নাসিম রুবার দিকে তাকিয়ে বলল, রুবা!
উঁ।
এই মাছটা পুকুরের না নদীর বল তো দেখি।
কি করে বলব? মাছের গায়ে তো লেখা নেই made in river কিংবা made in pond.
অবশ্যই লেখা আছে। সেই লেখা পড়ার চোখ থাকতে হয়। নদীর রুই মাছ হয় লম্বা। এদের স্রোতের বিরুদ্ধে চলতে হয়। লম্বা না হলে এদের চলাফেরা সমস্যা। পুকুরের মাছগুলি হয় মোটা, গোলগাল। তোকে ভাল জিনিস শিখিয়ে দিলাম।
থ্যাংকস। আরো কিছু শেখাও।
বল দেখি–এই মাছটা টাটকা না বাসি?
বিশ্রী গন্ধ আসছে। মনে হচ্ছে বাসি।
হল না। মাছের তেলটার দিকে তাকিয়ে দেখ। ধবধবে সাদা। এর মানে টাটকা মাছ। এক টুকরা মুখে দিবি, অমৃতের মত লাগবে।
নাসিম ভাই, কেন তুমি আজ এত খুশি?
খুশি হবার মত কারণ ঘটেছে। অসাধারণ একটা মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হল। আমি আমার এই জীবনে এমন অসাধারণ মেয়ে দেখি নি।
রুবার মুখ কালো হয়ে গেল। সে নিজের অজান্তেই বড় ধরনের একটা ধাক্কা খেল। তার এই পরিবর্তন নাসিম ধরতে পারল না। ধরতে পারলে সেও চমকে উঠত।
বুঝলি রুবা, মেয়েটার বাপটাকে চিনি। হারামজাদা নাম্বার থ্রী। মানুষ সমাজের কলংক। কিন্তু মেয়েটা এত ভাল যে বাপের অপরাধও মেয়ের দিকে তাকিয়ে ক্ষমা করা যায়।
নাম কি মেয়ের?
ভাল নাম মেহেরুন্নিসা। ডাকনাম বোধহয় তুহিন। তুহিন করে ঐ বাড়ির সবাই ডাকছিল।
আজই পরিচয় হল?
হুঁ।
অনেকক্ষণ গল্প করলে?
হুঁ। ভেবেছিলাম মিনিট পাঁচেক গল্প করব। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে প্রায় ঘণ্টা খানিক থাকলাম। চা খেলাম। কেক খেলাম। কেকটা অমৃতের মত। কিন্তু কিছু মানুষ আছে না, প্রথম দেখাতেই মনে হয়–আরে, এই মানুষটাকে তো অনেকদিন ধরেই চিনি। এই মেয়েও সে রকম।
আমার চেয়েও ভাল?
নাসিম হো-হো করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, তোর ধারণা তুই একটা দারুণ মেয়ে?
হ্যাঁ আমার তাই ধারণা।
মুখ এমন কালো করে ফেলেছিস কেন? ব্যাপার কি?
তোমার অসাধারণ একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। মুখ আলো হয়ে আছে। আমার তো আর কোন অসাধারণ পুরুষের সঙ্গে পরিচয় হয় নি আমার পরিচয় তোমার মত একজনের সঙ্গে মাকে সবাই ডাকে–গিট্টু। কাজেই আমার মুখ অন্ধকার।
ঘরে মসলাপাতি কি আছে দেখ। কি ফটফটি হয়েছিল। ফটফট করে কথা। সেই দিন এতটুকু প্যান্ট পরে খালি গায়ে ঘুরঘুর করতে দেখলাম।
রুবা কঠিন গলায় বলল–নাসিম ভাই, তুমি আমাকে কখনো খালি গায়ে ঘুরঘুর করতে দেখ নি।
আচ্ছা যা দেখিনি। তুই এত রাগছিস কেন?
তুমি আজেবাজে কথা বলবে, আমি রাগব না?
রুবা উঠে দাড়াল। নাসিম বলল, যাচ্ছিস কোথায়?
মসলা আছে কি-না দেখতে যাচ্ছি।
রুবা রান্নাঘরে গেল না। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। সে কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। কেন তার এত কান্না পাচ্ছে তা সে নিজেও বুঝতে পারছে না। নাসিম ভাই বলেছে তার একটা অসাধারণ মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, তাতে তার নিজের এত খারাপ লাগছে কেন? ভাগ্যিস তার এই খারাপ লাগাটা অন্য কেউ দেখতে পাচ্ছে না। দেখতে পেলে কি ভয়ংকর ব্যাপার হত!
