ইলা বলবে, দরজা তো খোলা যাবে না। আপনি দরজার নিচে দিয়ে দিন।
আপী, আর্জেন্ট টেলিগ্রাম–সই করে রাখতে হবে।
ইলা দরজা খুলবে, তারপর? তারপর কি? ইলা ঘামতে লাগল। বুক শুকিয়ে কাঠ। কখন আসিবে হাসান? বেশি দেরি নিশ্চয়ই করবে না। ইলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। বারান্দা থেকে রাস্তার এক অংশ দেখা যায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতেও তার খারাপ লাগছে। বারান্দার রেলিংটা নিছু। এখানে দাঁড়ালেই তার কেন জানি লাফিয়ে নিচে পড়ে যেতে ইচ্ছা করে।
জামান ফিরল রাত বারটায়। হাতে কফির একটা কৌটা। বিরস গলায় বলল, কফি বানাতে পার?
ইলা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
জামান বলল, হ্যাঁ বা না বল। মাথা নাড়ানাড়ি কেন? ভাল করে কফি বানাও। আমি রাতে ভাত খাব না। খেয়ে এসেছি।
ইলা কফি বানাতে চলে গেল। সে নিজে না খেয়ে অপেক্ষা করছিল। খিদে মরে গেছে। একা একা এত রাতে খেতে বসার অর্থ হয় না।
জামান অনেক সময় নিয়ে গোসল সেরে বের হল। বারান্দায় অন্তু মিয়ার বিছানা। নতুন মশারি খাটানো হয়েছে। জামান বলল, মশারি পেলে কোথায়?
কিনেছি। হাসানকে বলেছি, হাসান কিনে দিয়েছে।
টাকা?
ভাইয়া আমাকে কিছু টাকা দিয়েছে।
কিছু মানে কত?
অল্প।
অ্যামাউন্টটা বলতে অসুবিধা আছে?
পাঁচশ।
তুমি টাকা চেয়েছিলে?
না।
না চাইতেই পাঁচশ টাকা দিয়ে দিল?
ভাইয়ার যখন হাতে টাকা-পয়সা হয় তখন সবাইকেই কিছু কিছু দেয়।
উনার হাতে এখন টাকা-পয়সা হয়েছে?
ইলা জবাব দিল না। কফির কৌটা নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। আবার তার বুক ধড়ফড় করছে। মিথ্যা কথাটা কি ধরা পড়ে যাবে। সেই সম্ভাবনা কতটুক? খুব অল্প। জামান যাত্রাবাড়িতে কখনো যায় না। ভাইয়ার সঙ্গে তার দেখা হবার সম্ভাবনা নেই বললেই হয়। আর দেখা হলেও জামান নিশ্চয়ই টাকার প্রসঙ্গ তুলবে না। এতটা নিচে কি সে নামবে?
ইলা দু কাপ কফি বানিয়েছে। জামান নিজের কাপে চুমুক দিচ্ছে। ইলা কাপ সামনে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। তার খেতে ইচ্ছা করছে না। বরং কেমন বমি বমি লাগছে। জামান বলল, পাঁচশ টাকা পেয়েই অন্তুর জন্যে নেটের মশারি, লে তোষক এইসব কিনে ফেলেছ? কোলবালিশ কিনেছ? না-কি এই আইটেম বাদ পড়েছে?
শুধু মশারি কিনেছি।
বাড়াবাড়ি করা তোমাদের সব ভাইবোনদের একটা স্বভাব। নিজে খেতে পায় না শংকরকে ডেকে আনে। বাড়াবাড়ি না করলে হয় না?
