- বইয়ের নামঃ ছায়াবীথি
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ পার্ল পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
রাত দশটার মত বাজে
রাত দশটার মত বাজে। এমন কিছু রাত না, কিন্তু নায়লার অস্থির লাগছে। গেটে শব্দ হতেই সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ জায়গাটাকে বারান্দা বলা ঠিক না। জায়গাটা ছাদের অংশ। তবু নায়লা বারান্দা বলে। ফ্ল্যাট বাড়ির গেট। কত মানুষ আসছে, কত মানুষ যাচ্ছে।
নায়লা বারান্দায় পঁড়িয়ে রইল। বারান্দা অন্ধকার, বাইরে থেকে তাকে দেখা যাবে না। সে ঠিকই দেখতে পাবে। গেটের কাছে এখন দুশ পাওয়ারের বাতি জ্বলে। এত দূর থেকে মানুষ চেনার কথা না, কিন্তু নায়লা চিনতে পারে।
কাজের মেয়ে ফিরুর মা রান্নাঘর থেকে তাকে ডাকছে। এমন চেঁচিয়ে ঢাকার মানে কি? সে কি বাবুর ঘুম ভাঙাতে চায়? এরা কিছুই শিখবে না? কতবার বলা হয়েছে চেঁচিয়ে ডাকবে না। যা নিষেধ করা হয় এই মহিলা সেটাই বেশি করে।
ও আম্মা। ও আম্মা।
বারান্দা থেকে নড়তে ইচ্ছা করছে না। যে কোন মুহূর্তে জামান এসে পড়বে। দশটার ভেতর সে সব সময় বাড়ি ফেরে। রিকশা থেকে নেমে সে গেট খুলে ঢুকছে এই দৃশ্য দেখতে নায়লার ভাল লাগে। অন্য কেউ এ কথা শুনলে তাকে পাগল ভাববে। রিকশা থেকে নেমে একটা লোক গেট খুলে বাড়িতে ঢুকছে–এতে ভাল লাগার কি আছে? কিন্তু নায়লার ভাল লাগে। শুধু ভাল লাগা না–শান্তি শান্তি ভাব হয়।
ও আম্মা। আম্মা।
চেঁচাচ্ছ কেন? বাবু উঠে যাবে না?
ভাইজানের গোসলের পানি দিয়া আসমু?
গা জ্বালা-করা কথা। এটা জিজ্ঞেস করার কি আছে? গোসলের গরম পানি বাথরুমে দিতে সে বলে এসেছে। ফিরুর মার মাথাটা খারাপ কিনা কে জানে। তাকে আম্মা ডাকছে, অথচ জামানকে ডাকে ভাইজান। ব্যাপারটা তাকে এক লক্ষ বার বলা হয়েছে। যতই বলা হয় ততবারই সে জিবে কামড় দিয়ে বলে, কিচ্ছু মনে থাকে না। ফিরুর শরণের পর থাইক্যা মাখা গেছে আউলাইয়া …
এই এক সমস্যা। যে কোন প্রসঙ্গে সে ফিরুর কথা নিয়ে আসে। সেদিন নতুন চায়ের কাপ হাত থেকে ফেলে ভেঙে ফেলল। এক সপ্তাহও হয়নি কেনা হয়েছে। নায়লা কিছু বলার আগেই সে কঁদো কাঁদো গলায় বলল, ফিরুর মরণের পর থাইক্যা কি যে হইছে আম্মা–হাত-পাও কাঁপে।
ও আম্মা। আম্মা। পানি দিমু বাথরুমে?
দাও। আর চেঁচিয়ে কথা বলো না। বাবু উঠে যাবে।
রিক্সা এসে থেমেছে গেটের কাছে। জামান নামছে। এত দূর থেকে মুখ দেখা যায়, কিন্তু নায়লা নামার ভঙ্গি দেখে বলে দিতে পারে। জামানের হাতে কি যেন পোটলা দেখা যাচ্ছে। তার বিশ্রী অভ্যাস হল, দুপুর-রাতে মাছ কেনা। তাও সব মাছ না–ইলিশ মাছ। বাজারের ব্যাগ নামিয়ে রেখে বলবে–ঝটপট দুটা পিস ভেজে দাও তো। কড়া ভাজবে।
রাত-দুপুরে কার মাছ কুটতে ভাল লাগে? তাছাড়া মাছ কাটার পর হাত আঁশটে গন্ধ হয়ে থাকে। সেই গন্ধ সারারাত লেগে থাকে। কি আছে ইলিশ মাছে? শীতকালের ইলিশ কেউ কেনে না। জামনি কিনে আনে।
ফিরুর মা?
জ্বি আম্মা। তরকারী গরম দাও। তোমার ভাইজান এসেছে।
রোজ দিন কেন যে এমুন দিরং করে! শহর-বন্দর জায়গা। একটা বিপদ-আপদ হইলে উপায় আছে?
তোমাকে ওস্তাদী ধরনের কথা বলতে হবে না। তোমাকে যা করতে বলা হয়েছে, কর।
গেট থেকে ফ্ল্যাটের দরজা পর্যন্ত আসতে জামানের ঠিক এগারো মিনিট লাগে। এর বেশিও না, এর কমও না। নায়লা ঘড়ি দেখে বের করেছে। দুতলা পর্যন্ত সিঁড়ি বেয়ে উঠতে সময় লাগে। জামান এক নাগাড়ে উঠতে পারে না। থেমে থেমে উঠতে হয়। তাদের একতলা একটা বাড়ি যদি থাকতো। ছোট্ট সুন্দর ছিমছাম একটা বাড়ি। কয়েকটা নারিকেল গাছ থাকবে বাড়ির সামনে। একটা কঁকড়া আমগাছ। যার ডালে একটা দোলনা কুলবে। বাবু দোলনায় চড়বে। দোলনায় চড়র বয়স বাবুর এখনো হয়নি। খুব শিগগিরই হবে–ছোট বাচ্চারা দেখতে দেখতে বড় হয়। ঐ তো মাত্র সেদিন ওঁয়া ওঁয়া করে কাঁদতো! পাশ কি করে ফিরতে হয় তাও জানতো না–আর আজ বাবার চশমা চোখে দিয়ে বলে–আপিস যাব। আপিস যাব।
জামানকে একদিন বলতে হবে ওকে যেন একদিন অফিসে নিয়ে যায়। দেখে আসুক আপিস ব্যাপারটা কি?
কলিংবেল বাজছে।
আজ কি ওর আসতে সময় বেশি লেগেছে? নায়লার মনে হচ্ছে সে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে।
জামান হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকল। এই ফ্ল্যাটবাড়ির সিঁড়িগুলি খড়ি। উঠতে গেলে বুকে চাপ পড়ে। সে থেমে থেমে উঠে। এক একটা তালা উঠে খানিকক্ষণ সিড়ির রেলিং ধরে বিশ্রাম করে এটা না করে একটানে আসলে কম পরিশ্রম হবে ভেবে সে একবার একটানে উঠেছিল। এতে এমন সমস্যা হল–দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। হেঁচকির মত উঠে গেল। হার্টের কোন সমস্যাটমস্যা আছে নিশ্চয়ই।
দেখি নায়লা, পানি দাও তো। খুব ঠাণ্ডা পানি।
নায়লা পানি এনে দিল। খুব ঠাণ্ডা পানি দেবার উপায় নেই। ঘরে ফ্রীজ থাকলে তবে তো ঠাণ্ডা পানি। মাঝে মাঝে পাশের সীমাদের ফ্ল্যাট থেকে ঠাণ্ডা পানির বোতল নিয়ে আসে। রোজ রোজ তো আর আনা যায় না। নায়লঃ লক্ষ্য করল, বেচারা ঠাণ্ডা পানি মনে করে খুব আগ্রহ করে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে চুমুক দিয়েই মনটা খারাপ করল। আচ্ছা, সে তো জানে তাদের ফ্রীজ নেই। তারপরও রোজ এসে ঠাণ্ডা পানি চায় কোন যুক্তিতে?
বাথরুমে গরম পানি দেয়া হয়েছে। গোসল করে ফেল।
যাচ্ছি। একটু জিরিয়ে নেই।
মানুষটা মুখ বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেলছে। দেখতে মায়া লাগছে। এত অল্পতে সে কাহিল হয়? গোসল করে সে চুপচাপ মিনিট পাঁচেক সময় শুয়ে থাকবে–তারপর খেতে আসবে। সেই গোসলও টকটকে গরম পানি ছাড়া হবে না। ভাদ্র মাসের গরমেও তার গোসলের জন্যে গরম পানি চাই।
জামান শার্ট খুলতে খুলতে বলল, বাবু ঘুমিয়ে পড়েছে?
হুঁ।
ওর ঘুমটা ভাঙাও দেখি।
কেন?
ওর জন্যে একটা খেলনা এনেছি।
কি খেলনা?
জামান কাগজের প্যাকেট খুব সাবধানে খুলছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় চমকে যাবার মত কিছু বেরুবে। যদিও নায়লা খুব করে জানে, সেই সম্ভাবনা একেবারেই নেই। আজ মাসের ২৩ তারিখ। ওর হাতে কোন টাকাই নেই। সস্তা দামে প্লাস্টিকের বলল কিছু কিনেছে বোধহয়। বাবু অবশ্যি বল পেলেই খুশি। বল কেন যে কোন কিছু হাতে দিলেই খুশি। সেদিন জামান পকেট থেকে চকচকে সাদা রঙের একটা পাথর বের করে বলল, বাবা নাও, পাথর।
নায়লা বলল, পাথর পেলে কোথায়?
জামান উৎসাহের সঙ্গে বলল, মালিবাগ রেল ক্রসিং-এর কাছে রিকশা থেকে নেমে রেল লাইন থেকে নিয়ে এসেছি।
পাথর দিয়ে হবে কি?
বাবু খেলবে।
নায়লা প্রায় বলতে যাচ্ছিল–আমার বাবুর কি এতই খারাপ অবস্থা যে তাকে পথির দিয়ে খেলতে হবে? নিজেকে সামলে নিল–জামানকে এই কথা বলার কোন যুক্তি নেই। সে তার সাধ্যমত করছে। তাছাড়া মজার ব্যাপার হচ্ছে–বাবু ঐ পাথর পেয়ে যত খুশি হয়েছে অন্য কোন খেলনা পেয়ে তত খুশি হয়নি। পাথর সারাক্ষণ তার সঙ্গে সঙ্গে আছে। সে যখন গোসল করবে তখন পাখরটাকেও গোসল করাতে হবে। তেল মাখাতে হবে। পাথরের মাথার চুল আঁচড়ে দিতে হবে।
জামান প্যাকেটটা প্রায় খুলে ফেলেছে। কালো স্কচ টেপ সরানো হয়েছে। সে রহস্যময় ভঙ্গিতে বাক্স ধরে আছে।
কই লায়লা, বাবুকে তুললে না?
এখন ঘুম ভাঙলে কান্নাকাটি করবে।
যে জিনিস এনেছি দেখলে আর কান্নাকাটি করবে না।
কি এনেছ?
আন্দাজ কর তো দেখি।
মনে হচ্ছে ফুটবল।
ফুটবল বুঝি এ রকম প্যাকেট করে দেয়? বল একটা পলিথিনের ব্যাগে ভরে দিয়ে দেয় …, এ অন্য জিনিস দেখলে তোমার ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে যাবে।
জিনিসটা শেষ পর্যন্ত বেরুল। একটা হেলিকপ্টার। দেখার মতই জিনিস। সুইচ টিপে দিতেই লাল, নীল, সাদা, নানান রকম বাতি জ্বলতে লাগল। সাইরেনের মতো কয়েকবার শব্দ করার পর বন বন করে পাখা উড়তে লাগল। নায়লা হতভম্ব হয়ে বলল, এ কি! এটা কি আকাশে উড়ে যাচ্ছে নাকি?
কথা বলো না। মা দেখ।
হ্যাঁ, আকাশেই তো উড়ছে। উড়ার ভঙ্গি করছে। খট করে দরজা খুলে গেলো—পাইলট বেরিয়ে আসছে নাকি? তাই তো। তাই তো। নায়লা বললো, কী আশ্চর্য! পাইলট বেরিয়ে আসছে?
হুঁ।
জামান হাসছে। এমন ভঙ্গিতে হাসছে যেন এই খেলনা সে নিজেই বানিয়েছে। সে খুব সাবধানে সুইচ বন্ধ করলো।
জিনিসটার দাম কত আন্দাজ কর তো দেখি?
তুমি কিনেছ?
আমি কিনেছি কি না সেটা পরের কথা। দাম আন্দাজ কর।
এক হাজার?
যা বললে তাকে তিন দিয়ে গুন কর।
তিন হাজার টাকা দাম?
চেয়েছিল তিন হাজার। দুহাজার পাঁচশতে দিয়েছে।
তুমি নিশ্চয়ই কেনোনি?
পাগল হয়েছ? আমি কোথেকে কিনব? সে এক ইন্টারেস্টিং ইতিহাস। দাঁড়াও, বলি। গোসল করে নেই। গরম পানি দিয়েছ?
দিয়েছিলাম তো। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে বোধহয়! দাঁড়াও, আবার গরম করি।
লাগবে না, লাগবে না। তুমি টেবিলে ভাত দিয়ে দাও। খিদে মারাত্মক লেগেছে। নায়লা, খেলনাটা খুব সাবধানে টেবিলের উপর তুলে রাখ! ব্যাটারিটা খুলে রাখ। থাক, দরকার নেই–তুমি খুলতে পারবে না।
জামান বাথরুমে ঢুকে গেছে। বাবু উঠে পড়েছে। সে বিছানায় বসে চেঁচাচ্ছে–মাম্মাট। মাম্মাট।
ছোট বাচ্চারা মাকে মাই ডাকে। মা ডাকটাই সহজ। কিন্তু বাবু ডাকে মাম্মটি। দুই বছরের বাচ্চা এমন কঠিন শব্দ কি ভাবে বলে কে জানে? এরকম কঠিন শব্দ শিখলই বা কার কাছে?
আম্মাট। মাম্মাট?
আসছি বাবা। আসছি।
বাতিস দুদু দাও।
বাতিস দুদু হচ্ছে তাকে বালিশে শুইয়ে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। সে তিন রকম দুধ খেতে চায়–কোল দুদু (কোলে করে খাওয়াতে হবে), বসা দুদু (নায়লা বসে থাকবে, সে দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাবে) এবং বাতিস দুদু।
নায়লা বাতিস দুদু খাওয়াচ্ছে। জামান গোসল করার মাঝখানে সাবান গায়েই বাথরুমের দরজা খুলে মুখ বের করলো, বাবু উঠে গেছে না কি?
হুঁ। বাতিস দুদু খাচ্ছে।
ওকে ঘুম পাড়িও না। জাগিয়ে রাখবে।
ও জাগবে না। বাতিস দুদু খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়বে।
কথা বলে বলে জাগিয়ে রাখ।
কথা বলে জাগাবে কি, বাবু এর মধ্যেই ঘুমিয়ে কাদা। দুধ খাচ্ছে এই সঙ্গে অভ্যাসমত মায়লার মাথার চুল ধরে আছে।
নায়লা!
হুঁ।
হেলিকপ্টারের শানে নজুলটা শোন …
গোসল শেষ করে এসো, তারপর শুনব। বেশিক্ষণ পানি লাগাবে না ঠাণ্ডা লাগবে।
জামান গোসলের শেষে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকে। আজ আর সে অন্যদিনের মত গোসল শেষ করে বিছানায় শুয়ে থাকলো না–সঙ্গে সঙ্গে খেতে বসলো।
বুঝলে নায়লা, দুপুরে লাঞ্চকে হয়েছে। আমার বস বদরুল সাহেব খবর পাঠালেন–আমার টেলিফোন। উনি খুবই বিরক্ত। উনার টেবিলে কেউ টেলিফোন করলেই উনি বিরক্ত হন। উনার ধারণা, এটা উনার পার্সোনাল টেলিফোন—অফিসের না। যাই হোক, টেলিফোন ধরলাম। দেখি একটা মেয়ে টেলিফোন করেছে। খুব মিষ্টি গলা।
নায়লা বলল, মেয়েটা কে?
বলছি তো–অস্থির হয়ো না। অস্থির হবার কিছু নেই। মেয়েটা হল হোটল শেরাটনের রিসিপশনিস্ট। এস, আলম নামের এক লোক আমাকে খোঁজ করছেন। রুম নম্বর দিয়ে রেখেছেন, আমি যেন সন্ধ্যার পর তার সঙ্গে অবশ্যই দেখা করি। আমি ধাধার মধ্যে পড়ে গেলাম–এস. আলমটা কে? একবার ভাবলাম যাব না, তারপর মনে করলাম, দেখেই আসি। গিয়ে দেখি আমাদের বল।
বল্টুটা কে?
স্কুল জীবনের বন্ধু। ভেরি ক্লোজ ফ্রেণ্ড। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত বেঁটেখাট ছিল–আমরা বল্টু ডাকতাম। হঠাৎ লম্বা হওয়া শুরু করলো–দেখতে দেখতে তালগাছ। তখন তার নাম হয়ে গেলো স্ক্রু ড্রাইভার। তবে ঐ নাম স্থায়ী হল না। আগের নামটা রয়ে গেল।
নায়লা খিলখিল করে হাসছে। হাসতে হাসতে সে বিষম খেলো। জামানও আনন্দিত চোখে তাকিয়ে আছে। এস, আলমের গল্প বলতে তার ভাল লাগছে।
তারপর হল কি–আমি তো হোটেলে উপস্থিত হলাম। গিয়ে দেখি পুরোদস্তুর এক সাহেব। সেই সাহেব আর কেউ না, আমাদের বন্দু।
বল্টু না, স্ক্রু ড্রাইভার।
ও হ্যাঁ, ক্রু ড্রাইভার। তের বছর পর ব্যটিাকে দেখলাম–আই এ পরীক্ষায় ফেল করে পালিয়ে গিয়েছিল।
কোথায় পালিয়ে গিয়েছিল?
কোথায় আমরাও জানতাম না। একদিন খবরের কাগজ খুলে দেখি, ছবি ছাপা হয়েছে শেষের পাতায়–সাবেহ আলম সাইকেলে করে বিশ্ব পর্যটনে বের হয়েছে। ভাঙা লক্কড় একটা সাইকেলে সাইনবোর্ড লাগানো–S. Alam World Tour. বন্টুর গলায় একটা ফুলের মালা হাসি হাসি মুখ।
মজার মানুষ তো!
মজার তো বটেই। সে যে বিশ্ব ভ্রমণে যাচ্ছে সে বিষয়ে আমাদের কিছুই বলে নাই–তার আত্মীয়-স্বজনদেরও কিছু বলে নাই। খুবই ইরেসপনসিবল টাইপের ছেলে। এই দেখ না, ঢাকায় সে এসেছে, দেশের বাড়িতে যায়নি। আত্মীয়-স্বজনের খোঁজও নেয়নি। হোটেল বসে আছে।
উনার মার সঙ্গেও দেখা করেননি?
মার সঙ্গে দেখা করবে কি? মা-কি বেঁচে আছে?
বাবুর খেলনা উনি কিনে দিলেন?
হুঁ। কেউ যে আড়াই হাজার টাকা দিয়ে খেলনা কিনতে পারে তাই জানতাম না। আশ্চর্য!
তুমি নিষেধ করলে না?
বন্দুকে নিষেধ করব আমি? আমার নিষেধ সে শুনবে? বন্টুর সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়নি বলে এমন কথা তুমি বলতে পারলে–ওকে কাল নিয়ে আসব।
নায়লা চিন্তিত মুখে তাকিয়ে রইলো। মাসের শেষের দিকে গেস্ট আনার মত অবস্থাঁ কি আছে? ছেলেবেলার বন্ধু এলে একবেলা তো খাওয়াতেই হবে। ভালমত খাওয়াতে হবে। পোলাও-টোলাও করতে হবে। বাবুকে এ মাসে দুবার ডাক্তার দেখাতে হল। হাত এক্কেবারে খালি। ওর কাছে টাকা চাইতে হবে। ওই-বা কোথায় পাবে।
নায়লা, খুব সিম্পল খাওয়ার ব্যবস্থা করবে–ভাজি-ভুজি, টাকি মাছের ভর্তা ফর্তা, শুটকি, পারবে না?
পারব। উনি করেন কি?
কি করে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি। থাকে সিয়াটলে তবে প্রচুর পয়সা করেছে। দেশে এসেছে বিয়ে করার জন্যে। বিয়ে করে বউ নিয়ে ফিরবে।
বউ পেয়েছেন?
আসলই তো মাত্র পরশুদিন। এর মধ্যে বউ কোথায় পাবে? বউ তো আর দোকানে সাজানো থাকে না। হা হা হা…
সাজানো থাকলেই তোমার বন্ধুর জন্যে ভাল হত। দেখে-শুনে পছন্দসই কিনে নিতে পারতেন। পছন্দ না হলে এক সপ্তাহের মধ্যে ফেরত দিয়ে নতুন একজন …।
জামান বিরক্ত হয়ে বলল, এইসব কি ধরনের কথা?
ঠাট্টা করছি।
আজেবাজে ধরনের ঠাট্টা করবে না। চা দাও দেখি–চা খাব।
এখন চা খাবে? চা খেলে তো তোমার ঘুম হয় না।
কাল ছুটির দিন আছে। ঘুম দেরিতে এলেও ক্ষতি নেই।
টেবিল পরিষ্কার করে তারপর দেই।
আচ্ছা।
নায়লা শোন, দুধ-চিনি ছাড়া শুধু লিকারে এক কাপ চা দাও। লিকারের চা শরীরের জন্যে ভাল।
আচ্ছা।
চা বানিয়ে এনে নায়লা দেখে জামান নিজেই মুগ্ধ হয়ে হেলিকপ্টার দিয়ে খেলছে। শিশুরাও এত মুগ্ধ হয়ে কোন খেলনা নিয়ে খেলে না। নায়লাকে দেখে সে লজ্জিত মুখে বললো, ইন্টারেস্টিং, তাই না?
হুঁ।
সামান্য খেলনা, অথচ কি করেছে! সবই ইলেকট্রনিক্স। সায়েন্স কোথায় চলে যাচ্ছে। ঘরে পান আছে?
আছে।
চা খাবার পর পান খাব। কাল মিষ্টিপানের ব্যবস্থা রেখো তো নায়লা–বন্টুর আবার দেখি পান খাবার অভ্যাস হয়েছে। একসঙ্গে দুটা মিষ্টিপান মুখে দিয়ে কচকচ করে চিবোচ্ছে।
উনি দেখতে কেমন?
ছোটবেলায় বেকুপ টাইপ চেহারা ছিল। এখন রাজপুত্রের মত। যে কোন সিনেমায় তাকে হিরোর পার্ট দেবো।
জামানের চা খাওয়া হয়েছে, পানি খাওয়া হয়েছে। রাত প্রায় বারোটার মত বাজে। এখন ঘুমুতে যাওয়া দরকার। জামানের ঘুম আসছে না। স্ত্রীর সঙ্গে আরো কিছুটা সময় কাটাতে ইচ্ছা করছে। খুব অন্তরঙ্গ কিছু সময়। গোপন ইচ্ছাটা নায়লাকে কি ভাবে বলবে তাও বুঝতে পারছে না। লুজ্জালজ্জা লাগছে। এই সমস্যাটা তাকে খুব বিরক্ত করে। অন্য স্বামীদের এই সমস্যা হয় কিনা কে জানে।
নায়লা বলল, শুবে না?
জামান অস্বস্তির সঙ্গে বলল, ঘুম আসছে না। চা খাওয়াটা বোধহয় ঠিক হয় নি। বাজে কটা?
বারোটা পাঁচ।
ও, রাত তো অনেক হয়ে গেলো। চল ঘুমুতে যাই।
বলেও জামান বসেই রইলো। তার এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, সে নায়লার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও পারছে না। তার ভয় হচ্ছে, সে তাকালেই নায়লা বুঝে ফেলবে কেন তার ঘুম আসছে না।
নায়লা।
উঁ।
খুব ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দাও তো।
খুব ঠাণ্ডা পানি তো পাব না। সাধারণ এক গ্লাস পানি দেই?
আচ্ছা দাও। ফিরুর মা কি শুয়ে পড়েছে?
হুঁ। কেন?
না এম্নি।
জামানের কেমন জানি উদাস উদাস লাগছে। মনে হচ্ছে মুখ ফুটে আজ রাতে সে স্ত্রীকে কিছু বলতে পারবে না।
নায়লা তাকে পানি দিয়ে চলে গেছে। যাবার সময় রহস্যময় ভঙ্গিতে বলেছে–তুমি বসে থাকে। আমি আসছি। বলতে বলতে ঠোটের ফাঁকে একটু যেন হাসলো। এর মানে কি? সে কি কিছু বুঝে ফেলল? বুঝে ফেললে খুব অস্বস্তির ব্যাপার হবে। শুধু অস্বস্তি না, লজ্জাও।
নায়লা শোবার ঘরে এসে নিজের মনেই খানিকক্ষণ হাসল। মানুষটার এত লজ্জা কেন? সে কি বাইরের কেউ? অনেক দূরের কেউ যাকে মুখ ফুটে কিছুই বলা যাবে না? নায়লা খুব সাবধানে স্টীলের আলমিরা খুলে টকটকে লাল রঙের শাড়ি বের করলো। ঠোটে লাল করে লিপিস্টিক দিল। কপালে টিপ দিল। চুল পিঠে ছড়িয়ে দিল। কাজল বানানো নেই। কাজল থাকলে সুন্দর করে চোখে কাজল দেয়া যেতো। মানুষটা কাজল খুব পছন্দ করে। বিয়েবাড়ি-টারি কোথাও যেতে হলে সে একবার না একবার বলবেই–নায়লা কাজল দিয়েছ? যেন সাজসজ্জার একটাই বিষয়–কাজল। আজ সে দারুণ একটা সাজ করে মানুষটাকে বলবে–দেখ তো কেমন লাগছে?
শাড়ি বদলাবার আগেই বাবু উঠে পড়েছে। বাতিস দুদু, বাতিস দুদু বলে চেঁচাতে শুরু করেছে। নায়লা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে মশারির ভেতর ঢুকল।
মম্মাট, বাতিস দুদু।
দিচ্ছি রে বাবা, দিচ্ছি।
বাবু এক হাত দিয়ে নায়লার চুল টানছে। পা গুটিয়ে বুকের কাছে নিয়ে ছোট্ট পুটলির মত হয়ে পড়েছে। তার গা থেকে কি সুন্দর গন্ধ আসছে। আচ্ছা, শিশুদের গা থেকে এক এক সময় যে এক এক রকম গন্ধ আসে তা কি কেউ লক্ষ্য করেছে?
ঘুমে নায়লার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আধ-ঘুম আধো জাগরণে তার মৃনে হচ্ছে–আহা! বেচারা একা একা বসে আছে।
নায়লাদের বাসাটা ফ্ল্যাটবাড়ি
নায়লাদের বাসাটা ফ্ল্যাটবাড়ি বলতে যা বোঝায় তা না। ফ্ল্যাটের মালিক শুরুতে ছাদে ড্রাইভারদের থাকার জন্য কিছু ঘর করেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, এই ঘরগুলি বেশ ভাল টাকায় ফ্ল্যাটের মালিকরা কিনে নেবেন। বাস্তবে দেখা গেল, ড্রাইভারদের জন্যে ঘর নিতে কেউ আগ্রহী নয়। ফ্ল্যাট-মালিক তৈরী ঘরগুলি নষ্ট করলেন না। রাজমিস্ত্রীকে দিয়ে আরো কিছু কাজ করিয়ে তিনটা ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাট বানালেন। একটা শোবার ঘর। একটা বসার ঘর। ডাইনিং টেবিল বসানোর জন্যে সামান্য কিছু ফাঁকা জায়গা। এই ফ্ল্যাটগুলি বিক্রির চেষ্টা হচ্ছে–খুব সস্তা। ন লক্ষ টাকা। এক সঙ্গে ক্যাশ পেমেন্ট করলে আরো কম–আট লাখ পঞ্চাশ হাজার।
মিনি ফ্ল্যাটও বিক্রি হল না। শেষ পর্যন্ত ভাড়াটে খাজা হতে লাগলো। জামানের মতো কয়েকজনকে পাওয়া গেল। এদের মধ্যে জামান সবচে ভাগ্যবান, কারণ তাকে স্বচে কম ভাড়া দিতে হয়–মাত্র ১৭ শ টাকা। তার ভাড়া কম হওয়ার কারণ হলো, সে ফ্ল্যাটওয়ালাদের এসোসিয়েশনের কিছু কাজকর্ম করে দেয়। সে তাদের একজন পার্ট-টাইম এমপ্লোয়ি।
জামানের এই ফ্ল্যাট খুব পছন্দ! প্রথম দিনেই মুগ্ন গলায় বলেছিল, ফ্ল্যাট যেমন তেমন, কতবড় ছাদ দেখেছ? ছাদের মালিক তো আমরাই। ছাদটা সব সময় থাকবে আমাদের দখলে। বাবু ছোটাছুটি করে খেলতে পারবে। নায়লা, তোমার পছন্দ হয়েছে?
নায়লা হাসলো। তার হাসি দেখে মনে হতে পারে মিনি ফ্ল্যাট তার খুব পছন্দ হয়েছে। আসলে তার মোটেই পছন্দ হয়নি। এত উঁচুতে মানুষ থাকে? পায়ের নিচে মাটি নেই–এ কেমন থাকা? তাছাড়া ছাদের রেলিং নিচু। বাবু আরেকটু বড় হলেই রেলিং-এ চড়ার চেষ্টা করবে। তখন?
বুঝলে নায়লা, ১৭ শ টাকায় এরকম বাড়ি ঢাকা শহরে পাওয়া ভাগ্যের কথা। আমি হলাম একজন মহাভাগ্যবান ব্যক্তি। কি রকম হওয়া দেখেছ? ভাদ্র মাসেও দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখতে হবে। এমনই হবে হাওয়ার যন্ত্রণা। মশারিও খাটাতে হবে না।
মশারি খাটাতে হবে না কেন?
মশা পাখায় ভর করে এত উঁচুতে উঠতে পারে না। যত উপরে উঠবে হাওয়া তত
হালকা হবে। এটা হল সায়েন্সের কথা।
নায়লা বলল, তোমার বাড়ি খুব পছন্দ হয়েছে?
অবশ্যই হয়েছে। পছন্দ না হওয়ার কোন কারণ আছে? ছাদের উপর জুটা চেয়ার ফেলে রাখব। দুজনে বসে চা খাব। জোছনা রাতে ছাদে বসে চা খাবার মজাই আলাদা। শুধু সিঁড়ি ভেঙে এতদূর উঠা একটা কষ্টের ব্যাপার হবে। তবে বার বার উঠা-নামার দরকার কি?
সিড়ি ভেঙে উঠতে হবে কেন? লিফট আছে না?
লিফট তো আর ছাদ পর্যন্ত আসবে না।
আটতলা পর্যন্ত তে আসবে। সেখান থেকে একতলা হেঁটে উঠবে।
জামান লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো, লিফটে উঠা যাবে না নায়লা।
কেন?
ওরা নিষেধ করে দিয়েছে। এসোসিয়েশন। কারণ আমরা ছাদে যারা আছি তারা তো আর লিফটের খরচা দিচ্ছি না। আমরা হচ্ছি ফ্ল্যাটের থার্ড গ্রেড সিটিজন। ড্রাইভার শ্ৰেণী। আমাদের উঠতে হবে হেঁটে হেঁটে।
এটা কেমন কথা?।
জামান উজ্জ্বল মুখে বলল, এর একটা ভালো দিকও আছে। আত্মীয়স্বজন সহজে কেউ আসবে না। মেহমানদারির খরচ বেঁচে গেল। এই জমানায় মেহমানদারির খরচ তে! সহজ খরচ না। বেজায় খরচ।
তুমি সিড়ি ভাঙবে কি ভাবে? অল্প খানিকটা উঠতেই তোমার যে অবস্থা হয়। নিঃশ্বাস নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
আমার কোনই অসুবিধা হবে না। আস্তে আস্তে উঠব। তাছাড়া এক্সারসাইজ হবে। এক্সারসাইজের তো দরকার আছে। এমনিতে তে এক্সারসাইজ হয়ই না। সিড়ি ভাঙার কারণে যদি হয়। শাপে বর হলো আর কি? হা হা হা।
শাপে বর ঠিক হয় নি।
আজ একদিনে চারবার জামানকে উঠা-নামা করতে হয়েছে। বাইরের একজন মেহমান খাবে। বাজার আছে। সব কিছু একসঙ্গে হয় না। প্রথমবার পান আনতে ভুলে গেলো।
পান আনার পর মনে হল, মিষ্টি কিছু থাকা দরকার। জামান আবার রওনা হলো। নায়লা বলে দিল, শোন, লিফটে করে আসবে। হঠাৎ হঠাৎ উঠা। কেউ দেখবেও না।
জামান হাসল, তার মানে সে লিফটে উঠবে না। হেঁটেই উঠবে। কোন মানে হয়?
শোন, তুমি কিন্তু তোমার বন্ধুকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে রওনা দেবে না। অবশ্যই লিফটে আসবে।
আচ্ছা, সেটা দেখা যাবে।
দেখা যাবে টেখা যাবে না। অবশ্যই লিফটে উঠবে।
জামান আবার হাসল।
সব সময় এরকম হাসি দেখতে ভাল লাগে না। রাগ লাগে। নায়লার রাগ লাগছে।
আলম ফুলের তোড়া কিনেছে। পঞ্চাশটা গোলাপের বিশাল-তোড়া। আড়াই শ টাকা নিল তোড়ার দাম। এত টাকা দিয়ে ফুল কেনার কোন মানে হয়? জামান বলল, ফুল কেনাকেনির দরকার কি?
আলম বলল, কোন দরকার নেই। ফুল দিয়ে কি হয়? কিছুই হয় না। লাউ ফুল হলেও একটা কথা ছিল। বড়া বানিয়ে তুই খেয়ে ফেলতিস।
জামান বলল, ঘরে ফুলদানি-টুলদানি নেই। এত ফুল রাখবে কোথায়?