রুবা কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সামলাল। চোখে মুখে পানি দিয়ে এসে দেখে নাসিম বঁটি দিয়ে হাত কেটে ফেলেছে। রক্ত বের হচ্ছে গলগল করে। নাসিম বলল, তোর আরোগ্য নিকেতন চট করে নিয়ে এসে হাতটা বেঁধে দে।
তুমি তো হাত একেবারে দু টুকরা করে ফেলেছ!
দু টুকরা করলেও কেন জানি ব্যথা পাচ্ছি না। একটা মজার জিনিস লক্ষ করেছিস রুবা, মাছের রক্ত আর মানুষের রক্ত এক রকম। এইখানে দেখ পাশাপাশি মাছের রক্ত আর মানুষের রক্ত। কোনটা কার বল তো?
রুবা কিছু বলল না। তার অষুধের বাক্স আনতে গেল। নাসিম কৌতূহলী চোখে মাছের এবং মানুষের রক্ত দেখছে।
জামানের ফিরতে আজও দেরি হবে
জামানের ফিরতে আজও দেরি হবে। গেট খোলা রাখতে হবে বলে গেছে। কি করছে সে জয়দেবপুরে? বাড়ি বানানো কি শুরু করে দিয়েছে? কোত্থেকে পাচ্ছে এত টাকা? হারানো মানিব্যাগের কথা এর মধ্যে একবারও তুলে নি। সে হয়ত ভুলেই গেছে। ইলা ভুলতে পারে নি। ভুলবে কিভাবে? মানিব্যাগটা তো তার কাছেই। সে লুকিয়ে রেখেছে তার স্যুটকেসে। যদি জামান কোন কারণে তার স্যুটকেস খুলে তখন কি হবে? ভয়ংকর কোন কাণ্ড যে হবে তা সে জানে। সেই ভয়ংকর মানে কি রকম ভয়ংকর? মাঝে মাঝে ইলার ইচ্ছা করে ভয়ংকর কাণ্ডটা ঘটে যাক। দেখা যাক সে কি করে।
জামানের রাগ ভয়ংকর। রাগের সময় সে এমনভাবে তাকায়, এমন ভঙ্গি করে যে ইলাকে হতভম্ব হয়ে দেখতে হয়। ইলা রাগ করে না, দুঃখিত হয় না, সে শুধু অবাক হয়ে দেখে। বিস্ময় বোধটাই তার প্রধান হয়ে দাড়ায়। একদিন জামান রেগে গিয়ে এমন ভঙ্গি করল মে ইলার মনে হল সে তাকে চড় মারতে আসিছে। যদি সত্যি সত্যি চড় মেরে বসত তাহলে কি বিশ্রী ব্যাপার হত। অথচ ঘটনা কিছুই না। জামান বাথরুমে ঢুকে দেখে বেসিনের উপর একটা আঙটি। ইলার আঙটি। সে আঙটি খুলে হাত ধুয়েছিল। তারপর আর পরতে মনে নেই। এমন কোন ভয়ংকর ঘটনা না। কিন্তু জামান কি বিশ্রী কাণ্ড করল। হাত উঁচিয়ে ছুটে এল–কাণ্ডজ্ঞান নেই? তোমার কাণ্ডজ্ঞান নেই? ইলার বয়স চব্বিশ। এই চব্বিশ বছরের জীবনে সে প্রথম একজনকে দেখল যে হাত উঁচিয়ে তাকে মারতে আসছে।
আঙটি ফেলে আসায় যে মানুষ এমন করেছে সে যদি শুনে ইলার স্যুটকেসে তার মানিব্যাগ। মাঝে মাঝে সেখান থেকে টাকা বের করে সে খরচ করে। তাহলে কি করবে? তার চেয়েও ভয়ংকর কিছু ইলা শুনতে পারে। এমন ভয়ংকর কিছু যে শোনার পর ঐ মানুষটা হাত উঁচিয়ে তাকে মারতে আসবে না কারণ তার সেই ক্ষমতা থাকবে না। সে অবাক বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে ইলাকে দেখবে। কিংবা মাথা ঘুরে নিচে পড়ে যাবে। মুখ দিয়ে ফেনা বের হবে।