ইলা বসে আছে চুপচাপ। এই মানুষটার কথা এখন আর আর শুনতে ইচ্ছা করছে না। সে তাকিয়ে আছে শূন্য দৃষ্টিতে। চেষ্টা করছে যেন কিছুই তার কানে না আসে। কাজটা কঠিন। সব সময় পারা যায় না। মাঝে মাঝে পারা যায়। নিয়মটা খুব সহজ। যার কথা শুনতে ইচ্ছা করে না তার দিকে তাকাতে হয় কিন্তু কখনো তার চোখের দিকে নয়। ভুলেও না। তাকাতে হয় মানুষটার ভুরুর দিকে, ভাবতে হয় অন্য কিছু। এমন কিছু যা ভাবতে ভাল লাগে। এই মুহূর্তে ইলা ভাবছে বি. করিম সাহেবের কথা।
ঠিকানা খুঁজে খুঁজে ইলা এক বিকেলে কলতা বাজারে উপস্থিত হল। ভদ্রলোক দরজা খুলে রুক্ষ গলায় বললেন, কে, কি চাই?
বি. করিম সাহেবকে খুঁজছিলাম।
আমিই বি. করিম। ব্যাপার কি?
আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?
আমার কি চেনার কথা?
জ্বি। আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।
দেখা হলেও–তুমি যখন আমাকে চিনতে পারি নি, আমি তোমাকে চিনব এটা ভাবছ কেন? বাদ দাও এই প্রসঙ্গ। এসেছ কেন?
আমি টাকাটা দিতে এসেছি।
কিসের টাকা?
একবার আপনি আমার রিকশা ভাড়া দিয়েছিলেন।
আমি তোমার রিকশা ভাড়া দিতে যাব কেন?
কি কর্কশ কথাবার্তা! খালি গায়ে দরজা খুলেছে, কিন্তু কোন বিকার নেই। খালি গায়েই দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কি পারে একজন তরুণীর সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে? কোন সংকোচ নেই। কোন দ্বিধা নেই। আর তুমি তুমি করেই বা ভদ্রলোক বলছেন কেন?
ইলা তার হ্যান্ডব্যাগ খুলে টাকা বের করতে করতে বলল–আপনি সত্যি সত্যি চিনতে পারছেন না? আমরা দুই বোন ছিলাম। আমার ছোট বোনটা কাঁদছিল।
ও আচ্ছা। ইয়েস। মনে পড়েছে। বায়তুল মুকাররমে।
জ্বি।
কত টাকা দিয়েছিলাম?
কুড়ি।
গুড। দাও, টাকাটা দাও, কাজে লাগবে। হতি খালি। পারলে আরো কিছু বেশিও দিতে পার। আছে?
ইলা ভাবল লোকটা ঠাট্টা করছে। কিন্তু না ঠাট্রা না। তিনি সত্যি সত্যি চাইছেন। ইলা একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিল। তিনি বিন্দুমাত্র সংকোচ না করে নিলেন।
এস, খানিকক্ষণ বসে যাও। চা খেয়ে যাও।
জ্বি-না।
না কেন? খেয়ে যাও যাও যাও, ভেতরে ঢুকে পড়। আমি চায়ের কথা বলে আসি।
ভদ্রলোক লুঙ্গি পরা অবস্থাতেই টাকা নিয়ে চলে গেলেন। হয়ত চায়ের কথাই বলতে গেলেন। ইলা ভেতরে ঢুকল না, আবার চলেও গেল না। দাঁড়িয়ে রইল। ভদ্রলোক দ্রুত ফিরে এসে বিরক্ত গলায় বললেন–দাঁড়িয়ে আছ কেন? দরজা তো খোলাই ছিল। এস।
ঘর বেশ গোছানো, তবে মেঝেতে একটা বিশাল পার্টি পাতা। বড় একটা খাতা পড়ে আছে। খাতার পাশে দুতিনটা কলম।
আপনি লিখছিলেন?
হুঁ।
কি লিখছিলেন?
সিনেমার স্ক্রিপ্ট। ঐ আমার পেশী। লেখক হবার ইচ্ছা ছিল, তা হওয়া গেল না, হয়ে গেলাম স্ক্রিপ্ট রাইটার। ছবি দেখ তুমি?
খুব বেশি না।
জিন্দেগী দেখেছ?
জ্বি-না।
আমার লেখা। না দেখে ভাল করেছ। দেখলে হলের মধ্যে বমি করে ফেলতে। আমি নিজে লিখে শেষ করার পর সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলেছি।