ইলা খিলখিল করে হেসে ফেলল। ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন–তোমার হাসি তো খুব সুন্দর। দাঁতও সুন্দর। অভিনয় করবে?
ইলা হকচকিয়ে গেল। বলে কি এই লোক।
ভদ্রলোক হড়বড় করে বললেন–অভিনয় করবার ইচ্ছা হলে আমাকে বলবে। আমার কথা মজিদ আলি ফেলে না। দুজন নায়িকা আমি মজিদকে দিয়েছি। দুটাই হিট। একজনের সাইনিং মানিই এখন এক লাখ। শুনেছি খুব দেমাগ হয়েছে। তবে আমাকে এখানে খাতির করে। দেখা হলে পা ছুঁয়ে সালাম করে।
চা চলে এল। ভদ্রলোক পিরিচে ঢেলে চা খেতে লাগলেন। খানিকক্ষণ সিষ দেবার ভঙ্গি করলেন। ঠোঁট সুঁচাল করে ফুঁ দিচ্ছেন। লাভ হচ্ছে না। শব্দ হচ্ছে না। ভদ্রলোক খানিকটা বিরক্ত হলেন। বিরক্তি ঝেড়ে ফেলে বললেন, মজিদ আলি সেদিন বলছিল, অনেকদিন তো হল আরেকটা নায়িকা দিন। দেখি হিট করে কি না। আমি বলেছি, দেব। তোমার যদি অভিনয় করার শখ থাকে বলবে। লজ্জার কিছু নেই।
আমার কোন শখ নেই।‘
শখ না থাকলে ভিন্ন কথা।
ইলা বলল, আমি এখন উঠি?
আচ্ছা ঠিক আছে। এসো আরেক দিন। বাড়তি টাকা ফেরত নিয়ে যাবে। আমি ঋণ রেখে মরতে চাই না।
জ্বি আচ্ছা, আমি আরেক দিন আসব।
সপ্তাহখানিক পরে এসো। এর মধ্যে লেখা শেষ হয়ে যাবে। গল্পটা পড়ে শুনাব। নাম কি তোমার? ইলা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, পরী।
পরী।
জ্বি পরী।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। নাম নিয়ে মিথ্যা বলব কেন?
তাও তো ঠিক। নাম নিয়ে মিথ্যা কেন বলবে? আমি খুবই অবাক হয়েছি, বুঝলে–আমি যে স্ক্রিপ্টটা লিখছি তার নায়িকার নামও পরী। তোমার কি বিশ্বাস হচ্ছে, না-কি ভাবছ আমি বানিয়ে বলছি?
বিশ্বাস হচ্ছে।
উঁহু, বিশ্বাস হচ্ছে না। তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। নাও, এই পৃষ্ঠাটা পড়। এক পৃষ্ঠা পড়লেই বুঝতে পারবে। গোটাটা পড়তে হবে না।
ইলা পৃষ্ঠাটা হাতে নিল। চোখের সামনে ধরল। পড়ল না। পড়তে ইচ্ছা করছে না।
কি, আমার কথা বিশ্বাস হল?
আমার কাহিনীর পরী নাচ জানে, গান জানে, রাইফেল চালাতে জানে। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফাস্ট হয়। যে সেকেণ্ড হয় তারচে একশ নম্বর এগিয়ে থাকে।
পরী কি নায়িকা?
না। পরী নায়িকা নয়, নায়িকার ছোট বোন। নায়িকার ছোট বোনেরই এই অবস্থা। এখন নায়িকার অবস্থা চিন্তা কর। হা হা হা…।
ভদ্রলোক হেসেই যাচ্ছেন। ইলা হাসছে না। তার কেন জানি হাসি আসছে না বরং ভয় ভয় লাগছে–মনে হচ্ছে মানুষটা ঠিক সুস্থ নয়। একজন সুস্থ মানুষ এত দীর্ঘ সময় ধরে এমন ভাবে হাসে না। ইলা বলল, আমি যাই?
