সুরমা কঠিন গলায় বললেন, বলে বিরটি অন্যায় করেছি–এখন আমাকে কি করতে হবে। পা ধরে ক্ষমা চাইতে হবে?
তোমার বিরক্তি মেজাজ হয়েছে মা। মনে হয় ব্লাড প্রেসার আরো নেমে গেছে। দুধ-ডিম কি তুমি ঠিকমত খাচ্ছ?
সুরমা কিছু বললেন না। মা এবং মেয়ে দুজন দুজনের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। সুরমাই প্রথম চোখ নামিয়ে নিলেন। ইলা হাসিমুখে বলল, চোখে চোখে তাকিয়ে থাকার প্রতিযোগিতায় তুমি কখনো জিততে পার না মা। তুমি সব সময় হেরে যাও। কোনদিন পারবে না।
এটা কি ধরনের কথা?
ইলা হেসে ভাত খাওয়া শুরু করল। খাওয়া শেষ করে সহজ ভঙ্গিতে বলল, ঘরে পান আছে মা? একটা দাও তো।
সুরমা পান এনে দিলেন। ইলা বলল, আমি খানিকক্ষণ ঘুমুব মা। তুমি আমাকে ঠিক পাঁচটার সময় ঢেকে দেবে।
আমার ঘরে ঘুমুবি? ঐ ঘরটায় আলো আসে না। আরাম করে ঘুমুতে পারবি। রুবার খরে রোদ আসে।
আমার ঘরটা এখন হয়েছে রুবার ঘর?
বিয়ের পর–স্বামীর ঘরই ঘর। আর কোন ঘর–ঘর না।
জামানের সঙ্গে তোমার মিল আছে মা। জামানও এই ভাবে কথা বলে।
সুরমা স্তম্ভিত হয়ে বললেন, জামান জামান করছিস কি রে?
কি বলব? জামান সাহেব? নাকি মিস্টার জামান?
সুরমা কিছু বললেন না। ইলা হাসিমুখে বলল, তুমি আমাকে খুব ভয় পাও–তাই না মা? সুরমা ক্ষীণ গলায় বললেন, বিয়ের পর তুই কি রকম পাগলাটে হয়ে গেছিস। আমি তোকে ভয় পাব কেন?
ভয় পাও না, তাহলে এমন ফিসফিস করে কথা বলছ কেন?
সুরমা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। ইলা রুবার ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। শুধু দরজা না, জানালাও বন্ধ করল। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেল।
পাঁচটায় ইলাকে ডেকে তোলার কথা। সুরমা জেগে বসে রইলেন। ঠিক পাঁচটায় দরজা ধাক্কা দিতেই ভেতর থেকে ইলা বলল, ধাক্কাধাক্কি করবে না তো মা। আমার এখনো ঘুম আসে নি। তোমাকে ডাকতে হবে না। আমি নিজেই উঠব।
দিন খুব খারাপ করেছে ইলা। ঝড়বৃষ্টি হবে।
হোক।
সন্ধ্যা হয়ে গেলে তোর বাসায় যাবি কিভাবে? বাবু রাত দশট-এগারটার আগে বাসায় ফেরে না! তোকে দিয়ে আসবে কে?
আমাকে দিয়ে আসতে হবে না। আমি এখানেই থাকব। তুমি আর বিরক্ত করো না তো মা। আমি এখন ঘুমুব।
ইলার ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার আগে আগে। রুবা ফেরে নি। ঘরে সুরমা একা। তাঁর মনে হচ্ছে রুবার কোন একটা সমস্যা হয়েছে। হয়ত লঞ্চ ডুবে গেছে। কিংবা লঞ্চের উপর ছোটাছুটি করতে গিয়ে পা পিছলে রুবা পানিতে পড়ে গেছে। রুবা সাঁতার জানে না।
সুরমা তাঁর মনের অস্থিরতা কিছুতেই কমাতে পারছেন না। বাবুও বাসায় নেই, কাকে তিনি কি বলবেন? ইলার ঘুম ভাঙতে তিনি ব্যাকুল গলায় বললেন, রুবা তো এখনো ফিরল না। বলে গিয়েছিল চারটার সময় ফিরবে।
ইলা হাই তুলতে তুলতে বলল, পিকনিক-টিকনিকে গেলে খানিকটা দেরি হয়। এসে যাবে।
তোর দুশ্চিন্তা লাগছে না?
