ওর আত্মীয়স্বজনদের কোন খবর দেয়া দরকার না?
পাগলের মত কি সব কথা যে তুমি বল। ওর আত্মীয়স্বজন আমি পাব কোথায়? এদের কি কোন ঠিকানা আছে না পোস্ট বক্স নাম্বার আছে? শোন, হাসানকে বলে রেখে। গেট যেন খুলে রাখে। অফিস থেকে আবার যেতে হবে জয়দেবপুর।
ফিরতে দেরি হবে?
হুঁ হবে। গেট খোলা রাখতে বলবে।
দারুণ দুশ্চিন্তায় ইলার সময় কাটতে লাগল। তার মনে হচ্ছে এক্ষুণি হাসান রিকশা নিয়ে ফিরে এসে বলবে–ভাবী, রাস্তার মধ্যে এই কাণ্ড হয়েছে। মরে গেছে বুঝতে পারি নি। এখন কি করব?
হাসান এগারটার দিকে ঘামতে ঘুমিতে ফিরে এল। সে অসাধ্য সাধন করেছে। অন্তুকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে।
এক নম্বর ওয়ার্ডে আছে ভাবী। সিট নেই, বারান্দায় শুইয়ে রেখেছে। সিট হলে বিছানায় তুলে দিবে। জমাদারকে দশটা টাকাও দিয়ে এসেছি–বকশিস। জমাদার-টমাদার এরা অনেক কিছু করতে পারে।
জ্ঞান এসেছে?
হ্যাঁ, এসেছে। আসার সময় দেখে এসেছি কথাটথা বলছে। স্যালাইন দিচ্ছে। ডাক্তার সাহেব বললেন–ভয়ের তেমন কিছু নেই।
ভাই, তুমি আমার বিরাট উপকার করেছ।
ভর্তি করাতে খুব ঝামেলা হয়েছে। কেউ কোন কথা শুনে না। এদিকে অচেতন এই ছেলে নিয়ে আমি করি কি। আমার আবার অল্পতেই চোখে পানি এসে যায়। চোখে পানি এসে গেল। তাই দেখে একজন ডাক্তার ব্যবস্থা করলেন। ডাক্তারদের মধ্যেও ভাল মানুষ আছে ভাবী।
তা তো আছেই।
ডাক্তার সাহেব ভেবেছেন অন্তু আমার ভাই। আমি তাঁর ভুল ভাঙাই নি। ভাই ভেবেছে ভাবুক। কাজের ছেলে শুনলে হয়ত গা করবে না।
এস হাসান, ভেতরে এসে বস। কিছু খাবে?
জ্বি-না।
একটু কিছু খাও। এস লক্ষ্মী ভাই।
হাসান লজ্জিত মুখে ভেতরে ঢুকল। নিচু গলায় বলল, কোন চিন্তুা করবেন না ভাবী। দুপুরবেলা আমি আবার যাব।
ইলা বলল, হাসপাতাল থেকে কি খাওয়া-দাওয়া দেয়?
তা দেয়। আমি তিন টাকা দিয়ে একটা ভাব কিনে দিয়ে এসেছি। পাঁচটা টাকা বেঁচেছিল। ওর হাতে দিয়ে হেঁটে চলে এসেছি।
সে কি!
খামোকা টাকা খরচ করে লাভ কি বলেন? তাছাড়া হাঁটতে আমার ভালই লগি।
ইলা হাসানকে চা-বিসর্কিট এনে দিল। হাসান মাথা নিচু করে খাচ্ছে। এক পলকের জন্যেও এদিক ওদিক তাকাচ্ছে না। তার পরনে আকাশী রঙের একটা শার্ট। শাঁটটা নতুন, তবে পেটের কাছে পয়সার সাইজের একটা পোড়া দাগ আছে। হাসনি একটা হাত সব সময় সেখানে দিয়ে রেখেছে।
বেচারার শার্ট বোধহয় এই একটাই। সব সময় এই একটা শার্টই গায়ে দিতে দেখা যায়। ইলা মনে মনে ঠিক করে ফেলল–আজই সে একটা শার্ট কিনবে। খুব। সুন্দর একটা শার্ট।
ভাবী যাই।
আচ্ছা ভাই এস।
আমি দুপুরে আবার যাব। আপনি চিন্তা করবেন না ভাবী।
হাসান পুরোপুরি চলে গেল না। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পড়ল। ইলা বলল, কিছু বলবে?
ভাবী, আপনি ভাইজানকে আমার জন্যে একটা চকিরির কথা বলবেন। যে কোন চাকরি। ছোট হলেও ক্ষতি নাই।
ইলা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। হাসান মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল–এখানে আর থাকতে পারছি না ভাবী। প্রেসে সীসা চুরি হয়েছে। সবাই বলছে আমি চুরি করেছি। আমার কোথাও যাবার জায়গা নাই।
আমি ওকে বলব। অবশ্যই বলব। আজই বলব। কিন্তু ও বোধহয় কিছু করতে পারবে না।
আপনার আর কেউ চেনা নাই? খুব ছোট চকিরি হলেও আমার কোন অসুবিধা নাই।
ইলাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে এত বড় একটা পুরুষ মানুষ হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ইলা কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।
হাসান নিজেকে সামলে নিল। হঠাৎ কেঁদে ফেলাতে নিজেই লজ্জা পাচ্ছে। অস্বস্তি ঢাকতে পারছে না। ইলা পরিস্থিতি সহজ করার জন্যে হাসিমুখে বলল, তোমাকে বলেছিলাম আমাকে আপা ডাকতে। তুমি কিন্তু ভাবীই বলে যাচ্ছি।
মনে থাকে না।
মনে না থাকলে তো হবে না। মনে থাকতে হবে।
হাসান চলে যেতে ধরল। ইলা দরজা ধরে দাঁড়িয়েছে। তার মনে হচ্ছে হাসান আরো কিছু বলতে চায়। বলার সাহস পাচ্ছে না। ইলা বলল, কিছু বলবে?
হাসান হড়বড় করে বলল, আমার সম্পর্কে কিছু শুনেছেন আপা?
না, কি শুনব?
পরে বলব। আজ যাই আপা। বাজারে যেতে হবে।
অনেকদিন পর ইলা আজ আবার ঘুরতে বের হয়েছে। ফ্ল্যাট তালাবন্ধ। হাসানকে বলা আছে, সে লক্ষ্য রাখবে। রাতি করে ফিরলেও আজ কোন সমস্যা নেই–জামানের ফিরতে দেরি হবে। জয়দেবপুরে এই মানুষটা কি করছে? কে জানে। কি করছে। এখন আর জানার আগ্রহ হচ্ছে না।
ইলা আজ কোথায় যাবে কিছু ঠিক করে নি। রিকশায় উঠে ঠিক করবে। বেশ কিছু টাকা সঙ্গে নিয়েছে। কত সে নিজেও জানে না। গুনে নেয় নি। জামানের মানিব্যাগ থেকে চোখ বন্ধ করে কয়েকটা নোট তুলে নিয়েছে। ইলা ঠিক করে রেখেছে–সব টাকা খরচ করবে। আবার ফ্ল্যাটে ফিরে আসবে খালি হাতে। সঙ্গে কিছু থাকবে না। কিছু থাকলে জামান টের পেয়ে যাবে।
ভাইয়ার জন্যে কোন একটা উপহার কিনতে পারলে ভাল হত। তা কেনা যাবে না। ভাইয়া কোন এক প্রসঙ্গে জামানকে বলে ফেলতে পারে। তাদের বাড়ির কারোর জন্যেই কিছু কেনা যাবে না। কি বিশ্রী সমস্যায় ইলা পড়েছে। টাকা আছে কিন্তু খরচ করতে পারছে না।
কোথায় যাওয়া যায়? ভূতের গলিতে জামানের বড় বোন থাকেন। হঠাৎ তার বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলে কেমন হয়? ভদ্রমহিলা চমকে উঠবেন কারণ তাদের বাড়িতে যাওয়া ইলার নিষেধ। জামান বিয়ের পরদিনই বলেছে–আমার কোন আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কোন রকম যোগাযোগ রাখবে না। আমার বড় বোন যদি আসে দরজাও খুলবে মা। দরজা খোলাও নিষেধ।