আচ্ছা বলব। মাসিমকেই বলব।
তুমি এত ভাল কেন মা?
মা হিসেবে যা করার তিনি করেছেন। ইলার মাথা থেকে ভূত দূর করেছেন। তিনি যা করেছেন যে কোন মা তাই করবে। তিনি তাঁর মেয়ের সাময়িক আবেগের দিকে তাকান নি। মেয়ের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েছেন। তাঁর সূক্ষ্ম কৌশল মেয়ে ধরতে পারে নি। জামানের সঙ্গে বিয়ে ঠিকঠাক হবার পর সে আপত্তি করে নি। বিয়ে করেছে।
এখন মনে হচ্ছে ইলা তাঁর সূক্ষ্ম চাল ধরে ফেলেছে। ধরে ফেলারই কথা। ইলা বোকা মেয়ে নয়। বুদ্ধিমতী মেয়ে। সে এখন যে কষ্ট পাচ্ছে তা সাময়িক কষ্ট। স্বামীর সংসারে এক সময় মন বসে যাবে। ছেলেমেয়ে হবে। পুরানো কথা কিছুই মনে থাকবে না।
সুরমা যে কাজটি করেছিলেন তাঁর জন্যে তাঁর মনে কোন অপরাধ বোধও নেই। তিনি এমন কোন অন্যায় করেন নি। এক সন্ধ্যায় নাসিমকে গোপনে ডেকে এনে বলেছিলেন–বাবা তোমার কাছে আমি একটা অনুরোধ করব। তুমি কি রাখবে?
নাসিম হকচকিয়ে গিয়ে বলেছে–অবশ্যই রাখব খালা। আপনি একটা কথা বলবেন আমি রাখব না। তা কি করে হয়!
আমি তোমার কাছে হাত জোড় করছি বাবা।
ছিঃ ছিঃ খালা–কি করছেন আপনি।
নাসিম এসে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করল। সুরমা বললেন, তুমি কি ইলাকে ডেকে একটু বলবে যে তুমি তাকে ছোটবোনের মত দেখ।
তাই তো দেখি খালা।
আমি জানি বলেই বলছি। তুমি তাকে বল–ইলাকে তুমি ছোটবোনের মতই স্নেহ কর। তুমি চাও তার একটা ভাল বিয়ে হোক।
তা তো খালা আমি সব সময় চাই। এরকম ভাল একটা মেয়ে তার একটা ভাল বিয়ে-তো হতেই হবে। ইলার মত সুন্দর মেয়ে এই পৃথিবীতে খুব কম আছে। চার পাঁচটার বেশি না।
তাহলে বাবা তুমি ইলাকে একটু বল।
এটা বলার দরকার কি?
সুরমা খানিকক্ষণ ইতস্তুত করে বললেন, বলার দরকার আছে। তার ধারণী তুমি তাকে অন্য চোখে দেখ। এই ভেবে সে হয়ত মনে কষ্ট পায়।
নাসিম ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সুরমা বললেন, এই সব কথা তাকে বলার দরকার নেই। তুমি শুধু বল যে তুমি তাকে ছোটবোনের মৃত দেখ।
খালা আমি আল্পই বলব। ইলা গেছে কোথায়?