ফুলদানি নেই? বলবি তো। চল ফুলদানি কিনি।
আরে না না।
সব সময় না না করবি না। চল, সুন্দর একটা ফুলদানি কিনি। তোর বৌ খুশি হবে।
জামানের অস্বস্তির সীমা রইল না। ফুলদানির কথাটা বলাই ভুল হয়েছে। কেন যে বলল। জার্মান ক্রিস্টালের ফুলদানির দাম পড়ল সতের শ টাকা। এতটাকা দিয়ে লোকজন ফুলদানি কেনে? এত টাকা মানুষের আছে?
আলম বলল, আর কি কেনা যায়?
যথেষ্ট হয়েছে। আর কি কিনবি?
তোর বাচ্চার জন্যে খাবার। সে চকলেট খায় তো?
আলম, তোর পায়ে পড়ি, আর কিছু কিনতে হবে না।
চকলেট তো কিনতেই হবে। ছোট বাচ্চাদের ফুল দিয়ে ভুলানো যায় না। ওদের ভুলাতে হয় খাবার দিয়ে।
এক প্যাকেট চকলেট কেনা হলো। ইংল্যাণ্ডের কেডবেরিজ কোম্পানীর চকলেট। সাড়ে চার শ টাকা খরচ হল চকলেটে। জামান দ্রুত হিসেব করছে কত খরচ হল। আড়াই শ টাকা ফুল, সতেরো শ টাকা ফুলদানি, সাড়ে চার শ টাকা চকলেট–সব মিশিয়ে দু হাজার চার শ। কি সর্বনাশের কথা।
জামান।
কি?
আর এখন তোর বৌয়ের জন্যে একটা শাড়ি কিনি। তার কি রঙ পছন্দ বল তো?
অসম্ভব। আর কিছু তোকে কিনতে দেব না।
তুই না বললে তো হবে না। কেনার ব্যাপারটা আমার। তোর দায়িত্ব হচ্ছে উপহারের ব্যাগ হাতে নিয়ে ঘোর। এখানে কি ভাল কফি শপ আছে? কড়া করে এক কাপ কফি খেয়ে নতুন উত্তেজনায় শাড়ি কেনা শুরু হবে। কফি শপ এখানে নেই?
আছে কি না জানি না। নিউ মার্কেটে এসে তো কখনো কফি খাইনি। চায়ের দোকান আছে।
চা-তেও চলবে। চল চা খওয়া যাক।
চায়ের দোকানে জামান লজ্জিত ও সংকুচিত ভঙ্গিতে বসে আছে। বড় অস্বস্তির মধ্যে পড়া গেল। আলম পাগলা টাইপের সব সময়ই ছিল। এখন কি তার পাগলামি আরো বেড়েছে? সামান্য দাওয়াত খেতে যাবার সময় এত কিছু কেউ কেন? এটা কি বাড়াবাড়ি না?
জামান?
হুঁ।
তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে তোর উপর দিয়ে একটা রোলার চলে গেছে। কিছুক্ষণ আগেও তো বেশ হাসিখুশি ছিলি। এখন হয়েছে কি?
কিছু না।
কিছু না হলে পুরানো বন্ধুর সঙ্গে হাসিমুখে চা খা। তোকে দেখে মনে হচ্ছে এক কাপ ইদূর-মারা বিষ সামনে নিয়ে বসে আছিস। চ-টা ভাল হয়েছে। চুমুক দে।
জামান যন্ত্রের মতো চায়ে চুমুক দিল। আলম ঝুঁকে এসে বলল, শেনি রে ব্যাটা, তোর এত অস্বস্তি বোধ করার কিছুই নেই। আমি হত-দরিদ্র ছিলাম, এখন ভাল টাকাপয়সা হয়েছে। কি পরিমাণ হয়েছে শুনলে তুই ভড়কে যাবি। সামান্য খরচ করি। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের জন্য যে খরচ করব সেই উপায়ও তো নেই। নো আত্মীয়স্বজন, নো বন্ধু-বান্ধব। তা ছাড়া এইসব উপহার-টুপহার কেনার পেছনে আমার উদ্দেশ্যও আছে। আমি এখন একজন ব্যবসায়ী মানুষ। ব্যবসায়ীরা বিনা উদ্দেশ্যে কিছু করে না।
উদ্দেশ্যটা কি?
এটা হল আমার এক ধরনের ইনভেস্টমেন্ট। আমি ইনভেস্ট করছি।
কিসের ইনভেস্টমেন্ট?
আমি বিয়ে করব। আমাকে একটা মেয়ে খুঁজে দিতে হবে। কে খুঁজবে? তোর বৌকেই খুঁজতে হবে। তাকে খুশি না করলে এই কাজটা সে আগ্রহ নিয়ে করবে না। এটা হল আমার প্রথম উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হল, এক থেকে থেকে আমার জীবন অসহ্য হয়েছে। একটা ফ্যামিলীর সঙ্গে থাকা যে কি জিনিস আমি ভুলেই গেছি। তোর বৌ যদি বলে ফেলে, আপনি হোটেলে পড়ে আছেন কেন? অল্প কদিন থাকবেন। আমাদের সঙ্গে থাকুন। তখন পোটলা-পুটলি নিয়ে উঠে আসব। তোর কি ধারণা? এ রকম কলার সম্ভাবনা আছে?
না।
আলম অবাক হয়ে বলল, না কেন? সে কি বন্ধু-বান্ধব পছন্দ করে না?
খুবই পছন্দ করে। তোকে সে রাখবে কোথায়? থাকার জন্যে একটা ভালো বিছানা তে অদ্ভুত দিতে হবে। আমাদের বাসায় একটা মাত্র বাথরুম, সেই বাথরুমে যেতে হয় শোবার ঘরের ভেতর দিয়ে।
তুই বলতে চাচ্ছিস সে কখনোই আমাকে থাকতে বলকে না?
না।
হোটেলে যে কি ভয়াবহ অবস্থায় আছি সেটা করুণ গলায় বললেও লাভ হবে না?
না।
তোর সঙ্গে এক হাজার টাকা বাজি–সে আজ রাতেই বলবে হোটেল ছেড়ে দিতে। নে, সিগারেট নে। ধোয়া দিয়ে মাথাটাকে একটা ওয়াশ দে। তারপর চল্ সুন্দর দেখে শাড়ি কিনি। কি রঙ তোর বৌয়ের পছন্দ?
জানি না।
জানি না মানে? স্ত্রীর কোন ব্রঙ পছন্দ সেটা হাসবেন জানবে না। আমেরিকা হলে এই অপরাধে তোর ডিভোর্স হয়ে যেত। তুই কি তোর স্ত্রীকে নিয়ে কখনো শাড়িটারী কিনতে আসিস নি?
এসেছি। খেয়াল করিনি।
তোর স্ত্রীর গায়ের রঙ ফর্সা না কালো? না-কি এটাও খেয়াল করিসনি?
ফর্সা।
তাই-ই বল–বেঁটে না লম্বা?
লম্বা।
কি রকম লম্বা–তালগাছ না বাঁশ গাছ?
মোটামুটি।
চল দেখা যাক। শাড়ির দোকানের সঙ্গে ব্যবস্থা করে যাব, পছন্দ না হলে যাতে ফেরত নেয়।
আলম উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, বুঝলি আলম, এই পৃথিবীতে সবচে সহজ কাজ হলো মেয়েদের খুশি করা। এরা খুশি হবার জন্যেই বসে আছে। অথচ আমাদের রবীন্দ্রনাথ ভুল কথা বলে গেলেন–রমণীর মন। সহস্র বৎসরের সখ সাধনার ধন। সহস্র বৎসর লাগে না। ঘণ্টা খানিকের সাধনাতেই কাজ হয়।
জামান বলল, আমি জানতাম না।
সবচে সহজে খুশি করা যায় কাদের জানিস? বিবাহিত মেয়ে, যার ছোট একটা বাচ্চা আছে। বাচ্চাটাকে মার সামনে টেনে নিয়ে শুধু বলবি, এই রাজপুত্র কার? ব্যস, The battle is won. বাচ্চাটার খেলনা নিয়ে তার সঙ্গে খেলবি। তাকে কাতুকুতু দিয়ে হাসবি। দেখবি কি অবস্থা হয়।
তোর কথাবার্তা আমার ভাল লাগছে না।
আলম হাসতে হাসতে বলল, ভাল না লাগারই কথা। যা বললাম সবই বইয়ের কথা। আমেরিকান এক মহিলা তিন শ পৃষ্ঠার এক বই লিখেছেন–কি করে মেয়েদের ভুলাতে হয়। How to tale the girls, এই বই অমি বাইবেলের মতো গভীর মনযোগের সঙ্গে পড়েছি। মুখস্থ করে ফেলব বলে ভাবছি! এইটা তোরও পড়া দরকার। স্বামী হিসেবে তুই ১০০-এর ভেতর ৩২/৩৩-এর বেশি পাস না বলেই আমার ধারণা। বই পড়লে তোর রেটিং বাড়বে।
নায়লা দরজা ধরে দাঁড়িয়েছিল।
সে হালকা রঙের সবুজ শাড়ি পরেছে। এটা তার খুব প্রিয় শাড়ি, কিন্তু এক জায়গায় সামান্য ভেঁড়া আছে। হেঁড়া অংশটি খুব সাবধানে রিপু করা, তারপরেও এই শাড়ি পরলেই মনে হয় রিপু করা অংশটা বুঝি বের হয়ে এল। রান্না-বান্না শেষ করে কিছুক্ষণ আগে গোসল করা হয়েছে বলে তার সারা শরীরে স্নিগ্ধ ভাব। চুল শুকায়নি তাই বাঁধা হয়নি। ভেজা চুল পিঠের উপর ছড়ানো বলে এক ধরনের অস্বস্তিবোধ আছে। নায়লার মন আজ অত্যন্ত প্রফুল্ল। গত মেরিজ এ্যানিভার্সারী উপলক্ষে সে কয়েকটা দামী চিনামাটির প্লেট কিনেছিল। একটা টেবিল ক্লথ এবং কঁচের একটা মোমদানি কিনেছিল। এক বছর পর এই প্রথম ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু মোমদানিটা বোধহয় ব্যবহার করা যাবে না। ইলেকট্রিসিটি গেলে মোমদানি কি করে ব্যবহার করা যাবে? তবুও সে মোম বসিয়ে মোমদানি সাজিয়ে রেখেছে। মোমদানির পাশে একটা নতুন দেয়াশলাই। এই দিকে রাত আটটা থেকে মস্টার মধ্যে একবার না একবার কারেন্ট যাবেই। ভাগ্য ভালো থাকলে আজও হয়ত যাবে। মোমদানিটা ব্যবহার করা যাবে।
আলম নায়লার সামনে দাঁড়িয়ে নায়লাকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলল, কেমন আছি নায়লা?
নায়লা পুরোপুরি হকচকিয়ে গেল। এ কেমন সম্বােধন? বিদেশে যারা থাকে তারা কি এই ভাবেই বন্ধুপত্নীর সঙ্গে কথা বলে? এখন কি এই মানুষটা হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেবে? যদি সত্যি হাত বাড়ায় তাহলে সে কি করবে? হ্যান্ডশেক করবে? নায়লা কাতর চোখে স্বামীর দিকে তাকাল। জামানের মুখে কোন বিব্রত ভাব নেই। তার মুখ হাসি হাসি। মনে হচ্ছে নায়লার হকচকিয়ে যাওয়াটা উপভোগ করছ।
আলম আগের চেয়েও স্বাভাবিক গলায় বলল, নায়লা, আমি তোমার জন্যে কিছু ফুল নিয়ে এসেছি। ফুলগুলো কি নেবে?
নায়লার অস্বস্তির সীমা রইল না। মানুষটা এভাবে কথা বলছে কেন? জামান হাসিমুখে বলল, নাও, ফুলগুলো নাও। তুমি লজ্জায় মরে যাচ্ছ কেন? এ আমার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এ রকম ভাল ছেলে সচরাচর পাবে না।
আলম বলল, নায়লা, তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে, তুমি আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না। যদি দরজা থেকে সরে দাঁড়াও তাহলেই ভেতরে ঢুকতে পারি। আর আমি যে অতি ভাল ছেলে এই সার্টিফিকেট তো জামান দিলই।
নায়লা লজ্জা পেয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। আলম ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ভাবী, আপনি নিশ্চয়ই আমার ব্যাপারে খুব বিরক্ত হচ্ছেন। চিনে না শুনে না একজন মানুষ নাম ধরে ডাকছে, তুমি করে বলছে, Unacceptable. তবে ভাবী, আপনাকে না চিনলেও আপনার কর্তীকে হাড়ে-গোশতে চিনি। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় আমরা দুজন একসঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলাম। সেই ইতিহাস কি সে আপনাকে বলেছে?
জি-না।
খুবই মজার ইতিহাস। আমি বলব। ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় ও যে একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে গেল। মাথা খারাপের মত অবস্থা। পীর-ফকির ধরাধরি। শেষটায় বিষ খাওয়ার জন্যে বিষ কিনে আনা। এই ঘটনা জানেন?
নায়লা বিস্মিত হয়ে বলল, না।
এই ঘটনাও আপনাকে বলব। এখন কথা হচ্ছে, আমি জামানকে ডাকি তুই করে। আর আপনাকে ডাকব আপনি করে। সেটা কি শোভন হবে? গুরুচণ্ডালী হয়ে যাচ্ছে না? আপনাকেও তুই করে বলা উচিত। সেটা সম্ভব না বলে আমি এখন থেকে তুমি করে বলব। আপনি রাগ করুন আর না করুন, কিছু যায় আসে না।
নায়লা বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, আপনি তুমি করেই বলবেন।
আমি ভাবীও বলতে পারব না। ভাবী বললেই মনে হয় বয়স্ক একজন পান-খাওয়া মহিলা। পরনে গরদের লালপাড় শাড়ি। এরকম বাচ্চা একতা মেয়েকে আমি ভাবী বলতে পারব না। নাম ধরে ডাকব।
নায়লা কিছু বলল না। জামান বলল, এত কথার দরকার কি? তুই নাম ধরে ডাকবি।
না, নাম ধরে ডাকব না। নায়লা ভাবী এখনো মুখ শক্ত করে রেখেছে। বাঙালী মেয়েদের বিয়ের পর নাম ধরে ধরে ডাকলে এরা খুব রাগ করে। আমি ভাবীই বলব, তবে তুমি করে বলবো। নায়লা ভাবী, ঠিক আছে?
হ্যাঁ, ঠিক আছে।
আরেকটা ব্যাপারে তোমার মনটা কালো হয়ে আছে, বুঝতে পারছি। স্বামীর প্রেম কাহিনী শুনলে মন কালো হয়েই। ভাবী শোন, জামান হচ্ছে এমন এক ছেলে যে কোনদিন কোন মেয়ের দিকে মুখ তুলে তাকায়নি। তার কোন মেয়ের প্রেমে পড়ার প্রশ্নই ওঠে না। প্রেমে পড়েছিলাম আমি। হায় রে, কি প্রেম! মজনুর প্রেম এর কাছে কিছু না। ঐ মেয়ে রিকশা করে আসতো, আমার মনে হতো–রিকশাওয়ালাটার কি সৌভাগ্য! এক একবার ইচ্ছা করলে, রিকশাওয়ালাকেই কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করি।
নায়লা অনেক চেষ্টা করেও হাসি চাপতে পারল না। খিলখিল করে হেসে ফেলল। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, আপনাদের বিয়ে হয়নি কেন?
বিয়ে হবে কি ভাবে? ইন্টারমিডিয়েট ফেল ছেলের কাছে কোন মধ্যবিত্ত বাবা মেয়ে বিয়ে দেয়? তাও যদি মেয়েটার প্রেম থাকতো তাহলে একটা কথা হতো। পালিয়ে-টালিয়ে একটা ব্যবস্থা করা যেত। ঐ মেয়ে আমাকে দুই চক্ষে দেখতে পারত না।
কেন?
কেন সেটা ঐ মেয়েই জানে। যাই হোক ভাবী, তোমার পুত্র কোথায়?
কাজের মেয়েটা নিচে হাঁটতে নিয়ে গেছে। কাঁদছিল।
ওর নাম যেন কি?
বাবু।
ওকে ডেকে আনার ব্যবস্থা করা যায়? তোমার সামনে বাবুকে সিরিয়াস ধরনের আদর করতে হবে। বুঝলে নায়লা ভাবী, একটা বইতে পড়েছি–মাদের মন জয় করার একমাত্র উপায় হল–মার আদরের পুত্র-কন্যাদের আদর দেখানো। বাচ্চার নাক দিয়ে হয়তো সিকনি পড়ছে, তাকে টান দিয়ে কোলে তুলে নিয়ে নিজের রুমাল দিয়ে নাক মুছে তৎক্ষণাৎ সেই নাকে চুমু খেতে হবে। তাহলেই কর্ম কাভার। বাচ্চার হৃদয় অবশ্যি জয় করা যাবে না। বাচ্চারা এত সহজে ভুলে না তবে মার হৃদয় জয় করা যাবে। মা কেনা হয়ে যাবেন ফর গুড।
আপনি কি আমাকে কিনে ফেলতে চান?
না, তা চাই না। তবে আমি তোমার ফেভার চাই। তোমার ভোর ছাড়া আমার গতি নেই। তুমি আমাকে বিয়ে করার জন্যে একটা মেয়ে জোগাড় করে দেবে। এই পবিত্র কাজটি যে আর কেউ করে দেবে সেই উপায় নেই, কারণ–আমার আর কেউ নেই।
আচ্ছা সে ব্যবস্থা হবে। আলম ভাই, ভাত কি এখনই দেব না আরো পরে?
খাবার এখন দিলে তো খেয়েই চলে যেতে হবে। পরে খাওয়াই ভাল। তবে এই ফাঁকে কফি খেতে পারি।
কফি নেই।
আমি নিয়ে এসেছি। ইনসটেন্ট কফি। এই প্যাকেটে কফি আছে। আর এই প্যাকেটে একটা শাড়ি আছে। তোমার জনে সামান্য উপহার। আমাকে যদি তোমার পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে দয়া করে নতুন শাড়িটা পর। তোমার যে শাড়িটা পরে আছে সেটা খুবই সুন্দর। তবে শাড়ির ভেঁড়া অংশটা ঢেকে রাখার জন্যে যে পরিশ্রম করছ সেটা চোখে লাগছে।
নায়লা অস্বস্তি নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে গেল। কি অদ্ভুত মানুষ! ছেঁড়া শাড়ির কথা এই ভাবে কেউ বলে? না বলা উচিত? সব কিছুরই শোভন-অশোভন বলে একটা সীমা আছে। চট করে এই সীমা অতিক্রম করা কি উচিত? নায়লার খুব জ্জাও লাগছে। ভদ্রলোক দামী একটা শাড়ি উপহার নিয়ে এসেছেন ভাল কথা–তাই বলে তাঁর এমন কোন অধিকার জম্মেনি যে তিনি বিপু করা শাড়ির প্রসঙ্গ তুলেন। নতুন শাড়ি এখন পরতে ইচ্ছা করছে না। না পরলেও ভাল দেখায় না। কফি বানাতে হবে। কফি কি করে বানায় সে জানে না। তাদের বাড়িতে কফির চল ছিল না। কৌটার গায়ে কি লেখা আছে? এক কাপে কতটা করে দিতে হয়? এক চামচ?
আলম জুতা-মোজা খুলে ঘরোয়া হয়ে বসেছে। বসার ঘরে বেতের চেয়ারের সঙ্গে একটা খাট পাতা। আলম বসেছে খাটে। ঠিক বসা নয়। আধশোয়া হয়ে বসা। তার সামনেই জামান বেতের চেয়ারে বসে আছে। জামানের মাথা ধরেছ। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় হঠাৎ মাথাটা ধরে উঠল। ঘরে মাথাধরার কোন ট্যাবলেট খুব সম্ভব নেই। ট্যাবলেটের জন্যে তাকেই নিচে নামতে হবে। এখন আর তা সম্ভব না।
জামান!
হুঁ।
তুই এমন চোখ-মুখ শুকনো করে বসে আছিস কেন? ইজ এনিথিং রং?
না। মাথা ধরেছে।
শোবার ঘরে গিয়ে চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ শুয়ে থাক। আমার ক্রমাগত কথা শুনে মাখী ধরেনি তো? আসার পর থেকে আমি তো ক্রমাগতই কথা বলে যাচ্ছি।
জামান ক্লান্ত গলায় বলল, আমার শরীরটা বোধহয় ভাল না। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে বুকে হাঁপ ধরে। মাথাধরা তো লেগেই আছে। সামান্য পরিশ্রমেই কাহিল।
তুই কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাক। রাতের পাঁচ ঘণ্টা ঘুমে যত উপকার হয়, অন্য সময়ের দশ মিনিটের বিশ্রামেও সমান উপকার। তুই যা তো।
জামান সত্যি সত্যি উঠে গেল।
নায়লা কফি বানিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে আলম একা একা খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। নায়লা বলল, ও কোথায়?
আলম হাসতে হাসতে বলল, খুব সম্ভবত ঘুমুচ্ছে। আমি ওকে ঘুমুতে পাঠিয়ে দিয়েছি। বলেছে, মাথা ধরেছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে ও খুব টায়ার্ড। আচ্ছা, ওর কি কোন অসুখ-বিসুখ আছে?
কেন বলুন তো?
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় দেখি হা হা করে শ্বাস নিচ্ছে। হার্টের কোন সমস্যা থাকতে পারে বলে আমার ধারণা। যদি সমস্যা থাকে তাহলে তো সিঁড়ি ভেঙে এত দূর উঠা ঠিক না। লিফট থাকতে সিড়ি বেয়ে উঠার ব্যাপারটা আমি বুঝিনি।
আপনার না বোঝাই ভাল। নিন, কফি নিন। আমি কফি কখনো বানাইনি। কাজেই ঠিকমত হয়েছে কি না বুঝতে পারছি না। হয়ত তিতা হয়ে গেছে।
কফি তিতা হতে হয়। আমি কফি খাই গন্ধের জন্যে, স্বাদের জন্যে না। ভাবী, তুমি বোস।
নায়লা বসল। সে শাড়ি বদলেছে। নতুনটা পরেছে, কিন্তু তার ধারণা তাকে আগের শাড়িতেই অনেক বেশি সুন্দর লাগছিল।
নায়লা ভাবী!
জি।
তুমি কি রাগ করেছ আমার উপর?
রাগ করার মতো আপনি কি কিছু করেছেন?
হ্যাঁ, করেছি। আমি ছেড়া শাড়ির কথা বলেছি। এটা অভদ্রতা, অন্যায় এবং চূড়ান্ত রকম অশোভন একটা কাজ।
অশোভন যদি জানেন তাহলে কেন করলেন?
জানি না কেন করেছি। আর কোনদিন করব না। শেনি নায়লা ভাবী, এই শাড়িটায় তোমাকে মোটেই মানাচ্ছে না।
আমি জানি। বদলে কি ভেঁড়াটা পরে আসব?
প্লীজ।
নায়লা উঠে চলে গেল। আলম লক্ষ্য করলো–নায়লা বের হল অতিরিক্ত ব্যস্ততার সঙ্গে। যেন কোন রকমে পালিয়ে যেতে পারলে সে বাঁচে।
শোবার ঘরে কুণ্ডলী পাকিয়ে জামান ঘুমুচ্ছে। জ্বর আসছে না-কি? নায়লা খুব সাবধানে কপালে হাত ছুঁয়াল। না, জ্বর নেই, তবে গা একটু বোধহয় গরম। নায়লা স্বামীর পাশে খানিকক্ষণ বসল। ওকে একজন ডাক্তার দেখাতে হবে। বেচারা সিঁড়ি দিয়ে একেবারেই ওঠানামা করতে পারে না। বড় কোন অসুখ বাধায়নি তো। সংসারের যে হাল–বড় কোন অসুখ হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
ফিরুর মা বাবুকে কোলে নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকল। বাবু ঘুমুচ্ছে। নায়লা সাবধানে ছেলেকে বাবার পাশে শুইয়ে দিলো। দুজনই আরাম করে ঘুমুচ্ছে। কি সুন্দর লাগছে এই দুজকে! এই দৃশ্য বোধহয় অনন্তকাল ধরে দেখা যায়।
ফিরুর মা।
জি।
খাবার-দাবারগুলি সব গরম করতে থাকো।
চইদ্দবার তরকারি গরম করলে তরকারির স্বাদ নষ্ট হয়গো আম্মা।
তোমাকে যা করতে বলছি, কর। মুখে মুখে তর্ক করবে না।
পরনের শাড়িটা কি নয়া আম্মা?
হুঁ।
ব্যাটাটা যে বইয়া আছে হে আনছে?
এত কথা কেন বলছ?
ভাব-ভালবাসার দুই-একটা কথা হুনলেই ওমন গোসা হন ক্যান?
গোসা হই না। তুমি যাও।
খাবারের আয়োজন বেশ ভাল। চিকন চালের ভাত, মাছের ভর্তা, কুমড়ো ফুলের বড়া, ছোট মাছের চচ্চড়ি, কইমাছ ভাজা, একটা শুটকির আইটেম, দু পদের ডাল।
আলম বললো, এত ভাল খাবার আমি সারাজীবনেও খাইনি। যত দিন আমি বেঁচে থাকবে ততদিন এর কথা মনে থাকবে। এরকম ভালো খাবার কি প্রায়ই হয়?
জামান বলল, ভাল খাবারের কি দেখলি? সামান্য ভাজা-ভুজি। অবশ্য ভালো খাবারের সামর্থও নেই।
এটা যদি ভাল খাবার না হয় তাহলে ভাল খাবার কোনটা? রোস্ট, পোলাও, মুরগি–মোসাল্লাম? মোঘলরা আমাদের রুচি নষ্ট করে দিয়েছে। এখন ভাল খাবার মানেই রোস্ট পোলাও! নায়লা ভাবী।
জি।
পরের বার তুমি আমার জন্যে লাউ শাকের একটা তরকারি করবে। আমার মা করতেন। পাতাগুলি আস্ত আস্ত থাকতো। সরুয়াটা হত খুব পাতলা। প্রায় পানি পানি। আস্ত কাঁচামরিচ থাকতো এক গাদা। ঝালের চোটে মুখে দেয়া যেতো না কিন্তু অসাধারণ …
জি আচ্ছা, পরের বার লাউ পাতার তরকারি করব।
নায়লা! ভাবী, বল তো স্বর্গের অমৃতের স্বাদ কি? টক না মিষ্টি, না নোনতা?
জানি না তো। স্বর্গের অমৃত তো কখনো খেয়ে দেখিনি …
আমি না খেয়েই বলতে পারছি–স্বর্গের অমৃতের স্বাদ টকও না, মিষ্টিও না, ঝাল-ঝাল।
মানুষটা এত আগ্রহ করে খাচ্ছে যে দেপ্ততে ভাল লাগছে। কুমড়ো ফুলের বড়া সব কষ্টা শেষ করার পর বলেছে, ভাবী, আর কি আছে?
জ্বি না। আর নেই।
নায়লার খুব লজ্জা লাগল। পরের বার এই রান্নাটাও রাঁধতে হবে।
নায়লা ভাবী, তুমি কি পাতুরী রাঁধতে পার? মশলা দিয়ে মাখিয়ে, কলাপাতা দিয়ে মুড়িয়ে মাছটাকে পুড়ানো হয় …
পারি।
ওটাও খেতে ইচ্ছা করে। বুঝলে নায়লা ভাবী, তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে আমি ঢাকায় অপ্রচলিত খাবারের একটা দোকান দেব। দেশে যেখানে যত অপ্রচলিত রান্না আছে জোগাড় করা হবে। ভাল বাবুর্চি দিয়ে যত্ন করে রান্না করানো হবে। মনে কর, কেউ খেতে গেলো কুমরো ফুলের বড়া, তার পছন্দ হল, সঙ্গে সঙ্গে কুমড়ো ফুলের বড়ার রেসিপি তাকে দিয়ে দেয়া হবে। আইডিয়া তোমার কাছে কেমন লাগছে?
বুঝতে পারছি না।
আলম জামানের দিকে তাকিয়ে আগ্রহ নিয়ে বলল, বুঝেছিস জামান, ঢাকায় পথে পথে ঘুরি আর নানান ধরনের আইডিয়া মাথায় ঘোরে। আমেরিকা ফিরে যেতে ইচ্ছা করে না। মনে হয়, আমার তো যথেষ্ট টাকাপয়সাই আছে, এ দিয়ে দেশেই একটা কিছু শুরু করি না কেন?
জামানের মাথাধরা সেরেছে, তবে শরীর এখনো কেমন দুর্বল দুর্বল লাগছে। আলোচনা ভাল লাগছে না। সে হাই তুলতে তুলতে বলল, এই দেশে ভর্তা-ভাজাভুজির দোলন চলবে না।
চলবে না কেন? খাবারের মধ্যে মানুষ বৈচিত্র্য খুঁজে না? সব সময় কি চায়নীজ খেতে হবে?
ভাজা-ভুজির মধ্যে বৈচিত্র্য কিছু নেই। এগুলি অপরিচিত কোন খাবার তো না। সব ঘরেই এসব রান্না হয়।
আলম বললো, নায়লা ভাবী, তোমার কি ধারণা?
আমার ধারণা, চলবে। খুব ভাল চলবে, তবে …
তবে কি?
শায়লা চুপ করে গেল। আলম আগ্রহের সঙ্গে বললো, বল, তুমি কি বলতে চাও। স্পষ্ট করে বল।
ধরুন, আপনি যদি চারতলা একটা বাড়ি নেন, খুব সাজানো, খুব সুন্দর, সামনে বাগান, পানির ফোয়ারা…
তুমি থেমো না,বলে যাও।
সেই চারতলায় এক একতলায় এক এক রকম খাবার। একতলায় দেশীয় খাবার, দোতলায় চাইনীজ, তিন তলায় …
আলম নায়লার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে উৎসাহের সঙ্গে বলতে লাগলো, তিনতলায় ফাস্ট ফুড–বার্গার, পিজা। চারতলায় কন্টিনেন্টাল ফুডস। শুধু চারতলায় হবে না। পাঁচতলা লাগবে। পাঁচতলায় সুন্দর হলঘর, যেটা ভাড়া দেয়া হবে। জন্মদিন, পার্টি এইসব।
আলম চুপ করে গেল। তার কপালের চামড়ায় ভাজ পড়েছে। মনে হচ্ছে, সে গভীর চিন্তায় পড়েছে। আমান বলল, তুই কি সত্যি সত্যি হোটেল দিচ্ছিস না কি?
আলম তার জবাব দিল না। খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে ধুতে বলল–নায়লা ভাবী, বিয়ের কথাটা এখন বলি। তুমি আমাকে একটা মেয়ে জোগাড় করে দাও।
কি রকম মেয়ে?
ভাল একটা মেয়ে। বুদ্ধিমতী। জীবনের বড় অংশ যার সঙ্গে কাটাতে হবে সে বৃদ্ধিমতী না হলে তো মুশকিল। একটা রসিকতা করব–বুঝতে পারবে না, হা করে তাকিয়ে থাকবে, তা হয় না।
মেয়েটাকে নিশ্চয়ই সুন্দর হতে হবে? পুরুষদের প্রথম কথাই সুন্দর মেয়ে।
মেয়েদেরও কিন্তু প্রথম কথাই হচ্ছে সুন্দর পুরুষ। তুমি কি এমন কোন মেয়ে পেয়েছ যে অসুন্দর পুরুষ বিয়ে করতে চায়? চায় না। একটা কথা প্রচলিত আছে–টাকাওয়ালা কুশ্রী পুরুষরা টাকার জোরে সুন্দর সুন্দর মেয়েদের বিয়ে করে। আছে না এমন কথা?
হ্যাঁ, আছে।
নায়লা ভাবী, এই কথাটা কিন্তু আমরা উল্টো করেও বলতে পারি। আমরা বলতে পারি যে, সুন্দর মেয়েরা টাকার লোভে কুশ্রী পুরুষদের হাতে ধরা দেয়। বলতে পারি না?
আলম ভাই, মেয়েদের সেই স্বাধীনতা নেই। সবাই মিলে যা ঠিক করে দেয় তাদের তাই করতে হয়। তবে কিছু মেয়ে হয়ত নিজেই আগ্রহ করে টাকাওয়ালা বর খুঁজে। তাদেরও দোষ নেই। ওরা অভাবে অভাবে বড় হয়। অভাব অসহ্যবোধ হয়। মুক্তি পেতে চায়।
টাকার মধ্যে মুক্তি আছে?
হ্যাঁ, আছে। টাকার মুক্তিই বড় মুক্তি। আনন্দময় মুক্তি।
আলম বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, সেটা আবার কি?
আরেকদিন আপনাকে বুঝিয়ে বলব।
না, আজই বল।
এই যে আপনি আমাদের এখানে বেড়াতে এসেছেন, কত উপহার কিনে এনেছেন। কিনতে গিয়ে আনন্দ পেয়েছেন, আমরাও উপহারলি পেয়ে আনন্দ পেয়েছি। এই আনন্দ আপনার টাকা আছে বলে আপনি কিনতে পারলেন। আমাদের টাকা নেই। আমরা কোনদিন কিনতে পারব না।
নায়লা ভাবী, তুমি কি প্রচুর টাকা চাও?
কেন চাইব না? চাই।
আলম হাসতে হাসতে বলল–আচ্ছা দেখি এমন কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা যাতে একদিন তোমার প্রচুর টাকা হয়। এখন পান খাওয়াও। পান খেয়ে চলে যাব।
জামান বলল, রাত অনেক হয়েছে। এত রাতে আর যাবি কি? খেকে যা।
নো। থ্যাংক ইউ।
যাবার সময় আলম মানিব্যাগ থেকে দুটা পাঁচ শ টাকার নোট বের করে জামানের দিকে এগিয়ে দিল। জামান বিস্মিত হয়ে বললো, টাকা কিসের?
বাজির টাকা। এক হাজার টাকার একটা বাড়ি ছিল না তোর সঙ্গে? তুই বাজি জিতেছিস।
নায়লা বিশিত হয়ে বললো, কিসের বাজি?
