আমি বাচ্চাটাকে দেখতে যাব না?
না। খাল কেটে কুমীর আনতে হবে না।
ইলা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। জামান তার বিস্মিত দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলল, আর তুমি যদি মনে কর আমার চড় খেয়ে অন্তু মারা যাচ্ছে সেটাও ভুল কথা। চড় তাঁকে ঠিকই মেরেছিলাম। পড়ে গিয়ে ঠোঁট কেটে ফেলেছে সেটাও সত্যি। সামান্য ঠোঁট কাটা থেকে কেউ মরে যায় না। নানান অসুখ-বিসুখ এই ছেলের আগেই ছিল।
তোমার এতটুকুও খারাপ লাগছে না?
লাগছে মা কেন লাগছে। খারাপ লাগাটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি না। প্রশ্রয় দিলে যে যন্ত্রণা হবে তা সামাল দেয়া যাবে না। পেছনের ফ্ল্যাটের ব্যাপারটাই ধর। তিনটা ছেলে ঐ বাড়িতে ঢুকল। ছেলে তিনটাকে সবাই চেনে। কেউ কি বলেছে তাদের কথা? কেউ বলে নি। বলবে না।
তুমি কি বলছ কিছু বুঝতে পারছি না। ছেলে তিনটাকে সবাই চেনে মানে কি?
সবাই চেনে মানে সবাই চেনে। পালের গোদা আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে।
তোমাকে কে বলেছে?
জামান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আমি জানি। আমার কথা বিশ্বাস না হলে হাসানকে জিজ্ঞেস কর। জিজ্ঞেস না করাই ভাল। আমরা খোঁজখবর করছি এটা প্রচার হলেও অসুবিধা। আসল কথা হচ্ছে–চুপচাপ থাকতে হবে। সব সময় পর্দার আড়ালে থাকতে হবে। কেউ যেন কিছু বুঝতে না পারে। অন্তুর মরে যাওয়াটা দুঃখের ব্যাপার, কিন্তু আগ বাড়িয়ে ভালবাসা দেখাতে গেলে হবে ভয়াবহ ব্যাপার।
তুমি আমাকে যেতে দেবে না?
না।
ঠিক আছে যাব না। আমি হাসানকে বলে আসি যে যেতে পারব না। ও গিয়ে দেখে আসুক।
তুমি থাক। আমি বলে আসছি–ওরও যাবার দরকার নেই।
জামান শর্টি গায়ে দিয়ে নিচে নেমে গেল। ইলার নিজের শরীর খুব খারাপ লাগছে। গা গুলাচ্ছে। বমি আসছে। ইলা বেসিনের কাছে গিয়ে মুখ ভর্তি করে বমি করল।
জামান হাসানকে ডেকে রাস্তার কাছে নিয়ে গেছে। কথা বলছে নিচু গলায়।
কেমন আছি হাসান?
জ্বি ভাল।
তুমি অন্তুর ব্যাপারে আর খোঁজখবর করবে না।
জি আচ্ছা।
ছেলেটা মরে গেলে সবার যন্ত্রণা। তোমারও যন্ত্রণা।
তুমি কি ইলার কাছে প্রায়ই যাও? ভাবী ডাকলে যাই। টুকটাক কাজ করে দি।
এখন থেকে ডাকলেও যাবে না। ইলার এমন কিছু কাজ নেই যে তোমাকে করে দিতে হবে। যখন-তখন তার কাছে গেলে লোকজন নানান কথা বলতে পারে। টাকাটা রাখ আমাকে এক প্যাকেট সিগারেট এনে দাও। ভাংতি ফেরত দেয়ার দরকার নেই।
জ্বী আচ্ছ।
জামান দাঁড়িয়ে আছে। হাসান সিগারেট আনতে যাচ্ছে। হাঁটছে মাথা নিচু করে। জামানের মনে হল এই ছেলের জন্মই হয়েছে মাথা নিচু করে থাকার জন্যে।
বাবু দাড়ি শেভ করতে বসেছে
বাবু দাড়ি শেভ করতে বসেছে।
ব্লেডটা পুরানো কাজেই গালে সাবান লাগিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকতে হবে। দাড়িগুলিকে নরম হবার সময় দিতে হবে। সে তাই করছে। সাবান লাগিয়ে বসে আছে। রুবা দাঁত মাজতে মাজতে ভাইকে লক্ষ্য করছে।
কতক্ষণ বসে থাকবে ভাইয়া?