বাবুর সঙ্গে কোথায় যেন গেছে। তিন ভাইবোন মিলে গেছে। তুমি বরং চলে যাও। অন্য একদিন এসে বলে।
জ্বি আচ্ছা।
আর শোন বাবা। তুমি নিজেও এখন একটা বিয়ে-টিয়ে কর। আমরা দেখি।
করব খালা। একটু সামলে সুমলে উঠি তারপর। খালা আজ যাই।
সুরমা যা করেছেন নিজের মেয়ের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েই করেছেন। আজ সে তা বুঝতে পারছে না। একদিন পরিবে। আজ সে তার মাকে ক্ষমা করতে পারছে না। একদিন অবশ্যই পারবে।
সুরমা চা নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখেন ইলা চলে গেছে। কিছু বলে যায় নি। তিনি চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। রুবা রিকশা করে ফিরছে। মাকে দেখে সে খুব হাত নাড়ছে। রুবার হাতে লাল রঙের বিরাট এক বেলুন।
ইলাদের বাসার সামনের রাস্তাটা আজ অন্ধকার। আবারো বোধহয় ঢিল ছুঁড়ে স্ট্রিট ল্যাম্প ভাঙা হয়েছে। আকাশ মেঘলা বলেই চারদিক অন্ধকার। রিকশা থেকে নেমেই ইলা তাদের ফ্ল্যাটের দিকে তাকাল। ফ্ল্যাটের সবগুলি বাতি জ্বলছে। ইলার বুক ধকধক করা শুরু হয়েছে। ফ্ল্যাটের সব আলো জ্বলার অর্থ একটাই–জামান আজ সকাল সকাল ফিরেছে। তার কাছে চাবি আছে, ঘরে ঢুকেছে তালা খুলে। কতক্ষণ আগে সে এসেছে জানতে পারলে ভাল হত। হাসানকে জিজ্ঞেস করে গেলে হয়।
ইলা রিকশা ভাড়া দিল। ভয়ে ভয়ে সে এগুচ্ছে। তার হাত-পা কাঁপছে। এটা নিশ্চয়ই ভয়ংকর কোন অসুখের পূর্ব লক্ষণ। নয়ত সে এত ভয় পাবে কেন?
ভাবী?
ইলা চমকে উঠল। সিঁড়ির মুখে অন্ধকারে মিশে হাসান দাঁড়িয়ে আছে। নীল শার্টের ছোঁড়াটা হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছে। বেচারার জন্যে শার্টটা কেনা হয় নি। কাল একবার যেতে হবে।
ভাবী একটা খারাপ খবর আছে।
ইলা দাঁড়িয়ে আছে। হসান তাকে কি খারাপ খবর দিতে পারে সে বুঝতে পারছে না।
কি খবর?
অন্তুর শরীর খুবই খারাপ।
সে কি?
ডাক্তার বলছেন–বাঁচবে না। ঠোঁটের ঘা থেকে নানান সব সমস্যা হয়েছে। আজ বিকেলে দেখতে গিয়েছিলাম। আমাকে চিনতে পারল না। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
কি বলছ এসব?
ভাবী আমার মনটা খুব খারাপ হয়েছে। ছেলেটা এদিক ওদিক কাকে যেন শুধু খুঁজে। বোধহয় আপনাকে খুঁজে। আপনি কি যাবেন?
হ্যাঁ যাব।
ভাইজান এসেছেন। ভাইজানকে বললাম, উনি চান না যে আপনি যান।
তুমি এখানে থাক আমি তোমার ভাইজানের সঙ্গে কথা বলে আসি।
দরজা খোলাই ছিল। ইলা ঘরে ঢুকে দেখে জামান চা খাচ্ছে। নিজেই বানিয়েছে। শুধু চা না। পিরিচে বিসকিট আছে। ইলা সহজ গলায় বলল, কখন এসেছ?
জামান চা খেতে খেতে বলল, দুপুরে।
ইলা নিজ থেকেই বলল, আজ দুপুরে চলে আসবে তা তো বলে যাও নি। বলে গেলে ঘরে থাকতাম। দুপুরে খেয়েছ?
কোথায় খেয়েছ? বাসায় না বাইরে?
বাইরে।
ঘরে খাবার তৈরি ছিল। ফ্রীজে রেখে দিয়েছিলাম।
জামান কিছু বলল না। সে নিঃশব্দে চা খাচ্ছে। সে যে ইলার উপর খুব রেগে আছে তা মনে হচ্ছে না। ইলী বলল, অপুর শরীর খুব খারাপ ত কি তোমাকে হাসান বলেছে?
হ্যাঁ বলেছে।
আমি ওকে একটু দেখে আসব। হাসান নিচে আছে ও আমাকে নিয়ে যাবে।
বস অমিরা সামনে।
ইলা বসল। জামান চায়ের কাপ নামিয়ে শান্তু গলায় বলল, দেখতে যাবার কোন দরকার নেই। যদি সত্যি সত্যি মরে যায় নানান যন্ত্রণা হবে। ডেডবড়ি নিয়ে সমস্যা হবে। পত্রপত্রিকায় লেখা হবে। কি দরকার।