আলম গম্ভীর গলায় বলল, জামানের সঙ্গে বাজি রেখেছিলাম যে তুমি আমাকে বলবে, হোটেলে আপনি কষ্ট করে কেন খাবেন? অল্প কদিন তো আছেন, আমাদের এখানে থাকুন। জামান বলল তুমি কখনো এ জাতীয় কথা বলবে না। এইন ইয়ে এক টাকা বাজি ছিল। তুমি কিছু বললে না। কাজেই জামান বাজি জিল। নে জামান, টাকা রাখ। বাজির টাকা নিতে হয়।
জামান অস্বস্তির সঙ্গে তাকিয়ে আছে।
আলম নোট দুটো টেবিলে নামিয়ে বের হয়ে এল।
বেতনের দিনগুলি
বেতনের দিনগুলি কি আলাদা?
জামানের তাই মনে হয়। মাসের প্রথম দিন অফিসের সবার মুখ হাসি-হাসি থাকে। অফিস কেন্টিনে ভিড় বেশি হয়, গল্প-গুজব বেশি হয়। পান খাওয়া বেশি হয় জামান লক্ষ্য করেছে, ঐদিন সবাই অন্যদিনের চেয়েও ভাল কাপড় পরে আসে। শুধু ক্যাশিয়ার যার হাত দিয়ে টাকা বের হয় তার মুখটা খাকে গম্ভীর। মেজাজ থাকে খিটখিটে। ভাবটা এ রকম যেন তার পকেট থেকে টাকাগুলি যাচ্ছে। এটা কি শুধু তাদের অফিসের ক্যাশিয়ার আবদুল করিমের ক্ষেত্রেই ঘটে, না সব ক্যাশিয়ারের ক্ষেত্রেই কে জানে।
জামান বেতন নিতে এসে দেখে করিম সাহেবের মুখ আজ অন্য দিনের চেয়েও একশ গুণ বেশি গম্ভীর। করিম সাহেব শুকনো গলায় বললেন, টাকা গুনে নিন।
জামান লজ্জিত গলায় বলল, আপনি তো গুনলেন।
কথা বাড়াবেন না। টাকা গুনুন, তারপর বিদায় হন।
নতুন টাকা গুনতেও আনন্দ। এরা কি নতুন টাকায় নেশা ধরাবার মত কিছু দিয়ে দেয়? কিছুক্ষণ টাকাগুলি নাকের সামনে ধরে রাখলে ঝিমঝিম ভাব হয়।
জামান বলল, এক শ টাকা বোধহয় বেশি দিয়েছেন। আবার গুনে দেখি।
আমি কাউকে বেশি দেই না। নিজের সীটে গিয়ে গুনে দেখুন। যান।
জমান টাকা নিয়ে তার ঘরে চলে গেল। তার ঘর ঠিক বলা চলে না। তারা তিনজন এই ঘরটায় বসে। তিনজনের দুজন এখন নেই। তবে জামানের চেয়ারের মুখোমুখি চেয়ারটায় নুরু বসে আছে। নুরু নায়লার ছোট ভাই। গত বছর বি কম দিয়েছিল, পাশ করতে পারেনি। এ বছর আবার দেবার কথা, দিচ্ছে না। প্রিপারেশন না-কি তেমন হয়নি। নুরু হাসিমুখে বলল, দুলাভাই, কি খবর?
খবর ভাল। তুমি এই সকালে ক্ষি ব্যাপার?
সকাল কোথায় দেখলেন? সাড়ে এগারোটা বাজে। দুলা ভাই, চা খাব, সিঙ্গারা খাব। আপনাদের এখানে সিঙ্গারা অসাধারণ বানায়।
বেতনের দিন বেয়ার-টেয়ারা কাউকেই ডেকে পাওয়া যাবে না। জামান নিজেই চা-সিঙ্গারা আনতে উঠে গেল। সে শংকিত বোধ করছে। নুরুর সকালবেলা এসে হাসিমুখে বসে থাকা ভাল লাগছে না। টাকাপয়সার জন্যে এসেছে নাকি? হাক-ভাব। সে রকম। নুরু যতবারই টাকার জন্যে আসে সুন্দর একটা গল্প তৈরি করে আসে। গল্পটা যখন বলে তখন জামান বুঝতে পারে যে মিথ্যা গল্প! তারপরেও শুনতে ভাল লাগে।
সিঙ্গারা অসাধারণ হয়েছে দুলাভাই। আপনাদের ক্যান্টিনের বাবুর্চি মারা গেলে আল্লাহ তাকে বেহেশতের ক্যান্টিনে ভাল বেতনে চাকরি দিয়ে দেবেন।
জামান কিছু বলল না। অস্বস্তি নিয়ে বসে রইল। টাকাটা আবার গুনা দরকার। এক শ টাকা বেশি মনে হচ্ছে। আবার করিম সাহেব বলছেন, ঠিকই আছে। ক্যাশিয়াররা টাকা গুনতে কখনো ভুল করে না।
নুরুর সামনে টাকা বের করা ঠিক হবে না। নুরু চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, দুলাভাই, আপনাদের এই সিঙ্গারাওয়ালাকে কোন একটা টাইটেল দেয়া দরকার–যেমন ধরুন, সিঙ্গারা-সম্রাট বা এই জাতীয় কিছু। সিঙ্গারা-সম্রাট খলিল মিয়া বা এই জাতীয় কিছু শনুতেও ভাল লাগবে। দুলাভাই, লোকটার নাম কি?
নাম জানি না।
বলেন কি? এরকম বিখ্যাত একজন লোক অথচ নাম জানেন না?
এসেছ কি জন্যে বল তো নুরু।
আমার কিছু টাকার দরকার।
কত?
সামান্যই। আপনি যেমন মুখ কালো করে ফেলেছেন সে রকম মুখ কালো করার কিছু না।
সামান্যটা কত?
চল্লিশ হাজার।
ঠাট্টা করছ না-কি নুরু?
না দুলাভাই, ঠাট্টা করছি না। আপনি যেমন সিরিয়াস ধরনের মানুষ, আপনার সঙ্গে কি ঠাট্টা করা যায়? আমার চল্লিশ হাজার টাকাই দরকার। এর এক পয়সা কম হলে চলবে না।
এটা সামান্য টাকা?
আপনার আমার কাছে অনেক বেশি টাকা। কিন্তু এই শহরে কয়েক হাজার লোক আছে যাদের কাছে টাকাটা কিছুই না। লোকজন নাকের সর্দি যেমন ঝেড়ে ফেলে এরা চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকাও সে রকম ঝেড়ে ফেলে।
তুমি তো ওদের কাছে যাওনি নুরু। তুমি এসেছ আমার কাছে।
আপনার চিন্তার কারণ নেই দুলাভাই। চল্লিশ হাজারের পুরোটা আপনাকে দিতে হবে না। আপনি দেকেন অংশবিশেষ। মেজ দুলাভাই দেবেন অংশবিশেষ আর বাকিটা আমি জোগাড় করব। আপনাকে খুব বেশি রকম লাইক করে আপনার ভাগে সামান্য রেখেছি। সেই সামান্যটা হচ্ছে পাঁচ শ। এই বার দয়া করে হাসুন। আপনি চোখ-মুখের যে অবস্থা করে রেখেছেন, মনে হচ্ছে হার্ট এ্যাটাক হচ্ছে। দিন দুলাভাই, পাঁচ শটা টাকা দিন, চলে যাই।
জামান পাঁচ শ টাকা বের করে দিল। নুরু টাকাটা পকেটে রাখতে রাখতে বলল, টাকাটা দিয়ে কি করব জানতে চাইলেন না?
কি করবে?
ইন্দোনেশিয়ান এক জাহাজে চাকরি পেয়েছি। চিটাগাং-এর এক লোক আছে ঐ জাহাজে উঠব। সেই জাহাজ আমেরিকা হয়ে ইউরোপ যাবে। আমি আমেরিকার কাছাকাছি গিয়ে ঝাপ দিয়ে সমুদ্রে পড়ে যাব। সাঁতরে পাড়ে উঠব।
ভাল কথা, উঠে পড়।
সাঁতার জানি না, এইটাই হল সমস্যা। এক ফাকে সার্তারটা দ্রুত শিখে নিতে হবে। দুলাভাই উঠি?
আচ্ছা উঠ।
ভাংতি দশ-বিশটা টাকা দিন তো দুলাভাই। রিকশাভাড়া। পাঁচ শ টাকার নোট ভাঙিয়ে তো আর রিকশা ভাড়া দেয়া যাবে না।
জামান আরো দশটা টাকা দিল। নুরু ফুর্তিবাজের ভঙ্গিতে বলল, দুলাভাই, কাইন্ডলি মুখ থেকে বিমর্ষ ভাবটা দূর করুন। নিজের শালাকে পাঁচ শটা টাকা দিয়েছেন। এমন বড় কিছু না। শালা-শালীদের জন্যে মানুষ অনেক টাকাপয়সা খরচ করে। শালা-শালীরা সাধারণত সিন্দাবাদের ভূতের মত হয়। দুলাভাইদের ঘাড় চেপে থাকে আর নামতে চায় না। সেই তুলনায় আমি বলতে গেলে কখনোই আপনার ঘাড়ে চড়ি না। আর শুনুন দুলাভাই, সিঙ্গারাওয়ালার নামটা জোগাড় করে রাখবেন–প্লীজ। আমি ওর নামটা দিয়ে ক্রেস্ট বানাব। নিচে লেখা থাকবে সিঙ্গাড়া সম্রাট।
জামান মন-খারাপ ভাবটা দূর করার চেষ্টা করছে। পারছে না। পাঁচ শ টাকা অনেকগুলি টাকা। তাছাড়া ব্যাপার এমন না যে আই নুরুর উপদ্রব শেষ। এটা লেগেই থাকবে। যত দিন যাবে তত বাড়বে।
জামান টাকাগুলি বের করে আবার গুনল। এক শ টাকা বেশিই আছে। করিম সাহেব ভুল করেছেন। জামান টাকা ফেরত দিতে গেল।
করিম সাহেব নিতান্ত অবহেলায় এক শ টাকার নোট পকেটে রাখতে রাখতে ললেন, বসুন, চা খেয়ে যান।
চা খাব না। একটু আগে খেয়েছি।
আহা, বসুন না রে ভাই। আপনাকে একটা মজার কথা বলি, ভেবেছিলাম কাউকে কোনদিন বলব না। আপনাকে বলার লোভ সামলাতে পারছি না।
বলুন।
করিম সাহেবের ঘরে কেউ নেই। বেয়ারা ছিল, তাকে চা আনতে পাঠিয়েছেন। তারপরও তিনি গলা নিচু করে বললেন, মাঝে মাঝে এই কাণ্ডটা আমি করি ইচ্ছা করে। এক শ টাকা বেশি দিয়ে দি। দেখার জন্যে যে বাড়তি টাকাটা পেয়ে আপনারা কি করেন। আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানেন? কেউ বলে না, টাকা বেশি হয়েছে। আপনি প্রথম বললেন।
এরকম করার অর্থ কি?
মানুষের অনেক রকম পাগলামি থাকে। এটাও একটা পাগলামি। আমার নিজের ভেতর তো অনেক মন্দ আছে, এই জন্যেই অন্যের মন্দটা দেখতে ভাল লাগে।
এটা ঠিক না।
আমিও জানি এটা ঠিক না। তারপরেও করি। ঠিক কাজের চেয়ে বেঠিক কাজ করতে মানুষের বেশি আনন্দ–এটাও জানেন না?
চা চলে এসেছে। করিম সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে আরামের শব্দ করলেন। তাঁকে এখন অনেক প্রফুল্ল মনে হচ্ছে। তার মনের মেঘ কেটে গেছে।
জামান সাহেব।
জি।
আপনার সঙ্গে এখন যে এক্সপেরিমেন্ট করলাম, সেই এক্সপেরিমেন্ট এখন কুদুস সাহেবের সঙ্গে করব। নিজের চোখে দেখে যান। ভাল লাগবে।
না। খাক।
আহা, দেখুন না রে ভাই। শুধু নিজে কেমন সেটা জানলে তো হবে না–চারপাশের মানুষগুলি কেমন সেটাও জানতে হবে।
করিম সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বেয়ারার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই, যা ততা কুদ্দুস সাহেবকে বল, আমি সালাম দিয়েছি।
কুদ্দুস সাহেব অত্যন্ত পরহেজগার মানুষ। নামাজ পড়ে পড়ে কপালে দাগ ফেলে। দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ, বিসমিল্লাহ এবং সোবাহানাল্লাহ এই তিনটি শব্দ ব্যবহার না করে কোন বাক্য বলেন না। অফিসে তার টেবিলে একটি কোরান শরীফ আছে। অফিসে ঢুকে মিনিট পাঁচেক কোরান পাঠ করেন। প্রতি চারমাস পর ঘোষণা দেন–আঙ্গ কোরান, মজিদ শেষ করেছি। আসুন দোয়ায় সামিল হন। দোয়া করা হয়। এটা অফিসের রুটিনের অঙ্গ।
কুদ্দুস সাহেব ঘরে ঢুকে হাসিমুখে বললেন, করিম সাহেব, কি জন্যে ডেকেছেন ভাই?
এম্নি ডেকেছি। আপনি সুফী মানুষ, আপনাকে দেখলে ভাল লাগে। আতর মেখেছেন নকি? সুন্দর গন্ধ দিচ্ছে।
জ্বি, সামান্য দিয়েছি। নবীয়ে করিম দিতেন। আতরের যা দাম! রোজ দিন তো দেয়া সম্ভব না। আজ বেতনের দিন বলে দিলাম।
বসুন ভাই। চা খান।
শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। চা খাব না, তবে বসলাম। বলুন কি ব্যাপার।
সবার বেতন দিয়ে দেয়ার পর দেখি এক শ টাকা বাড়তি আছে। মনে হয় কাউকে কম দিয়েছি। সবাই আমার সামনে বসে গুনে নিয়েছে। আপনিই শুধু গুনে নেননি। দেখুন তো ভাই আপনাকে কম দিলাম কি না। একটু গুনে দেখুন। কষ্ট দিচ্ছি, কিছু মনে করবেন না।
কুদুস সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, ঘরে গিয়ে গুনেছিলাম–এক শটা টাকা কম আছে।
আগে বলেন নি কেন?
লজ্জা লাগল। সামান্য কটা টাকা। ভাবলাম…
এরকম কাজ আর কখনো করবেন না কুন্দুল সাহেব। এর পর থেকে সব সময় গুনে নিবেন।
ইনশাআল্লাহ করব।
কুদ্দুস সাহেব টাকা নিয়ে উঠে পড়লেন।
করিম সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। জামান অস্বস্তি নিয়ে বসে রইল। সে নিতান্তই অস্বাভাবিক একটা ঘটনা ঘটতে দেখল।
করিম সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, দেখলেন জামান সাহেব, এমন একজন ভাল মানুষ অথচ সামান্য এক শ টাকার লোভ সামলাতে পারলেন না। লোভ সামলানো কঠিন ব্যাপার। এভারেস্ট জয় করা যায় কিন্তু লোভ জয় করা যায় না। সাতাশ বছর ক্যাশ হেন্ডেল করে করে এই কঠিন সত্য শিখেছি।
জামান উঠে পাঁড়াতে সঁড়াতে বলল, মানুষকে ছোট করার জন্য যে কাজটা আপনি করেন এই কাজটা করবেন না। এটা ঠিক না। মানুষকে আপনি লোভ দেখান। আদম এবং হাওয়াকে শয়তান লোভ দেখিয়েছিল।
আপনি আমাকে শয়তান বলছেন?
না, তা না।
প্রকারম্ভিরে তাই বললেন, তবে ভুল বলেন নি। ঠিকই বলেছেন। করিম সাহেব আবার মুখ কালো করে ফেললেন। জামানের মন খারাপ হয়ে গেল। মানুষের ক্ষুদ্রতা দেখতে ভাল লাগে না।
বেতন পেয়ে জামান কখনো খালি হাতে বাসায় ফেরে না। নায়লার রসমালাই খুব পছন্দ। আধা কেজি রসমালাই কেনে। কোন কোন দিন বগুড়ার মিষ্টি দৈ। আজ কিছুই কিনতে মন চাচ্ছে না। নুরুর জন্যে এতগুলি টাকা চলে গেল! এই টাকাটা সামাল কি ভাবে দেয়া হবে সে বুঝতে পারছে না। সংসারে প্রতিটা পয়সা হিসাবের পয়সা। ডালের দাম বেড়ে গেলে ভাল কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিতে হয়। এই অবস্থায় পাঁচ শ টাকা সামলানো মুশকিল। ধার-টার করার উপায় নেই। কার কাছ থেকে ধার করবে? সবার অবস্থাই এক রকম। প্রাইজবন্ড ভাঙাতে হবে। হাজার দুই টাকার প্রাইজবন্ড কেনা আছে। সেগুলা ভাঙাতে হবে।
রাস্তার পাশে গ্যাস বেলুন বিক্রি হচ্ছে। এক একটা বেলুন বিশাল আকৃতির। বাবুর জন্যে কিনতে ইচ্ছা করছে। পাঁচ টাকা দাম শুনে পিছিয়ে পড়ল। পাঁচ টাকা বেলুন কেনার বিলাসিতার সময় এখন না। থাক।
জামান বাড়ি ফিরলো হেঁটে হেঁটে। বেতনের টাকা পকেটে নিয়ে সে বসে উঠে না। বিয়ের পর পর বেতনের টাকা সঙ্গে নিয়ে বাসে উঠেছিল। পকেটমার হয়ে গেল। কি নিদারুণ সমস্যা। ঘরে নতুন বৌ। হাতে নেই টাকা। এর থেকে জামানের একটা শিক্ষা হয়েছে। মাসের এক তারিখে বাসে চড়তে নেই।
সিড়ি ভেঙে উপরে ওঠার সময় মনে হল, বাবুর জন্যে বেলুনটা কিনলেই হত। একেক বয়সের জন্যে একেক জিনিস। বেলুনের বয়স পার হয়ে গেলে বেলুন দিয়ে সে কি করবে? সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হচ্ছে। বুকে হাঁপ ধরে যাচ্ছে। আজ লিফটে উঠে পরলে হত।
ছাদে বাবু একা একা খেলছে। হাতে মশারির একটা স্ট্যাণ্ড। বাবুর মাথায় নীল রঙের হ্যাট। হ্যাটের চারদিকে লাল ফিতা। কি সুন্দর লাগছে বাবুকে! জামান ডাকল–এই গুণ্ডু বাবা। গুণ্ডু বাবা।
বাবু ফিরে তাকাল। বাবাকে দেখেই ছুটে আসতে যাচ্ছে। হাতে লম্বা মশারির স্ট্যাণ্ড নিয়ে ছুটে আসাও মুশকিল। এই বুঝি পড়ল। জামনি ছুটে গিয়ে ছেলেকে ধরে ফেলল।
বাবু খিলখিল করে হাসছে।
দরজা ধরে নায়লা এসে দাড়িয়েছে। সে জামানকে আগেই ঢুকতে দেখেছে। নতুন হ্যাটটা মাথায় পরিয়ে বাবুকে দাড় করিয়ে দিয়েছে ছাদে যাতে জামান উপরে ওঠামাত্র বাবুকে দেখে। নায়লা সামান্য অস্বস্তি বোধ করছে। হ্যাট দেখে জামান রাগ করবে কি-না বুঝতে পারছে না।
আজ সে বাবুকে নিয়ে ইস্টার্ন প্লাজায় গিয়েছিল। সেখানে চারতলা পর্যন্ত এসকিলেটর আছে। বাবু এসকিলেটরে চড়তে খুব ভালবাসে। নায়লা ঠিক করেছিল বাবুকে নিয়ে কয়েকবার ওঠানামা করবে, তারপর চলে আসবে। খালি হাতে কোথাও বেরুতে খারাপ লাগে বলে তার হ্যান্ডব্যাগে অলিমের রেখে যাওয়া দুটা নোট নিয়ে গিয়েছিল। এটা কড় ধরনের ভুল হয়েছে। হাতে টাকা আছে বলেই বাবুর জন্যে দুশ টাকা খরচ করে হ্যাটটা কিনে ফেলল। বাবু ঐ দোকানেই একটা ব্যাটারী দেয়া গাড়ি দেখে এমন কান্না শুরু করল যে শেষ পর্যন্ত গাড়িও কিনতে হল। চলে গেল আরো দুশি। জামানের জন্যে একটা সুয়েটার কিনল। শীত পড়তে শুরু করেছে। সুয়েটার। লাগবেই। গত বছরের স্যুয়েটারটা হারিয়ে গেছে। ছাদে শুকুতে দিয়েছিল, কিছুক্ষণ পর এসে দেখে নেই। সুন্দর ছিল স্যুয়েটারটা। তবে আজকের স্যুয়েটারটা আরো অনেক বেশি সুন্দর–সাদার উপর নীল এবং খয়েরী রঙের ত্রিভুজ। মাখনের মত নরম। দুশ টাকা দাম নিয়েছে, তবু মনে হয় সস্তা হয়েছে।
ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দাও তো নায়লা।
কি অদ্ভুত মানুষ! জানে ঘরে ফ্রীজ নেই তবু বলবে, ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দাও তো। তবে আজ এই অদ্ভুত মানুষের ছোট্ট একটা চমক আছে। খুব ঠাণ্ডা এক বোতল পানি নায়লা এনে রেখেছে। সাততলার এক মহিলার সঙ্গে নায়লার খাতির আছে। তিনি ছাদে কাপড় শুকুতে এলে কিছুক্ষণ নায়লার সঙ্গে গল্স করেন। এক বোতল হিমশীতল পানি নায়লা উনার কাছ থেকে চেয়ে এনেছে।
জামান গ্লাসে চুমুক দিয়ে বিস্মিত হয়ে বলল–আরে, ঠাণ্ডা পানি দেখছি?
তুমি তো ঠাণ্ডা পানি চেয়েছিলে।
পেয়েছ কোথায়?
তা বলব না। সব রহস্য ভাঙা ঠিক না। আচ্ছা, বাবুর হ্যাটটা কত সুন্দর দেখেছ?
হুঁ। সুন্দর। খুব সুন্দর।
বিদেশী বাচ্চাদের মৃত লাগছে না?
লাগছে।
তুমি তো কিছু বললে না।
আলম কি এসেছিল?
না, অলিম ভাই আসেন নি। দু-একটা শৌখিন জিনিস কি আমি কিনতে পারি না?
টাকা পেয়েছ কোথায়?
টাকা তো আমার কাছে ছিল? ঐ যে তোমার বন্ধু, তোমার সঙ্গে বাজিতে হেরে এক হাজার টাকা রেখে গেল। শোন, আমি কিন্তু সব টাকা খরচ করে ফেলেছি।
জামান তাকিয়ে আছে। সে কিছুই বলছে না।
প্লীজ, রাগ করো না। এই প্রথম এতগুলি টাকা নিয়ে বাজারে গেলাম। তারপর কেমন যেন মাথায় গোলমাল হয়ে গেল। যা দেখি তাই কিনে ফেলতে ইচ্ছা করে।
আর কি কিনেছ?
বলছি। তার আগে বল তুমি রাগ করেছ কি-না।
না, রাগ করিনি।
বাবুকে কোল থেকে নামিয়ে তুমি বসো। হাঁপাচ্ছে তো।
বাবু কোল থেকে নামবে না। জামানকেও বসতে দেবে না। ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে জামানের কষ্ট হচ্ছে। হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় খানিক্ষণ শুয়ে থাকলে ভাল লাগতো।
মেঝের উপর দিয়ে একটা তেলাপোকা হেঁটে যাচ্ছে। বাবু জামানের কোলে নড়েচড়ে উঠল, বাবা, পোকা পোকা।
হুঁ পোকা।
পোকা নিব।
জামান ছেলেকে নামিয়ে দিল। বাবু পোকার দিকে এগুচ্ছে। তার চোখে-মুখে কি গভীর বিস্ময়।
নায়লা চা নিয়ে এসেছে। চা আর এক বাটি মুড়ি। চ-তে ভেজানো মুড়ি চামচ দিয়ে তুলে খেতে জামান পছন্দ করে। নায়লা বলল, মাঝে মাঝে বাবুর মুখে খানিকটা মুড়ি দিও তো। ও মুড়ি খায়। নায়লা নিজের জন্যেও এক কাপ চা এনেছে। পেটমোটা বিরাট একটা কাপ। এটা না-কি তার ছেলেবেলার কাপ। বিয়ের পর বাবার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে।
নায়লা বলল, আমরা যখন খুব বড়লোক হব তখন কি করব জান? প্রতি সপ্তাহে দু-তিন হাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে দোকানে যাব–যা পছন্দ হয় কিনে ফেলব।
বড় লোক হবে কি ভাবে?
জানি না কি ভাবে হব। যদি হই …
জামানের মায়া লাগছে। বেচারীকে কিছু হাতখরচ প্রতি মাসে দিতে পারলে ভাল হত। এই সৌভাগ্য কি তার কোনদিন হবে?
আজ ইস্টার্ন প্লাজায় বাবুকে নিয়ে গিয়ে কি যে মুশকিলে পড়েছি! যাই দেখবে তাই কিনবে।
জামান হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ও তো আর জানে না অর্থ বলে একটা ব্যাপার আছে। বাবুর ধারণা, সমস্ত পৃথিবীটাই তার। যতই বয়স বাড়তে থাকবে ততই তার পৃথিবী ছোট হতে থাকবে …।
হাই ঘটের কথা বাদ দাও। ইস্টার্ন প্লাজাতে গিয়ে আজ কার সঙ্গে দেখা হয়েছে জান? অরুনার সঙ্গে। অরুনাকে মনে আছে?
হ্যাঁ, মনে আছে খুব সুন্দর একটা মেয়ে।
ও আরো সুন্দর হয়েছে। এক্কেবারে জাপানি পুতুল। অরুনা আমাকে কফি খাওয়ালো। বাবুকে চকলেট কিনে দিল।
উনি এখন করছেন কি?
রিসিপশনিস্ট। তষে বলছে চাকরি ছেড়ে দেবে। চাকরি ভাল লাগে না। সবাই নাকি বিরক্ত করে।
সুন্দরী মেয়ে, কিছু বিরক্ত তো করবেই।
আমিও তাই বললাম। মাঝে মাঝে তোমার কথা আর আমার কথা এমন মিলে যায়। আচ্ছা শোন, অরুনাকে দেখার পর থেকে আমার মাথায় একটা জিনিস ঘুরছে। তোমার বন্ধুর সঙ্গে কি এই মেয়ের বিয়ে হয় না? অরুনাকে দেখে পছন্দ করবে না এমন ছেলে তো বাংলাদেশে নেই।
অরুনা আলমকে পছন্দ করবে কিনা কে জানে?
পছন্দ করবে না কেন? তোমার বন্ধু তো দেখতে সুন্দর। টাকাপয়সা আছে। পড়াশোনা করছে। আমেরিকায় থাকে …।
তুমি কি বিয়ের ব্যাপারে অরুনার সঙ্গে কথা বলেছ?
সরাসরি কিছু বলিনি–ইশারায় বলেছি। ওর বাসার ঠিকানা নিয়েছি। অরুন এখন তার ছোট মামার সঙ্গে থাকে। আমি বলেছি একদিন আমাদের এক বন্ধুকে নিয়ে ওর বাসায় যাব।
ভাল–আলমকে নিয়ে যাও।
এই শুক্রবারে গেলে কেমন হয়?
ভালই হয়।
তোমার বন্ধুকে তে খবর দেয়া দরকার।
আমি টেলিফোনে বলে দেব।
নায়লা ইতস্তত করে কলল, তারচে এক কাজ করলে কেমন হয়? চল না আমরা সবাই মিলে উনার হোটেলে উপস্থিত হই। উনি চমকে যাবেন। তাছাড়া বড় হোটেল আমি কখনো দেখিনি–দেখতে ইচ্ছা করে, …।
কবে যেতে চাও?
আজই চল। নতুন হ্যাটটা বাবুর মাথায় পরিয়ে দেব। তোমার জন্যে একটা স্যুয়েটার কিনেছি, তুমি স্যুয়েটারটা পরবে … যাবে?
জামানের কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু নায়লার উৎসাহ দেখে মায়া লাগছে।
নায়লা বলল, বাবুকে কাপড় পরাবো?
পরাও।
আমি কোন্ শাড়িটা পরব?
এত আগ্রহ করে নায়লা প্রশ্ন করেছে। উত্তর দিতে হয় … জামান কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। নায়লার কি শাড়ি আছে তাও সে জানে না। শাড়ি তো তেমন থাকার কথাও না। বিয়ের পর সে কি কোন শাড়ি কিনে দিয়েছে? মনে পড়ছে না। গত ঈদে শাড়ি দেয়া হয়নি। শ্বশুরবাড়ি থেকে একটা শাড়ি এলো। নায়লা বলল, আর লাগবে না। যদিও সেই শাড়ি নায়লার পছন্দ হয়নি। পরার পর মন খারাপ করে বলেছে–জংলি একটা প্রিন্ট। কি বিশ্রী লাগছে।
নায়লা বলল, চুপ করে আছ কেন? বল না কোন্ শাড়িটা পরব?
আলমের দেয়া শাড়িটা পর। সুন্দর শাড়ি।
ওটার ব্লাউজ নাই যে।
যেসব ব্লাউজ আছে তার সঙ্গে পরা যায় না?
উঁহু। আচ্ছা এক কাজ করি, রিকশা করে নিউমার্কেট চলে যাই, দেখি সেখানে রেডিমেড কিছু পাওয়া যায় কিনা। যাব?
যাও।
জাম্মানের ঘুম পাচ্ছে। সে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়ল দেখতে দেখতে।
আলমের গলায় মুগ্ধ বিস্ময়
আমি কি চোখে ভুল দেখছি?
আলমের গলায় মুগ্ধ বিস্ময়। সে সত্যি সত্যি বিস্মিত। সেজেগুজে তিনজন তার হোটেলের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। নায়লা শ্যামলা ধরনের মেয়ে–প্রথমদিন তাকে যতটা সুন্দর লাগছিল আজ তারচেয়ে হাজার গুণ সুন্দর লাগছে। প্রথম দিন নায়লার চোখে-মুখে চাপা অস্বস্তি ছিল। আজ সেই অস্বস্তি নেই–ঝলমলে ছটফটে ভাব।
আলম বলল, জামান, আমি কি স্বপ্ন-টপ্ন দেখছি? না কি তোরা সত্যি এসেছিস?
নায়লা বলল, আপনি কি দরজা ধরে দাড়িয়ে থাকবেন, না আমাদের ভেতরে আসতে দেবেন?
এসো ভাবী, এসো। এখন থেকে আমি কিন্তু পুরোপুরি তুমি বলব–রাগ করলে করবে। কিচ্ছু আসে যায় না।
আচ্ছা বলবেন।
এবং ভাবী বলাও বন্ধ। এখন থেকে শুধুই নায়লা। জামান মনে মনে রাগ করবে। কিন্তু কোন উপায় নেই–রূপবতীকে ভাবী ডাকা যায় না। নায়লা, তোমার বাচ্চাটাকে
আমার কোলে দাও। ও কি আসবে আমার কোলে?
হাত বাড়াতেই বাবু কোলে ঝাপিয়ে পড়ল। যেন সে এর জন্যেই অপেক্ষা করছিল। আলম বলল, জামান শোন, তোকে একটা ভাল উপদেশ দিচ্ছি–বৌকে নিয়ে বাইরে যখন বেড়াতে যাবি তখন বাচ্চা রাখবি সব সময় নিজের কাছে। মারা বাড়িতে সারাক্ষণ বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকে–বাইরে গেলেও বাচ্চা-কাচ্চা তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া খুব অন্যায়। অয়ি, তারা ভেতরে আয়।
নায়লা মুগ্ধ হয়ে হোটেলের সাজসজ্জা দেখছে। সব কিছু কেমন পরিস্কার ঝকঝকে। কোথাও এক কনা ধুলো নেই। কাঠের আসবাবপত্রের দিকে তাকালে মনে হয় এই কিছুক্ষণ আগে পালিশ করা হয়েছে। দেয়ালে সূর্যাস্তের পেইনটিং। এত সুন্দর যে অকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।
আলম বলল, নায়লা, তুমি নিশ্চয়ই হোটেলের বাথরুম দেখতে চাও। আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় আমি জানি মেয়ে মাত্রই হোটেলের ঘরে ঢুকলে প্রথম উঁকি দেয় বাথরুমে। কি, দেখতে চাও বাথরুম?
হুঁ।
উঁকি দাও। ঐ যে দরজা।
নায়লা লজ্জিত মুখে বাথরুমের দরজা খুলে মুগ্ধ হয়ে গেল। মার্বেলের মেঝে। এক পাশে বাথটাব। বাথটাব ভর্তি টলটলে পানি। সব কিছু ধবধবে শাদা। বাথটাবটা নীল রঙের বলে পানি হয়েছে হালকা নীল।
জামান বলল, সন্ধ্যে সাতটার দিকে আমি একবার ফাইন্যাল গোসল করি। বাথটাবে পানি ভরেছি–এমন সময় তোমরা এলে।
নায়লা নিজের অজান্তেই বলে ফেলল–আমি কখনো বাথটাবে গোসল করিনি। বলেই খুব লজ্জা পেল। এ ধরনের কথা বলা উচিত না। কেন সে বলল?
আলম বলল, নেমে পড়। কোন অসুবিধা নেই।
বাবু পানিতে যাবার জন্যে ছটফট করছে, আলমের কোলে আর থাকতে চাচ্ছে। না। আলম বলল, জামান, তুই তোর বাচ্চার কাপড়-চোপড় খুলে নেংটো করে দে। ব্যাটাকে পানিতে নামিয়ে দেই। দেখি ব্যাটা কি করে।
জামান বলল, ঠাণ্ডা লেগে যাবে। শুধু শুধু ঠাণ্ডা লাগবে কেন? গরম পানি। এর মধ্যে ঝাপাঝাপি কবে খুব আরাম পাবে! দে ব্যাটাকে ছেড়ে।
বাবুকে পানিতে ছাড়া হয়েছে। কয়েকটা ছবি তোলা হয়েছে। এখন বাথরুমে শুধু নায়লা এবং বাবু। নায়লা বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। বাবুর হাত ধরে সে বসে আছে। বাবু বাথটাবের ভেতরে, সে বাইরে। তার খুব ইচ্ছা করছে বাবুকে কোলে নিয়ে টলটলে পানিতে বসে থাকতে। আরেকদিন এই কাজটা সে অবশ্যই করবে। গোসলের জন্যে বাড়তি কাপড় নিয়ে আসবে।
বাবু বলল, মাম্মাই পানি।
হুঁ পানি। সুন্দর পানি।
মাম্মাট সুন্দল পানি।
সুন্দল না বাবু, বল সুন্দর। সুন্দর পানি।
সুন্দল পানি।
বাবু দুই হাতে পানি ছিটাচ্ছে। পানি ছিটানোর একটা ছবি যদি নেয়া যেত। আলমকে কি বলবে–বাবুর পানি ছিটানোর একটা ছবি নিন। খাক। আরেক দিন।
জামান খাটের উপর খানিকটা জড়সড় হয়ে বসে আছে। আলম বসেছে খাটের সাইড টেবিলে। আলমের হাতে সিগারেট। আলম বলল, নে, সিগারেট ধরা।
সিগারেট খাব না।
তুই এমন মনমরা হয়ে আছিস কেন? শরীর খারাপ?
