টিভিতে ম্যাকগাইভার শুরু হবার পর ইলা নিচে নামল। ম্যাকগাইভারের কাণ্ডকারখানা দেখবে না। ভয়ে বুক ধড়ফড় করাটা তাহলে আবার শুরু হতে পারে। গেট খোলা রাখার কথা হাসানকে বলে আসতে হবে। পেছনের বাড়ির ঐ ঘটনার পর দশটা বাজার আগেই গেট বন্ধ করে দিচ্ছে।
হাসানকে পাওয়া গেল না। সে বেশির ভাগ সময়ই বারান্দায় ক্যাম্পখাট পেতে ঘুমায়। ঝড় বৃষ্টির সময়ও একই জায়গা। তখন পর্দার মত কি যেন দেয়। এই ছেলেটির জন্যে বাড়ির ভেতরে কোন জায়গা হয় নি।
আজ ঝড় না হোক, বৃষ্টি হবে। অসহ্য গরম পড়েছে। আকাশ মেঘলা। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ইলা বাড়িওয়ালার স্ত্রীকে বলে আসতে গেল। বৃষ্টির মধ্যে জামান এসে যদি দাঁড়িয়ে থাকে, আর যদি গেট খোলা না হয় তার পরবর্তী অবস্থা কি হবে চিন্তা করা যায় না।
বাড়িওয়ালার স্ত্রী সুলতানী খেতে বসেছেন। আজ তাঁকে অন্যদিনের চেয়েও মোটা লাগছে। গলার চামড়া থলথল করছে। ব্লাউজের বোতাম লাগান নি। তাঁর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ইলাকে দেখে বললেন–বসে যাও তো মা। চারটা ভাত খাও আমার সাথে। রূপচান্দা শুটকির দোপেঁয়াজা। ঝাল ঝাল করে রাঁধা। খেয়ে দেখ।
ইলা বলল, আরেক দিন খাব। আজ রাতে গেটটা একটু খোলা রাখতে হবে। হাসানকে যদি একটু বলে দেন।
দিব, বলে দিব।
আরেকটা কাজ আছে। অন্তুকে ডাক্তার দেখাতে হবে।
চিন্তা করো না তে। হাসান নিয়ে যাবে। সারাদিন তো ঘরে বসেই ঝিমায়। ঐ দিন মগবাজার যাবে–আমার কাছে রিকশা ভাড়া চায়। চিন্তা করে দেখ কত বড় সাহস। মগবাজার এমন কি দূর। গাখী, তুই হেঁটে চলে যা। এত বাবুয়ানা কিসের?
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এইসব কথা শুনতে ভাল লাগছে না, আবার চলে যাওয়া যাচ্ছে না। খাওয়া বন্ধ রেখে একজন এত আগ্রহ নিয়ে গল্প করছে তার সামনে থেকে উঠে চলে যাওয়া যায় না।
বস না মা, দাঁড়িয়ে আছ কেন?
অন্তু একা আছে।
থাকুক না একা। একটা জিনিস তোমার মধ্যে দেখি যেটা আমার পছন্দ না। কাজের লোক তুমি মাথায় তুলে রাখ। কাজের লোক থাকবে কাজের লোকের মত। কয়েকদিন আগে দেখলাম রিকশা করে যাচ্ছ, চাকর ছোঁড়া বসে আছে তোমার পাশে। সে বসবে নিচে। পায়ের কাছে। পাশে বসালে এরা কোলে বসতে চাইবে।
খালা এখন যাই।
আহা বস না। পেপসি আছে–পেপসি খাবে। খাও একটা পেপসি। ও রত্না, পেপসি দে।
ইলাকে বসতে হল। পেপসির গ্লাস হাতে নিতে হল। সুলতানা গলা নিচু করে বললেন, পেছনের বাড়ির ঘটনা পত্রিকায় উঠেছে, দেখেছ? ব্যাপার সব ফাস করে দিয়েছে। রেইপ কেইস। হেডিং ছিল–গৃহবধূ ধর্ষিতা। আমি মেয়েটাকে দেখতে গিয়েছিলাম। হাসবেন্ড্রটা খুব চালাক। চোখে মুখে কথা বলে। আমাকে বলে কি–খালাম্মা দেখেন না– পত্রিকায় বানিয়ে বানিয়ে কি সব লিখেছে। এখন কাউকে মুখ দেখাতে পারি না। আমি মানহানির মামলা করব। হাতকড়া পরাব। দুজন এডভোকেটের সাথে আলাপও করেছি। বুঝলে ইলা, ইতং বিতং কথা বলেই যাচ্ছে। শাক দিয়ে কি আর মহি ঢাকা যায়?
