একটু আগে না বললে ভাইয়ার জ্বর, রোগী দেখতে যাচ্ছি। যাকে দেখার জন্যে যাচ্ছ সে-ই তোমাকে পৌঁছে দেবে এটা কেমন কথা। যা বলরে লজিক ঠিক রেখে বলবে।
জামান উঠে দাঁড়াল। বিরক্তমুখে বলল, অপুর ঠোঁট বোধহয় কেটে গেছে। ঘরে ডেটল আছে। ডেটল লাগিয়ে দিও আমি চললাম। দরজা ভাল করে বন্ধ কর।
অন্তুর ঠোঁট ভয়াবহভাবে কেটেছে। দুভাগ হয়ে গেছে। রক্তে তার শার্ট ভিজেছে। যেখানে বসে আছে সেই মেঝে ভিজেছে। রক্ত এখনো বন্ধ হয় নি। চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। সমস্ত মুখ ফুলে চোখ দুটা ছোট ছোট হয়ে গেছে। অন্তুকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। ইলা হতভম্ব হয়ে গেল।
ঠোঁট কাটল কিভাবে? পড়ে গিয়েছিলি?
হুঁ।
কিভাবে ঠোঁট কাটল?
অন্তু জবাব দিল না। এতক্ষণ সে কাঁদে নি। এইবার কাঁদতে শুরু করেছে। এ বাড়ির পুরুষ মানুষটাকে সে যমের মত ভয় পায়। তার সম্পর্কে নালিশ করতে ভয় লাগে বলে সে নালিশও করছে না। নয়ত বলত, চড় খেয়ে মেঝেতে পড়ে গিয়ে ঠোঁট কেটে গেছে।
ব্যথা করছে অল্প?
হুঁ।
খুব বেশি?
হুঁ।
চুপ করে বসে থাক। তোকে এক্ষুণি ডাক্তারের কাছে পাঠাব। এই কাপড়টা ঠোঁটের উপর চেপে ধরে রাখ তো। রক্ত বন্ধ হোক। আমি বাড়িওয়ালার ভাগ্নেটাকে ডেকে নিয়ে আসি।
চিন্তিত মুখে ইলা বসার ঘরে ঢুকল। সে ভেবে পাচ্ছে না, দরজা খোলা রেখে সে নিজেই একতলায় যাবে, না অন্তুকে পাঠাবে। অন্তুর যে অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে না সে একা একা নিচে যেতে পারবে। কিন্তু দরজা খোলা রেখে সে-ই বা যাবে কিভাবে? অন্তু এখন কাঁদছে শব্দ করে। ইলার মনটাই খারাপ হয়ে গেলি। আট নবছরের বাচ্চা একটা ছেলে। এরকম ব্যথা পেলে তার মা তাকে কোলে নিয়ে হাঁটত।
অন্তু মিয়া।
হুঁ।
দরজা বন্ধ করে বসে থাক, আমি নিচ থেকে আসি। যাব আর আসব। মুখ থেকে কাপড়টা সরা তো–দেখি রক্ত বন্ধ হয়েছে কি না।
রক্ত বন্ধ হয় নি। ক্ষীণ ধারায় এখনো পড়ছে। অন্তু মাঝে মাঝে জিভ বের করে রক্ত চেটে চেটে দেখছে। ইলা বলল, রক্ত চেটে খাচ্ছিস কেনরে গাধা? রক্ত কি খাবার জিনিস? ইলা চিন্তিত মুখে নিচে গেল। হাসানকে পাওয়া গেল না। বাড়িওয়ালার স্ত্রী সুলতানা বললেন, গাধাটাকে এক কেজি চিনি আনতে বলেছিলাম। চল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে, ফেরার নাম নেই। কখন হুজুরের ফিরতে মর্জি হবে কে জানে? আসুক, আসলে পাঠায়ে দিব।
ইলা বলল, খালা, গেটটা আজ একটু খোলা রাখতে হবে। ও জয়দেবপুর গেছে, ফিরতে রাত হবে।
হাসানকে বলে দিও। গেটের চাবি তার কাছে থাকে। আর তোমাকেও একটা কথা বলি, দিনকাল খারাপ–তোমার বয়স অল্প। একা একা থাক–এটা ঠিক না। কখন কি ঘটে যায়। পিছনের বাড়ির টেলিভিশন নিয়ে গেছে বলে যা শুনেছ সব ভুয়া। রেপ কেইস। তিনটা ছেলে ঢুকেছে। ঢুকেছে ১২ টার সময়, গেছে তিনটায়। কতক্ষণ হল? তিন ঘণ্টা। একেক জনের ভাগে এক ঘণ্টা। বুঝতে পারলে? সুলতানা চোখ ছোট করে রহস্যময় ইংগিত করলেন। ইলা চমকে উঠল–এমন কুশ্রী ইংগিত এমনভাবে কেউ করে?
খালা, আমি যাই।
আহা দাঁড়াও না। বিস্তারিত শুনে যাও। এরা আসল ঘটনা চাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। চাপা দিলেই কি চাপা দেয়া যায়। বলে কি টেলিভিশন নিয়ে গেছে। টেলিভিশন নিয়ে গেলে বাড়িতে ডাক্তার আনা লাগে? ঐ বাড়িতে দুনিয়ার আত্মীয়স্বজন এসে উপস্থিত হয়েছে। মরাকান্না। ব্ল্যাক এণ্ড হোয়াইট টেলিভিশন এমন কি জিনিস যে গুষ্টিসুন্ধা মরাকান্না কাঁদবে। তুমি আমাকে বল।
খালা, অন্তু একা আছে। আমি যাই।
যাই যাই করছ কেন? ঘটনা শুনে যাও–মেয়েটার হাসবেন্ডকে দেখলাম দুজনে ধরাধরি করে বেবিটেক্সিতে তুলল। একটা টেলিভিশন নিয়ে গেলে এই অবস্থা হয়। তুমিই বল। আমি কি ভুল বললাম?
জ্বি-না।
তোমার বয়স কম। নতুন বিয়ে। খুব সাবধানে থাকবে। পারতপক্ষে বারান্দায় যাবে না। তোমার আবার বিশ্রী স্বত্ব বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করা। এইসব রেপিস্টদের নতুন বিয়ে হওয়া মেয়েগুলির দিকে নজর থাকে বেশি–সাবধান। খুব সাবধান–। চা খাবে?
জ্বি-না।
খাও না।
আরেকদিন এসে খেয়ে যাব।
আসবে–নিজের বাড়ি মনে করে আসবে। বাড়িওয়ালা-ভাড়াটে সম্পর্ক আমার না। আমার বাড়িতে যে এসে উঠবে–সে আমার আপনা মানুষ। তার ভাল আমার ভালমন্দ। মাসের শেষে টাকা নিয়ে দায়িত্ব শেষ–এই জিনিস আমাকে দিয়ে হবে না। সবাইকে দিয়ে সব জিনিস হয় না।
সুলতানা হাঁপাতে লাগলেন। শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমে যাওয়ায় একনাগাড়ে বেশিক্ষণ কথা বলতে কষ্ট হয়। কষ্ট হলেও তিনি কথা বলেন। ধর্ষণ জাতীয় খবরে তিনি বড় মজ্জা পান। এইসব খবর আগে শুধু কাগজে পড়তেন। এখন বাড়ির কাছে ঘটে যাওয়ায় বড় ভাল লাগছে।
ইলা আবার বলল, আসি খালা। বলে আর দাঁড়াল না। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল। সুলতানা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। ইলা মেয়েটা অতিরিক্ত রকমের সুন্দর। তাঁর বড় ছেলের জন্যে তিনি অনেকদিন ধরে একটা সুন্দর মেয়ে খুঁজছেন। পাচ্ছেন না। সুন্দর মেয়েগুলি গেল কোথায়? যে কটাকে পাওয়া যায় সব কটার বিয়ে হওয়া। মায়ের পেট ঘেঁকে পড়েই এরা বিয়ে করে ফেলে না-কি? কোন মানে হয়?
আশ্চর্য, অন্তুর ঠোঁট থেকে এখনো রক্ত পড়ছে।
অন্তু, বেশি ব্যথা করছে?
হুঁ।
হাসান এসেই তোকে নিয়ে যাবে। এক্ষুণি আসবে, খবর দিয়ে এসেছি। শুয়ে থাকবি খানিকক্ষণ? বিছানা করে দেই?
অন্তু ঘাড় কাত করল। এবং কেন জানি প্রবল কষ্টের মধ্যেও হাসার চেষ্টা করল। অন্তুর বিছানা বলতে ভাঁজ করা একটা মাদুর। একটা বালিশ পর্যন্তু ছেলেটার নেই। ইলা জামানকে একবার বলেছিল, একটা বালিশ নিয়ে এসো। বেচারা বালিশ ছাড়া ঘুমায়। জামান গম্ভীর গলায় বলেছে–এদের বালিশ দরকার হয় না। খামোকা বড়লোকি শেখাতে হবে না। ইলা ঠিক করে রেখে এবার মার বাসায় গেলে একটা বালিশ আর একটা কাঁথা নিয়ে আসবে।