ক্লান্ত লাগছে। অফিস থেকে আসলাম।
অফিস থেকে এমন আধমরা হয়ে ফিরতে হয়? অফিসে কি করতে হয়? ইট ভাঙতে হয়?
জামান হাসল।
আলম বলল, তুই ডাক্তার-ফাক্তার দেখা। আমার মনে হয় তোর শরীর খারাপ। শরীর ঠিকই আছে।
তোরা আমার এখানে এসে খুব ভাল করেছিস। আমার মনটা ছিল খারাপ।
তোদের দেখে ভাল লাগছে।
মন খারাপ কেন?
অনেক ঘোরাঘুরি করলাম, বুঝলি–ব্যবসাপাতির খোঁজ-খবর করলাম। কোন ভরসা পাচ্ছি না। সবকিছুই আনস্টেবল। টাকা ইনভেস্ট যে করব, কিসের ভরসায় করব? যেখান থেকে এসেছিলাম আমাকে সেখানেই ফিরে যেতে হবে। আশা করে এসেছিলাম দেশে থাকব। আশা ভঙ্গ হয়েছে।
তোর আশা ভঙ্গ হবে কেন? ব্যবসাপাতি করে অনেকেই তো খাচ্ছে।
ব্যবসাপাতি সব কিছুতে দু নম্বরী। স্ট্রেইট ব্যবসা বলে এখানে কিছু নেই। আমার সাহসের অভাব কোন কালে ছিল না। এখন সাহসের অভাব বোধ করছি।
তুই তাহলে ফিরে যাবি ঠিক করেছিস?
হুঁ। বিয়ে করব। বউ নিয়ে ভাগবো। আমার বৌ খুঁজে পেয়েছিস?
নায়লা খুঁজে বেড়াচ্ছে।
গুড। তাড়াতাড়ি করতে হবে। হোটেলে বসে থাকতে এখন আর ভাল লাগছে না। তোর খিদে হয়েছে? খিদে হলে চল খেতে যাই।
বাসায় গিয়ে খাব।
বাসায় গিয়ে খাবি কেন? বাইরের খাবার খাস না? আমার সঙ্গে ফর্মালিটি করলে ক্ষুর দিয়ে মাথা কামিয়ে দেব।
বাবু শেষ পর্যন্ত পানি থেকে উঠেছে। ঠাণ্ডায় দীর্ঘ সময় থাকার জন্যে তার ঠোঁট নীল হয়ে আছে। সে অল্প অল্প কাঁপছে। নায়লা ভীত গলায় বলল–বাবু কেমন কাঁপছে, ওর জ্বরটর আসবে না তো?
আলম বলল, এত অস্থির হয়ো না নায়ল। বাচ্চাদের শরীর অনেক শক্ত। অল্পতে ওদের কিছু হয় না–চল খেতে যাই। দাও, বাবুকে আমার কোলে দাও।
নায়লা বলল, ও আপনার কোলে যাবে না।
অবশ্যই যাবে। বাবু এসো তো।
বাবু নায়লাকে অবাক করে গুটি গুটি পায়ে অলিমের দিকে এগুতে শুরু করেছে। আলম বলল, শিশুদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচারের ক্ষমতা অসাধারণ। অনেক কিছু ওরা বড়দের চেয়ে দ্রুত ধরতে পারে–বাবু ধরে ফেলেছে, এই সুন্দর বাথটাবের মালিক আমি। আবার এই বাথটাবে নামতে হলে আমাকে খুশি রাখতে হব। এই জন্যেই সে আমার দিকে এগুচ্ছে। আমাকে তার খুব যে পছন্দ–তা কিন্তু না। শিশু এবং মহিলা এই দুই শ্রেণী নিজের স্বার্থ সম্পর্কে খুব সজাগ।
শেরাটনের ডাইনিং হলে খাবারের ব্যবস্থা। এক পাশে গান হচ্ছে। ফর্সা রোগা একটা ছেলে গলায় গিটার বুলিয়ে কৃত্রিম গলায় গাইছে –
Oh my mimi
Oh my mimi …
গানের সঙ্গে যে ভাবে পা নাচ্ছাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে হাঁটু থেকে তার পা খুলে আসবে। বাবু মুগ্ধ হয়ে পা নাচাননা দেখছে। নায়লা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে পাশের টেবিলের দিকে। সেই টেবিলে স্বচ্ছ নেটের পোশাক পরে অফ্রিকান এক তরুণী তার ছেলেবন্ধুর সঙ্গে বসেছে। এই পোশাক পরা এবং না পরার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। নায়লা ভেবে পাচ্ছে না একটা মেয়ে কি করে এমন এক পোশাক পরে এত সহজ ভঙ্গিতে বসে থাকতে পারে। আবার কী সুন্দর হাসছে, গল্প করছে।
আলম হাসতে হাসতে বলল, নায়লা, এমন হা করে তাকিয়ে থেকো না।
আমাদের দেখার জন্যেই তো এই মেয়ে এমন কাপড় পড়েছে। দেখতে অসুবিধা কি।
অসুবিধা নেই, দেখো। নায়লা, তোমার যুক্তি সুন্দর। কথার পিঠে চট করে যুক্তি দেয়া সহজ ব্যাপার না।
নায়লা লজ্জা পেল। টেবিলটার দিকে এখন আর তাকানো যাবে না, কিন্তু নায়লার খুব ইচ্ছা মেয়েটার কাণ্ডকারখানা দেখে! এই মেয়ে কি পারবে এই পোশাকে হোটেলের বাইরে যেতে? মনে হয় না। ঢাকার রাস্তায় বের হলে তার চারদিকে ভিড় জমে যাবে।
বেয়ারারা খাবার আনতে শুরু করেছে। এত খাবার! কে খাবে এত খাবার? কত টাকা বিল হবে একবেলা খাবারের জন্যে? ন্যাপকিনের দু পাশে ঝকঝক করছে চামচ। চামচগুলি কি রূপার? দেখে সে রকমই মনে হচ্ছে।
আলম বলল, ভাবী, তুমি চোখ-মুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছ কেন? খাওয়া শুরু কর।
নায়লা চমকে উঠল। ভাবী বলে ডাকার জন্যেই চুমকাল। এতক্ষণ নায়লা নায়লা করছিল, হঠাৎ ভাবী। সে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল নায়লা ডাকেই। মানুষ কত সহজেই না অভ্যস্ত হয়।
ভাবী, আমার বিয়ের জন্যে কন্যা দেখতে শুরু করেছ?
এতক্ষণ তে নায়লা নায়লী ডাকছিলেন হঠাৎ ভাবী ডাকা শুরু করলেন কেন?
ভাবী সম্পর্কটা আমি ভুলে যাইনি। এটা বোঝাবার জন্যেই ভাবী ডাকা। মাঝে মধ্যে ডাকব। তুমি আমার প্রশ্নের জবাব এখনো জবাব দাও নি–মেয়ে দেখেছ?
হুঁ, একজন দেখেছি।
নাম কি?
অরুনা।
নাম মন্দ না। দেখতে কেমন?
খুব সুন্দর।
গায়ের রঙ?
ধবধবে শাদা রঙ।
চোখের মনির রঙ কি কালো না কটা?
এত খুঁটিয়ে তো দেখিনি।
উচ্চতা?
লম্বায় আমার মতই।
ওজন? কোমরের মাপ?
নায়লা তাকিয়ে আছে। আলম বলল, শোন নায়লা, তুমি যা করবে তা হচ্ছে–একটা গজফিতা নিয়ে ঐ মেয়ের কাছে যাবে। হাইট মাপবে, কোমর মাপবে . . . ওজনটা জানবে। পার্সোনাল হেবিটস নোট করবে। অসুখ-বিসুখ কি আছে তাও জানা দরকার। যে ডাক্তারের কাছে এই মেয়ে সচরাচর যায় তাকে জিজ্ঞেস করবে …
আচ্ছা আপনি পাগলের মত এইসব কি বলছেন?
মোটেই পাগলের মত কিছু বলছি না। প্রাকটিক্যাল মানুষের মত কথা বলছি। টরেন্টোতে একটা ছেলে ছিল–বসিরুল হক নাম। দেশ থেকে বিয়ে করে বৌ নিয়ে এল। ডানাকাটা পরী বলতে যা বোঝায়, তাই। মনে হয় সদ্য ডানা কাটা হয়েছে। কাটার দাগ এখনো মিলায়নি। রূপের কম্পিটিশনে এই মেয়ে হয় মিস বাংলাদেশ হবে কিংবা রানার্স আপ হবে। যাই হোক, রূপবতীকে বিয়ে করে বসিরুল হক যে বিপদে পড়ল তার কোন তুলনা নেই। হেন রোগ নেই যা এই মেয়ের নেই। হাঁপানি আছে, বুক ধড়ফড় আছে, হিস্টিরিয়া আছে, ব্লাড প্রেসারের সমস্যা আছে। সামান্য ডায়াবেটিসও আছে। কিছু দিন আগে শুনলাম হার্টের সমস্যাও ধরা পড়েছে–ড্রপ বিট হয়, ..
নায়লা শব্দ করে হেসে উঠল। আশেপাশের টেবিলের সবাই তাকাচ্ছে। নায়লা হাসি থামাতে পারছে না।
বাবুও মার সঙ্গে হাসছে। হঠাৎ হাসি থামিয়ে–বলল, মাম্মাট বাকরু।
বাকুরু হচ্ছে ভয়াবহ ধরনের সিগন্যাল। বাকরু মানে সে বাথরুমে যাবে এবং কড় কাজটি করবে।
নায়লা হাসি থামিয়ে শুকনো মুখে জামানের দিকে তাকাল। জামান বিড় বিড় করে বলল, সমস্যা হয়ে গেলো তো।
অলিম বলল, সমস্যা কি, বাবু বাথরুম করবে?
বাথরুম বন্ধ হয়ে যাওয়াটা সমস্যা। বাথরুম করতে চাওয়াটা সমস্যা না। জামান, তুই যা, ছেলেকে বাথরুম করিয়ে আন।
নায়লা বলল, ও পারবে না। আমি যাচ্ছি।
উঁহু, বাইরে এসে মায়েরা বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত হবে না। নিয়ম নেই–আমি যাচ্ছি।
না না, আপনি পারবেন না।
অবশ্যই পারব। একটা শিশুকে বাথরুম করানো এমন কোন টেকনিক্যাল কাজ না যে আমি পারব না। তার আগে আমাকে দু মাসের ট্রেনিং নিতে হবে। তোমরা দুজন চালিয়ে যাও, আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমাদের সঙ্গে জয়েন করব। বাবু এসো!
বাবু সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়াল। নায়লার খুব লজ্জা লাগছে, বাইরের একজন মানুষ তার ছেলেকে বাথরুম করাবে, এটা কেমন কথা? মায়লা অস্বস্তি নিয়ে জামানের দিকে তাকাল। জামান স্টেজে লম্বা গিটারিস্টের গান শুনছে। মনে হচ্ছে খুব মন দিয়ে শুনছে। নায়লা বলল, খাবারগুলি তো তেমন ভাল লাগছে না। কোনটাতেই মনে হয়। লবণ হয়নি।
জামান বলল, রুচির ব্যাপার আছে। আমরা তো এইসব খেয়ে অভ্যস্ত না, এই জন্যে আমাদের কাছে ভাল লাগছে না। আমরা খাই ভাজি, ভর্তা, শুটকি, ছোট মাছ …।
নায়লা বলল, তুমি আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলছ না কেন? স্টেজের দিকে তাকিয়ে আছি কেন?
ছেলেটার নাচানাচি দেখছি। যে ভাবে ঠ্যাং বাকাচ্ছে, মনে হয় ওর একটা হাঁটু না, দুটা হাঁটু।
নায়লা জামানের দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে খিলখিল করে হেসে উঠল। জামান খুব শুকনো মুখে সিরিয়াস ভঙ্গিতে রসিকতা করে। হঠাৎ হঠাৎ করে বলেই শুনতে এত মজা লাগে। নায়লা হাসছে–জামান গম্ভীর মুখে স্টেজের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন সে তার স্ত্রীকে চেনে না।
রাত দশটা বেজে গেছে। জামান ভেবেছিল একটা বেবীটেক্সী নিয়ে চলে যাবে। আলম তাতে রাজি না। সে রেন্ট-এ-কার আনতে পাঠিয়েছে।
জামান বলল, সুন্দর চাদনী রাত আছে। গাড়ি নিয়ে কিছুক্ষণ শহরে ঘুরে তারপর বাসায় চলে যা। তোর হাই তোলা দেখে মনে হচ্ছে–নিশুতি রাত।
বাবুর মেজাজ এখন খারাপ। সে ঘন ঘন বলছে–মাম্মাট কোলা দুদু। অর্থাৎ তাকে কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াতে হবে। লজ্জায় নায়লা মরে যাচ্ছে। আমি কিছু বুঝতে পারছে কি-না কে জানে। বুঝতে পারলে বলে বসবে–বাচ্চাকে দুধ খাওয়াবে, এতে এত লজ্জা কিসের? খাওয়াও। ভদ্রলোকের মুখে কিছু আটকায় না।
বাবু ঘ্যান ঘ্যান করছেই—মাম্মাট কোলা দুদু। মাম্মাট কোলা দুদু।
আলম বলল, মাম্মাট কোলা দুদু বাক্যটার মানে কি?
নায়লা বলল, ওর ঘুম পাচ্ছে। ঘুম পেলে এরকম বলে।
আলম বলল, জামান, তুই ওকে কোলে নিয়ে বারান্দা বরাবর খানিকটা হাঁটাহাঁটি কর। ও ঘুমিয়ে পড়ুক। সামান্য একটা গাড়ি আনতে এত দেরি করছে কেন কে জানে।
জামান ছেলেকে নিয়ে হোটেলের লবীর শেষ মাথায় চলে গেল। আলম এবং নায়লা শুধু দাড়িয়ে। আমি তাকিয়ে আছে নায়লার দিকে। হঠাৎ নায়লার কেমন অস্বস্তি লাগতে লাগল। তার মনে হচ্ছে–কিছু একটা হয়েছে। চারপাশের পরিবেশ পাল্টে গেছে বা অন্য কিছু। এ রকম মনে হবার কারণ কি? নায়লার বুক ধরফড় করছে। পিপাসা বোধ হচ্ছে।
আলম সিগারেট ধরাল। লম্বা একটা টান দিয়ে বলল, নায়লা। তুমি আমার দিকে তাকাও তো।
নায়লা তাকাল।
আলম বলল, একটা বড় ধরনের সমস্যা হয়েছে। সমস্যাটা তোমাকে বলা দরকার।
কি সমস্যা?
সমস্যা নিয়ে আলোচনা না করাই ভাল ছিল। কিছু কিছু সমস্যা আছে যা নিয়ে আলোচনা করতে নেই। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে …
সমস্যাটা কি বলুন।
তুমি কিছু ধরতে পারছ না?
না।
আমার মনে হয় তুমি ধরতে পারছ। তুমি কোন বোকা মেয়ে নও। বুদ্ধিমতী মেয়ে। আমার ধারণা অসম্ভব বুদ্ধিমতী।
আমার সম্পর্কে আপনি ভুল ধারণা করেছেন। আমি মোটেই বুদ্ধিমতী না?
আলম আধ-খাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়ে দু হাত প্যান্টে ঘসতে ঘসতে স্পষ্ট গলায় বলল, কলেজে পড়ার সময় একটা মেয়েকে বিয়ে করার জন্যে আমি প্রায় পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। অনেক কষ্টে তাকে যখন প্রায় ভুলেছি তখন তোমার সূঙ্গে দেখা। জামান কি কখনো তোমাকে বলেছে যে তুমি দেখতে হুবহু সেই মেয়েটির মত? হাসলে ঐ মেয়েটির বা গাকে টোল পড়ত। তোমারও পড়ে। এই যে তুমি আমার জন্যে মেয়ে দেখে বেড়াচ্ছি, এটা অর্থহীন বলে মনে হচ্ছে। আমি কাউকে বিয়ে করতে পারব না। আমার নিয়তি কি জান? আমার নিয়তি হচ্ছে এক একবার প্রেমে পড়ব। কিন্তু প্রেমিকাকে কাছে পাব না। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়াটা ভুল হয়েছে। আমি আমি … আচ্ছা বাদ দাও।
আলম আরেকটা সিগারেট ধরে কাশতে লাগল। গাড়ি চলে এসেছে। ছোট গাড়ি পায়নি, বার সীটের মাইক্রোবাস। আলম এগিয়ে গিয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা কলল। জামান ছেলেকে কোলে নিয়ে স্ত্রীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাবু ঘুমিয়ে পড়েছে। আলম বলল, ড্রাইভারকে বলেছি তোদের নিয়ে খানিকক্ষণ ঘুরে তারপর বাসায় যাবে। আর শোন, ভাড়া আমি দিয়ে দিয়েছি। যা, গড়িতে ওঠ।
জামান বলল, তুইও আয় আমাদের সঙ্গে। আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে আসবি।
না।
নায়লা যন্ত্রের মত গাড়িতে উঠেছে। জানালার পাশে বসেছে। তার চোখ গাড়ির মেঝেতে নিবদ্ধ। সে একারও চোখ তুলে কোন দিকে তাকাচ্ছে না। বাইরে শীতল হাওয়া কিন্তু তার গরম লাগছে। খুব পানি খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। বরফের কুচি মেশানো ঠাণ্ডা পানি।
ঘুমন্ত বাবুকে কোলে নিয়ে জামাল সিড়ি দিয়ে উঠতে যাচ্ছে। নায়লা বলল, লিফটে উঠ। এক-আধবার লিফটে উঠলে কিছু যায় আসে না।
জামান বলল, না না, ঠিক হবে না। তুমি ওঠ। লিফটে ওঠ। আমি সিঁড়ি দিয়ে থেমে থেমে ওঠব। অসুবিধা হবে না।
জামান সিঁড়ি ভেঙে ওঠছে। নায়লা লিফটের বোতাম টিপে লিফটের জন্যে অপেক্ষা করছে। বাবুকে জামানের কাছ থেকে নিয়ে নেয়া উচিত ছিল। কেন সে নেয়নি? সব কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। তার ঘুম পাচ্ছে, প্রচণ্ড ঘুম। মনে হচ্ছে সে লিফটে উঠেই ঘুমিয়ে পড়বে।
তার ঘুমুতে গেল রাত এগারোটার দিকে। নায়লা বাইরের কাপড় বদলায়নি। নতুন শাড়ি পরেই হাত-পা গুটিয়ে শুয়ে আছে। মশারিও খাটানো হয়নি। সে ক্লান্ত গলায় বলল, মশারি খাঁটিয়ে বাতিটা নিভিয়ে দেবে?
তুমি কাপড় বদলাবে না?
না।
জামান মশারি খাটাল। বাবুকে ঘুমের মধ্যেই বাথরুম করিয়ে আনল। বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে এলো। খাটের দু প্রান্তে দুঞ্জন, মাঝখানে বাবু।
খুব প্রচণ্ড ধুমের কিছু সমস্যা আছে। প্রচণ্ড ঘুম নিয়ে বিছানায় যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম কেটে যায়। তখন আর ঘুম আসতে চায় না। নায়লার কি তাই হয়েছে? জামান বাতি নেভানোর সঙ্গে সঙ্গে তার ঘুম কেটে গেছে। মাথায় চাপা যন্ত্রণা নিয়ে সে শুয়ে আছে। এই যন্ত্রণা দূর হবার নয়। ঠাণ্ডা করে নিচে মাখা দিয়ে দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হয়ত মাথার যন্ত্রণাটা কমত।
নায়লা বিছানায় উঠে বসল। ঘুম আসবে না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হবার পর আর শুয়ে থাকা যায় না। জামান, বাবু দুজনেই ঘুমুচ্ছে। অন্ধকারে তাদের দেখা যাচ্ছে না–কিন্তু তারা যে আরাম করে নিঃশ্বাস ফেলছে এই শব্দ কানে আসছে …।
নায়লা অন্ধকারে পা টিপে দরজা খুলে ছাদে চলে এল।
জামান বড় সাহেবের কাছে ফাইল নিয়ে গিয়েছিল
জামান বড় সাহেবের কাছে ফাইল নিয়ে গিয়েছিল। এক মিনিটে কাজ হয়ে যাবার কথা–দুটা সই দেবেন। সে ফাইল নিয়ে চলে আসবে। সে জায়গায় সময় লাগল এক ঘন্টা দশ মিনিট। বড় সাহেবের টেলিফোন চলে এল। তিনি একটা সিগনেচার দিয়ে টেলিফোন ধরলেন এবং কাঁটায় কাঁটায় এক ঘণ্টা কথা বললেন।
এই এক ঘণ্টা জামানকে দাঁড়িয়ে থাকতে হল। কারণ কেরানি শ্রেণীর কেউ বড় সাহেবের ঘরে চেয়ারে বসবে না। এটাই অলিখিত নিয়ম। জামানকে ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে হল, বড় সাহেব বসার জন্যে ইশারা করলেন না। ঘরে যে একজন মানুষ ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে আছে এই ব্যাপারটা তিনি যেন পুরোপুরি ভুলে গেলেন। স্মৃতিভ্রষ্ট হলেন।
টেলিফোনের কথা শেষ হওয়া মাত্র আবার তাঁর স্মৃতি ফিরে এল–তিনি জামানের দিকে তাকিয়ে বললেন, আর কোথায় সই করতে হবে? সব দেখে দিয়েছেন তো?
জি স্যার?
গুড। প্রয়োজনে একবারের জায়গায় দশবার দেখবেন কিন্তু ভুল যেন না থাকে।
জামান ফাইল হাতে নিজের ঘরে এসে দেখে নায়লা তার সামনের চেয়ারে বসে আছে। নায়লার মুখ হাসি হাসি। কাজেই কোন দুঃসংবাদ দিতে আসেনি। সাহেবদের স্ত্রীরা অফিসে গল্প-গুজব করতে আসেন। তার মতো মানুষের স্ত্রীরা অফিসে আসে দুঃসংবাদ নিয়ে।
কি ব্যাপার লায়লা?
তোমার ভাত নিয়ে এসেছি।
কোন দরকার ছিল না তো। ক্যান্টিনে খেয়ে নিতাম।
লায়লা হাসল। জামানকে অবাক করে দিতে পেরেছে এতেই সে আনন্দিত। আজ সকালে সে জামানের ভাত রাধতে পারেনি। এমন ঝামেলা বেঁধে গেল! একদিকে বাবু কাঁদে, অন্যদিকে ফিরুর মার চিৎকার–সে কাজ করবে না। তাকে বেতন দিয়ে বিদায় দিতে হবে।
এই মহা ঝামেলার ভেতর ভাত হবে কি ভাবে? জামান বলেছে, তুমি ব্যস্ত হয়ে না, আমি ক্যান্টিনে খেয়ে নেব। নায়লা বলেছে, আচ্ছা। কিন্তু তখনি সে মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, ভাত বেঁধে সে টিফিন কেরিয়ারে করে অফিসে নিয়ে আসবে।
জামান বলল, বাবু কোথায়? ওকে কার কাছে রেখে এসেছ? ফিরুর মার কাছে?
পাগল! ওর কাছে আমি বাবুকে রেখে আব? মার কাছে রেখে এসেছি।
কলাবাগানে গিয়েছিলে?
হুঁ।
এত ঝামেলা করার কোন দরকার ছিল না।
একটু না হয় করলামই ঝামেলা। রোজ রোজ তো করি না। এখন বল ভাতটা খাবে কোথায়, এখানে?
না, ক্যান্টিনে।
তাহলে চল ক্যান্টিনে যাই।
তুমি বাসায় চলে যাও, আমি খেয়ে নেব।
নায়লা হাসিমুখে বলল, আমি তোমার সঙ্গে গেলে কি কোন অসুবিধা আছে? নাকি তোমাদের ক্যান্টিনে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ?
নিষেধ না, চল।
প্লেট-গ্লাস এগুলি কি ক্যান্টিন থেকে নেবে?
হুঁ।
তাহলে দুটা প্লেট নিও তো। আমিও তোমার সঙ্গে খাব। দুজনের খাবার এনেছি।
জামান খানিকটা ব্রিত ভঙ্গিতেই স্ত্রীকে নিয়ে কোণীর দিকে একটা টেবিলে বসেছে। তাদের ক্যান্টিনে দুজন মাত্র মহিলা কাজ করেন, তারা কখনো ক্যান্টিনে খেতে আসেন না। কাজেই এই ক্যান্টিন মহিলা বর্জিত। ক্যান্টিনের বয়-বাবুর্চি সবাই কৌতূহলী চোখে দেখছে।
নায়লা বলল, মার বাসায় আজ খাসির গোশত রান্না হয়েছে। তোমার কাছে আসছি শুনে মা গোশত দিয়ে দিয়েছেন। আমি এনেছি শুধু বেগুন ভাজা আর ডাল। এদেরকে বলেলে কি এরা কাঁচামরিচ দেবে? আমি কাঁচামরিচ আনতে ভুলে গেছি।
জামান কাঁচামরিচ দিতে বলল।
নায়লা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খাচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে প্রায়ই দুপুরে এই ক্যান্টিনে এসে সে খেয়ে যায়। নায়লা বলল, তুমি নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছ, ব্যাপার কি? কথা বল।
কি কথা বলব?
যা ইচ্ছা বল।
অফিসে তুমি কথাবার্তা বল না? আচ্ছা, আজ অফিসে সবচে মজার ঘটনা কি ঘটেছে?
অফিসে মজার ঘটনা কিছু ঘটে না।
নায়লা বলল, আজ তো একটা মজার ঘটনা ঘটেছে, সেটাই না হয় বল।
জামান বিস্মিত হয়ে বলল, কই, আজ তো কিছু ঘটে নি।
ঘটবে না কেন? এই যে আমি এসেছি এটা একটা মজার ঘটনা না?
নায়লা হাসছে। হাসলে তার বাম গালে টোল পড়ে। দেখতে জামানের বেশ মজা লাগে। ভরাট গালের মেয়ে, হঠাৎ সেখানে একটা গর্ত হয়ে গেল।
নায়লা বলল, অবাক হয়ে কি দেখছ?
কিছু না।
অবশ্যই কিছু দেখছ। বল না কি?
কিছু দেখছি না নায়লা।
তুমি আরাম করে খচ্ছি না। বার বার শুধু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছ। আরাম করে খাও তো। তুমি তোমার স্ত্রীর সঙ্গে বসে খাচ্ছ, এটা কোন গুরুতর অপরাধ না যে এমন সংকুচিত হয়ে থাকতে হবে। খাসির গোশতটা খেতে কেমন হয়েছে?
ভাল।
মেথি দিয়ে রান্না। এই রান্নাটা আমি জানি না। কতবার ভেবেছি শিখে নেব, আর শেখা হয় না। তোমার বন্ধুকে দাওয়াত করে একদিন মার হাতের মেথি দিয়ে রান্না করা গোশত খাওয়াব। তাহলে সে বুঝবে রান্না কাকে বলে।
আচ্ছা।
তোমার বন্ধু ভাল খাবার খুব পছন্দ করে, তাই না।
হুঁ।
এরকম লোককে খাইয়ে অনিন্দ আছে। তোমাকে খাইয়ে কোন আনন্দ নেই। তোমার কাছে মনে হয় সব খাবারই এক রকম লাগে, তাই না?
জামান হাসল।
সঙ্গে সঙ্গে নায়লাও হাসল। হাসতে হাসতে বলল, আমি কিন্তু পান খাব। তোমাদের এখানে পান পাওয়া যায়?
যায়।
তাহলে আনতে বল। মিষ্টিপান খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। আমি কিন্তু কিছুক্ষণ এখানে বসে তোমার সঙ্গে গল্প করব। এই অপরাধে তোমার বড় সাহেব আবার তোমার চাকরি নট করে দেবে না তো?।
জামান কিছু না বলে নিজেই পান আনতে গেল। মিষ্টিপান এখানে পাওয়া যায় না। রাস্তার ওপাশে একটা দোকানে ভাল মিষ্টিপান করে।
দুটা পান এক সঙ্গে মুখে দিয়ে নায়লা বলল, ঐ মেয়েটা কি পান খেত?
জামান বিস্মিত হয়ে বলল, কোন মেয়ে?
যে মেয়েটার প্রেমে তোমার বন্ধু হাবুডুবু খাচ্ছিল।
ও আচ্ছা, রেশমার কথা বলছ?
ওর নাম রেশমা?
হুঁ।
রেশমা কি পান খেত?
জানি না তো। এত লক্ষ্য করিনি।
মেয়েটা দেখতে কেমন ছিল?
সুন্দর ছিল।
সুন্দর মানে কি রকম সুন্দর? খুব সুন্দর?
হ্যাঁ, খুব সুন্দর। মেয়েটা দেখতে অনেকটা তোমার মতই ছিল।
সত্যি?
হুঁ।
নায়লা আগ্রহের সঙ্গে বলল, ওর কোন জিনিসটা আমার মত ছিল, চোখ, চুল, নাক, মুখ–কোনটা?
আমি বলতে পারব না। আলমকে জিজ্ঞেস করো। ও বলতে পারবে।
ঐ মেয়ের গালেও কি টোল পড় তো?
হুঁ।
এটা দেখি আবার মনে আছে।
আলম সব সময় বলতে, এই জন্যে মনে আছে।
আচ্ছা, তুমি আমাকে আগে কিছু বলনি কেন?
আগে কি বলব?
এই যে মেয়েটার চেহারার সঙ্গে আমার চেহারার এত মিল–এটা।
বলে কি হবে? বলার কি আছে?
আমার সঙ্গে তুমি কথা বলে কোন আরাম পাও না, তাই না?
জামান তাকিয়ে আছে। নায়লা কি বলতে চাচ্ছে সে ঠিক বুঝতে পারছে না। নায়লা হাই তুলতে তুলতে বলল, আমাকে বিয়ে না করে অন্য কাউকে বিয়ে করলে তুমি অনেক সুখি হতে। এটা বলায় রাগ করলে নাকি?
না।
তোমার এই গুণটা ভাল। কিছুতেই রাগ কর না। যার যা ইচ্ছে বলুক, তোমার কিছু যায় আসে না।
জামান বলল, নায়লা, তুমি এখন বাসায় চলে যাও–আমি কিছু কাজকর্ম করি।
কাজকর্ম তে সারাজীবনই করলে, একদিন না হয় না করলে। আজ ছুটি নিয়ে নাও না। চল আজ দুজনে ঘুরে বেড়াই।
কোথায় যাব?
সাভার স্মৃতিসৌধে যাব। এত সুন্দর জায়গাটা! ঐখানে পর্যটনের একটা রেস্টুরেন্ট আছে। চল আজ বিকেলের চটা ঐ রেস্টুরেন্টের বারান্দায় বসে খাব।
আরেকদিন যাব নায়লা। অনেক কাজ আছে। অফিসের অবস্থা ভাল না। নানা রকম গুজব শোনা যাচ্ছে। এবার নাকি অনেক ছাটাই হবে।
সারা বছর কাজ করেছ, একদিন শুধু আধবেলা কাজ না করার জন্যে তুমি ছাটাই হয়ে যাবে?
তা না।
তাহলে চল।
আজ থাক লায়লা। বড় সাহেব আমাকে একটা ফাইল দিয়েছেন–ফাইলটা আজই শেষ করে উনাকে দিতে হবে।
উনাকে গিয়ে বল–স্যার, আজ আমার স্ত্রীর জন্মদিন। ও এসে বসে আছে। ওকে নিয়ে একটু বাইরে না গেলে পারিবারিক সমস্যা হবে। তুমি বলতে না পারলে আমি বলি।
জামান বলল, আজ তোমার জন্মদিন নাকি?
না। সামান্য একটু মিথ্যা না হয় স্ত্রীর কারণে বললে।
জামান বলল, সামনের শুক্রবারে চল সাভার থেকে ঘুরে আসব। টেনশান নিয়ে কোথাও যাওয়া ঠিক না।
নায়লা ক্লান্ত গলায় বলল, আচ্ছা। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে সে চোখের পানি আটকে রাখছে। আজ সত্যি তার জন্মদিন।
একা একা সে কি করবে? রাস্তায় হাঁটবে? আচ্ছা, সে যদি আলমের হোটেলে উপস্থিত হয়ে বলে–আচ্ছা শুনুন, আজ আমার জন্মদিন। আজ সারাদিন আমি আপনাকে নিয়ে ঘুরব? তাহলে কেমন হয়?
নায়লা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। মানুষ যা ভাবে খুব কম সময়ই তা করতে পারে।
আচ্ছা, একা একা সাভার চলে গেলে কেমন হয়?
রাস্তায় নেমে নায়লা চোখ মুছতে লাগল। বার বার তার চোখ পানিতে ভিজে উঠছে।
নায়লা চোখ বড় বড় করে বলল
নায়লা চোখ বড় বড় করে বলল, আপনি এত বড় গাড়ি নিয়ে এসেছেন? আমরা যাব পুরানো ঢাকায়। এত বড় গাড়ি তো গলি দিয়ে চকুবে না।
আলম বলল, যতদূর যাওয়া যায় চল যাই, তারপর না হয় রিকশা নিয়ে নেব। জামান যাচ্ছে না?