আচ্ছা যাও।
সে ঠিক করে রেখেছিল সে আর কোনদিন যাবে না। কিন্তু দশ দিনের মাথায় সে আবার গেল। তিনি বাসাতেই ছিলেন। সেদিন আর খালি গায়ে না। নতুন মটকার পাঞ্জাবী। পাঞ্জাবীর বোতামগুলি বোধহয় সোনার। ঝিকঝিক করছে। তাঁর গা দিয়ে ভুরভুর করে আতরের গন্ধ বেরুচ্ছে। ইলা বলল, আমাকে চিনতে পারছেন?
ভদ্রলোক শুকনো গলায় বললেন, চিনতে পারছি। এখন যাও, বিরক্ত করো না। অন্য একদিন এসো।
লজ্জায় অপমানে ইলার চোখে প্রায় পানি এসে যাচ্ছিল। সে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল। ভদ্রলোক বিরসমুখে বললেন, মজিদ আলিকে তোমার কথা বলেছি। তবে ব্যাটা ইন্টারেস্টেড না। শুধু করে। অবশ্য একেবারে আশা ছেড়ে দেয়ার কিছু নেই। আমি আবার বলব। পরে এসে খোঁজ নিয়ে যেও
ইলা বলল, আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কি খোঁজ নিয়ে যাব?
নায়িকা হিসেবে তোমার কোন সুযোগ হয় কি না।
এই সুযোগের জন্যে তো আমি আপনার কাছে আসি নি।
কি জন্যে এসেছ? আচ্ছা, ঠিক আছে কি জন্যে এসেছ পরে শুনব। আজ যাও। আমি বেরুব।
ইলা চলে এল।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ভাল বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে অদ্ভুর কান্নার শব্দ কানে আসছে। ছেলেটার এ কী অবস্থা হল! ইলা তার কাছে গেল। ফিসফিস করে বলল, এত শব্দ করে কাঁদিস না রে অন্তু। উনার ঘুম ভেঙে যাবে। অন্তু সঙ্গে সঙ্গে কান্না থামাল। ইলা অন্তুর গায়ে হাত দিয়ে দেখে– অনেক জ্বর।
ইলা পেছনের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। 6/B ফ্ল্যাটে আলো জ্বলছে। শুধু একটা ঘরে না, সব কটা ঘরে। এত রাত পর্যন্তু এরা জেগে আছে কেন? কালও দেখেছে অনেক রাত পর্যন্ত ঐ বাড়ির ফ্ল্যাটে আলো জ্বলছে। মেয়েটা এখন বোধহয় বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে পারে না। তাদের উচিত এই পড়া ছেড়ে চলে যাওয়া। বোকা মেয়েটা কেন এখনো পড়ে আছে? কি আছে এখানে?
দিনটা শুরু হয়েছে খুব খারাপ ভাবে
আজকের দিনটা শুরু হয়েছে খুব খারাপ ভাবে। সকাল থেকেই বিরাট এক ঝামেলা। অন্তু জ্বরে অচেতন। তার মুখ দিয়ে লালা ভাঙছে। হাসান এসে তাকে কোলে করে নিচে নামিয়েছে। রিকশা করে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। ইলা জামানকে বলল, তুমি যাও না একটু সাথে। জামান মহা বিরক্ত হয়ে বলল–আমি সাথে গিয়ে করব কি?
জ্ঞান নেই। আমার কেন জানি ভয় লাগছে। না হয় আমি সঙ্গে যাই।
তোমার যাবার দরকার নেই। যা করার ঐ করবে। ভ্যাবদা ধরনের ছেলে। এরা কাজ গুছাতে ওস্তাদ। ডাক্তারদের হাতে পায়ে ধরে দেখবে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে।
ইলার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কি ধরনের কথাবার্তা। পরের বাড়ির একটা ছেলে। এত ছোটাছুটি করছুে অথচ লোকটার এত্বটুকু গরজ নেই। দিব্যি শর্টিপেন্ট পরছে। যদি ছেলেটার কিছু হয়? অবস্থা আরো খারাপ হলে তো আত্মিীয়জনদের খবর দিতে হবে।, আমি বেরুচ্ছি, বুঝলে। তেমন কিছু হলে বাড়িওয়ালার বাসা থেকে টেলিফোন করে দিও। আর ভয়ের কিছু নেই। ওয়ার্কিং ক্লাসের লোকদের এত অল্পতে কিছু হয় না। দুএকটা স্যালাইন ট্যালাইন পড়লেই চাঙ্গা হয়ে উঠবে।