এই কিছুক্ষণ। দাড়ি নরম হোক।
কি বিরাট যন্ত্রণা তোমাদের, তাই না ভাইয়া?
হুঁ।
বিশেষ করে তোমার মত যাদের টাকা-পয়সা কম তাদের আরো বেশি যন্ত্রণা। এক ব্লেড যাদের এক মাস ব্যবহার করতে হয়।
বাবু জবাব দিল না। আয়না হাঁটুর উপর রেখে ব্লেড হাতে নিল। রুবা তখন খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নতুন কেনা ঝকঝকে শেভিং বাক্স তার সামনে এনে রাখিল। বাবু অবাক হয়ে বলল, ব্যাপার কি? টাকা কোথায় পেলি?
যেখান থেকেই পাই তাতে তোমার কি। দাও ব্রেড় ভরে দেই। জিনিসটা সুন্দর ভাইয়া? এই দেখ সঙ্গে ব্রাশও আছে।
বাবু বিস্মিত হয়ে বলল, এতো দামী জিনিসরে।
হুঁ দামী। দুশি পঁচিশ টাকা পড়েছে।
বলিস কি?
আপা আমাকে কিছু টাকা দিয়েছে, ঐ টাকায় কিনলাম। হা করে তাকিয়ে থাকিবে না তো? দাড়ি কাটতে শুরু কর আমি দেখি।
টাকা নষ্ট করলি? সংসারে দিলে কাজে লাগত। এতগুলি টাকা। এটা এখন ফেরত দিলে ফেরত নেবে না?
না নেবে না।
টাকাটা পানিতে ফেললি রুবা।
মোটেই পানিতে ফেলি নি। তুমি মুখটা ফেনায় ফেনায় ভর্তি কর তো ভাইয়া, আমি দেখি।
বাবু লজ্জিত মুখে ব্রাশ ঘসছে। শেভ করতে তার কেন জানি লজ্জা লজ্জা লাগছে। রেজার টানতেই গাল খানিকটা কেটে গেলে। ধবধবে সাদা ফেনার লাল রক্ত। রুবা তাকিয়ে আছে। বাবু বিব্রত মুখে বলল, বড়লোকি জিনিসে অভ্যাস নেই। এই দেখ গাল কেটে ফেলেছি।
রুবা ভাইয়ের পাশে বসল। গলা নিচু করে বলল, ভাইয়া তুমি আপাকে একদিন গিয়ে দেখে আস না কেন? তাদের নতুন ফ্ল্যাটে তুমি একদিনও যাও নি।
ইলা কি কিছু বলেছে?
না বলে নি। আপা কোনদিন কিছু বলবে না। না গেলে কষ্ট পাবে–এই পর্যন্তই।
যাব। একদিন যাব। খালি হাতে তো যাওয়া যায় না। হাতেও টাকা-পয়সা নেই। একসের মিষ্টি তো অদ্ভুত নিয়ে যাওয়া উচিত।
একসের মিষ্টির দম আমি তোমাকে দেব।
বলিস কি।
আমার কাছে টাকা আছে। ইলা আপা পাঁচশ টাকা দিয়েছে।
এত টাকা সে পেল কোথায়?
দুলাভাই দিয়েছে। এ ছাড়া আর কোথায় পাবে?
বাবুর গাল আবার খানিকটা কেটেছে। সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। এতগুলি টাকা বোনকে দিয়ে দিল, জামান জানতে পারলে অশান্তি করবে। লোকটা টাকা পয়সার ব্যাপারে খুব কৃপণ। জামানকে না জানিয়ে ইলার উচিত নয় এত টাকা এদিক-ওদিক করা। পাঁচশ টাকা অনেক টাকা, জামানের স্বভাব ভাল না। জামানের স্বভাব যে খারাপ তা বাবু ইলার বিয়ের এক সপ্তাহ পরই টের পেয়েছে। বোনকে দেখতে গিয়েছিল। ভেবেছিল যাবে আর দেখা করে চলে আসবে। ইলা কিছুতেই আসতে দেবে না। কেঁদে-টেদে এককাণ্ড–খেয়ে আসতে হবে।