না। ও বাবুকে ডাক্তারের কাছে নিয়েছে। বাবুর কাশি হয়েছে। কাল রাতে খুব কেশেছে। অবশ্যি বাবু সুস্থ থাকলেও সে যেত না। ওর নকি মেয়ে দেখতে যেতে ভাল লাগে না।
আলম খানিকটা অবাক হয়ে নায়লাকে দেখছে। নায়লা কেমন হড়বড় করে কথা বলে যাচ্ছে।
আমাদের বিয়ের সময়ও কিন্তু ও আমাকে আগে দেখেনি।
চোখ বন্ধ করে বিয়ে হয়েছে?
অনেকটা সে রকম।
তাহলে চল রওনা হই। তুমি যা সাজ দিয়েছ, তোমার পাশে তো অরি অন্য কোন মেয়েকে ভাল লাগবে না।
নায়লা লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। হালকা গোলাপি রঙের সুতির শাড়ি পরেছে। সাজের মধ্যে সাজ হল–চোখে কাজল। নিজেই কাজলদানে কাজল বানিয়ে চোখে দিয়েছে। প্রথমে হাতে দুগাছি সোনার চুড়ি পরেছিল। তাকিয়ে দেখে হাত খালি খালি লাগছে। হাত ভর্তি সোনার চুড়ি থাকলে একটা কথা। এত চুড়ি সে পাবে কোথায়? বিয়ের সময় বাবা যা দিয়েছিলেন তাই। সেখান থেকেও কিছু নষ্ট হয়েছে। বাবুর জন্মের সময় গলার হারটা বিক্রি করতে হল।
নায়লা সোনার চুড়িগুলি খুলে ফেলে হাত ভর্তি কাচের চুড়ি পরল। সবুজ রঙের চুড়ি। সবুজ পাথর বসানো একটা আঙটি হাতে থাকলে খুব মানাতো?
আলম বলল, নায়লা, একটা কাজ করা যাক। রওনা হবার আগে চল কোন কফি হাউসে বসে এক কাপ কালো কফি খাই। কফি খেতে খেতে আমাদের স্ট্রাটেজি ঠিক করে নেই।
স্ট্র্যাটেজি কিসের?
একটা পরিকল্পনা করতে হবে না যাতে মেয়েটা আমাকে পছন্দ করে? ফাস্ট ইমপ্রেশন ভাল না হলে খেলা ড্র হয়ে যাবে।
বেশ তো, চলুন কফি খাই।
আর গাড়িটাও বদলাতে হবে, ছেটি গাড়ি নিতে হবে। আমার পোশাক-আশাক কি ঠিক আছে?
হ্যাঁ ঠিক আছে।
আমার নিজের কাছে ভাল লাগছে না। তোমার পোশাকের সঙ্গে ম্যাচ করছে না। তুমি পরেছ খাঁটি বাঙালী পোশাক–আমি জিনসের প্যান্ট, রঙচঙা শার্ট। আমিও বাঙালী পোশাক পরব।
বাঙালী পোশাকটা কি? লুঙ্গি-গেঞ্জি?
ছেলেদের বাঙালী পোশাক হচ্ছে পায়জামা-পাঞ্জাবি, কাধে চাদর। পায়ে চটি জুতা …।
আগে ছিল, এখন আর এইসব কেউ পরে না।
তুমি তাহলে বলছ আমার ড্রেস ঠিক আছে?
হুঁ।
গায়ে সেন্ট মেখেছি, বুঝতে পারছ তো? সেন্টটা কোন সমস্যা করবে না তো?
নায়লা বিস্মিত হয়ে বলল, সেন্ট সমস্যা করবে কেন?
অনেক মেয়ে আছে–ছেলেদের সেন্ট মাখা একেবারেই পছন্দ করে না। তারা ভাবে, এটা হল এফিমিনেট–মেয়েলী ব্যাপার। পুরুষদের গায়ে ঘামের কড়া গন্ধে তাদের কিছু যায়-আসে না, কিন্তু আফটার শেভের মিষ্টি গন্ধ তাদের পছন্দ না।
অপিনি বুঝি মেয়েদের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে খুব চিন্তা করেন?
আগে করতাম না। এখন করি। বিয়ের চেষ্টা যে আমি এখন শুরু করেছি তা না। বেশ কিছু দিন থেকেই করছি। বিদেশেও বাঙালী মেয়েরা আছে। কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তাও এগিয়েছিল–শেষে তারা পিছিয়ে গেল। আমি হলাম ঘরপোড়া গরু–কাজেই এবার আমি খুব সাবধান …।
কফি শপটা সুন্দর। লোকজন একেবারেই নেই। সকাল দশটার দিকে এ দেশের লোকজন কফি খেতে চায় না। এরা কফি খায় বিকেলে। আলম বলল, নায়লা, এখন তুমি তোমার বান্ধবী সম্পর্কে আমাকে ব্রীফিং দাও–তার নাম হল–অরুণা, তাই না?
হুঁ।
পড়াশোনা কতদূর?
বিএ পাশ করার পর বিএড ডিগ্রী নিয়েছে–এক সময় স্কুলে পড়াত। এখন রিসিপশনিস্টের কাজ করছে।
সর্বনাশ! মাস্টারনী?
মাস্টারনীতে অসুবিধা কি?
মাস্টাররা পৃথিবীর সবাইকে ছাত্র মনে করে–এই হচ্ছে অসুবিধা। বাসররাতে জিজ্ঞেস করে বসতে পারে–বাসররাত কোন সমাস?
নায়লা হাসছে। শব্দ করে হাসছে। গালে কী সুন্দর টোল পড়েছে! আলম বলল, তোমার নিজের পড়াশোনা কি? নায়লা হাসি থামিয়ে বলল, আমার পড়াশোনা নেই।
স্বরে অ, স্বরে আ জান? না তাও জান না?
না জানার মতই। আমি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করতে পারিনি। পরীক্ষার একমাস আগে বিয়ে হল–পরীক্ষা দেয়া হল না। পরের বছর পরীক্ষা দেব ভেবেছিলাম–সেই বছর বাবু হল, এখন উৎসাহ চলে গেছে।
বিয়ের জন্যে পড়াশোনা দরকার ছিল, বিয়ে হয়ে গেছে, আর পড়াশোনা দিয়ে কি হবে, তাই না?
নায়লা জবাব দিল না। আলম বলল, তোমার মন খারাপ করিয়ে দিলাম কি?
উঁহু।
চল যাওয়া যাক। মন খারাপ করার কিছু নেই। আমি সত্যি কথাই বলছি। এখন পর্যন্ত মেয়েদের সবকিছু বিয়ে এবং বিয়ের পরে স্বামী নামক বস্তুটি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। জামানের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বলে তুমি একরকম হয়েছ জামানের সঙ্গে বিয়ে না হয়ে আমার সঙ্গে হলে তুমি হতে অন্যরকম। আমি বা জামান–আমরা বদলাচ্ছি না। বদলাচ্ছ তুমি। মেয়েরা পুরোপুরি পানির মত। নিজের আকৃতি নেই–যে পাত্রে রাখা হচ্ছে সেই পাত্রের আকার ধারণ করছে।
সবাই করচ্ছে না। কেউ কেউ হয়ত করছে।
আলম বলল, করছে না এমন সংখ্যা খুবই অল্প। যারা করছে না–তাদের আবার বিয়ে হচ্ছে না–হলেও বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। বিয়ে টিকছে না। বিয়ে যাতে না ভাঙে, এই জন্যেই মেয়েরা নিজেদের বদলায়। বদলানোর ব্যাপারটা পুরুষদের জন্যে কঠিন বলেই মেয়েরাই এই কাজটা করে। তারা যে জেনেশুনে করে তাও কিন্তু না। প্রকৃতি তাদের ডিএনএ অণুতে এই ব্যাপারটি লিখে দিয়েছে। প্রোগ্রাম করা। কেন এ রকম প্রোগ্রাম করা সেটা জান?
না।
জানতে চাও? বলব?
অন্য সময় বলবেন। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। অরুণাকে পাব না।
না পেলে না পাব। কথাগুলি জরুরী, তুমি শুনে রাখ। তোমার লাভ হবে।
কি লাভ?
নিজেকে জানতে পারবে। নিজেকে যত ভাল জানবে ততই লাভ। নিজেকে জানতে চাও না?
নায়লা কিছু বলল না। আলম বলল, এসো আরেক কাপ কফি খাওয়া যাক। কফি খেতে খেতে ব্যাপারটা তোমার কাছে ব্যাখ্যা করি।
আমি আর কফি খাব না, আপনি খান।
তুমি তাহলে চা খাও–দিতে বলি?
বলুন।
আলম চায়ের কথা বলে নায়লার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এল। তার চোখ চকচক করছে। আগ্রহী শ্রোতাকে কথা শোনানোর আনন্দের সবটাই এখন তার চোখে মুখে।
প্রকৃতি যে এই কাজটা করে, কেন করে? প্রকৃতি অকারণে কিছু করে না। তার সবকিছুর পেছনে কারণ আছে। যুক্তি আছে। বর্তমান নিয়ে প্রকৃতির তেমন মাথাব্যথা নেই। প্রকৃতির দৃষ্টি সব সময় ভবিষ্যতের দিকে। প্রকৃতি দেখে মানবজাতির ভবিষ্যৎ কি। সে সেই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্যেই এই কাজটা করে। বুঝতে পারছ?
না।
তোমার এবং তোমার স্বামীর সুসম্পর্কের উপর নির্ভর করছে তোমার ছেলেমেদের ভবিষ্যৎ। প্রকৃতি সেই দিকে লক্ষ্য রেখে চেষ্টা চালাবে সম্পর্ক ঠিক রাখতে। স্ত্রীর মনে স্বামীর প্রতি যে ভাবলাসী ও মমতা তৈরি হয় তার অনেকটাই মিখা ভালবাসা, মিথ্যা মমতা। এই মিথ্যা প্রকৃতির সৃষ্টি।
কি যে আপনি বলেন।
শুনতে খারাপ লাগলেও যা বলছি তা সত্যি। তুমি জামানকে ভালবাস, বাস না?
এই প্রসঙ্গ খাক।
থাকবে কেন, এসো আমরা এনালাইজ করি। ধরে নেয়া যেতে পারে, এই ভালবাসা তীব্র। জামান অফিস থেকে ফিরতে দেরি করলে তুমি অস্থির হও। ফেরার সময় গেটের দিকে তাকিয়ে থাক। যেই দেখ সে রিকশা থেকে নামছে তুমি আনন্দে অভিভূত হও …।
আপনি বলতে চাচ্ছেন এই আনন্দের মধ্যে ভালবাসা নেই?
থাকলেও খুব সামান্য। এই আনন্দের প্রায় সবটাই নিরাপত্তাবোধের আনন্দ। তুমি একজনকে দেখছ যে তোমার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে, তোমাকে আশ্রয় দেবে, তোমার শারীরিক চাহিদা মেটাবে।
আপনি বলতে চাচ্ছেন–আমাদের যে সব চাহিদা আছে সেই সব বাইরে থেকে মেটাবার ব্যবস্থা থাকলে আপনার বন্ধুর জন্যে আমার ভালবাসা থাকবে না?
না থাকারই কথা। তোমাদের দুজনের চরিত্র সম্পূর্ণ দুরকম।
সম্পূর্ণ দুধরনের চরিত্রের দুটি মানুষ একজন আরেকজনকে ভালবাসতে পারে না?
ভালবাসা ব্যাপারটাই ধোঁয়াটে। প্রকৃতির এক খেলা, যার উদ্দেশ্য ভবিষ্যৎ মানব সৃষ্টির নিরাপত্তা…
আপনার এই বক্তৃতা বন্ধ করুন। শুনতে ভাল লাগছে না।
চল রওনা দেয়া যাক।
আজ গিয়ে লাভ হবে না–অরুনা স্কুলে চলে গেছে।
জামান খুশি খুশি গলায় বলল, আজ না যাওয়াই ভাল। তাছাড়া তোমার সঙ্গে যেতেও চাচ্ছি না। এক তরুণীকে সঙ্গে নিয়ে আরেক তরুণীকে দেখতে যাওয়ার কোন মানে হয় না। আমি জামানকে নিয়ে কাল-পরশু যাব।
আমি চলে যাই তাহলে?
এত তাড়া কিসের? বস।
বসে কি করব?
গল্প করবে। তুমি গল্প করতে না চাইলে আমি গল্প করব, তুমি শুনবে।
নায়লার অস্বস্তি লাগছে। সে গল্প করবে? কি গল্প করবে?
নায়লা।
জি।
তুমি এমন গাল-টাল লাল করে বসে আছি, ব্যাপার কি? তুমি কি আগে কখনো কোন ছেলের সঙ্গে বসে চা খাওনি?
নায়লা জবাব দিল না।
বিয়ের আগে প্রেম-টেম কিছুই হয়নি?
আলম ভাই, আজ আমি উঠি। বাবুর শরীরটা ভাল না, কাশি?
বাবু তো জঙ্গলে পড়ে নেই। বাবার সঙ্গে আছে। ভাক্তার তাকে দেখবেন। ইতিমধ্যে হয়ত ওষুধও দেয়া হয়েছে। আমার সঙ্গে বসে থাকতে কি তোমার অস্বস্তি লাগছে?
অস্বস্তি লাগবে কেন?
সেটাই তো কথা–অস্বস্তি কেন লাগবে? শোন নায়লা, আমি যে ক্রমাগত বক বক করে যাচ্ছি তার একটা কারণ আছে। আমি আমেরিকার যে অঞ্চলে বাস করি সেখানে বাঙালীর বংশও নেই। মাসের পর মাস চলে যায় কোন বাংলা কথা শুনি না।
বাংলা কথা শুনবার জন্যে আপনি আমাকে বসিয়ে রেখেছেন?
না। তোমার সঙ্গ পাবার জন্যে বসিয়ে রেখেছি। এই সময়ের তরুণী মেয়েরা কি ভাবে কথা বলে, কি ভাবে, এই সব আমার জানা দরকার। দুদিন পর একজনের সঙ্গে বাস করতে যাচ্ছি। তোমার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখছি।
কি শিখছেন?
প্রথম যা শিখলাম তা হচ্ছে–এ দেশের বিবাহিত মেয়েরা স্বামীর অনুপস্থিতিতে অন্য কোন যুবকের সঙ্গে সহজ হতে পারে না। তারা সহজ হয় স্বামীর উপস্থিতিতে। অথচ উল্টোটাই হওয়া উচিত ছিল। শোন নায়লা, বেলা বারোটা পর্যন্ত তোমাকে আমার সঙ্গে থাকতে হবে।
কেন?
কারণ বারোটা পর্যন্ত আমি একটা গাড়ি ভাড়া করেছি–আমার ধারণা ছিল অরুণা নামের তোমার ঐ বান্ধবীর বাসায় যাওয়া—গল্প করা—তারপর তোমাকে নামিয়ে দেয়াতে বারোটার মত বেজে যাবে। যেহেতু অরুণা-প্রোগ্রাম বালি সেহেতু তোমাকেই থাকতে হবে বারোটা পর্যন্ত। আমি তো শুধু শুধু টাকা নষ্ট হতে দিতে পারি না।
এত কিছু বলার দরকার নেই। আমি থাকব বারোটা পর্যন্ত।
গুড। তাহলে চল একটা ঘোড়া কিনে নিয়ে আসি।
কি কিনবেন?
ঘোড়া–The Horse.
সত্যি ঘোড়া কিনবেন?
অবশ্যই কিনব। সাভারে পাওয়া যায়। তুমি বোধহয় আমার কথা বিশ্বাস করছ না?
নায়লা ক্ষীণ গলায় বলল, আমি বিশ্বাস করছি।
বিশ্বাস করছ কেন?
বিশ্বাস করছি, কারণ আপনি শুধু শুধু আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলবেন কেন?
ঠিক ধরেছ। আমি মোটেই মিথ্যা বলছি না। আমি দেখে এসেছি সাভারে ঘোড়া বিক্রি হয়। তাই একটা কিনব।
চলুন যাই।
সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধের কাছে মাটির খেলনার দোকান থেকে আলম বিশাল আকৃতির মাটির মোড় কিনল। শুধু ঘোড়া না–ঘোড়া এবং হাতী দুটাই কিনল। হাসিমুখে বলল, তোমার ছেলের জন্যে কিনলাম। ঘোড়া এরা সুন্দর বানিয়েছে। কিন্তু হাতি সুবিধা হয়নি। দেখতে ইঁদুরের মতে লাগছে। তাই না? মনে হচ্ছে না বড় সাইজের ইঁদুর?
হুঁ।
তুমি এমন গম্ভীর হয়ে আছ কেন নায়লা? মনে হচ্ছে তোমার আশাভঙ্গ হয়েছে। তুমি কি ভেবেছিলে আমি সত্যি সত্যি ঘোড়া কিনব?
হ্যাঁ। টাকাওয়ালা মানুষদের কত অদ্ভুত শখ থাকে। আমরা তাদের সেইসব শখ দেখে মজা পাই?
ভুল কথা বললে নায়লা। টাকাওয়ালা মানুষদের অদ্ভুত শখ থাকে না। আসলে তাদের কোন শখই থাকে না। শখ থাকলেই টাকা খরচ। টাকা খরচ হলে এর টাকাওয়ালা হবে কিভাবে? চল যাওয়া যাক।
নায়লা বলল, স্মৃতিসৌধটা দেখে যাই। আমি আগে কখনো দেখিনি।
তোমার দেরি হয়ে যাবে না?
হবে। একবার যখন দেরি হয়ে গেছে, হোক।
গুড। এই হল স্পিরিট।
নায়লা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, জায়গাটা এত সুন্দর, ক্যামেরা থাকলে ছবি তুলতাম।
ক্যামেরা আমার ব্যাগে আছে। ছবি তুলতে চাইলে তুলে দেব।
না থাক, লাগবে না।
কেন লাগবে না? অবশ্যই লাগবে। তুমি এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক, আমি ক্যামেরা নিয়ে আসছি।
নায়লা দাঁড়িয়ে আছে। আলম ক্যামেরা আনতে যাচ্ছে। গাড়ি অনেক দূরে। আলমকে অনেকখানি জায়গা হাঁটতে হবে। নায়লার কেন জানি অস্থির অস্থির লাগছে। অস্থিরতাটা কি অন্যে? বাবুকে বেখে এসেছে, সে অন্যে? নাকি এর পেছনে অন্য কোন কারণ আছে? জামান বাবুকে ডাক্তার দেখিয়ে মার কাছে রেখে অফিসে যাবে। এই ছিল কথা। রেখে এসেছে নিশ্চয়। আচ্ছা, বাবু কি কিছু খেয়েছে? মার বাসায় বাবুকে দিয়ে আসার এই এক সমস্যা। এরা নিয়ে শুধু খেলবে–খাওয়ার সময় খাওয়াবে না। তাছাড়া বাবুর একটা বড় সমস্যা হচ্ছে পিপি আটকে রাখা। কিছুতেই করবে না। বাথরুমে নিয়ে শিষ দিয়ে দিয়ে পিপি করাতে হয়।
নায়লা, দেখি তাকাও তো?
নায়লা তাকাতেই আলম ছবি তুলল। হাসতে হাসতে বলল, আমি ড্রাইভারকেও নিয়ে এসেছি। সে আমাদের ছবি তুলে দেবে।
আমাদের ছবি তুলে দেবে মানে কি? নায়লা কি চেয়েছে আলমের সঙ্গে ছবি তুলতে? এখন সে কি বলবে? সে কি বলবে, আপনার সঙ্গে ছবি তুলব না। এটা বলা যায় না। অভদ্রত হয়। আলম চাইলে–ছবি তুলতে হবে। আলম দীর্ঘদিন বাইরে আছে–তার কাছে এই ব্যাপারগুলি হয়ত খুব স্বাভাবিক। এ দেশের জন্য না। এ দেশে স্বামীর অনুপস্থিতিতে স্বামীর বন্ধুর সঙ্গে ছবি তোলা যায় না।
নায়লা, আমার পাশে দাঁড়াও।
নায়লা দাঁড়াল।
হাসিমুখে দাঁড়াও। তুমি এমন মুখ কালো করে দাঁড়িয়েছ যে মনে হচ্ছে–ফাঁসির হুকুম হয়েছে। ছবি তোলার পর পরই তোমাকে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে। মুখ এমন কালো কেন?
নায়লা ক্ষীণ স্বরে বলল, দুঃশ্চিন্তা লাগছে। বাবুকে রেখে এসেছি।
বাঙালী মেয়েদের সঙ্গে বিদেশী মেয়েদের এই একটা বড় তফাৎ। বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেলে বাঙালী তরুণী আর তরুণী থাকে না–মা হয়ে যায়। বিদেশীনীদের ব্যাপারটা কেমন জান? বাচ্চা যখন পাশে থাকবে তখন মা, যখন পাশে থাকবে না তখন লাস্যময়ী তরুণী। নায়লা শোন, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি—আমার ধারণা, বাচ্চাকে বাসায় রেখে তুমি কখনো জামানকে নিয়ে ঘুরতে বের হও না। না-কি হও?
না হই না। আমরা মজা করে ঘুরব আর ঐ বেচারা একা ঘরে থাকবে?
মাঝে মাঝে এই কাজটা করবে, নয়ত দেখবে একদিন জামান তোমার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। তোমার কথা মনে হলেই তার মনে মাতৃমূর্তি ভেসে উঠছে–প্রেমিক-মূর্তি না।
আপনার উপদেশ মনে রাখব। এখন চলুন বাসায় যাই।
আমি কিন্তু চলেই যেতে চেয়েছিলাম, এখানে এসেছি তোমার আগ্রহে।
আমার আগ্রহ শেষ হয়েছে, এখন চলুন ফেরত যাই।
চল যাই। তার আগে ছবি বিটা শেষ করে ফেলি–অল্প কটা ছবি বাকি। রিল শেষ করলেই প্রিন্ট করতে দেব। তবে ছবি ভাল হবে না–সূর্য একেবারে মাখার উপর।
নায়লা মনে মনে বলল, ছবি একেবারে না উঠলেই সবচে ভাল হয়।
হাতী-ঘোড়া সহ আলম নায়লাকে তাদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেছে। খালি বাসা। ফিরুর মাও নেই। জামান কি তাকেও রেখে এসেছে? তালা দেয়া ঘর খুলতে কেমন জানি লাগে। এতক্ষণ সে একা একা থাকবে? আগে কথা ছিল অরুণীর বাসা থেকে সে মার বাসায় চলে যাবে। সেখান থেকে সবাইকে নিয়ে বিকেলে বাসায় ফিরবে। সব পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে গেছে। খিদেও লেগেছে। শুধু নিজের জন্যে রান্না করতে ইচ্ছা করছে না।
অনেক সময় নিয়ে নায়লা গোসল করল। বাথরুমে তার কেমন ভয় ভয় লাগছে। কেন জানি মনে হচ্ছে গোসল শেষ করে বাথরুমের দরজা খুলতে গিয়ে দেখবে, দরজা খুলতে পারছে না।
দুপুরে সে অভুক্ত অবস্থায় বিছানায় শুয়ে রইল। দিনে ঘুমিয়ে তার অভ্যাস নেই–তবু বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যেই বাজে ধরনের দুঃস্বপ্ন দেখল। দুঃস্বপ্নটা বাজে এবং নোংরা যেন তার স্বামী আলম, জামান নয়। সে আলমের সঙ্গে বেড়াতে বের হয়েছে। আলম ছবি তুলবে, কোত্থেকে শুটকা ধরনের একটা লোকটা ধরে নিয়ে এসেছে। তাকে গম্ভীর ভঙ্গিতে বলছে, অটোফোকাস ক্যামেরা। শুধু বাটন টিপলেই হবে।
লোকটা ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়েছে। অলিম তাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে আছে। তার একটু অস্বস্তি লাগছে, কারণ বাইরের একটা লোক, সে কি জানি মনে করছে। তারচেয়েও বড় কথা–নায়লা দাঁড়িয়ে আছে শুধু পেটিকোট পরে। তার গায়ে আর কোন কাপড় নেই। অথচ এই ব্যাপারটায় কেউ কিছু মনে করছে না। যেন এটাই স্বাভাবিক। শুধু নায়লা একাই লজ্জায় মরে যাচ্ছে।
নায়লার ঘুম ভাঙল সন্ধ্যা মিলিয়ে যাবার পর। জামান অফিস থেকে এসে দরজা ঠক ঠক করছে, তখনো নায়লা ঘুমে। ঘর অন্ধকার। মুখের চারপাশে মশা ভন ভুন করছে …। উত্তরের জানালা খোলা জানালা দিয়ে শীতের হাওয়া আসছে। শরীর কাঁপছে শীতে। নায়লা উঠে দরজা খুলল।
জামান বলল, কি ব্যাপার, শরীর খারাপ?
হুঁ।
ঘর অন্ধকার করে রেখেছ–ঘুমুচ্ছিলে?
হুঁ। বাবুকে আননি?
না। আমি ভাবলাম তুমি নিয়ে আসবে।
জামান বাথরুমে ঢুকে গেল। কোন কৌতূহল নেই, কোন আগ্রহ নেই। আশ্চর্য মানুষ তো! অরুণাকে আলমের পছন্দ হয়েছে কি না জানতে চাইবে না? ঘরের ভিতরে বিশাল আকৃতির মাটির ঘোড়া, মাটির হাতী। সেদিকেও লক্ষ্য নেই। একবার তো জিজ্ঞেস করবে–এগুলি কোখেকে এসেছে? নায়লা রান্নাঘরে ঢুকল। জামানকে চা দেবে। ঘরে খাবার কি কিছু আছে? মুড়ি থাকার কথা। মিইয়ে গেছে কিনা কে জানে। বাবুকে আনতে যেতে হবে। জামানকেই আনতে যেতে হবে।
ঘরে মুড়ি ছিল না। একটা টিনে কয়েকটা টোস্ট বিসকিট। সব কটা মিইয়ে গেছে। চায়ে ভিজিয়ে খাওয়া যাবে কি? নায়লা চা ও টোস্ট বিসকিট দিয়েছে। জামান সেই মিয়ানো টোস্ট আগ্রহ করে খাচ্ছে।
জামান বলল, মাটির এত বড় খেলনা আলম কিনেছে?
হ্যাঁ।
এতবড় খেলনা হয় জানতাম না। আমাদের সময় ছোট ছোট ছিল।
নায়লা বলল, চা খেয়ে বাবুকে নিয়ে এসো।
আচ্ছা।
নায়লা নিজের থেকেই বলল, অরুণীর কাছে শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হয়নি। দেরি হয়ে গেল।
জামান বলল, ও আচ্ছা। তোমার বন্ধু আবার আমাকে নিয়ে যেতেও চায় না। একজন মেয়েকে নিয়ে আরেকজন মেয়েকে দেখতে যেতে তার নাকি ইচ্ছা করে না।
OP দেখ তো আমার ঘর কি-না।
জামান কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখল। জ্বর আছে কি-না তা বলল না। বোধহয় নেই। জ্বর থাকলে বল তো। নায়লা বলল, আজ খুব ঘুরেছি।
কোথায়?
নিউ মার্কেটে?
ও আচ্ছা।
জামান ওঠে পড়েছে। সে বাবুকে আনতে যাবে। নায়লা তীব্র অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করছে। তার ধারণা, জামান জানতে চাইবে নিউ মার্কেটে কি আলমের সঙ্গে পূরেছে? জামান কিছু বলল না। ফট করে মিথ্যা কথাটা সে কেন বলল? সে তো নিউ মার্কেটে যায়নি, সে গিয়েছে সাভারে। সত্যি কথাটা বললে জামান কি রাগ করতে? মোটেই না। নায়লার বলা উচিত ছিল–তোমার বন্ধু আজ আমাকে বিরক্ত করে মেরেছে। তার জন্যেই দেরি হয়ে গেছে, অরুণার কাছে যেতে পারিনি। আবার তার জন্যেই যেতে হয়েছে সাভার–সেখান থেকে সে নাকি বাবুর জন্যে মাটির হাতী ঘোড়া কিনবে। এই সহজ সত্য সে বলতে পারল না কেন? তার নিজের মনে কি কোন অপরাধবোধ আছে? অপরাধবোধ থাকার তো কোন কারণ নেই।
তবে স্বামীকে যে সব কিছু খুলে বলতে হবে তাও তো না। সব মানুষের কিছু গোপন ব্যাপার থাকে যেগুলি কাউকে বলতে নেই। জামানের আগে এক বার বিয়ে ঠিক হয়েছিল–মার্চেন্টশীপের এক ইঞ্জিনিয়ারের সাথে–রফিকুল ইসলাম। লম্বাচওড়া ছেলে–সুন্দর দেখতে। সব সময় সানগ্লাস পরে বের হত। ঐ ছেলের সঙ্গে নায়লার এনগেজমেন্ট হয়ে গেলো। এনগেজমেন্টে তারা নায়লাকে একটা সবুজ রঙের কাতান, সবুজ পান্না আংটি এবং সবুজ বেল্টের এক জোড়া হিল জুতা দিল। আংটি শাড়ি না, সবুজ জুতা দেখে সবাই মুগ্ধ।
যেহেতু এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে, কাজেই তার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে কোন বাধা নেই। সে মোটর সাইকেল নিয়ে এসে প্রায়ই নায়লাকে উঠিয়ে নিয়ে যেত। তার প্রধান কাজ ছিল ঘুরে বেড়ানো। মোটর সাইকেল নিয়ে কোথায় কোথায় যে চলে যেত। একবার নিয়ে গেল জয়দেবপুরে ফরেস্টের এক বাংলোতে। নির্জন বাংলো। শুধু একজন কেয়ারটেকার এবং দারোয়ান। কেয়ারটেকার ঘর খুলে দিল। কাঠের বারান্দায় চেয়ার পেতে দিল। এত নির্জন চারদিক, নায়লার ভয় ভয় করছিল। রফিকুল ইসলাম চোখ থেকে সানগ্লাস খুলতে খুলতে বলল, বলল, কি খুকী, ভয় লাগছে (লোকটা তাকে মজা করে খুকী ডাকত)?
না।
ভয় করার কোন কারণ নেই। স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে এসেছ! তাই না?
হুঁ।
আমরা এখানে রাত দশটা পর্যন্ত থাকব। তোমার বাবা-মাকে বলে এসেছি, কাজেই ওরা চিন্তা করবে না।
ডাকবাংলোয় রাত দশটা পর্যন্ত থাকব এটা বলে এসেছেন?
আরে না, পাগল হয়েছ? বাংলাদেশী বাবা মা ডাকবাংলো শুনলেই আঁৎকে উঠবেন। তাঁদেরকে বলেছি, তোমাকে নিয়ে আমার এক অসুস্থ খালাকে দেখতে যাব। ফিরতে দেরি হতে পারে, নস্টা-দশটা বাজবে। তাঁরা খুশি মনে বলেছেন, আচ্ছা।
সেই ডাকবাংলোয় তারা রাত দশটা না, রাত এগারোটা পর্যন্ত ছিল। নায়লা ডাকবাংলোয় তার অভিজ্ঞতার গল্প কাউকে বলেনি। বলা সম্ভবও নয়, এবং উচিতও নয়। তবে রফিকুল ইসলাম নামের সানগ্লাস পরা ঐ লোক ডাকবাংলোর গল্প নিশ্চয়ই অনেকের সঙ্গে করেছে। ছেলেরা এই জাতীয় গল্প বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে করতে ভালবাসে। অনেকে স্ত্রীদের সঙ্গেও করে। কিছু কিছু স্ত্রী আছে স্বামীর মুখে এ জাতীয় গল্প শুনতে ভালবাসে। নায়লার দূর সম্পর্কের এক মামী আছেন–রাঙ্গামামী–তিনি সুযোগ পেলেই তাঁর স্বামীর এই ধরনের একটা গল্প শুনিয়ে দেবেন–বুঝলি নায়লা, বিয়ের আগে তোর মামা ছিল ভয়াবহ এক চীজ। মেয়েদের পটানোর সে এক হাজার একটা কৌশল জানে। কোন মেয়েকে তার মনে ধরেছে তো আর দেখতে হবে না। ঐ মেয়ের কপালে দুঃখ আছে। তোর মামা তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বিছানাতে নেবেই। তবে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল–একবার বিছানায় নেবার পর তোর মামার সব আগ্রহ শেষ। এই চ্যাপ্টার ক্লাজ–নতুন আরেক চ্যাপ্টার …।
রফিকুল ইসলাম নামের লোকটাও কি তার স্ত্রীর কাছে ইন্টারেস্টিং গল্প হিসেবে নায়লার গল্প করেছে? করেছে বলেই মনে হয়। গল্প করার মত অনেক কিছুই সেই ডাকবাংলোয় ঘটেছিল। রফিকুল ইসলাম মজা করে ঐ গল্প করলেও নায়লা কোনদিনও কারো সঙ্গে এই গল্প করবে না। যদিও প্রায়ই তার মনে হয় জামানকে ঘটনাটা বলে! হয়ত বলবে। এখন না হলেও কোন একদিন। যখন তারা দুজনই বুড়ো হয়ে যাবে। ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে যাবে। তারা চলে যাবে দূরে দূরে। যখন নায়লার জামান ছাড়া কোন আশ্রয় থাকবে না। জামানেরও নায়লা ছোড়া কেউ থাকবে না–তখন। এই গল্প আপাতত বাক্সবন্দী থাকুক।
সাভার স্মৃতিসৌধে বেড়াতে যাবার গল্পটাও চাপা থাকুক। এমন কিছু না যে আগ বাড়িয়ে বলে বেড়াতে হবে। নায়লার কি জ্বর আসছে? গা জ্বালা করছে–মাথায় শিরা দপদপ করছে . . .। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে বাবুর জন্যে কেনা থার্মোমিটার আছে। জ্বরটা দেখলে হয়। ইচ্ছা করছে না।
সামনের সোমবারে বাবুর জন্মদিন। দুবছর হবে। ঠিক দুবছরে তার দুধ ছাড়িয়ে দিতে হবে। বিশ্রী ঝামেলা করে–বাতিস দুদু, কোলা দুদু। লজ্জায় পড়তে হয়।
আচ্ছা, বাবুর জন্মদিনে ছোটখাট ঘরোয়া ধরনের একটা অনুষ্ঠান করলে কেমন হয়? একটা কেক কেনা হল। বাসায় সে পোলাও-কোরমা রান্না করল। কয়েকজনকে খেতে বলল। তার মা-বাবা, আলম। এই সূঙ্গে অরুণাকেও বলা যেতে পারে। তাহলে জন্মদিনের আসরেই দুজনের দেখা হয়ে যায়। ঝামেলা চুকে যায়। আলমকে অবশ্যি জন্মদিনের কথা বলা যাবে না। বললেই দামী একটা কিছু কিনে নিয়ে এসে সবাইকে অস্বস্তিতে ফেলবে। অলিমকে বললে–খাবার-দাবার আরেকটু ভাল করতে হবে। বড় মাছের একটা পেট কিনে আনতে পারলে মাছের আইটেম করা যায়। বড় মাছ কি সে পছন্দ করে? ঐ দিন ছোট মাছ খুব আগ্রহ করে খেল। মাকে নিয়ে গিয়ে মেথি দিয়ে গোশত রান্না করালে কেমন হয়? আচ্ছা, সে শুধু আলমের কথা ভাবছে কেন? তার কি অন্য চিন্তা-ভাবনা কিছু নেই?
