হুঁ।
চা খাবে? তুমি বসে খাক–আমি তোমার জন্যে চা নিয়ে আসছি। বাবুর দিকে লক্ষ রাখে।
নায়লা ঝলমল করতে করত বের হয়ে গেল। বাবু বসে আছে ঘোড়ার পিঠে। মাথা নিচু করে বসে থাকা গম্ভীর একজন মানুষ। দু বছর আগে এই সময়ে মানুষটার জন্যও হয়নি। জন্ম হয়েছে বিকেল তিনটায়। তাহলে দুবছর আগে এই সময় মানুষটা তার মার পেটে গুটিশুটি মেরে অপেক্ষা করছিল। তখন কি ছিল তার মনে? ভয়? আশংকা, না আনন্দ? যে মার সঙ্গে এতোদিন সে মিশেছিল তার সঙ্গে বিচ্ছেদের আশংকা, আবার এই বিচ্ছেদেও মাকে অন্যরূপে পাবার আনন্দ।
জামান বাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা, তোমার নাম কি?
বাবু গভীর গলায় বলল–ঘোড়া।
উঁহু। ঘোড়া তোমার নাম না। তুমি ঘোড়ায় বসেছ। তোমার নাম কি?
ঘোড়া।
না বাকা। বল আমার নাম বাবু।
বাবু নাম বলছে না। কিন্তু ধবধকে শাদা দাঁতে কুটি কুটি করে হাসছে। জামান বলল–তোমার ইঁদুরের মৃত দাঁত কেন হল বাবা?
বাবু বলল, আমি ইঁদুল।
জামান তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে। ছেলেটা কি মিষ্টি করে কথা বলে! র বলতে পারে কিন্তু সব সময় না। ঘোড়া বলার সময় পরিষ্কার ও উচ্চারণ করল কিন্তু ইঁদুরের বেলায় পারছে না। বাচ্চাদের কথা বলার সময়টা কি যে অদ্ভুত।
নায়লা চা নিয়ে এসেছে। এক হাতে চায়ের কাপ। অন্য হাতে পানি ভর্তি গ্লাস।
নায়লা বলল, পানি দিয়ে কুলি করে মুখের বাসি ভাব দূর করে তারপর খাও। আর পিরিচে করে আমাকে একটু দাও। বাবু, তুই চা খাবি?
বাবু মার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি ঘোড়া।
নায়লা খিলখিল করে হাসছে। হাসির ঝাপ্টায় হাতের চায়ের কাপ কাঁপছে–চা ছড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে হাসি শুনে ফিরুর মা এসে দরজা ধরে দাঁড়িয়েছে। জামান খানিকটা বিস্ময় নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে–সে এত হাসতে নায়লাকে কখনো দেখেনি।
শেষ পর্যন্ত আলমকে জন্মদিনের দাওয়াত দেয়ার দায়িত্ব নায়লার উপরেই পড়েছে। জামান থাকবে বাবুকে নিয়ে। নায়লা অরুণীকে দাওয়াত দিয়ে ফেরার পথে জামানকেও দাওয়াত করে আসবে।
হোটেলের লবীতে ঢোকার সময় নায়লার খানিকটা ভয় ভয় করছিল। সেই ভয় কিছুক্ষণের মধ্যেই কেটে গেল। সে আলমের রুম নাম্বার জানে–সেই রুম হোটেলের কতালীয় তাও জানে–লিফটে করে উঠতে হয়। সেটাও কোন সমস্যা নয়। লিফটম্যানকে বললেই হল–৪১১ নম্বর রুম।
নায়লা প্রথম গেল রিসিপশানে। সুন্দর চেহারার স্মার্ট দুজন তরুণ দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেরই হাসি হাসি মুখ। নায়লা বলল, ৪১১ নম্বর রুমের মিঃ আলমের সঙ্গে কথা বলব। উনি কি আছেন?
জ্বি ম্যাডাম আছেন। এই এক মিনিট আগে উনার সঙ্গে কথা হয়েছে। আপনি কি কথা বলবেন ম্যাডাম? টেলিফোনে লাইন দেব?
না, আমি সরাসরি যাব। আপনাদের সিড়ি কোন্ দিকে?
