ওদের ভয় দেখালি?
কি কি বলেছি নিজেরো মনে নেই তবে বুড়ো এক লোক ছিল–তাঁর আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে। হাত থেকে বই পড়ে গেছে। মনে হয় লুঙ্গিও ভিজিয়ে ফেলেছে–হা হা হা। হো হো হো।
তুই হাসছিস? আমার কিন্তু ভয় লাগছে।
ভয়ের কিছু নেই।
ভয়ের কিছু নেই বাক্যটি বিকেল নাগাদ মিথ্যা প্রমাণিত হল। পুলিশ এসে বন এন্টারপ্রাইজের অফিস থেকে নাসিমকে ধরে নিয়ে গেল।
হাসান খুব অবাক
হাসান খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, ইলা অন্তুর মৃত্যু সংবদি খুব সহঞ্জভাবে গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে কোন রকম উত্তেজনা বা উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে না। হাসান ভেবেছিল ইলা জানতে চাইবে–কিভাবে মারা গেল? কখন মারা গেল? ইলা সেদিক দিয়ে গেল না। সে শুধু ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে রইল। জানতে চাইলে হাসান বিপদে পড়ত, কারণ সে নিজেও পুরোপুরি জানে না।
ভাবী, ডেডবড়ি কি নিয়ে আসব?
না। তোমার ভাই চান না। তুমি তো এ বাসার ঠিকানা হাসপাতালে দিয়ে আস। নি। তাই না?
জ্বি-না, আমি ভর্তি করবার সময় শুধু লিখেছিলাম, ঝিকাতলা, ঢাকা। ওর অবস্থা খারাপ ছিল। এত কিছু লেখার সময় ছিল না।
ঠিকানা না দিয়ে ভালই করেছ। তোমার ভাই খুশি হয়েছে।
ডেডবডি কি হাসপাতালেই থাকবে?
থাকুক, তোমার ভাই বলেছে বেওয়ারিশ লাশের জন্যে ওদের অনেক ব্যবস্থা আছে।
ভাবী, আমি তাহলে যাই?
একটু দাঁড়াও। তোমার জন্যে আমি সামান্য একটা উপহার কিনেছি। দেখ তো তোমার পছন্দ হয় কি-না।
ইলা শার্টের প্যাকেটটা হাসানের দিকে বাড়িয়ে দিল। হাসনি অবাক হয়ে প্যাকেটটা নিল।
আমি তো তোমার মাপ জানি না। অনুমানে কিনেছি। পরে দেখ হয় কি না। না হলে বলবে, তোমাকে নিয়ে গিয়ে বদলে নিয়ে আসব।
হাসান ধন্যবাদ-সূচক কিছু বলতে গেল, বলতে পারল না। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। আজ এই চমৎকার মেয়েটা এমন আচরণ করছে কেন?
ইলাকে আজ তার কাছে লাগছেও অন্য রকম। মুখ ফোলা ফোলা। চোখের নিচে কালি পড়েছে। হাসানের খুব ইচ্ছা করছে জিজ্ঞেস করে, আপনার কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করতে পারছে না।
ভাবী যাই?
আচ্ছা যাও।
হাসান গেল না। দাঁড়িয়ে রইল। ইলা বলল, কিছু বলবে হাসান?
জ্বি-না।
আমি তোমার চাকরির কথা তোমার ভাইকে কিছু বলি নি। ওকে বললে কোন লাভ হবে না। আমি অন্য একজনকে বলব। তাঁকে বললে কাজ হবে। যাকে বলব তাঁর ক্ষমতা খুবই সামান্য। তবু উনি কিছু কিছু জোগাড় করে দেবেন।
কবে কথা বলবেন?
খুব শিগগিরই বলব।
আপনি বরং একটা চিঠি লিখে দিন। আমি হাতে হাতে দিয়ে আসব। আমি এখানে আর থাকতে পারছি না ভাবী।
আচ্ছা তুমি একটু ঘুরে আস। ঘণ্টা খানিক পরে খোঁজ নিও। লিখে রাখব।
জ্বি আচ্ছা।
ইলা দরজা বন্ধ করল। সঙ্গে সঙ্গে চিঠি নিয়ে বসল না। চোখে-মুখে খানিকটা পানি দিল। রান্নাঘরে ঢুকে চায়ের পানি বসাল। চা খেতে ইচ্ছা করছে। চুলায় চায়ের পানি ফুটছে, সে গিয়ে অন্তুর বেতের স্যুটকেসটা খুলল। এই স্যুটকেসটা ইলার, সে অন্তুকে দিয়েছে। স্যুটকেস খুব সুন্দর করে গোছানো। যে সব জিনিস অন্তুর মনে ধরেছে সবই সে স্যুটকেসে তুলে রেখেছে। চায়ের একটা চামচ ভেঙে গিয়েছিল। চামচের সেই মাথা অতি যত্নে তুলে রাখা হয়েছে। জামানের জুতার ফিতা ছিঁড়ে গিয়েছিল। নতুন ফিতা কিনেছে। পুরানো ফিতা ফেলে দিয়েছিল। সেই ফেলে দেয়া ফিতাও স্যুটকেসে রাখা আছে। ইলা যে পাঁচ টাকার নোটটা দিয়েছিল সেটা একটা খামে ভরা। ইলা তার একটা ছবিও খুঁজে পেল। ছবির অর্ধেকটা ছেড়া। তার এবং জামানের পাশাপাশি বসে তোলা বিয়ের সময়কার ছবি। কোত্থেকে অন্তু পেয়েছে কে জানে। ছবির একটি অংশ সে নষ্ট করে ফেলেছে–প্রিয় অংশটি রেখে দিয়েছে।
ছেলেটার নিশ্চয়ই বাবা আছে, মা আছে, ভাইবোন আছে। মরবার সময় তাকে মরতে হয়েছে একদল অপরিচিত মানুষদের মধ্যে। ইলা পাশে থাকলে কি লাভ হত? সে কি বলতে পারত–অমিয়া শোন, এই পৃথিবী তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। এই কষ্ট তোমার প্রাপ্য ছিল না। আমি পৃথিবীর পক্ষ থেকে তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। নাও, তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে থাক। পৃথিবী ছেড়ে যাবার সময় অতি প্রিয় একজন কাউকে জড়িয়ে ধরে থাকতে হয়–