ব্যাপারটা শুরু হয় এই ভাবে। তিনি বছর দুই আগে ভয়ংকর আতংক নিয়ে লক্ষ্য করেন নাসিম এ বাড়িতে এলেই তার বড় মেয়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। ফেল করা আই এ, পসি এক ছেলে। যার বাবা মোটর মেকানিক। কিছুদিন পরপর বিয়ে করা যার প্রধান হবিগুলির একটি। যার সর্বশেষ বিয়েটি হল জনৈক রিকশাওয়লার টৌদ্দ বছরের সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে। ইলার রুচি এত নিচে কি করে নামে তিনি ভেবে পান না। তাঁর এম. এ. ক্লাসে পড়া মেয়ে কেন নাসিম নামের রাস্তার একটা ছেলের গলার স্বর শুনলে আনন্দে ঝলমল করে উঠে? কি আছে এই ছেলের? যেমন তার ভাঁড়ের মত চেহারা ঠিক তেমনি ভাঁড়ের মত আচার-আচরণ। হো হো করে হাসা ছাড়া এই ছেলে আর কি পারে। তার কোন কাজটা স্বাভাবিক। একদিন সন্ধ্যায় রিকশায় করে একটা স্যুটকেস, একটা ট্রাংক নিয়ে উপস্থিত। দাঁত বের করে বলল, কয়েকটা দিনের জন্যে আশ্রয় দিতে হয় খালা। বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। ভদ্রভাবে বের করে নি, স্পঞ্জ পেটা করেছে।
রুবা বলল, স্পঞ্জ পেটাটি কি?
জুতা পেটার চেয়েও নিম্নমানের। স্পঞ্জ স্যান্ডেল নিয়ে তাড়া করেছে …
কেন?
কে জানে কেন? রাত বারটার সময় মদফদ খেয়ে বাসায় ফিরেছে। ঐ জিনিস খেলে পিতাজীর মেজাজ থাকে খারাপ। নতুন মার সঙ্গে বোধহয় হয়েছে গণ্ডগোল। রাগ ঝাড়ার লোক পায় নি। আমাকে পেয়েছে। স্পঞ্জের স্যাঙুেল নিয়ে তাড়া করেছে। হা হা হা।
সুরমা বললেন, হাসছ কেন? এর মধ্যে হাসির কি আছে?
ব্যাপারটা খুবই হাসির ছিল খালা। আপনি দেখেন নি তো, তাই বুঝতে পারেন। নি। দেখলে বুঝতেন। বাবা আমার পিছনে পিছনে ছুটছে। ভয় পেয়ে আমার হয় বেনি ছুটছে দুদিকে। নতুন মা ছুটছে আরেক দিকে। ভয়াবহ অবস্থা। এর মধ্যে আমার নতুন মা আবার আছাড় খেয়ে পড়ে গেল। নতুন মার অবস্থা খেকে বাবার মন দুঃখে নরম হয়ে গেল। স্যান্ডেল হাতে মার দিকে ছুটে গেলেন। কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন–ব্যথা লাগছে ময়না?
গল্প শুনে সুরমার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল আর হেসে ভেঙে পড়ছে তাঁর বড় মেয়ে! তার এত আনন্দ?
ইলা বলল, নাসিম ভাই তুমি আমাদের সঙ্গে কতদিন থাকবে?