লিফটে করে চলে যান ম্যাডাম। বাঁ দিকে লিফট।
লিফটে আমি চড়ব না। আমার লিফট ভয় লাগে।
নায়লা মিষ্টি করে হাসল। তার নিজের কাছেই মনে হচ্ছে সে একটু অদ্ভুত আচরণ করছে। অকারণে কথা বলছে। রিসিপশনিস্টের সঙ্গে এতগুলি কথা বলার কোন প্রয়োজন ছিল না। তাছাড়া সে লিফটে চড়তে ভয়ও পায় না। লিফট তার কাছে অপরিচিত কিছুও নয়। প্রতিদিনই সে লিফটে চড়ছে।
ম্যাডাম, আপনি ডানদিকে যান। ডানদিকে যাবেন, তারপর ফার্স্ট রাইট টার্ন।
থ্যাংক য়্যু।
ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নায়লার ভাল লাগছে। দোতলা পর্যন্ত ওঠার পর দুটি বিদেশী ছেলেমেয়েকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখা গেল। দুজনই বাবুর বয়েসী ছেলেটির হাতে ললি টকটকে বল। সে খুব গম্ভীর ভঙ্গিতে বল হাতে মামছে। এত ছোট ছেলেমেয়েদের বাবা-মা একা একা ছেড়ে দিল কি ভাবে? ছোট মেয়েটি নায়লাকে দেখে হাত নেড়ে বলল–হাই। নায়লাও হাত নাড়ল। বাচ্চা দুটির সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করছে। ইংরেজি রপ্ত থাকলে এদের সঙ্গে গল্প করা যেত।
আলম দরজা খুলে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, নায়লা এসো। সে এমন সহজ স্বরে কথা বলল যে, নায়লার মনে হল আলম এতক্ষণ তার জন্যেই অপেক্ষা করছে।
আলম সবেমাত্র বাথরুম থেকে গোসল সেরে বের হয়েছে। একটা বড় টাওয়েল তার গায়ে জড়ানো, আরেকটা টাওয়েল গলায় ঝুলছে। এখনো গা মোছা হয়নি। টপ টপ করে পানি পড়ছে।
নায়লা, আমার অর্ধনগ্ন মূর্তি দেখে তোমার রুচিবোধ আহত হচ্ছে না তো? আহত হলে ক্ষমা করে দাও। আমার গোসল শেষ হয়নি। তোমার ঘন ঘন বেল বাজানোর শব্দে গোসল আধাআধি রেখে উঠে এসেছি।
যান, গোসল শেষ করুন। আমি বসছি।
শুধু বসলে হবে না। টেলিফোন তুলে জিরো জিরো ডায়াল করে রুম সার্ভিসকে বল আমাদের দু কাপ কফি দিয়ে যেতে। গোসল শেষ হতে হতে কফি এসে যাবে।
আলম বাথরুমে ঢুকে গেল। কি সহজ, কি স্বাভাবিক আচরণ। নায়লা কফির কথা বলল। প্রথম দিন এই ঘরটা অনেক বড় লাগছিল–আজ এত বড় লাগছে না। সব অপরিচিত ঘরকেই প্রথম দেখায় একটু বোধহয় বড় লাগে। বেল বাজছে! নায়লা জা খুলে দিল। কুড়িএকুশ বছরের সুন্দর একটা মেয়ে কফি ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আচ্ছা, এরা কি কফি তৈরি করেই বসেছিল?
ম্যাডাম, কফি চেয়েছিলেন?
হ্যাঁ। টেবিলের উপর রেখে দিন।
মেয়েটা সাবলিল ভঙ্গিতে কফির ট্রে টেবিলে রাখছে। তাকে দেখে নায়লার হিংসা লাগছে। কাজ করছে, টাকা রোজগার করছে। আর নায়লা কি করছে?–অন্যের রোজগারে ভাগ বসাচ্ছে। বাবুর জন্মদিনে সে তার নিজের হয়ে কোন উপহার কিনতে পারবে না। উপহার কিনতে হবে জামানের টাকায়। নায়লার জানতে ইচ্ছা করছে–মেয়েটা এই হোটেলে কাজ করে কত টাকা পায়? জানতে ইচ্ছা করলেও জানা যাবে না। এই প্রশ্ন মেয়েটাকে কখনো করা যাবে না।