ঘর কি ময়লা হয়ে আছে। ফিরুর মা নিশ্চয়ই আজ ঘর ঝাঁট দেয়নি। এই মহিলা আছেই শুধু ফাঁকিবাজিতে। বাবুর জন্মদিন উপলক্ষে ফিরুর মাকে একটা শাড়ি দেয়া দরকার। বাবুর জন্যে দরকার হাফহাতা একটা স্যুয়েটার…। লাল রঙের হাফহাতা সুয়েটার বাবুকে খুব মানায়। এ বছর প্রচুর সুয়েটার এসেছে–একদিন সময় করে সুয়েটার দেখে আসতে হবে।
যেদিন তাড়া থাকে
যেদিন তাড়া থাকে সেদিনই একের পর এক সমস্যা দেখা দেয়। আজ জামানের সকাল সকাল অফিসে যাবার কথা। বছর শেষের এই দিনটি জামানদের অফিসের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। এইদিন অফিসে কাজকর্ম তেমন কিছু হয় না। কয়েকটা মিটিং হয়। মিটিংএর বিষয়বস্তু হল–বিগত বছরে কোম্পানী কি করেছে তার পর্যালোচনা। সামনের বছরে কোম্পানী কি করবে তার আভাস। পদোন্নতির ব্যাপারগুলিও এই দিনই জানা যায়। দুপুরে কোম্পানীর খরচে লাঞ্চ দেয়া হয়। ফুল রোস্ট, রেজালা, দৈ, মিষ্টি, কোল্ড ড্রিংকস …।
ঠিকমত অফিসে পৌঁছার জন্যে জামান আজ অন্যদিনের চেয়ে আগেই রওনা হয়েছিল। বাসে করে যাচ্ছে–শাহবাগের মোড়ে বাসের ভেতর প্রচণ্ড হৈ চৈ। বাস নাকি বেবীটেক্সির উপর উঠে গেছে। চারদিক থেকে ধর ধর শব্দ। নিমেষের মধ্যে বাসের ড্রাইভার দরজা খুলে লাফিয়ে নেমে পড়ল। সে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে ছুটছে, তার পেছনে ছুটছে রাজ্যের মানুষ। কণ্ডাক্টার পালাতে পারেনি। বাসের যাত্রীরা তাকে ধরে ফেলেছে। শুরু হয়েছে প্রচণ্ড মার। এই লোকটার দোষ কি? একসিডেন্টের সময় যে যাত্রীদের ভাড়া আদায় করছিল। বেবীটেক্সির উপর বাস তুলে দেয়াতে তার কোন ভূমিকা ছিল না। লোকটাকে কি মেরেই ফেলবে? গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে–এই শব্দের ফাঁকে ফাঁকে কণ্ডাক্টার বলছে–ঘরে আমার ছোট ছোট দুইটা মাইয়া। আপনাদের আল্লাহর দোহাই লাগে–আঁ আঁ আঁ!
জামান বাস থেকে নামল। পুলিশ ছাড়া এই লোককে বাঁচানো অসম্ভব। শাহবাগের মোড়ে একসিডেন্ট পুলিশ নিশ্চয়ই চলে এসেছে। ওয়ারলেস সেট হাতে একজন পুলিশ সার্জেন্টকে মোটর সাইকেলে বসে থাকতে দেখা গেল। জামান এগিয়ে গিয়ে কণ্ডাক্টারের কথাটা বলল। পুলিশ সার্জেন্ট অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল, আমরা দেখছি, আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না।
লোকটাকে মেরে ফেলছে!
মানুষ এবং বিড়াল এই দুই প্রাণী সহজে মরে না। আপনি আপনার কাজে যান। ভিড় বাড়াবেন না।
ভিড় যা হয়েছে, দর্শনীয়। মুহূর্তের মধ্যে এতগুলি লোক জড় হল কি করে সে এক রহস্য। ভিড় ঠেলে বের হতে জামানের আধ ঘন্টার মত লাগল।
খালি রিকশা অনেক আছে। কিন্তু কেউ মতিঝিল যাবে না। এখানকার মজা শেষ না করে কেউ নড়বে না। বেবীটেক্সি আছে–এতগুলি টাকা খরচ করে বেবীটেক্সি নেবার কোন অর্থই হয় না। হেঁটে যাওয়াও অসম্ভব। স্যাণ্ডেলের স্ট্র্যাপ ছিড়ে গেছে। পা। ছেড়ে ছেড়ে কতদূর আর যাওয়া যায়!
নটার ভেতর অফিসে পৌছার কথা। জামান অফিসে পৌছল দশটা কুড়িতে! ম্যানেজমেন্টের মিটিং শুরু হয়ে গেছে। হঘরে চেয়ার পাতা হয়েছে। ডেকোরেটরের কাছ থেকে ভাড়া করে আনা চেয়ার। চেয়ারে যারা বসে আছে তাদের সবার মুখ শুকনো। এমড়ি সদরুদ্দিন সাহেবের বক্তব্য মনে হয় কারো তেমন পছন্দ হচ্ছে না।
জামান খুব সাবধানে পেছনের দিকের একটা চেয়ারে বসল। এমডি সাহেব ইংরেজিতে লিখিত বক্তৃতা পাঠ করছেন। বক্তৃতার বিষয় হল –
কোম্পানীকে নিজের পায়ে শক্ত করে দাঁড় করাতে হবে। কোম্পানী এবং বৃক্ষ এক রকমের। ছোট্ট চারা থেকে হয় মহীরুহ। তেমনি ছোট্র কোম্পানী থেকে হয় বিরটি মাল্টিনেশনাল কোম্পানী। বৃক্ষ নড়বড়ে হয় তখন, যখন তার শাখা-প্রশাখা বেড়ে যায়। এই কোম্পানীও শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে নড়বড়ে অবস্থায় চলে এসেছে। কাজের লোকের চেয়ে অকাজের লোক বেশি। হেড অফিসেই টাইপিস্টের সংখ্যা তের জন। অথচ ওয়ার্ড প্রসেসর ইউনিটও আছে। তের অন টাইপিস্টের বলতে গেলে কোন কাজ নেই। এরা অফিসে আসে, গল্প-গুজব করে বাসায় ফিরে যায়–নিয়মমত তারা একটা কাজই করে, সেটা হল বেতন নেয়া …
জামানের পাশে রকিব সাহেব বসেছিলেন। সিনিয়র হেড এ্যাসিসটে। কোম্পানীর জন্মলগ্ন থেকে এর সঙ্গে আছেন। রকিব সাহেব ফিস ফিস করে বললেন, জামান ভাই, অনেক ছাঁটাই হয়েছে।
ছাঁটাইয়ের কথা কি বুড় সাহেব বলেছেন?
সরাসরি এখনো কিছু বলে নাই তবে শোনা যাচ্ছে। এই বছর কোম্পানী অনেক লস দিয়েছে…।
কারা ঘঁটাই হয়েছে কিছু শুনেছেন?
না। শোনা যাচ্ছে মোট আঠার জন।
বলেন কি?
এমডি সাহেব কোম্পানীর উন্নতির জন্যে যে সব কর্মচারী সৎ এবং আন্তরিক চেষ্টা চালাচ্ছেন তাদের ধন্যবাদ দিয়ে বক্তৃতা দিলেন এবং সবাইকে তাঁর সঙ্গে এক কাপ চা খাবার আমন্ত্রণ জানালেন–
দুপুরে লাঞ্চের ঠিক আগে আগে ছাঁটাইকৃত কর্মচারীরা তাদের নাম জানল। মোট এগার জন উঁটাই হয়েছে। জামানের নাম দশ নম্বরে।
কোম্পানী আইনের ধারা উল্লেখ করে তারা জামানের কাছে যে চিঠি দিয়েছে তার ভাষা বড়ই কঠিন –
আপনাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হল।
চিঠি পকেটে নিয়ে জামান চুপচাপ বসে আছে। দুঃখবোধের চেয়েও যে ব্যাপারটা তাকে আলোড়িত করছে তা হল লজ্জাবোধ। সবাই আসছে, সান্ত্বনার কথা বলছে, চিঠি পড়তে চাচ্ছে।
কিছুক্ষণের ভেতর লাঞ্চের ডাক পড়বে। সেখানেও যেতে হবে। লাঞ্চ না খেয়ে চুপচাপ বসে থাকা মানে রাগ করে ভাত না খাবার মত। জামান কার উপর রাগ করবে?
অনেকেই এসে তাকে বলছে, আপনি এমডির সঙ্গে সরাসরি দেখা করুন। আপনার মত মানুষের চাকরি চলে যাবে, এটা একটা কথা না-কি? আপনি যান, আমরা সবাই আপনাকে সাপোর্ট দেব। মগের মুল্লুক? এক কথায় চাকরি নট? কোর্টকাচারি করে সব ছেড়াবেড়া করে ফেলব না?
জামান জানে, এও কথার কথা। দেশে চাকরি বাকরির অবস্থা খুব খারাপ। চরম দূঃসময়। এই সময়ে নিজের চাকরি নিয়ে সমস্যা হতে পারে এ ধরনের কিছু কেউ করবে না।
অন্য সবার মতই জামান বর্ষশেষ লাঞ্চে গেল। বুফে লাঞ্চের ব্যবস্থা। বড় টেবিলে খাবার সাজানো। সবাই নিজের পছন্দমত খাবার উঠিয়ে নিচ্ছে। আস্ত একটা মুরগীর রোস্ট একজনের পক্ষে খাওয়া মুশকিল, তারপরেও দেখা যাচ্ছে–কেউ কেউ দুষ্টা ব্রেস্ট নিয়েছে।
এমডি সদরুদ্দিন সাহেব প্লেটে সামান্য কিছু পোলাও নিয়েছেন। চামচে সেই পোলাওয়ের খানিকটা মুখে দিচ্ছেন এবং হেঁটে হেঁটে সবার সঙ্গে গল্প করছেন। তিনি হাঁটতে হাঁটতে এক সময় জামানের কাছে চলে এলেন, হাসিমুখে বললেন, কেমন আছেন জামান সাহেব?
জ্বি স্যার, ভাল।
অনেকেই দেখি দুটা করে রোস্ট নিয়েছে, আপনি একটা, ব্যাপার কি? নিন আরেকটা নিন।
জি না স্যার।
কাজ করুন। ভালমত কাজ করুন। আপনি কোম্পানীকে দেখবেন। কোম্পানী আপনাকে দেখবে।
জামান ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল–এমডি সাহেব জানেনও না যে সে এখন আর কোম্পানীর সঙ্গে যুক্ত না। এমডিদের এত তুচ্ছ জিনিস নিয়ে মাথা ঘামালে চলে না।
সদরুদ্দিন জামানের কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে বললেন, সবাই আমার একটা ঘোষণা শুনুন। আমি একটা প্রাইজ ডিক্লেয়ার করছি। মেক্সিমাম নাম্বার অব ব্রেস্ট যে কনজিউম করবে তার জন্যে সুন্দর একটি পুরস্কার।
সবার মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। একজন উজ্জ্বল চোখ করে জিজ্ঞেস করল, প্রাইজটা কি স্যার?
প্রাইজ কি এখন বলব না–তবে ভাল প্রাইজ। ইউ উইল লাইক ইট। আচ্ছা, বলেই দেই–টিকিট। কক্সবাজারের বিমানের টিকিট। একটি না, দুটি টিকেট। স্পাউস সঙ্গে নেয়া যাবে।
সদরুদ্দিন সাহেব হাসছেন। অন্যরাও হাসছে। ক্যাশিয়ার আবদুল করিম সাহেবকে ব্রেস্টের থালার দিকে এগিয়ে যেতে দেখা গেল।
বাবু মাটির ঘোড়ার উপর বসে আছে
বাবু মাটির ঘোড়ার উপর বসে আছে। তার এখন খাবার সময়। ভাত-ডাল মেখে একটা বাটিতে করে আনা হয়েছে। খাওয়ানোর জন্যে তাকে ঘোড়া থেকে নামানো দরকার। সে নামবে না। ঘোড়াতে বসে খেলেও হয়–তাও খাবে না। অনুনয়, গল্প বলা, গান গাওয়া অনেক কিছুই হল–বাবু মুখ খুলবে না।
ফিরুর মা বলল, ফালাইয়া খুন আম্মা। খিদা লাগলে আপছে খাইব।
নায়লা কড়া করে তাকাল। সব কিছুর মধ্যে আগ বাড়িয়ে কথা বলা তার খুব অপছন্দ। নায়লা কঠিন গলায় বলল, তুমি তোমার কাজে যাও তো ফিরুর মা। তোমাকে উপদেশ দিতে হবে না।
উপদেশ না আম্মা, সত্য কথা।
সত্য কথা তোমার বলতে হবে না।
মিখ্যা বললে দোষ, আবার সত্য বললেও দোষ?
একটা কথা না ফিরুর মা। তোমার ভাইয়ের আসার সময় হয়ে গেছে। পানি গরম দিয়েছ?
হ, পানি গরম আছে।
ভাল করে গরম কর।
নায়লা ঘড়ি দেখল–নটা দশ বাজে। আজ ও এত দেরি করছে কেন? বছরের শেষ দিনে সে তো সব সময় সকাল সকাল ফেরে। তার উপর হঠাৎ করে শীত পড়েছে। শীতের কাপড়ও নিয়ে যায়নি। চদির নেয়নি। স্যুয়েটার অবশ্যি আছে। শুধু স্যুয়েটারে কি আর শীত মানে!
ফিরুর মা! ফিরুর মা!
জি।
একটু বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখ তো তোমার ভাইকে আসতে দেখা যায় কি-না।
আসলে তো আম্মা এইখানেই আসবো। আগ বাড়াইয়া দেখনের দরকার কি?
আচ্ছা যাও–তোমাকে দেখতে হবে না। তুমি যাও আমার সামনে থেকে। যাও বলছি।
সব সময় এমন মিরাজ করেন ক্যান আম্মা? ভাইয়ের তো কোনদিন এত মিজাজ দেখলাম না।
যাও বলছি। যাও…
কলিংবেল বাজছে। ফিরুর মা দরজা খুলতে গেল। নায়লা ক্ষিপ্ত গলায় বলল, খবর্দার, তুমি দরজা খুলবে না। খবর্দার বলছি। তুমি রান্নাঘরে গিয়ে বসে থাক। তুমি আমার সামনেই আসবে না।
জামান এসেছে। বাজার এনেছে। পলিথিনের ব্যাগের ফাঁক দিয়ে লাউয়ের মাথা বের হয়েছে। আজও ইলিশ মাছ কিনেছে কিনা কে জানে। এত রাতে বাজার করে কেউ ফিরে?
এত দেরি হল যে?
জামান কিছু বলল না। বাজারের ব্যাগ নামিয়ে রাখল।
তুমি কি চা খেয়ে গোসল করবে, না গোসল করে সরাসরি ভাত খাবে?
চা খাব না।
তাহলে বাথরুমে ঢুকে যাও, আমি গরম পানি নিয়ে আসছি। আজ তোমার পছন্দের খাবার আছে। সীমের বিচির তরকারি।
ফিরুর মা গরম পানি চুলাতেই দেয়নি। রাগে নায়লার গা জ্বলে যাচ্ছে। সে নিজেই পানি বসাল। ফিরুর মাকে আর রাখা যাবে না। বিদায় করে দিতে হবে। এতদিন যে তাকে সহ্য করা হয়েছে এই যথেষ্ট।
মনে হচ্ছে জামানের খেতে ভাল লাগছে না। মুখে যত না দিচ্ছে মাখাচ্ছে তারচেয়েও বেশি। নায়লা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, খেতে ভাল হয়নি?
হয়েছে।
খাচ্ছ না তো।
খিদে হয়নি।
খিদে হয়নি কেন? বিকেলে কিছু খেয়েছিলে?
জামান উত্তর দিল না। ভাত মাখাতে লাগল।
নিশ্চয়ই চা খেয়ে খেয়ে খিদে নষ্ট করেছ। কাচামরিচ নাও। কাচামরিচ খেলে নষ্ট খিদে ফিরে আসে।
জামান কঁচামরিচ নিল। নায়লা বলল, কল দিনটার কথা মনে আছে তো? বাবুর জন্মদিন।
মনে আছে।
বাসায় সামান্য খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা কি করব?
কর।
নায়লা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, জন্মদিন না করলেও অবশ্যি হয়। বাবু তো আর জন্মদিন-টন্মদিন বুঝে না। ওর কাছে সব দিনই সমান।
তাহলে আর জম্মদিনের দরকার কি? বাদ দাও। টাকা-পয়সার টানাটানি। আমি ভাবছিলাম, জন্মদিন উপলক্ষ্য করে তোমার বন্ধুকে খেতে বলব, সেই সঙ্গে অরুণাকেও আসতে বলব। দুজনের সঙ্গে দুজনের দেখা হল। আমার দায়িত্ব পালন হয়ে গেল।
জামানের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। সে উঠে দাঁড়িয়েছে। একা একা খেতে নায়লার খারাপ লাগে। দুজন একসঙ্গে খেতে বসেছে। একজন খাওয়া শেষ করে উঠে পড়েছে, অন্যজন পেটুকের মত খেয়েই যাচ্ছে … নায়লাও খিদে রেখে উঠে পড়ল। সে যে খাওয়া শেষ করেনি এটাও জামানের চোখে পড়ল না।
বাবু আজ সারাদিন কিছুই খায়নি। তার ঘোড়ায় চড়া রোগ হয়েছে। সারাদিন ঘোড়ার পিঠে বসে থাকে। আজ কি করেছে জান? দুপুরে খাওয়াতে নিয়ে গেছি, সে বলল, ঘোড়া দুদু। অর্থাৎ ঘোড়ার পিঠে বসে দুধ খেতে চায়। কি রকম বজ্জাত হয়েছে দেখো না।
ও কোথায়?
ফিরুর মা ঘুম পাড়াচ্ছে। ভাল কথা, শোন তো–তোমার অফিসের লোকজনদের বলে দিও তো–কেউ যদি কোন কাজের মেয়ে পায় তাহলে যেন আমাকে দেয়–আমি ফিরুর মাকে রাখব না। বিদায় করে দেব। আজই বিদায় করে দিতাম। বাবুর জন্মদিন পর্যন্ত রেখে তারপর বিদায় করে দেব। তুমি কিন্তু না বলতে পারবে না। সিগারেট খাচ্ছি না কেন? তুমি তো ভাত খাওয়ার পরপর সিগারেট খাও।
সিগারেট সঙ্গে নেই। কিনতে ভুলে গেছি।
আমি যদি এখন একটা সিগারেট এনে দেই আমাকে কি দেবে? দাঁড়াও, সিগারেট দিচ্ছি। তবে একটা শুধু পাবে। একটাই আমার কাছে আছে।
নায়লার কাছে একটা না, এক প্যাকেট সিগারেট আছে। আলমের প্যাকেট ভুল করে ফেলে দিয়েছিল। নায়লা তুলে রেখে দিয়েছে।
নায়লা বলল, আচ্ছা শোন, জন্মদিন কি করব?
কর, তোমার যদি ইচ্ছা করে।
আমার কোন ইচ্ছ-টিচ্ছা না–তোমার বন্ধু আর অরুণরি কথা ভেবে বলছি। শুধু ওদের দুজনকেই বলবে, আর কাউকে না। আচ্ছা, তোমাকে যে এত রাতে সিগারেট বের করে দিলাম তুমি তো আমাকে থ্যাংকসও দিলে না।
থ্যাংকস।
সব কিছু তোমাকে বলে বলে দিতে হয়। নিজ থেকে তুমি কিছুই কর না। কি যে অদ্ভুত মানুষ! তোমার বন্ধুকে কাল সকালেই কিন্তু দাওয়াত করে আসবে। পারবে না?
পারব।
তাকে জন্মদিনের কথা বলার দরকার নেই। জন্মদিন শুনলেই একগাদা উপহার কিনে হুলস্থূল করবে। তোমার বন্ধুর যা খরুচে স্বভাব। আমার অবশি খরুচে স্বভাবের মানুষই ভাল লাগে। টাকা তো খরচের জন্যে, জমা করে রাখার জন্যে না। তোমার যদি টাকা হয় তাহলে তোমার স্বভাব কেমন হবে? তুমিও কি খরুচে স্বভাবের হবে?
নায়লা গড় গড় করে কথা বলে যাচ্ছে। জামান শুনছে। মন দিয়েই শুনছে, উত্তর দিচ্ছে না। যে ভয়াবহ ঘটনা তার জীবনে ঘটে গেল সেটা নায়লাকে তার বলা দরকার, কিন্তু বলতে পারছে না। ছেলের জন্মদিন নিয়ে খুশিমনে কত পরিকল্পনা করছে সব ভেস্তে যাবে। তাছাড়া নায়লা ছোটখাট দুর্ঘটনাতেই ঘাবড়ে যায়। বড় কিছু ঘটলে কি হবে কে জানে! নায়লাকে যা বলার ধীরে সুস্থে বলতে হবে।
তুমি আমার কথা কিছুই শুনছ না।
শুনছি তো।
না শুনছ না। তুমি অন্য কিছু ভাবছ। কি ভাবছ?
কিছু ভাবছি না।
আচ্ছা শোন, তুমি কি এই মাসে আমাকে বাড়তি কিছু টাকা দিতে পারবে? আমি সংসারের টাকা জমিয়ে জমিয়ে তোমার টাকা ফেরত দেব। পারবে?
কত টাকা?
এক হাজার টাকা।
জামান মনে মনে বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলল। এক হাজার টাকা সে দিতে পারবে। তাকে তিন মাসের বেতন দেয়া হবে। প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের জমা কিছু টাকাও পাবে। খুব বেশি না —- গত বৎসর বাবুর অসুখের সময় বেশ কিছু টাকা তুলতে হল।
নায়লা আগ্রহের সঙ্গে বলল, কথা বলছ না কেন? দিতে পারবে?
পারব।
কাল সকালে দিতে পারবে?
হ্যাঁ পারব। আমার কাছে এখনই টাকাটা আছে–তুমি নিয়ে নিও।
আসলে টাকাটা আমার কি জন্যে দরকার তেমাকে বলি–নুরু এসেছিল। ওর এক বন্ধু এসেছে দুবাই থেকে। সাতটা ফ্রেঞ্চ শিফন নিয়ে এসেছে। শাড়িগুলির তিন হাজার টাকা করে দাম। সে নুরুকে বলেছে–নুরু যদি শাড়িগুলি বিক্রি করে দিতে পারে তাহলে নুরুকে সে এক হাজার টাকায় একটা শাড়ি বিক্রি করবে। নুরু হালকা গোলাপী একটা শাড়ি নিয়ে এসেছিল। কি যে সুন্দর!
শাড়িটা কি তুমি রেখে দিয়েছ?
না। কোন্ ভরসায় রাখব? শেষে টাকা জোগাড় না হল? কাল সকালে নুরুকে টাকাটা দিয়ে আসব। এত দাম দিয়ে আমার শাড়ি কেনা ঠিক না। কিন্তু এত সুন্দর শাড়ি দেখে লোভ লেগে গেল।
জামানের বলতে ইচ্ছা করছে–নুরুকে টাকা দিলে তুমি শাড়ি পাবে না। জামান বলতে পারল না। নিজের ভাই সম্পর্কে এমন কঠিন কথা নায়লা সহ্য করতে পারবে না।
তোমার কি ঘুম পাচ্ছে? শুয়ে পড়বে?
এসো তাহলে শুয়ে পড়ি। বাবু রাতে কিছুই খেলো না। ও সারারাত বিরক্ত করবে। বাতিস দুদু বাতিস দুদু করে আমাকে ছিবড়া বানিয়ে ফেলল! দুধ কি করে ছাড়াই বল তো? করলার রস বুকে মাখিয়ে রাখব। তুমি মনে করে করলা নিয়ে এসো তো।
বিছানায় নায়লা স্বামীর কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে এলো। ভারি জড়ানো গলায় ফিসফিস করে বলল, তোমার কি আর কিছু লাগবে?
জামান চমকে উঠে বলল, কি বললে?
কিছু বলিনি। আমাকে একটু আদর কর না। আজ তোমার কি হয়েছে বল দেখি? এমন হাত-পা এলিয়ে পড়ে আছি কেন?
আজ বাবুর জন্মদিন
আজ বাবুর জন্মদিন।
নায়লা এই সাতসকালে বাবুকে গরম পানিতে গোসল করিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে দিয়েছে। পায়জামা, পাঞ্জাবি, নাগরা জুতা। কি সুন্দর যে বাবুকে লাগছে! ঘরে কোন ক্যামেরা নেই। ক্যামেরা থাকলে ছবি তুলে রাখা যেত। একটা টুপি কেনা দরকার ছিল– টুপি পরিয়ে দিলেই একেবারে ষোল আনা মৌলানা।
এই বাবু, এই।
উঁ।
তুমি তো মৌলানা হয়ে গেছ। বল, আসসালামো আলায়কুম।
বাতিস দুদু।
উঁহু, কোন বাতিস দুদু না। আজ থেকে বাতিস দু বন্ধ। তুমি না বড় হয়েছ? তোমার দু বছর বয়স হয়ে গেছে। এত বড় যে হয়েছে সে কি ব্যতিস দুদু খায়?
মাম্মাট কোলা যাব। কোলা।
উঁহু, তুমি কোলাও যাবে না। তোমাকে কোলে নিলে আমি কাজ করব কিভাবে? আজ আমার কত কাজ। আজ না তোমার জন্মদিন? শুভ জন্মদিন বাবু সোনা। আচ্ছা বাবা বল তো–শুভ জন্মদিন।
মাম্মাট বাতিস দুদু।
নায়লা ছেলেকে বাতিস দুদু দিল না। মাটির ঘোড়ায় চড়িয়ে দিয়ে এলো। ছেলেকে দূধ ছাড়াতে হবে। একজন কারো বাবুর কাছে থাকা দরকার। ঘোড়া থেকে গড়িয়ে পড়ে হাত পা ভাঙতে পারে। জাম্মান ঘুমুচ্ছে। এত বেলা পৃর্যন্ত সে কখনো ঘুমায় না। আজ কি সে অফিসে যাবে না? শরীর ভাল আছে তো? নায়লা জামানের কপালে হাত রাখতেই জামান চোখ মেলল। নায়লা বলল, সাতটা চল্লিশ বাজে। অফিসে যেতে হবে না?
জামান জুড়ানো গলায় বলল, অফিসে যাব না।
অফিসে যাবে না কেন?
এম্নি।
নায়লা খুশি খুশি গলায় বলল, না গেলেই ভাল। কি দরকার রোজ রোজ অফিসে যাবার? তাছাড়া আজ বাবুর জন্মদিন। তুমি আজ বাবুকে দেখবে। আমি বাইরের কাজ সেরে এসে রান্না-বান্না করব। বাইরের কি কাজ?
ওমা, বাইরের কত কাজ। অরুণীকে জন্মদিনের দাওয়াত দিতে হবে। নুরুকে টাকাটা দিয়ে আসতে হবে–তুমি যদি বাইরে বেরুতে না চাও আমি তোমার বন্ধুকেও দাওয়াত দিয়ে আসতে পারি।
ওকেও দাওয়াত দিয়ে এসো।
নারে বাবা, দরকার নেই। বড়লোকী জায়গায় আমি একা একা যাব না। তুমি অদ্ভুত মানুষ তো! বাবুকে দেখে কিছু বলছ না?
কি বলব?
পায়জামা পাঞ্জাবি গায়ে মৌলানা সেজে বসে আছে। দেখ, কি সুন্দর ঘোড়ায় বসে আছে! ও তো কাউকে কোনদিন ঘোড়ায় চড়তে দেখেনি, ও ঘোড়ায় চড়া শিখল কি ভাবে? দেখে মনে হচ্ছে না খুব মজা পাচ্ছে?
হুঁ।
চা খাবে? তুমি বসে খাক–আমি তোমার জন্যে চা নিয়ে আসছি। বাবুর দিকে লক্ষ রাখে।
নায়লা ঝলমল করতে করত বের হয়ে গেল। বাবু বসে আছে ঘোড়ার পিঠে। মাথা নিচু করে বসে থাকা গম্ভীর একজন মানুষ। দু বছর আগে এই সময়ে মানুষটার জন্যও হয়নি। জন্ম হয়েছে বিকেল তিনটায়। তাহলে দুবছর আগে এই সময় মানুষটা তার মার পেটে গুটিশুটি মেরে অপেক্ষা করছিল। তখন কি ছিল তার মনে? ভয়? আশংকা, না আনন্দ? যে মার সঙ্গে এতোদিন সে মিশেছিল তার সঙ্গে বিচ্ছেদের আশংকা, আবার এই বিচ্ছেদেও মাকে অন্যরূপে পাবার আনন্দ।
জামান বাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা, তোমার নাম কি?
বাবু গভীর গলায় বলল–ঘোড়া।
উঁহু। ঘোড়া তোমার নাম না। তুমি ঘোড়ায় বসেছ। তোমার নাম কি?
ঘোড়া।
না বাকা। বল আমার নাম বাবু।
বাবু নাম বলছে না। কিন্তু ধবধকে শাদা দাঁতে কুটি কুটি করে হাসছে। জামান বলল–তোমার ইঁদুরের মৃত দাঁত কেন হল বাবা?
বাবু বলল, আমি ইঁদুল।
জামান তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে। ছেলেটা কি মিষ্টি করে কথা বলে! র বলতে পারে কিন্তু সব সময় না। ঘোড়া বলার সময় পরিষ্কার ও উচ্চারণ করল কিন্তু ইঁদুরের বেলায় পারছে না। বাচ্চাদের কথা বলার সময়টা কি যে অদ্ভুত।
নায়লা চা নিয়ে এসেছে। এক হাতে চায়ের কাপ। অন্য হাতে পানি ভর্তি গ্লাস।
নায়লা বলল, পানি দিয়ে কুলি করে মুখের বাসি ভাব দূর করে তারপর খাও। আর পিরিচে করে আমাকে একটু দাও। বাবু, তুই চা খাবি?
বাবু মার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি ঘোড়া।
নায়লা খিলখিল করে হাসছে। হাসির ঝাপ্টায় হাতের চায়ের কাপ কাঁপছে–চা ছড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে হাসি শুনে ফিরুর মা এসে দরজা ধরে দাঁড়িয়েছে। জামান খানিকটা বিস্ময় নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে–সে এত হাসতে নায়লাকে কখনো দেখেনি।
শেষ পর্যন্ত আলমকে জন্মদিনের দাওয়াত দেয়ার দায়িত্ব নায়লার উপরেই পড়েছে। জামান থাকবে বাবুকে নিয়ে। নায়লা অরুণীকে দাওয়াত দিয়ে ফেরার পথে জামানকেও দাওয়াত করে আসবে।
হোটেলের লবীতে ঢোকার সময় নায়লার খানিকটা ভয় ভয় করছিল। সেই ভয় কিছুক্ষণের মধ্যেই কেটে গেল। সে আলমের রুম নাম্বার জানে–সেই রুম হোটেলের কতালীয় তাও জানে–লিফটে করে উঠতে হয়। সেটাও কোন সমস্যা নয়। লিফটম্যানকে বললেই হল–৪১১ নম্বর রুম।
নায়লা প্রথম গেল রিসিপশানে। সুন্দর চেহারার স্মার্ট দুজন তরুণ দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেরই হাসি হাসি মুখ। নায়লা বলল, ৪১১ নম্বর রুমের মিঃ আলমের সঙ্গে কথা বলব। উনি কি আছেন?
জ্বি ম্যাডাম আছেন। এই এক মিনিট আগে উনার সঙ্গে কথা হয়েছে। আপনি কি কথা বলবেন ম্যাডাম? টেলিফোনে লাইন দেব?
না, আমি সরাসরি যাব। আপনাদের সিড়ি কোন্ দিকে?