পত্রিকায় কি উঠেছে সেই ঘটনার সবটা ইলাকে শুনতে হল। সুলতানা ফিস ফিস করে বললেন, ঘটনা আরো আছে। এত বড় ঘটনা ঘটল আর মেয়ে সাড়াশব্দ করল না। চুপ করে রইল। এর কারণ কি? চিৎকার দিলেও তো দশজনে শুনত? কিছু মেয়ে আছে এইসব পছন্দ করে … তারা চায় রেইপড হতে। একজনে মন ভরে না।
ইলা বলল, খালা আমি উঠি?
অহি মা বোস না, তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে। তোমার ছোট বোনটাকে ঐদিন দেখলাম। মুখের কাটিং ভাল। রঙ ময়লা, রঙ ভাল হলে আমার ছেলেটার জন্য বলতাম–কালো মেয়ে বিয়ে করিয়ে কি হবে…
ইলা উঠে পড়ল। আর বসে থাকা যায় না।
টুকটুক করে কে যেন দরজায় টোকা দিচ্ছে। ইলার বুক ধক করে উঠল। তার কি বিশ্রী কোন অসুখ হয়ে যাচ্ছে? দরজার সামান্য টোকায় পৃখিবীর কেউ এমন চমকে উঠে না। সে চমকাচ্ছে কেন?
কে?
ভাবী আমি। আমি হাসান। আপনি কি আমাকে খুঁজছিলেন?
হ্যাঁ খুঁজছিলাম।
ইলা দরজা খুলতে খুলতে বলল, তোমাকে না একবার বলেছি আপা ডাকতে। আজ আবার ভাবী ডাকছ। দাঁড়িয়ে আছ কেন, ভেতরে আস।
হাসান খুব অস্বস্তি নিয়ে ভেতরে ঢুকল। ইলা বলল, ভাই, আমাকে আরেকটা কাজ করে দিতে হবে। অন্তুর মুখের অবস্থা দেখ। ফুলেটুলে কি হয়েছে। ডাক্তারের কাছে একটু নিয়ে যাবে।
জ্বি আচ্ছা।
ঐ দিনের কিছু টাকা পাওনা ছিল, ঐ টাকাও তো নাও নি।
এখন দিয়ে দিন।
আরেকটা কাজ করে দিতে হবে। অন্তু মিয়ার জন্যে একটা মশারি কিনে দিতে হবে। সিঙ্গেল মশারি। কত লাগে সিঙ্গেল মশারির তুমি জান?
জ্বি না।
তোমাকে একটা পাঁচশ টাকার নোট দিচ্ছি–তোমার টাকটি। এখান থেকে রেখে দেবে, অন্তুকে ডাক্তার দেখাবে আর একটা সিঙ্গেল মশারি কিনবে।
মশারি কি এখনই কিনব? দোকান বোধহয় বন্ধ হয়ে গেছে।
কাল সকালে কিনে দিলেও হবে।
জ্বি আচ্ছা।
বস না। একটু চা খেয়ে যাও।
আমি চা খাই না ভাবী।
আচ্ছা তোমার জন্যে একদিন ভাল কিছু বানিয়ে রাখব। আজ দেরি না করাই ভাল। দেরি করলে হয়ত ডাক্তার পাবে না।
হাসান অন্তুকে নিয়ে নেমে গেল। রাত দশটার মত বাজে। পুরো ফ্ল্যাটে ইলা একা। তার বুক আবার ধকধক করা শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে ভয়ংকর কিছু ঘটবে। খুব ভয়ংকর কিছু। পেছনের ফ্ল্যাটে যেমন ঘটেছিল তেমনি কিছু। প্রথমে দরজায় টকটক শব্দ হবে। ইলা বলবে, কে? বাইরে থেকে খুব মিষ্টি গলায় একটি ছেলে বলবে–আপা, আমি টিএন্ডটির পিওন। টেলিগ্রাম নিয়ে এসেছি।