কেন?
আমি তাদের পছন্দ করি না।
তারা কি করেছে?
এত ইতিহাস বলতে পারব না। পছন্দ করি না। করি না। চাই না এদের সঙ্গে কোন রকম যোগাযোগ থাকুক।
জামানের বড় বোনকে ইলার অবশ্যি বেশ পছন্দ হয়েছিল। মোটামুটি মানুষ। চোখমুখে ভীত ভীত ভাব। অকারণেই চমকে উঠছেন। তিনি ইলাকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, আমি ভূতের গলিতে থাকি। ভূতের গলিতে ঢুকেই একটা ওষুধের দোকান–ডেল্টা ফার্মেসী। ফার্মেসীর উল্টো দিকে তিনতলা বাড়ির দোতলায় থাকি। মনে থাকবে?
থাকবে।
ফার্মেসীটার নাম কি বল তো?
ডেল্টা ফার্মেসী।
তুমি আসবে তো?
আসব।
জামানকে না জানিয়ে আসবে। জামানকে বললে সে আসতে দেবে না। অকারণে রাগ করবে। কি দরকার?
ইলার বিয়ের সময় জামানের বড় বোন ছাড়াও বাজিতপুর থেকে জামানদের অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছিলেন। জামানের বাবা এসেছিলেন। ভদ্রলোকের চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। হাত ধরে ধরে চলাফেরা করতে হয়। জামান তাঁকে বলল, আপনি কি জন্যে এসেছেন? তিনি থতমত খেয়ে বললেন–বিবাহ দেখতে আসলাম।
আপনি তো চোখেই দেখেন না। বিবাহু দেখবেন কি? খামোকা বাজে ঝামেলা করেন। আসা যাওয়ার খরচ আছে না? যাওয়ার সময়ও তো ভাড়া দিতে হবে। হবে না?
হবে।
তাহলে? এতগুলা মানুষ নিয়ে এসেছেন। থাকবেন কোথায়?
তোমার এইখানে থাকব। আর যাব কই?
দুই রুমের ফ্ল্যাট–থাকবেন বললেই তো হয় না। এ রকম উল্টাপাল্টা কাজ আর করবেন না। আপনি থাকতে চান খান–অন্যদের আমি হোটেলে দিয়ে আসব।
তাহলে আমাকেও হোটেলে দিয়ে আস। সবাই এক সঙ্গে থাকি।
সেটাও মন্দ না।
জামানের বাবা হোটেল থেকেই বাড়ি চলে গেলেন। প্রতি পনের দিন পরপর চিঠি লেখেন। জামান সেই সব চিঠির বেশির ভাগই পড়ে না। হাতে চিঠি দিলে হাই তুলে বলে–ফেলে দাও। কি লেখা আমি জানি–আমি ভাল আছি, তুমি কেমন আছ? গত সপ্তাহে মনি অর্ডার পাইয়াছি। টাকার পরিমাণ আরো কিছু বাড়াও–দ্রব্যমূল্য অত্যধিক বৃদ্ধি পাইয়াছে … ইলা কিছু কিছু চিঠি পড়েছে। আসলেই তাই। চিঠিগুলিতে টাকা-পয়সী ছুড়ি অন্য কোন কিছুরই উল্লেখ নেই।
ইলা প্রথম গেল বায়তুল মুকাররাম, সেখান থেকে রিক্সা করে নিউ মার্কেট। নিউ মার্কেট থেকে বেবিটেক্সি নিয়ে কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ। সেখানে সুন্দর একটা শপিং সেন্টার না-কি হয়েছে। সে কিছুই কিনল না। ঘুরে ঘুরে বেড়াল। ঐ শপিং সেন্টারে একটা বাচ্চা মেয়ে এক প্যাকেট চকলেট কেনার জন্যে খুব চাপাচাপি করছিল। মা কিছুতেই কিনে দেবে না। ইলা এগিয়ে গিয়ে বলল, আমি কিনে দিলে আপনি কি রাগ করবেন? মেয়েটির মা অবাক হয়ে বললেন, আপনি কিনে দেবেন কেন? সে কি!
যদি আপনি অনুমতি দেন তবেই কিনতে পারি, প্লীজ।
চকলেটের টিনটা কিনতে চারশ টাকা চলে গেল। টাকাটা দেবার সময় ইলার বুক খানিকক্ষণ খচখচ করল। এতগুলি টাকা! সেই খচখচ ভাব স্থায়ী হল না। বাচ্চা মেয়েটি চকলেটের টিন হাতে লাফাচ্ছে। দেখতে ভাল লাগছে। ভদ্রমহিলা বললেন, আন্টিকে স্নামালিকুম দাও। বল–চকলেটের জন্যে ধন্যবাদ।
মেয়েটি কোন কিছু বলাবলির ধার দিয়ে গেল না। সে সমানে লাফাচ্ছে।
ইলা যাত্রাবাড়িতে উপস্থিত হল একটার দিকে। সুরমা দরজা খুলে দিলেন। ইলা হাসিমুখে বলল, কেমন আছি মা? রান্না হয়েছে? প্রচণ্ড খিদে। ভাত খাব। বাসা খালি কেন? কেউ নেই?
না।
গেল কোথায়?
সুরমা বিরক্ত গলায় বললেন, দুপুর বেলায় কেউ বাসায় থাকে না-কি? রুবা গেছে পিকনিকে। লঞ্চে করে মানিকগঞ্জ যাবে। আবার ফিরে আসবে।
ভাইয়া? ভাইয়া কোথায়?
জানি না কোথায়। বাউণ্ডুলেটার সঙ্গে কোথায় কোথায় যেন ঘুরছে। ছোঁড়াটি। বাবুর মাথা খেয়েছে। এখন বলছে ভাতের হোটেল দিবে। বাবু তাতেই লাফাচ্ছে।
তুমি মনে হয় খুব রাগ করছ।
রাগ করব না? ভদ্রলোকের ছেলে ভাতের হোটেল দেবে কেন?
ইলা হাসিমুখে বলল, লোকের ছেলেরা দেবে পোলাওয়ের হোটেল।
সুরমা বিরক্ত গলায় বললেন, সব কিছু নিয়ে হাসবি না। এটা কোন হাসিঠাট্টার বিষয় না। হাতমুখ ধুয়ে আয়। ভাত বাড়ি।
ভাত খাব না মা। এখন চলে যাব।
একটু আগে না বললি খাবি।
এখন বলছি–খাব না। কারণ একটা জরুরী কাজ বাকি আছে।
জরুরী কাজটা কি?
তোমাকে বলা যাবে না।
ভূতি খেয়ে যা। কতক্ষণ লাগবে ভাত খেতে?
একবার তো মা বললাম, খাব না। কেন বিরক্ত করছ?
সুরমা বিস্মিত হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ইলা বাথরুমে ঢুকল। অনেক সময় নিয়ে গোসল করল, বের হয়ে এল হাসিমুখে।
ভাত দাও মা।
সুরমা ভাত বাড়লেন। তিনি আগ বাড়িয়ে আর কোন কথাবার্তায় গেলেন না। খাবার আয়োজন খুবই নগণ্য। ডুলি, বেগুন ভর্তা, ভাত। ইলার জন্যে একটা ডিম ভাজা করা হয়েছে। খেতে খেতে ইলা বলল, ভাইয়ার ব্যবসা মনে হয় জলে ভেসে গেছে। সুরমা তিক্ত গলায় বললেন, সঙ্গ দোষে ওর সব গেছে। ছোটলোকটা মাথার মধ্যে একেক বার একেকটা জিনিস ঢোকায়–বাবু লাফায়। আরে গাধা, তোর নিজের বুদ্ধিশুদ্ধি নেই।
ছোটলোক কাকে বলছ মা, নাসিম ভাইকে?
আর কাকে বলব!
আমরা কি বড়লোক?
সুরমা বিরক্ত গলায় বললেন, তুই কি এর মধ্যে প্যাঁচ ধরছিস নাকি? তোদের সঙ্গে তো কথাবার্তা বলাই মুশকিল। রাগের মাথায় ছোটলোক বলেছি।
কোন সময়ই এটা বলা উচিত না মা। কারণ তুমি ভাল করেই জান নাসিম ভাইকে শুধু ভাইয়া না, আমি, রুবা, আমরা দুজনই খুব পছন্দ করি। আমাদের খুব পছন্দের একজন মানুষকে তুমি কথায় কথায় ছোটলোক বলতে পার না।