যতদিন থাকতে দিস ততদিন।
সারক্ষীবন থাকতে হবে। আমরা তোমাকে যেতে দেব না।
ইলার কথা শুনে সুরমার গা হিম হয়ে গিয়েছিল। মেয়ে কি বুঝতে পারছে সে কি সর্বনাশা কথাবার্তা বলছে। এই বুদ্ধি কি মেয়ের আছে? মেয়ের যে এই বুদ্ধি নেই তা পুরোপুরি বুঝতে তাঁর দেরি হল না। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ইলার বিয়ে নিয়ে। যাকে পান তাকেই বলেন। অনেকে আগ্রহী হয়ে আসে। মেয়ে দেখে খুশি হয়। খুশি নাহার কোন কারণ নেই। কথাবার্তা অনেকদূর এগিয়ে ভেঙে যায়। আজকাল শুধু রূপে বিয়ে হয় না। রূপের সঙ্গে আরো অনেক কিছু লাগে। সেই অনেক কিছু তার নেই। তিনি লক্ষ্য করেন যতবার বিয়ে ভাঙে ততবারই আনন্দের আভা দেখা যায় ইলার চোখেমুখে। যেন খুব সুখের কোন ঘটনা ঘটেছে। সুরমা নিজেকে বুঝিয়েছেন–এটা আর কিছুই না–ভুনি। মেয়ে অভিনয় করছে। বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া যে কোন মেয়ের জন্যেই ভয়াবহ অপমানের ঘটনা।
সুরমার ধারণা যে ঠিক না তার প্রমাণ পেলেন এক রাতে। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়েছেন। শরীর ভাল না। গভীর রাতে দরজায় ধাক্কা পড়ল। ইলা চাপা গলায় ডাকল, মা। একটু দরজা খোল।
তিনি বিস্মিত হয়ে বিছানা ছেড়ে নামলেন। বাতি জ্বালালেন, দরজা খুললেন। ইলা দাঁড়িয়ে আছে। তার এতদিনের চেনা মেয়েকে তিনি চিনতে পারছেন না। যেন অন্য কোন মেয়ে। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে অদ্ভুত ভঙ্গিতে। থরথর করে কাঁপছে। তিনি বললেন, কি হয়েছে রে?
তোমার সঙ্গে কথা বলব।
আয় ভেতরে আয়। তোর কি শরীর খারাপ?
না। শরীর খারাপ না, শরীর ভাল। বাতি নেভাও মা।
বাতি নিভাতে হবে কেন?
আলো জ্বালা থাকলে কথা বলতে পারব না।
সুরমার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। ইলা কি বলবে তিনি বুঝতে পারছেন। সেই
কথা শোনার মত সাহস তাঁর নেই।
বল কি বলবি।
আমার বিয়ে নিয়ে তুমি যে চরিদিকে ছোটাছুটি করছ তার দরকার নেই মা।
দরকার নেই কেন?
আমি আমার নিজের পছন্দমত একটা ছেলেকে বিয়ে করব।
আছে এ রকম কেউ?
ইলা জবাব দিল না। সুরমা ইলার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনলেন। তিনি শান্তু গলায় বললেন, সেই ছেলেটা কি নাসিম? ইলার কান্নার শব্দ বাড়ল। এবারো জবাব দিল না।
সুরমা বললেন, তুই যে মাসিমকে বিয়ে করতে চাস তা কি সে জানে?
না জানে না।
কিছুই জানে না?
না।
তুই তাকে চিঠিফিঠি কিছু দিয়েছিস?
না।
আমার গা ছুঁয়ে বল।
গা ছুঁয়ে কিছু বলতে হবে না মা। নাসিম ভাই কিছুই জানে না।
তুই শুয়ে থাক বিছানায় আমি তোর গায়ে হাত বুলিয়ে দি।
ইলা বাধ্য মেয়ের মত শুয়ে পড়ল। তিনি মেয়ের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে ক্ষীণ গলায় বললেন, তুই আমাকে বললি কেন? তুই নিজে কেন তোর কথা তাকে বললি না।
আমার লজ্জা লাগল। আমার মনে হচ্ছিল–আমার কথা শুনে উনি হো হো করে হেসে ফেলবেন। সবার সামনে আমাকে ক্ষ্যাপাবেন।
ইলা ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। সুরমা বললেন, কাঁদিস না–যা বলার আমি বলব।
কবে বলবে?
কালই বলব।
নাসিম ভাইকে বলবে?
না তাকে প্রথমে বলব না। আগে তার বাবার সঙ্গে কথা বলব। তুই কাঁদিস না।
ইলা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, তার বাবার সঙ্গে কথা বলতে হবে না। তুমি তাকেই বল।