না।
ইলা চুল আঁচড়াল। শাড়ি ঠিকঠাক করে, হ্যান্ডব্যাগ হাতে নিয়ে বলল, যাই মা।
চলে যাচ্ছিস?
হুঁ।
তুই না বলেছিলি থাকবি।
থাকব না। ভাল লাগছে না। জামান সাহেব যদি কোন কারণে আজ আগেভাগে এসে পড়েন তাহলে তালাবন্ধ বাসা দেখে কি করবেন কিছুই বলা যায় না। আমাকে হয়ত কেটে কুচিকুচি করে তেল মসলা দিয়ে রান্না করে খেয়ে ফেলবেন।
সুরমা স্তম্ভিত গলায় বললেন, তোর কি মাখাটাথা খারাপ হয়ে গেছে?
ইলা হুসিল। সুন্দর করে হাসল। সেই হাসি দেখে সুরমা ভরসা পেলেন। আদুরে গলায় বললেন, থেকে যা না। রাতে বাবু ফিরলে তোকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। জামাইকে বুঝিয়ে বলবে।
বুঝিয়ে কি বলবে?
বলবে–রুবা বাসায় ফিরছিল না, আমি ভয়ে অস্থির হয়ে কান্নাকাটি করছিলাম। আমাকে সামাল দেবার জন্যে তুই থেকে গেছিস। তুই থাকতে চাচ্ছিলি না–আমিই জোর করে রেখে দিয়েছি …।
মা তুমি তো খুব গুছিয়ে মিথ্যা কথা বলতে পার।
সুরমার মুখ কালো হয়ে গেল। ইলা বলল, মা আমি যাচ্ছি। রুবাকে নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা করবে না। ও আমার মত বোকা মেয়ে না–ধর, যদি লঞ্চ ডুবেই যায়, সে ঠিক সাঁতরে পারে উঠে আসবে। সে সাঁতার জানে না। তারপরেও কোন না কোনভাবে ঠিকই ম্যানেজ করবে।
সুরমা বললেন, আমার উপর তৈীর এত রাগ কেন রে ইলা?
তোমার উপর আমার এত রাগ কেন তা তুমি ভাল করেই জান মা।
আমি যা করেছি, তোর ভালর জন্যেই করেছি।
ভালর জন্যে করেছ?।
হ্যাঁ। আজ তুই বুঝতে পারছিস না। একদিন বুঝতে পারবি।
সেই একদিনটা কবে?
যেদিন তোর বড় মেয়ের বিয়ের বয়স হবে সেদিন। আজ আমি যা করেছি সেদিন তুইও ঠিক তাই করবি।
ইলা আবার হাসিল। সুরমা এগিয়ে এসে মেয়ের হাত ধরলেন। ইলা বলল, হতি ছুড়ি মা। মসলা পিষে পিষে তোমার হাতে কড়া পড়ে গেছে। আমার ব্যথা লাগছে। সুরমা হাত ছড়িলেন না। কোমল গলায় বললেন–বোস। একটু বেসি। কেতলি চুলায় দিয়ে এসেছি। পানি ফুটছে। চা খেয়ে যা। তোর সঙ্গে খাব বলে আমিও চা খাই নি।
ঠিক আছে মা, বসছি। যাও, চা বানিয়ে আন।
চা বানাতে বানাতে সুরমা ঠিক করে ফেললেন–ইলাকে গুছিয়ে কথাগুলি কি করে বলবেন। অসংখ্যবার তিনি নিজের মনে কথাগুলি গুছিয়ে রেখেছেন। কখনো বলতে পারেন নি। আজ হয়ত বলতে পারবেন।
এক বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তিনি মা হিসেবে সেই পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। তিনি যেভাবে পরিস্থিতি সামলেছেন–অন্য মায়েরাও ঠিক একইভাবে পরিস্থিতি সমিলাবেন। তিনি কোন ভুল করেন নি। এই ব্যাপারটা ইলাকে বোঝাতে হবে। ইলা অবুঝ নয়। সে বুঝবে।