লিফটে করে চলে যান ম্যাডাম। বাঁ দিকে লিফট।
লিফটে আমি চড়ব না। আমার লিফট ভয় লাগে।
নায়লা মিষ্টি করে হাসল। তার নিজের কাছেই মনে হচ্ছে সে একটু অদ্ভুত আচরণ করছে। অকারণে কথা বলছে। রিসিপশনিস্টের সঙ্গে এতগুলি কথা বলার কোন প্রয়োজন ছিল না। তাছাড়া সে লিফটে চড়তে ভয়ও পায় না। লিফট তার কাছে অপরিচিত কিছুও নয়। প্রতিদিনই সে লিফটে চড়ছে।
ম্যাডাম, আপনি ডানদিকে যান। ডানদিকে যাবেন, তারপর ফার্স্ট রাইট টার্ন।
থ্যাংক য়্যু।
ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নায়লার ভাল লাগছে। দোতলা পর্যন্ত ওঠার পর দুটি বিদেশী ছেলেমেয়েকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখা গেল। দুজনই বাবুর বয়েসী ছেলেটির হাতে ললি টকটকে বল। সে খুব গম্ভীর ভঙ্গিতে বল হাতে মামছে। এত ছোট ছেলেমেয়েদের বাবা-মা একা একা ছেড়ে দিল কি ভাবে? ছোট মেয়েটি নায়লাকে দেখে হাত নেড়ে বলল–হাই। নায়লাও হাত নাড়ল। বাচ্চা দুটির সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করছে। ইংরেজি রপ্ত থাকলে এদের সঙ্গে গল্প করা যেত।
আলম দরজা খুলে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, নায়লা এসো। সে এমন সহজ স্বরে কথা বলল যে, নায়লার মনে হল আলম এতক্ষণ তার জন্যেই অপেক্ষা করছে।
আলম সবেমাত্র বাথরুম থেকে গোসল সেরে বের হয়েছে। একটা বড় টাওয়েল তার গায়ে জড়ানো, আরেকটা টাওয়েল গলায় ঝুলছে। এখনো গা মোছা হয়নি। টপ টপ করে পানি পড়ছে।
নায়লা, আমার অর্ধনগ্ন মূর্তি দেখে তোমার রুচিবোধ আহত হচ্ছে না তো? আহত হলে ক্ষমা করে দাও। আমার গোসল শেষ হয়নি। তোমার ঘন ঘন বেল বাজানোর শব্দে গোসল আধাআধি রেখে উঠে এসেছি।
যান, গোসল শেষ করুন। আমি বসছি।
শুধু বসলে হবে না। টেলিফোন তুলে জিরো জিরো ডায়াল করে রুম সার্ভিসকে বল আমাদের দু কাপ কফি দিয়ে যেতে। গোসল শেষ হতে হতে কফি এসে যাবে।
আলম বাথরুমে ঢুকে গেল। কি সহজ, কি স্বাভাবিক আচরণ। নায়লা কফির কথা বলল। প্রথম দিন এই ঘরটা অনেক বড় লাগছিল–আজ এত বড় লাগছে না। সব অপরিচিত ঘরকেই প্রথম দেখায় একটু বোধহয় বড় লাগে। বেল বাজছে! নায়লা জা খুলে দিল। কুড়িএকুশ বছরের সুন্দর একটা মেয়ে কফি ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আচ্ছা, এরা কি কফি তৈরি করেই বসেছিল?
ম্যাডাম, কফি চেয়েছিলেন?
হ্যাঁ। টেবিলের উপর রেখে দিন।
মেয়েটা সাবলিল ভঙ্গিতে কফির ট্রে টেবিলে রাখছে। তাকে দেখে নায়লার হিংসা লাগছে। কাজ করছে, টাকা রোজগার করছে। আর নায়লা কি করছে?–অন্যের রোজগারে ভাগ বসাচ্ছে। বাবুর জন্মদিনে সে তার নিজের হয়ে কোন উপহার কিনতে পারবে না। উপহার কিনতে হবে জামানের টাকায়। নায়লার জানতে ইচ্ছা করছে–মেয়েটা এই হোটেলে কাজ করে কত টাকা পায়? জানতে ইচ্ছা করলেও জানা যাবে না। এই প্রশ্ন মেয়েটাকে কখনো করা যাবে না।
আলম বাথরুম থেকে শীষ দিতে দিতে বের হল। সুন্দর পোশাক পরেছে। ধবধবে শাদা প্যান্টের সঙ্গে হালকা লাল গেঞ্জি। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে আলমকে। পোশাক মানুষকে অনেকখানি পাল্টায়। সুন্দর পোশাকে জামানকেও নিশ্চয়ই ভাল লাগবে। জামান সারাজীবন পরল পায়জামা-পাঞ্জাবি। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বুড়োরা। সে কি বুড়ো হয়ে গেছে? নায়লার ইচ্ছা করছে জামানের জন্যে একটা শাদা প্যান্ট এবং হালকা লাল রঙের গেঞ্জি কিনতে। নিশ্চয়ই আকাশ-পাতলি দাম।
আলম বলল, নাও, কফি নাও। চুপচাপ বসে আছ কেন?
ভাবছি।
কি ভাবছ?
আপনি আমাকে দেখে একেবারেই অবাক হন নি কেন তাই ভাবছি।
অব্যাক হব কেন? ঢাকা শহরে আমি চিনি তোমাদের দুজনকে। তোমরা আমার কাছে আসবে, এতে আমি অবাক হব কেন? না এলে অবাক হওয়ার একটা ব্যাপার থাকতো।
কি জন্যে এসেছি তাও তো জিজ্ঞেস করলেন না!
তুমি নিজেই বলবে, এটা জানি বলেই জিজ্ঞেস করিনি। বল কি জন্যে এসেছ।
আজ রাতে আপনি আমাদের সঙ্গে খাবেন।
ফাইন। খাব।
আমি অরুণাকেও আসতে বলেছি।
অরুণাটা কে?
কি আশ্চর্য! অরুণা কে তাও ভুলে গেছেন?
ও আচ্ছা, আচ্ছা। মনে পড়েছে। অরুণা হচ্ছে তোমার রূপবতী বান্ধবী। যার সঙ্গে আমার বিয়ের একটা চেষ্টা তুমি চালাচ্ছ।
হুঁ। অরুণা আসবে। তাকে দেখতে পারবেন। তার সঙ্গে কথাও বলতে পারবেন।
খুবই ভাল ব্যবস্থা। আমি যথাসাধ্য সেজেগুজে যাব। কি পরলে ভাল হয় বল তো?
যা পরে আছেন সেটাই তো ভাল। মোটেই না। এই পোশাকে আমাকে স্মার্ট দেখাচ্ছে। প্রেম করার জন্যে মেয়েরা স্মার্ট ছেলে খুঁজে, বিয়ের জন্য পছন্দ করে শান্তশিষ্ট ভদ্র ছেলে। সেই সব ছেলেদের পোশাক হচ্ছে পায়জামা-পাঞ্জাবি, স্যান্ডেল। এরা হাঁটবে মাটির দিকে তাকিয়ে। হাসবে লাজুক ভঙ্গিতে। নিজের স্ত্রী ছাড়া অন্য কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাবে না।
আপনি সেই রকম একটা ছেলে সেজে আমাদের বাসায় যাবেন?
অবশ্যই। আমার কোন পায়জামা-পাঞ্জাবি নেই। তুমি আমাকে পায়জামাপাঞ্জাবি কিনে দেবে।
আমি?
হ্যাঁ তুমি। আকাশ থেকে পড়লে বলে মনে হয়। এই দেশে কি পায়জ্জামা-পাঞ্জাবি কেনা অপরাধ বলে গণ্য করা হয়?
আমাকে বাসায় যেতে হবে। রান্নাবান্না কিছু করিনি। আমি বাজারে যাব। বাজার করব। কোট-বাছা হবে, রান্না হবে, তারপর আপনারা খাবেন।
আমরা না হয় আজ রাতে একটু দেরি করে খাব। ওঠ। আমি বেশি সময় নেব না। পায়জামা-পাঞ্জাবি কিনতে আমার সময় লাগবে খুব বেশি হলে পাঁচ মিনিট কফি শপে কফি খাব, তাতে যাবে আরো পনেরো মিনিট। সব মিলিয়ে কুড়ি মিনিটের মামলা।
কফি তো এই মাত্র খেলেন।
এটা হল হোটেলের কফি। হোটেলের কফি কোন কফি নয়। তা ছাড়া তুমি এসেছ–আমি খুশি হয়েছি। এই খুশির একটা প্রকাশ থাকবে না?
আমাকে কফি খাইয়ে সেই খুশির প্রকাশ দেখাবেন?
হ্যাঁ।
কফি আমার দু চক্ষের বিষ।
সেটাও বুঝতে পারছি। তুমি কাপে সর্বসাকুল্যে দুবার চুমুক দিয়েছ। চল আইসক্রীম খাব।
এই বয়সে কেউ আইসক্রীম খায়?
আইসক্রিম হল চুমুর মত। চুমু খাবার যেমন কোন বয়স নেই–আইসক্রীম খাবারও নেই।
নায়লা হকচকিয়ে গেল। এইসব কথা এমন করে কেউ বলে?
দুপুরবেলাতেও আইসক্রীম শপে মানুষ গিজ গিজ করছে। জায়গাটা খুব সুন্দর। ছোট ছোট টেবিল-চেয়ার। চারদিক ঝকঝক তকতক করছে। মিষ্টি গান হচ্ছে। নায়লাকে কোণার দিকের একটা টেবিলে বসিয়ে আলম আইসক্রীম আনতে গেল।
নায়লার অস্বস্তি লাগছে। পরিচিত কেউ দেখে ফেলবে না তো? দেখে ফেললে কি কি ভাববে? তবে দেখা হবার সম্ভাবনা কম–তার আত্মীয়স্বজনরা সবাই গরীব। এমন কায়দার জায়গায় তারা আইসক্রীম খেতে আসবে না।
আলম আইসক্রীম নিয়ে ফিরছে। নায়লা ঠিক করে ফেলল, এই জায়গায় সে জামান এবং বাবুকে নিয়ে আইসক্রীম খেতে আসবে। যত টাকা লাগে লাগুক। প্রতিদিন তো আর আসবে না–জীবনে একবারই আসবে।
নায়লা, তোমার জন্যে বাটার নাটি এনেছি। দেখ তো কেমন লাগে। অনেকে আবার আইসক্রীমে বাদাম পছন্দ করে না। তোমার যদি ভাল না লাগে তাহলে বদলে দেব।
আমার ভাল লাগছে।
ভাল লাগলে হাসিমুখে খাও। এমনভাবে খাচ্ছ মনে হয় বিষ খাচ্ছ। গল্প করতে করতে খাও।
কি গল্প করব?
যা ইচ্ছা কর। কি গল্প করবে সেটাও কি বলে দিতে হবে?
আমি গল্প জানি না। বরং আপনি গল্প করুন। আমি শুনি।
আমার গল্প শুনতে কি ভাল লাগবে?
হ্যাঁ লাগবে।
কি গল্প শুনতে চাও বল।
ঐ যে একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। তাকে বিয়ে করার জন্যে পাগল হয়ে পড়েছিলেন, সেই গল্পটা বলুন।
জামান তোমাকে বলেনি?
না। ও তো গল্প-টল্প করে না।
কি করে? অফিস করে আর বাসায় এসে ঘুমায়?
অনেকটা এরকম।
আলম বিরক্তমুখে বলল, জামানকে দোষ দিয়ে কি হবে? বেশির ভাগ মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতি এই রকম। খাওয়া-ঘুম-খাওয়া, এই সাইকেলে শুধু ঘুরছে। বেঁচে থাকার মধ্যে যে একটা আনন্দের ব্যাপার আছে তা এরা জানে না। স্বপ্নহীন জীবন যাপন।
নায়লা কলল, ওদের কথা বাদ দিন, আপনার গল্পটা বলুন। আমার সত্যি শুনতে ইচ্ছা করছে।
আলম আইসক্রীম খাচ্ছে। কোন কথা বলছে না। তার মুখ অসম্ভব গম্ভীর। আলমকে দেখে নায়লার কেমন জানি ভয়-ভয় লাগছে।
নায়লা!
জ্বি।
ঐ মেয়েটার নাম ছিল রেশমা।
জানি। আপনার বন্ধু আমাকে বলেছে।
ও যে দেখতে তোমার মত ছিল তা কি তোমাকে বলেছি?
নায়লা ক্ষীণ গলায় বলল, হ্যাঁ বলেছেন।
তুমি হাসলে গালে টোল পড়ে। রেশমা রাগলে তার গালে টেল পড়তো।
নায়লা অস্পষ্ট স্বরে বলল, আমি উঠি?
একটু বোস নায়লা। প্লীজ। এক মিনিটের জন্য বোস।
নায়লা বসে আছে। তার হাত-পা শির শির করছে। কপাল ঘামছে।
নায়লার অসম্ভব মাথা ধরল
সন্ধ্যার আগে আগে নায়লার অসম্ভব মাথা ধরল।
মাথা তো ধরবেই–একের পর এক সমস্যা হচ্ছে। নুরু টাকা নিয়ে গেছে কিন্তু, শাড়ি দিয়ে যায়নি। অথচ এই শাড়ি পরার জন্যে সে রেডিমেড় ব্লাউজ কিনে এনেছে। ইস্ত্রি করিয়ে রেখেছে।
চোখে কাজল দেবে, কাজলদানি খুঁজে পাচ্ছে না। ফিরুর মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, সে বলল, আমি তো আম্মা চউক্ষে কাজল দেই না। আমি কই ক্যামনে?
চোখে কাজল দাও না বলে কাজলদান কোথায় তুমি জানবে না?
জ্বে না। যার জিনিস হে খুঁজ রাখব।
রাগে নায়লার শরীর কাঁপছে। সে রাগ সামলাতে পারছে না। তিনতলার বাসা থেকে চারটা দামী গ্লাস এনেছিল, একটা ভেঙে গেল। সে নিজেই ভাঙল। রান্নাঘর থেকে ফিরুর মা বলল, আল্লা বাচাইছে, আফনের হাতে ভাঙছে, আমার হাতে ভাঙলে আইজ গজব হইত।
চুপ কর ফিরুর মা।
চুপ কইরাই তো আছি গো আম্মা ফিরু মরণের পর থাইক্যা…
আর একটা কথা বললে তোমাকে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেব—
দেন ফেলাইয়া। ফিরু মরণের পর থাইক্যা বাইচা খাকতে ইচ্ছা করে না।
এই পর্যায়ে নায়লার মাথা ধরল। রান্নাবান্নাও তখনো শেষ হয়নি। মাংস সিদ্ধ হচ্ছে। যত জ্বাল হচ্ছে মাংস মনে হয় ততই শক্ত হচ্ছে।
বাবু বিকেল থেকেই ঘ্যান ঘ্যান করছে–বাতিস দুদু। বাতিস দুদু। নায়লা ঠিক করেছে তাকে আর বুকের দুধ দেয়া হবে না। কাদুক যত ইচ্ছা। কেঁদে কেঁদে গলা ভেঙে ফেলুক।
জামান বাবুকে নিয়ে তখন থেকেই ছাদে ইটছে। গল্প বলে শান্ত করার চেষ্টা করছে। যতক্ষণ গল্প বলে ততক্ষণ বাবু শান্ত হয়ে শুনে। গল্প শেষ হলেই মাম্মাট বাতিস দুদু। মাম্মাট বাতিস দুদু। জামান গল্পের পর গল্প বলে যাচ্ছে। গল্পগুলি বাবু বুঝতে পারে কিনা কে জানে। যে ভাবে শুনে তাতে মনে হয় বুঝতে পারছে। অথচ বুঝতে পারার কোন কারণ নেই। জামান নতুন গল্প শুরু করল—
বাবু, কি হয়েছে শোন। আমার না চাকরি চলে গেছে। আর আমাকে অফিসে যেতে হবে না। মজা হয়েছে না? এখন শুধু তোমার সঙ্গে খেলব। তবে মাসের শেষে কোন টাকা আসবে না–এইটাই সমস্যা।…
এই জরুরী গল্প জামান এখনো নায়লাকে বলতে পারেনি অথচ বলা দরকার। সে ঠিক করেছে আজ রাতেই বলবে। বাবু যত শান্ত হয়ে শুনেছে নায়লা কি শুনবে? কেঁদেকেটে অস্থির হবে। নায়লা একবার কাঁদতে শুরু করলে থামতে পারে না।
বাবু ঘুমিয়ে পড়েছে। বাতিস দুদু পাওয়া যাবে না, এই ব্যাপারে হতাশ হয়েই বোধহয় ঘুমুচ্ছে। বড় মায়া লাগছে জামানের। ঘুমন্ত ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে সারাজীবন সে ছেলে কোলে নিয়ে ছাদে হাঁটতে পারবে।
নায়লা ছাদে এসে বলল, বাবু কি ঘুমুচ্ছে?
হুঁ।
ঘুমুচ্ছে, শুইয়ে দিচ্ছ না কেন? ছাদে নিয়ে হাঁটাহাটি করে ঠাণ্ডা লাগাবে নাকি? শুইয়ে দাও। আর শোন–কাচা বাজার থেকে শসা এনে দাও। শসা আনতে ভুলে গেছি।
আচ্ছা।
আমার শাড়িটা নিয়ে নুরুর আসার কথা, ও তো এলো না। তুমি কি মার বাসা হয়ে আসবে?
আচ্ছা যাব।
রান্নাই এখনো শেষ করতে পারিনি। কখন কি করব কিছু বুঝতে পারছি না। প্রচণ্ড মাথাও ধরেছে। এত অস্থির লাগছে।
সামান্য ব্যাপারে এত অস্থির হয়ো না।
নায়লা তীক্ষ্ম গলায় বলল–তোমার কাছে এই ঝামেলাগুলি সামান্য মনে হচ্ছে? আশ্চর্য–!
নুরুর কাছে শাড়ির খোঁজে যাওয়া অর্থহীন। তবু জামান শ্বশুরবাড়িতে গেল। নুরুকে পাওয়া গেল না। শাড়ির ব্যাপারে বাসায় কেউ কিছু জানে না। জামানের শাশুড়ি সঁতের ব্যথায় কাতর হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। গাল ফুলে একাকার। জামাইয়ের সঙ্গে কোন কথা বলার তার অবস্থা নেই। জামানের শ্বশুর মোর্তজা সাহেব এম্নিতেই কথা বেশি বলেন। রিটায়ারমেন্টের পর থেকে কথা বলাই তার একমাত্র কাজ হয়ে দাড়িয়েছে। কেউ বাড়িতে এলে তার আনন্দের সীমা থাকে না। কথা বলার মানুষ পাওয়া গেল। জামানকে তিনি বিশেষ পছন্দ করেন। কারণ জামান মন দিয়ে কথা শুনে, কথার মাঝখানে বিরক্ত করে না।
মোর্তজা সাহেব বললেন, জামান বাবা, কেমন আছ?
জি ভাল।
বাবু কেমন আছে?
ভাল।
বাবু নামটা বদলে দাও। বাবু বিবি এগুলো নাম হল-–? নাম হতে হয় সুন্দর, ভদ্র, শোভন। নামের মধ্যে অনেক কিছু প্রতিফলিত হয়। বাবা-মার রুচি, পরিবারের সামগ্রিক শিক্ষার মান। বোস না, দাঁড়িয়ে আছ কেন?
আজ চলে যাই। বাসায় কয়েকজনকে দাওয়াত করেছি।
দাওয়াত করেছ, এসে খেয়ে যাবে। পাঁচ মিনিট আগে খেতে, এখন খাবে পাছ মিনিট পরে। আজকের খবরের কাগজ পড়েছ?
জি না।
পড়বে। কাগজটা মন দিয়ে পড়বে। যা লিখে সবই মিথ্যা, তবু মিখ্যার ফাক দিয়ে কিছু কিছু সত্য বের হয়ে আসে! সত্য হচ্ছে আলোর মত। গোল আলু ধামাচাপা দিয়ে রাখা যায় কিন্তু সত্যের আলো রাখা যায় না। ফাঁক-ফোক দিয়ে কিছু বেরিয়ে আসবেই। বোস–চা খাও।
সালাদের জন্যে শসা কিনে বাসায় যেতে হবে।
একদিন সালাদ না খেলে কিছু হবে না। মানুষ তো আর ঘোড়া না যে প্রতিদিন কাচা ঘাস, লতাপাতা খেতে হবে। বোস তো।
জামান বসল। মোর্তজা সাহেজ বললেন, কাজের লোক বিদেয় হয়ে গেছে। তোমার শাশুড়ির এই অবস্থা। ব্যথা যতটুকু না চিৎকার শুনলে মনে হবে কি না কি হয়ে গেল। আরে বাবা, বয়স হয়েছে, এখন দাঁতের ব্যারাম হবে, বুক ধড়ফড় করবে, এসিডিটি হবে–দিস ইজ লাইফ। কি বল জামনি?
জ্বি।
বোস, চা খাও। আমি নিজেই বানাব। উপায় কি?
আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
হোক না একটু দেরি। কি হয় সামান্য দেরিতে? আমাকে তো আর বেশিদিন পাবে না। হঠাৎ একদিন শুনবে —শেষ। গেম ইজ ওভার। তখন নিজেই আফসোস করবে– আহা! বেচারা বুড়ো মানুষ! বসতে বলেছিল, বসলাম না। আমার অবস্থা এখন খুব খারাপ। কেউ এখন আর আমার ত্রিসীমানায় ঘেঁসে না। নুরুকে ডাকলে ও কি করে জান? ধর আমি ডাকলাম, নুরু! নুরু! সে মিষ্টি করে বলবে, আসছি বাবা। বলেই অন্য দরজা দিয়ে রাস্তায় চলে যাবে। দিস ইজ মাই লাইফ। বুড়ো বয়সে স্বামী-স্ত্রী বসে কুটকুট করে গল্প করে এমন একটা কথা শোনা যায়। আমার কপালে তাও নেই। ধর কোন একটা জরুরী কথা তোমার শাশুড়িকে বলতে চাচ্ছি। আমি মুখ খোলার আগেই তোমার শাশুড়ি বলবেন–চুপ কর। কথা শুরুর আগেই চুপ কর। আরে জীবনটাই তো চুপ করে করে কাটিয়ে দিলাম। ঠিক বলছি না?
জ্বি।
মরার পর যদি কোন কারণে আমার বেহেশতে স্থান হয় আমি কি চাইব জান?
কি চাইবেন?
আমি চাইব তোমার শাশুড়ি আমার সামনে বসে থাকবে, আর আমি ক্রমাগত কথা বলে যাব। সে শুধু শুনবে। কখনো বলতে পারবে না, চুপ কর। আমার কথা ভাল লাগুক আর না লাগুক তাকে শুনতে হবে। She must listen.
জামান ছাড়া পেল রাত আটটায়। শসা কিনে বাসায় পৌছতে পৌছতে আটটা পনেরো। তার অস্বস্তির সীমা রইল না। নায়লা রাগ করবে। রাগ করাটা স্বাভাবিক। সবার সামনে হৈ-চৈ শুরু না করলেই হয়।
অতিথি দুজনই এসেছে। বসার ঘরে আলম গল্প করছে অরুণার সঙ্গে। আলম সত্যি সত্যি পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে এসেছে। অরুণ পরেছে বাটিকের কাজ করা রাজশাহী সিল্ক। অরুণা এম্নিতেই সুন্দর। আজ তাকে আরো সুন্দর লাগছে। নায়লা রান্নাঘরে। পোলাও বসিয়েছিল–পোলাও নষ্ট হয়ে গেছে। পুড়ে একাকার। আবার নতুন করে পোলাও চড়িয়ে সে হাঁড়ির কাছে পঁড়িয়ে। তাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। সে কাপড় বদলায়নি। কাজলদানি খুঁজে পাওয়ায় শুধু চোখে কাজল দিয়েছে। সেই কাজলও ভাল হয়নি, লেপ্টে গেছে।
জামান রান্নাঘরে শসা রাখতে রাখতে বলল, খুব দেরি করে ফেললাম!
নায়লা জবাব দিল না। শুধু কঠিন চোখে তাকাল। জামান বলল, রান্না হয়নি?
রান্না নিয়ে তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না। শাড়ি এনেছ?
নুরু বাসায় ছিল না।
গ্রীন ফার্মেসীতে খোঁজ করেছিলে?
না।
ও বাসায় কতক্ষণ থাকে? ও তো দিনরাত গ্রীন ফার্মেসীতে পড়ে থাকে। সেখানে গিয়ে একটু খোঁজ নেবার কথা মনে পড়ল না? সামান্য বুদ্ধিটাও তোমার হয় না? বুদ্ধি জমা রেখে রেখে হবেটা কি?
সামান্য ব্যাপারে এত রেগে যাচ্ছ কেন?
আমার সবই তো সামান্য। রান্নাঘরে গাছের মত দাঁড়িয়ে থাকবে না। যাও, ওদের সঙ্গে বোস। না থাক, এদের সঙ্গে বোসতে হবে না। বাবুর কাছে যাও।
জামান চলে যেতেই ফিরুর মা বলল, স্বামী হইল গিয়ে আম্মা বেহেশতের চাবি। বেহেশতের দরজার মধ্যে বাইশ হাত লম্বা এক তালা ঝুলছে। স্বামী হইল হই তালার চাবি। কোন মেয়েছেলে বেহেশতে ঢুকনের আগে হেই চাবি দিয়ে দরজা খুলন লাগে। এই জন্যে স্বামীর সঙ্গে খারাপ কথা বলা কিতাবে নিষেধ।
ফিরুর মা, তোমার মুখটা দয়া করে তালাবন্ধ করে রাখ একটা কথা না।
জ্বাল কমাইয়া দেন আম্মা–পোলাও মরম হইব।
পোলাও নরম হবে না শক্ত হবে সেটা আমি দেখব। তোমার বক্তৃতা দিতে হবে না।
নায়লা রাগ করেই আগুনের আঁচ আরো বাড়িয়ে দিল। তার কান্না পাচ্ছে। আজ সবকিছু এমন খারাপভাবে এগুচ্ছে কেন?
অরুণার উপর তার ভয়ংকর রাগ লাগছে। যদিও রাগ লাগার তেমন কোন কারণ নেই। মেয়েটাকে আজ প্রচণ্ডরকম বেহায়া মনে হচ্ছে। ঠোটে লিপস্টিক দিয়ে কী করে রেখেছে। অন্য সময় তো এত লাল লিপস্টিক দিতে দেখা যায় না। আলমের প্রতিটি কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ছে। এই মেয়ের পেটে এত হাসি লুকানো ছিল? রান্নাঘর থেকে বসার ঘরের কথাবার্তা সবই শোনা যায়। নায়লা খুব মন দিয়ে শুনছে। এমন কিছু হাসির কথা তো আলম বলছে না। তাহলে এত হাসি কেন? কিশোরী মেয়েরা খিল খিল করে হাসলে মানায়। তুই এক ধামড়ি, তুই এমন করে হাসছিস কেন? সুন্দর ছেলে দেখে হুস নেই?
নায়লা রান্নাঘরে আটকে আছে। তার কি উচিত ছিল না একবার এসে খোঁজ নেয়া? ভদ্রতা করেও তো বলতে পারতো–তোর কি সাহায্য লাগবে বল। ভদ্রতাটতা এখন এই মেয়ে গুলে খেয়ে বসে আছে। কেউ বোধহয় তাকে বলে দিয়েছে। খিলখিল করে হাসলে ছেলেরা খুশি হয়। সে হেসেই যাচ্ছে। নায়লার ইচ্ছে করছে বলে আসে–আস্তে করে হাসো। বাবু উঠে যাবে।
সবাই খেতে বসল রাত নটায়। অরুণা বলল–এত রাত হয়েছে বুঝতেই পারিনি। বাসায় ফিরতে ফিরতে দশটা বেজে যাবে। কি সর্বনাশের কথা! আলম বলল, কেন সর্বনাশের কথা না। আনন্দের কথা। আমরা এই আসর ভাঙব রাত বারোটায়। আপনার ভয় নেই। আপনাকে আমি পৌঁছে দেব।
বারোটার সময় বাসায় পৌঁছে দিলে আমাকে স্ট্রেট বাসা থেকে বের করে দেবে। আমি হব পথবাসি।
নায়লার গা জ্বলে গেল–কি কাব্য! আমি হব পথবাসি! আলম বলল, আমরা থাকতে আপনি পথবাসি হবেন না। আচ্ছা অরুণা, শুনুন, আপনি কি গান জানেন?
উহুঁ।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি গান জানেন।
স্কুলের ফাংশানে গাইতাম–না জানার মতই।
নায়লার মুখ তেতো হয়ে গেল। স্কুলের ফাংশানে গাইতাম! তুই স্কুলের ফাংশানে গান গেয়ে সবাইকে উদাস করে দিয়েছিস! লতামুঙ্গেশকর এসেছে।
নায়লা ভেবে পাচ্ছে না আরুনার উপর তার এত রাগ হচ্ছে কেন! অরুণার উপর রাগ করে এমন খারাপ খারাপ কথাই বা কেন মনে আসছে? আলম বুলল, খাওয়ার পর
আপনার গান শুনব।
সর্বনাশ! আমার গান শুনলে এই এ্যাপার্টমেন্টের লোকজন আমাকে রাস্তায় বের করে দেবে।
নায়লা মনে মনে বলল, তোকে রাস্তায় বের করবে না, তোকে কানে ধরে স্টেডিয়ামে চক্কর দেয়াবে। তামুঙ্গেশগিরি বের করে দেবে।
আলম বলল, আপনার কোন অজুহাত শুনতে চাচ্ছি না। খাওয়ার পর শুরু হবে সংগীত। স্পেনিশরা কি করে জানেন? যে কোন পার্টির পর নাচতে শুরু করে, নাচ চলে একেবারে মধ্যরাত পর্যন্ত।
নায়লা মনে মনে বলল, তুই বসে আছিস কেন? তুই বল আমি স্কুলের ফাংশানে নেচেছি। আপনি চাইলে এখানেও নাচব।
বাবু উঠে গেছে। উঠেই কান্না। জামান খাওয়া বন্ধ রেখে ছেলেকে ধরল। ছেলে ব্যাকুল হয়ে বলল, বাবা, আমি বাতিস দুদু খাব না? এত দীর্ঘ একটা বাক্য ছেলে এই প্রথম বলল। জামানের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে ছেলেকে নিয়ে ছাদে হাঁটতে গেল।
আলম বলল, বাচ্চা-কাচ্চা খুব ভাল জিনিস, কিন্তু এদের জন্যে যে খাওয়া রেখে উঠে যেতে হয়, গল্পের আসর ফেলে কোলে নিয়ে ঘুরতে হয়, এটা খারাপ। বাচ্চাকাচ্চা কেমন হওয়া উচিত জানেন অরুণা? বাচ্চাকাচ্চা হওয়া উচিত চাবি সিস্টেমে। চাবি দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখলেন–আবার যখন আদর করতে ইচ্ছা করল চাবি দিয়ে জাগিয়ে খানিকক্ষণ আদর করলেন।
অরুণা খিলখিল করে হাসছে। হাসতে হাসতে সে বিষম খেল! নায়লা ভাবল–এই মেয়েটা নিতান্ত বেহায়ার মত হাসছি। বোঝাই যাচ্ছে বিয়ের জন্যে অস্থির হয়ে আছে। লজ্জা-শরম বিসর্জন দিয়েছে।
খাওয়া-দাওয়া শেষে অরুণা সত্যি সত্যি গান গাইতে বসল। নায়লা মেয়েটার নির্লজ্জতায় হতভম্ভ হয়ে গেল।
আপনারা কিন্তু আমার গান শুনে মুখ টিপে হাসতে পারবেন না। আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বলতেও পারবেন না–ভাল হয়েছে।
নায়লা মনে মনে বলল–ঢং করিস না বারি কোথাকার! গান গাইতে বসেছিস, গেয়ে ফেল। গানের শেষে তুই একটা খ্যামটা নাচও দেখাবি। আলম তোর খ্যামটা নাচও পছন্দ করবে।
অরুণা বলল, আমি কি একটা রবীন্দ্র সংগীত করব?
আলম বলল–আপনার যা ইচ্ছা করুন। শুধু দয়া করে খেয়াল ধরবেন না।
অরুণা আবারও হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। নায়লার ইচ্ছা করছে বলে–তুই যে ভাবে হাসছিস তোর দাঁতের মাড়ি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।
অরুণা গান শুরু করেছে–
আমি কান পেতে রই আমার আপন হৃদয় গহন দ্বারে
কোন গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শুনিবারে।
অরুণার গলা মিষ্টি। গাইছেও খুব সুন্দর করে। নায়লা বিষন্ন চোখে তাকিয়ে আছে। অরুণা এতো সুন্দর গাইতে পারে নায়লার জানা ছিল না।
গান শেষ করে অরুণা হালকা গলায় বলল, বাবার খুব শখ ছিল আমি গান শিখি। মাস্টার টাস্টার রেখে হুলস্থূল করেছিলেন। বাবা মারা গেলেন, গনিও মারা গেল। দশ বছর পর প্রথম একটা পুরো গান গাইলাম।
আলম বলল, অসাধারণ আপনার গলা। নায়লা, অসাধারণ না?
নায়লা বলল, হ্যাঁ।
আলম বলল, আমরা কি আরেকটা শুনতে পাব?
অরুণা বলল, হ্যাঁ পাবেন। এবং এইটাই শেষ। আর কোন গানই আমি পুরো জানি। অরুণা আবার শুরু করল —
মধুর, তোমার শেষ যে না পাই, প্রহর হল শেষ
ভুবন জুড়ে রইল লেগে আনন্দ-আবেশ।
নায়লা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল–তার কত শখ ছিল গান শেখার। স্কুলের আপা বলেছিলেন–নায়লা, তুই মন দিয়ে গান শেখ, তুই নাম করবি–তোর গলা ভাল। সেই ভাল গলা দিয়ে তার লাভটা কি হল? বাবাকে সে গানের স্যার রাখার কথা বলতেই তিনি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন—স্যার রেখে গান শিখতে হয় না-কি? রেডিও শুনে শুনে শিখবি। যে শিখতে পারে সে রেডিও শুনে শুনে শিখতে পারে। যে পারে না তাকে মাস্টার গুলে খাওয়ালেও পারে না।
আলম বলল, নায়লা, তুমি গান জান না? নায়লা কঠিন গলায় বলল, না।
গুন গুন করে গাওয়ার মত খানিকটা নিশ্চয়ই জান। ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে বাচ্চাকে ঘুম পাড়াও না? না-কি ঘুম পাড়াবার দায়িত্ব বাচ্চার বাবার?
নায়লা বলল, আমি রান্না আর ঘর ঝাট দেয়া ছাড়া আর কিছু জানি না। ঘর কি করে কাঁট দেয়া হয় দেখতে চাইলে ব্র আঁট দিয়ে দেখাতে পারি।
আচ্ছা বেশ, আমরা তাই দেখব। নিয়ে আস ঝাড়ু?
অরুণা আবার হেসে উঠল খিলখিল করে। নায়লার এমন রাগ লাগছে।
বাবু খুব কাঁদছে। ফেঁপাতে ফেঁপাতে ডাকছে, মাম্মাট মাম্মাট।
আলম বলল, নায়লা, তুমি বাবুর কাছে যাও তো। সে তোমার জন্যে অস্থির হয়ে আছে। আমরা এখন বিদেয় হব। তোমার বান্ধবীকে নিয়ে চিন্তা করবে না। আমি তাকে ঠিকমত নামিয়ে দেব। আরেকটা কথা, তোমার বান্ধবীর সামনেই বলছি–তোমার বান্ধবীকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। শ্রামার প্রসঙ্গে তোমার বান্ধবীর মনোভাবটা কি জানতে পারলে ভাল হত। তিনি কি বলবেন?
অরুণা মেঝের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
নায়লা মনে মনে বলল, বাদরি, তুই এত ঢং কোথেকে শিখেছিস? চিৎকার করে বলে ফেল–আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। এক্ষুণি চাই। এক্ষুণি চাই। সিনেমার নায়িকার মত তুই ঢং করছিস কেন রে ঢঙ্গি? এর মধ্যে ঢং করার কি আছে? কি কুৎসিত কথা সে অরুণাকে নিয়ে ভাবছে! অথচ অরুণা এত ভাল একটা মেয়ে। নায়লার কি হয়েছে? কেন সে এত খারাপ হয়ে গেছে?
নায়লা শোবার ঘরে বাবুকে দুধ খাওয়াচ্ছে। সারাদিন বাবু আজ মাকে কাছে পায়নি। সে দুহাতে শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। আমরা চলে গেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, যাবার আগে নায়লার কাছ থেকে বিদায় পর্যন্ত নেয়নি।
জামান ওদের আগিয়ে দিতে গেছে। নায়লা ফিরুর মাকে বলল বাতি নিভিয়ে মশারি খাঁটিয়ে দিতে। ক্লান্তিতে তার শরীর ভেঙে আসছে। সে বাবুকে নিয়ে শুয়ে থাকবে।
খাবার টেবিল নোংরা হয়ে আছে। টেবিল পরিষ্কার করতে হবে। তাকেই করতে হবে। ফিরুর মাকে দিয়ে হবে না। সে কাচের জিনিস ভাঙবে। ইচ্ছা করেই ভাঙবে।
ফিরুর মা বলল–আইট্যা বাসুন কি ধুমু আম্মা?
না। তুমি খেয়ে নাও।
ভাইজানরে কি পেলািও গরম কইরা দিমু? ভাইজানের খাওয়া হয় নাই। খাওনের মাঝখানে উইঠা গেল।
ভাইজানের চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। তুমি তোমার চিন্তা কর।
জামান ওদের গাড়িতে তুলে দিয়ে আসতে গিয়েছে এগারোটা দশে। এখন বাজে সাড়ে বারোটা। এর মধ্যে ফিরুর মা দুবার নিচে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসেছে। কেউ নেই। মানুষটা গেল কোথায়?
নায়লার ভয় ভয় লাগছে। ঢাকা বিচিত্র শহর। কত কি হতে পারে। তার ইচ্ছা করছে নিজেই একবার খোঁজ নিয়ে আসে। যদিও তা সে করল না। ঘর পরিষ্কার করল। খালা-বাসন ধুয়ে শুকনো ন্যাকড়া দিয়ে মুছল। সন্ধ্যাবেলাতেই সে একবার গোসল করেছে। আবার পানি গরম করে গোসল করল। গোসলের পারে মাথায় ভার ভার ভাবটা দূর হয়েছে। ভাল লাগছে। ফিরুর মা চা বানিয়ে দিয়েছে। প্রচণ্ড ক্লান্তির পর গরম চ-টা খেতে ভাল লাগছে।
ভাত খাওয়া হয়েছে ফিরুর মা?
জ্বে না।
খাওনি কেন?
ভাইজান ফিরতাছে না। ডরে আম্মা শইল কাঁপতাছে।
শরীর কাঁপাকাপির কিছু না। তোমার ভাইজান কচি খোকা না। যাও খেতে বোস।
নিচে দারোয়ানরে জিজ্ঞেস করলাম, ভাইজানরে দেখছেন? হে আমার সাথে মশকারা করে। আমারে কয় কি–আমি রাইতকানা, রাইতে চউক্ষে দেখি না।
চুপ কর তো! কথার যন্ত্রণায় অস্থির হয়েছি।
অল্পে অস্থির হওয়া তো আম্মা ভাল না।
তোমাকে আমি আর রাখব না ফিরুর মা। তুমি দেশে চলে যাবে।
আইচ্ছা।
জামান ফিরেছে। এত দেরি করে যে ফিরেছে তার জন্যে কোন দ্বিধা কোন সংকোচ নেই। আশ্চর্য মানুষ তো! নায়লা দেখছে মানুষটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে হাত-পা ধুচ্ছে। প্যান্ট বদলে লুঙ্গি পরে বলল, চল শুয়ে পড়ি।
নায়লা বলল, এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
অলিম ধরে নিয়ে গেল। অরুণাকে নামিয়ে ওর সঙ্গে খানিকক্ষণ ঘুরলাম।
রাত দুপুরে ঘুরলে?
আলমকে তো তুমি জান না। ও কিছু বললে না করা মুশকিল। ও আচ্ছা, তোমার ছবিগুলি সে দিয়ে দিয়েছে।
আমার কি ছবি?
ওর সঙ্গে সাভার গিয়েছিলে–ছবি তুলেছ, সেইসব ছবি। সুন্দর ছবি এসেছে। টেবিলের উপর রেখেছি। দেখো।
নায়লা শক্ত হয়ে গেল। জামান কি ব্যাপারটায় কিছু মনে করেছে? ছবি দেখে অন্য কিছু ভেবে বসেনি তো?
নায়লা!
হুঁ।
খুব ঠাণ্ডা লেছে। শোবার আগে চা খাওয়াবে?
নায়লা নিঃশব্দে চা বানাতে উঠে গেল। চা বানিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে, জামন ছবি দেখছে। খুব মনযোগের সঙ্গেই দেখছে।
নায়লা বলল, প্রথম যেদিন উনার কাছে গেলাম উনি বললেন, সাভার থেকে কি যেন কিনবেন। জোর করে ধরে নিয়ে গেলেন। তুমি রাগ করনি তো?
না। রাগ করব কেন? ও যাদের পছন্দ করে তাদের খুক আপন করে দেখে। তোমাকে খুব পছুন্দ করে।
আমাকে পছন্দ করে না। তোমাকে করে! আমি হচ্ছি ফাউ। দেখি ছবিগুলি।
ছবি সুন্দর এসেছে। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে আলমের পাশে নায়লা দাড়িয়ে। নায়ল আলমের দিকে তাকিয়ে হাসছে, আর আলম বা হাতে নায়লাকে জড়িয়ে ধরে আছে। নায়লার নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল। কখন এই ছবি তোলা হল? আলম কখন তাকে জড়িয়ে ধরেছিল? মনে নেই তো। কি সুন্দর হয়েছে ছবিটা! কি সুন্দর। নায়লা চোখ ফেরাতে পারছে না।
নায়লা।
হুঁ।
আলম তোমাকে কাল হোটেলে যেতে বলেছে।
নায়লা তীক্ষ্ম গলায় বলল, আমাকে তার হোটেলে যেতে বলবে কেন? এটা কেমন কথা–শুনতেও তো খারাপ লাগছে!
তার বিয়ের তারিখ-টারিখ ঠিক করবে। বিয়ের জিনিসপত্র কিনবে। ও সামনের সপ্তাহেই বিয়ে করতে চায়।
সামনের সপ্তাহেই করুক বা আগামীকালই করুক, তিনি তো আমাকে বলতে পারেন না। হোটেলে যেতে ব্যাচেলার একজন মানুষ, একা থাকেন …
তুমি হঠাৎ রেগে গেলে কেন? ওর মনে কিছু নেই বলেই ও এতো সহজে বলতে পারল। এটা তুমি কেন বুঝতে পারছ না? তাছাড়া এমন তো না যে তুমি তার হোটেলে যাওনি!
আমি গোপনে গিয়ে উপস্থিত হইনি। কাছে গিয়েছি।
সেও তোমাকে গোপনে যেতে বলছে না। জরুরী কাজেই ডেকেছে।
নায়লা কঠিন গলায় বলল, আমাকে তোমার বন্ধু হোটেলে ডেকে পাঠাচ্ছেন–আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি–দরজা বন্ধ করে জরুরী আলোচনা করছি–এটা তুমি সহজভাবে নেবে?
হ্যাঁ নেব। আলমকে আমি চিনি।
একজন স্বামীই কখনো তার স্ত্রীকে চিনতে পারে না আর তুমি ছেলেবেলার বন্ধুকে চিনে ফেলবে। তুমি কতটুকু জান কে?
অনেকখানিই জানি।
না, তুমি অনেকখানি জান না। তুমি জান না যে ঐ লোক আমাকে প্রেম নিবেদন করেছে।
জামান সহজভাবে বলল, তোমাকে প্রেম নিবেদন করেছে?
সরাসরি বলেনি, ইশারায় বলেছে।
তুমি যাকে ইশারা ভাবছ তা হয়ত ইশারা নয়।
তোমার ধারণা আমি এতই কম বুদ্ধির একটা মেয়ে যে কেউ আমার প্রেমে পড়তে পারে না?
তুমি শুধু শুধু রাগছ। আলম তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করেছে। ঠাট্টাটাই সত্য ভেবে তুমি কষ্ট পাচ্ছ।
ঠাট্টা হলে তো ভালই। চল ঘুমুতে যাই।
দুজন দুপাশে আর বাবু মাঝখানে শুয়ে আছে। একটা জানালা মনে হচ্ছে খোলা। বাতাস আসছে। নায়লার উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করতে ইচ্ছা করছে না। সে জেগে আছে। তবে পড়ে আছে মরার মত। তাকে দেখলে যে কেউ ভাববে সে ঘুমুচ্ছে।
বাবু ঘুমের মধ্যেই বলল, মাম্মাটের কাছে যাব। আমি মাম্মাটের কাছে যাব।
জামান ছেলের গায়ে হাত রেখে তাকে আদর করছে। বেচারা আজ মার আদর তেমন পায়নি। ঘুমের মধ্যেও সেই না পাওয়ার অস্থিরতা চলে আসছে। জামান বলল, নায়লা, ঘুমিয়ে পড়েছ?
না।
আমার অফিসে একটা ঝামেলা হয়েছে, তোমাকে বলা দরকার।
ঝামেলার কথা শুনতে ইচ্ছা করছে না। অন্য কিছু বলার থাকলে বল।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জামান বলল, তুমি খুব অস্থিরতার মধ্যে আছি। তোমার কি হয়েছে?
আমার কিছু হয়নি। জানালাটা বন্ধ করে দেবে? ঠাণ্ডা বাতাস আসছে।
জামান উঠে জানালা বন্ধ করল। নায়লা বলল, ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি খাওয়াও জামান পানি এনে দিল। নায়লা পানি খেল না। এক চুমুক দিয়েই গ্লাস ফিরিয়ে দিল। তার আসলেই কেমন জানি অস্থির লাগছে। জানালা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে ঘরটাও যেন অনেকখানি গরম হয়ে পড়েছে। নায়লা গা থেকে লেপ সরিয়ে দিল। এখন তার ইচ্ছা করছে–দরজা খুলে ছাদে গিয়ে বসে থাকতে।
জামান বলল, তোমার কি খারাপ লাগছে?
হ্যাঁ।
কেন বল তো?
বুঝতে পারছি না। বাতিটা জ্বালাও।
জামান বাতি জ্বালাল। নায়লা বলল, তোমার বন্ধুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা আমার উচিত হয়নি। খুব ভুল হয়েছে। আসলে ব্যাপারটা কি হয়েছে তোমাকে বলি…
আমাকে কিছু বলার নেই। তুমি ওর সঙ্গে ছবি তুলে তাতে কি হয়েছে?
অনেক কিছুই হয়েছে। না শুনলে তুমি বুঝবে না। উনি সাভার যাবেন, আমাকেও নিয়ে যাবেন। আমি যেতে চাইনি, উনি এমন জোর করলেন যে আমি না বলতে পারলাম না…
তুমি কেন কেউ পারবে না।
আমি তো আগে কখনো স্মৃতিসৌধে যাইনি–এত ভাল লাগল! ছবি তুলতে ইচ্ছা করল। উনাকে বলতেই উনি ক্যামেরা নিয়ে এলেন। এক সময় তার গাড়ির ড্রাইভারকে বললেন আমাদের দুজনের ছবি তুলে দিতে। বলেই তিনি আমার পাশে পঁড়ালেন। কখন যে তিনি তাঁর হাত আমার কাধে রেখেছেন বুঝতেই পারিনি। পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে খারাপ লেগেছিল বলে আমি তোমাকে কিছু বলতে পারিনি …
তোমার খারাপ লাগার কিছু নেই।
তুমি নিজে ভাল মানুষ বলে পৃথিবীটা তোমার মত করে দেখ। পৃথিবীর সব পুরুষই তুমি তোমার মত মনে কর। পৃথিবীর পুরুষগুলি তোমার যত না। পুরুষ মানুষদের সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা খুব খারাপ। তোমার বন্ধু সম্পর্কেও খারাপ। ঐ দিন আমার সঙ্গে ছবি তোলার পর থেকে তার ভাবভঙ্গি পাল্টে গেল…
কি যে তুমি বল!
আমি ঠিকই বলি। আমি ভুল বলি না। যেহেতু ঐ দিন ছবি তোলার সময় আমি আপত্তি করিনি কাজেই সে প্রশ্রয় পেয়ে গেল। প্রশ্রয় পেল বলেই এই ধরনের অস্বাভাবিক কথা সে বলতে পারল।
জামান মৃদু স্বরে বলল, আলম হল পাগল টাইপের। ও কি মনে করে কি বলেছে কে জানে। ওর কথায় অস্থির হয়ো না।
আমি অস্থির হয়ে আছি তোমাকে কে বলল? অস্থির হবার মত কি ঘটেছে? কিছুই ঘষ্টেনি। ফালতু ধরনের একটা ছেলে যদি আমাকে কিছু বলে বসে তাতে কি যায় আসে। আমি তো ফালতু মেয়ে না।
চট করে কাউকে ফালতু বলা ঠিক না।
যে ফালতু তাকে ফালতুই বলতে হয়। তোমার প্রাণের বন্ধুর স্বভাবটা কেমন তুমি জানতে চাও?
ওর স্বভাব কেমন আমি জানি নায়লা।
না, তুমি জান না। একজন পুরুষ অন্য একজন পুরুষের আসল স্বভাব কখনো ধরতে পারে না। একজন মেয়েই শুধু পারে। আমি বলি তোমার বন্ধুর স্বভাব কেমন। তার হল মেয়ে-ঘেঁসা স্বভাব। মেয়ে দেখামাত্রই তার মনে ছোক ছোক ভাব হয়। সে এমন একটা ভাল করে যেন প্রেমে পড়ে গেছে। মেয়েরা তার এই ভঙ্গিতে প্রতারিত হয়, ধরা দেয়।
তুমি কি প্রতারিত হয়েছ?
নায়লা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, আমি প্রতারিত হব কেন?
এম্নি বললাম।
না, তুমি এম্নি কলনি। তোমার মনে অন্য কিছু আছে। তুমি কি ভাব আমাকে?
জামান হকচকিয়ে গেল। নায়লা হঠাৎ এমন উত্তেজিত হয়ে গেল কেন?
তোমার কি ধারণা তোমার বন্ধুর প্রেমে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি?
এইসব কথা কেন আসছে?
কারণ আছে বলেই আসিছে। কারণ না থাকলে আসত না। তোমাকে আমি চিনি–তুমি ভালমানুষের মত ভঙ্গি করে থাক। ভঙ্গি পর্যন্তই। তোমার ভেতরটা অন্য পুরুষদের মতই অন্ধকার। তুমি কি ভেবেছ, তোমার মত ভালমানুষ পুরুষ আগে দেখিনি? দেখেছি। এরকম একজনের সঙ্গে আমার বিয়েও ঠিক হয়েছিল। তখন ধারণা হয়েছিল এই মানুষটার মত মানুষ পৃথিবীতে আর জন্মায়নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এই মানুষ আমাকে নিয়ে কি করল জানতে চাও? জানতে চাইলে বলতে পারি। শুনলে তুমি কলার খোসার মত আমাকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলবে।
নায়লা হাউ মাউ করে কাঁদছে। কান্নার শব্দে বাবু উঠে পড়েছে। সেও কাঁদতে শুরু করেছে। জামান তাকিয়ে আছে হতভম্ব হয়ে।
জামান অফিসে ঢুকল লজ্জিত ভঙ্গিতে
জামান অফিসে ঢুকল লজ্জিত ভঙ্গিতে। যেন অপরিচিত কারো বাড়িতে সে ঢুকতে যাচ্ছে। এক্ষুণি বাড়ির দারোয়ান বলবে, কাকে চান? কি প্রয়োজন? জামান এই মুহূর্তে কাউকে চাচ্ছে না। তার তেমন কিছু প্রয়োজনও নেই। তিন মাসের বেতন তাকে মাসের এক তারিখেই দিয়ে দেয়া হয়েছে। ক্যাশিয়ার বজলুর রহমান বলেছেন, প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা আপনাকে পরে হিসাব করে দিয়ে দেব। কয়েকদিন যাক, তারপর আসুন। চার দিন মাত্র গিয়েছে। এই চার দিনে কিছু হবার কথা না। তবু জামান এসেছে। প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকার জন্যে যে এসেছে তা না। কেন এসেছে নিজেও জানে না। কে জানে, হয়ত লজ্জা পাওয়ার জন্যেই এসেছে।
গেটের কাছে দারোয়ান ছগির মিয়া বিড়ি টানছিল। বিড়ি লুকিয়ে ফেলে বলল, স্যার, ভাল আছেন? তার গলায় অন্যদিনের চেয়েও বেশি আন্তরিকতা।
জামান বলল, ভাল আছি।
আপনের খবরে মনটা খুব খারাপ হইছে স্যার।
ও আচ্ছা। ঠিক আছে। ঠিক আছে?
দারোয়ানের সহানুভূতি জামানের ঠিক ভাল লাগছে না। আবার কারো সহানুভূতি তুচ্ছও করা যায় না। জামান অফিসে ঢুকল। তার চেয়ারটা খালি। টেবিলের ফাইলপত্র সরানো হয়নি। জামানের পাশের টেবিলের ইলিয়াস সাহেব উচু গলায় বললেন–আরে জামান ভাই যে, আসেন আসেন।
সবাই তাকাচ্ছে। বিশ্রী অবস্থা।
জামানের মনে হল, অফিসে আসাটা ভুল হয়েছে। না এলেই হত।
আপনার কোন খোঁজখবরই নাই। কি ব্যাপার বলুন দেখি।
এই ত আসলাম। কেমন আছেন?
আর থাকাথাকি! বসেন দেখি, চা খান।
ইলিয়াস সাহেব জামানকে চা খাওয়ার জন্যে অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ব্যস্ততাটাও চোখে পড়ে।
চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভাল করেছেন। গুড ডিসিসান। এখন ব্যবসা করুন। ব্যবসা ছাড়া বাঙালীর উন্নতি নেই। চাকরি আরো আগেই ছাড়া উচিত ছিল।
ইলিয়াস সাহেব এমন ভঙ্গি করছেন যেন জামান নিজেই চাকরি ছেড়েছে, তাকে ছাড়িয়ে দেয়া হয়নি। এই জাতীয় ছেলেমানুষী কথাবার্তার মানে আছে?
জামান সাহেব!
জ্বি।
দশটা-পাঁচটা অফিস করে বাঙালী জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। বাঙালী এখন মেরুদণ্ডবিহীন জাত। চাকরি ছেড়ে আপনি কাজের কাজ করেছেন।
চাকরি তো আমি ছাড়িনি, ওরা ছাড়িয়ে দিয়েছে।
একই ব্যাপার। সিঙ্গারা খান। চায়ের সঙ্গে গরম গরম সিঙ্গারা ভাল লাগবে।
জামান চা খেল। সিঙ্গারা খেল। অকারণে বসে থাকার কোন মানে হয় না। উঠে দাঁড়াল। ইলিয়াস সাহেব বললেন, চলে যাচ্ছেন নাকি?
জ্বি।
আবার আসবেন। মাঝে মধ্যে আপনাকে না দেখলে ভাল লাগে না। নিন, সিগারেট নিয়ে যান।
জামালকে সিগারেট নিতে হল। ফেরার পথে সে ক্যাশিয়ার আবদুল করিম সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেল। করিম সাহেব জামানকে দেখে নিষ্প্রাণ গলায় বললেন, বসুন। হাতের কাজ সেরে নেই।
বসব না। আজ যাই।
বসতে বলছি, বসুন।
জামান বসল। করিম সাহেব হাতের কাজ সারতে এক ঘণ্টার মত সময় নিলেন। এক ঘণ্টা পর মুখ তুলে বললেন–আপনার প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের কাগজপত্র সব রেডি করে ফেলেছি। সব মিলিয়ে আপনি পাচ্ছেন একুশ হাজার দুশ তিপ্পান্ন টাকা। আগামী সোমবার আসবেন। আমি চেক আপনার হাতে দিয়ে দেব।
জি আচ্ছা।
আপনার বেতন হিসাব করে দেখলাম, আপনি কিছু টাকা পান। পে ফিক্সেশনে ভুল ছিল। আপনি অফিসের কাছে তেইশ শ নব্বই টাকা পান। টাকা নিয়ে যান। রেভিন্যু স্ট্যাম্প আছে?
জ্বি না।
রেভিন স্ট্যাম্পের জন্যে দু টাকা দিন। দিয়ে সই করুন। ক্যাশ টাকা নিয়ে যান।
জামান সই করল। টাকা নিল।
টাকা গুনে নিন ভাই।
আবারও কি একশ টাকা বেশি দিয়েছেন?
না, বেশি দেইনি।
তাহলে আর মুনার দরকার নেই।
হঠাৎ এই টাকাটা পেয়ে কি খুশি হয়েছেন জামান সাহেব? ওই টাকা তো পাওয়ার কথা ছিল না। বলুন, খুশি হয়েছেন?
জ্বি।
আপনার চাকরি যে চলে গেছে এটা ভাবীকে বলেছেন?
এখনো বলিনি।
আমিও তাই ভেবেছি। পারেননি। বলা সম্ভবও না। পৃথিবীর সবার কাছে ছোট হওয়া যায়, স্ত্রীর কাছে ছোট হওয়া যায় না। আমার দুবার চাকরি গিয়েছে। এই ব্যাপারটা আমার চেয়ে ভাল কেউ জানে না। জামান সাহেব, আমার একটা উপদেশ শুনুন–এই যে টাকাটা পেলেন, এটা ভাবীর হাতে দিয়ে দিন। ভাবীকে বলুন ইচ্ছেমত খরচ করতে। ভাবী এতে খুব আনন্দিত হবেন। আনন্দ থাকতে কিতে এক সময় আপনার দুঃসময়ের কথা বলুন।
এতে তো কষ্টটা আরো বেশি হবার কথা।
হবে না। সেই বুদ্ধিও শিখিয়ে দিয়ে দেই। ভাবীকে বললেন–এই চাকরির চেয়েও ভাল একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে।
মিথ্যা কথা বলা হবে?
মিথ্যা কথা বলবেন। আপনি তো আল-আমিন না যে সব সময় আপনাকে সত্য কথা বলতে হবে। সংসার টিকিয়ে রাখতে হলে মিথ্যা বলতে হয়। শুধু সিমেন্ট দিয়ে ইট গাঁথা যায় না। সিমেন্টের সঙ্গে বালি মিশাতে হয়। সিমেন্ট যদি সত্যি হয়–মিথ্যা হল বালি। এই দুইয়ের মিলিত ফল হল বিশাল ইটের গাঁথুনি।
যা সত্যি তাই ওকে বলব বলে ঠিক করেছি।
ঠিক আছে ভাই সত্যবাদী–বলুন। চাকরি-বাকরির চেষ্টা কিছু করছেন?
না।
না করে ভালই করেছেন। চেষ্টা করেও কিছু হবে না। দেশে সব কিছু আছে, চাকরি নেই। আমি কি আপনার জন্যে বিকল্প ব্যবস্থা দেখব? আপনার মত অবস্থা আমার যখন হয়েছে তখন ঐ বিকল্প ব্যবস্থার উপর বেঁচেছিলাম। ঐ লাইন আমি কিছুটা জানি।
বিকল্প ব্যবস্থাটা কি?
টিউশানি। রমরমা ব্যবসা। অনেক পয়সাওয়ালা অপদার্থ বাবা-মা আছে যারা তাদের ছেলেমেয়ের জন্যে দেড় হাজার, দুহাজার টাকা বেতনে প্রাইভেট টিউটর রাখে। এ রকম দুটা জোগাড় করতে পারলে আপনার সমস্যার সাময়িক সমাধান হবে। চেষ্টা করব?
প্রাইভেট টিউশনি কখনো করিনি।
করেন নি, এখন করবেন।
কি পড়াব তাও তো জানি না।
থ্রি-ফোরের বাচ্চা পড়াবেন, তেমন কিছু জানতেও হবে না। বাবা-মারা তো আর পরীক্ষা নিতে আসছেন না আপনি কি পড়াচ্ছেন। আপনি যখন পড়বেন–তারা তখন স্টার টিভি দেখবে কিংবা পার্টি-ফার্টিতে যাবে। কি, চেষ্টা করব?
জামান কিছু বলল না। করিম সাহেব খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, আমি কি বলছি মন দিয়ে শুনুন। পরশু দিন সন্ধ্যার পর আমার বাসায় আসুন। সারভাইভালের চেষ্টা তো করতে হবে রে ভাই, হবে না?
জ্বি হবে।
আর এদিকে বড় সাহেবের সঙ্গে আমি আপনার ব্যাপারটা বলব। সৎ মানুষ এবং কাজের মানুষ–ওদের যদি চাকরি চলে যায় তাহলে তো চলবে না। তাহলে বুঝতে হবে কেয়ামত এসে গেছে।
জামান বলল, উঠি?
উঠবেন? উঠুন। মনে রাখবেন পরশু দিন সন্ধ্যা, আর ভাবীকে টাকাটা দিয়ে দেবেন। ইনার মনটা ভাল থাকা দরকার। বুঝতে পারছেন ভাই?
পারছি।
জামানের কোন কাজ নেই। বাসায় ফিরে যেতে পারে। অসময়ে বাসায় ফিরলে নায়লা খুব অবাক হবে। খুশিও হবে। বাবু কি করবে কে জানে। নিশ্চয়ই দাঁত কিড়মিড় করবে। বাড়াবাড়ি রকমের খুশি হলে বাবু দাঁত কিড়মিড় করে। বাবুর জন্যে কিছু বেলুন কিনে নিয়ে গেলে হয়। এক সঙ্গে চারটা চার রঙের গ্যাস বেলুন নিয়ে গেলে বাবু কি করবে? পাঁচ টাকা করে দাম হলে চারটা কুড়ি টাকা। এক সঙ্গে চারটা কেনার জন্য কিছু কমে হয়ত দেবে। নায়লার জন্যে কিছু কিনে নিয়ে গেলে হয়। কোন জিনিসটা তার সবচে পছন্দ জামান জানে না। কাচের চুড়ি কি পছন্দ? প্রায়ই কাচের চুড়ি কেনে।
দরজা খুলল, নায়লা। খুশি খুশি গলায় বলল, আরে তুমি? আজ সকাল সকাল চলে এলে যে?
জামান কিছু একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল, তার প্রয়োজন হল না। নায়লা চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল–বাবু দেখে যাও কে এসেছে, দেখে যাও।
নায়লা বলল, বাবু যে কি কাণ্ড শুরু করেছে না দেখলে তুমি বিশ্বাস করবে না। সে হাঁটা ভুলে গেছে। আজ সকাল থেকে হামাগুড়ি দিচ্ছে।
সেকি?
আমি হাসতে হাসতে বাঁচি না। বাচ্চারা হামাগুড়ি থেকে হাঁটা শেখে সে হাঁটা থেকে হামাগুড়ি। বাবু কই আসতো–বাবাকে দেখে যাও।
বাবু পর্দা ফাক করে বসার ঘরে এল। সে সত্যি সত্যি হামাগুড়ি দিচ্ছে। জামান হাত বাড়িয়ে ছেলেকে কোলে নিল।
নায়লা বলল, তোমাদের অফিস কি আজ সকাল সকাল ছুটি হয়ে গেছে?
হুঁ।
তুমি কি ভাত খাবে? না খেয়ে এসে?
খেয়ে এসেছি।
ক্যান্টিনে খেয়েছ নিশ্চয়ই। আজ ভাত নিয়ে যাওনি কেন? আমি রান্না শেষ করে এসে বসার ঘরে দেখি তুমি চলে গেছ।
দেরি হয়ে যাচ্ছিল…
দেরি হয়ে যাচ্ছিল বলেই তুমি বুঝি আমাকে না জানিয়ে চলে যাবে। আমার এত মন খারাপ হল। আচ্ছা শোন তুমি কি আমার উপর কোন রাগ করেছ?
নাতো।
আমার ধারণা গতরাতে আমার আজ বাজে কথা শুনে তুমি আমার উপর রাগ করেছ।
আমি এত চট করে কারো উপর রাগ করি না।
সেটাও জানি। রাগ না করাটাও ভাল না। রাগ টাগ করার মত আমি যদি কিছু করি তাহলে অবশ্যই রাগ করবে। যে রাগ করতে পারে না সে ভালও বাসতে পারে al
কে বলেছে–আলম?
হুঁ।
আলম মনে হয় আমেরিকা গিয়ে খুব ওস্তাদী ধরণের কথা শিখেছে।
নায়লা হেসে ফেলল। মাকে হাসতে দেখে বাবুও হাসছে। জামান বলল, আজ বিকেলে কোথাও বেড়াতে যাবে?
নায়লা বিস্মিত হয়ে বলল, বেড়াতে যাব কেন?
এম্নি। আমিরাতো যাই না কখনো। সব সময় ঘরেই থাকি।
নায়লা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার যাবার জায়গা নেই। কাবো বসায় যাবার চেয়ে বরং দোকানের ঘুরতে ভাল লাগে।
চল দোকানে দোকানে ঘুরব। খালি হাতে?
খালি হাতে?
না খালি হাতে না। এই টাকার রাখ তোমার কাছে। ইচ্ছামত খরচ কর।
নায়লা হতভম্ভ গলায় বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কিসের টাকা।
অফিসে থেকে হঠাৎ কিছু টাকা পেয়ে গেলাম। তোমাকেতো খরচ করার মত নগদ টাকা পয়সা কিছু দিতে পারি না।
তুমি কি সত্যি টাকাটা আমাকে দিচ্ছ?
হ্যাঁ।
এতো অনেক টাকা।
অনেক না। সামন্যই। তুমি ইচ্ছামত খরচ কর আমি দেখি।
আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে বোধহয় স্বপ্ন টপ্ন দেখছি।
জামান লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, সামান্য কয়েকটা টাকা কি যে তুমি বল।
সব টাকাটা যদি আমি আজ সন্ধ্যার মধ্যে খরচ করে ফেলি তুমি কিছু বলবে না?
না।
বেশ আজ সন্ধ্যার মধ্যে খরচ করব। আমি একা নিউমার্কেটে যাব। তুমি বাবুকে নিয়ে থাকবে। তুমি সঙ্গে থাকলে সব সময় মনের মধ্যে খচখচানি খাকবে–বাবুও বাতিস দুদু বাতিস দুদু করবে।
তুমি যাও। আমি বাবুকে রাখব।
জামান বাবুকে নিয়ে খাটে বসে আছে। একটু দূরে জামানের দিকে পিঠ দিয়ে গভীর আনন্দে টাকা গুনছে নায়লা। দৃশ্যটা এত সুন্দর লাগছে জামানের। আহা তরি যদি কিছু বেশি টাকা থাকতো। সে যদি প্রতিমাসে অন্তত একবার নায়লাকে এমন খুশি করতে পারতো।
নায়লা বিকেল থেকেই নিউমার্কেটে ঘুরছে
নায়লা বিকেল থেকেই নিউমার্কেটে ঘুরছে। অন্যদিন যা দেখে সবই কিনে ফেলতে ইচ্ছা করে। আজ আর কিছুই কিনতে ইচ্ছা করছে না। বাবুর জন্যে লাল টুকটুকে একটা বল শুধু কেনা হয়েছে। ছটা চিনামাটির প্লেট কেনার জন্যে এলিফেন্ট রোডের দোকানগুলিতে অনেক হাঁটাহাঁটি করল। পছন্দও করল। শেষ পর্যন্ত কিনল না। আজই কিনতে হবে এমনতো কোন কথা না। পরে কিনলেও হবে। বরং জামানের জন্যে একটা শার্ট কেনা যাক। রঙচঙা সার্ট, যা গায়ে দিলেই চট করে বয়স দশ বছর কমে যায়। ও পরতে চাইবে না। জোর করে পরাতে হবে।
শার্ট কিনতে গিয়ে নায়লার মনে হল আলমের জন্যেও একটা কিছু কেনা উচিত। সে এত উপহার দিয়েছে তাকে একটা কিছু না দিলে ভাল দেখায় না। ঐদিন যে পাঞ্জাবী পরে এসেছিল সেটা তেমন ভাল ছিল না। কত সুন্দর সুন্দর পাঞ্জাবী বের হয়েছে। সিল্কের কিছু প্রিন পাঞ্জাবী আড়ং এ পাওয়া যায়–এত সুন্দর। গায়ে দিলে দামী কিছুই দিতে হয়।
সন্ধ্যা হতে এখনো ঘণ্টা খানিক বাকি। এরমধ্যে পাঞ্জাবী কিনে আলমকে হোটেলে দিয়ে সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় বাসায় ফেরা যাবে। তা ছাড়া বিয়ের ব্যাপারে কতদূর কি হল সেটাও জানা দরকার। সে অরুনার সঙ্গে এসব নিয়ে আলাপ করেছে কি না তা জানার প্রয়োজন আছে। একটা ব্যাপার জামানকে বলতে সে ভুলে গেছে। অরুনাদের ফ্যামিলিতে পাগল আছে। অরুনার বড় মামা বদ্ধ উন্মাদ। মাঝে মাঝে তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। পাগলামী বংশগত রোগ। বংশে একজনের থাকলে পরবর্তী জেনারেশনে কারোর না কারোর দেখা যায়। সত্যি আবার এটা জেনে শুনেও যদি আলম বিয়ে করতে চায় করবে। তবে তাকে যদি মতামত জিজ্ঞেস করে সে কলবে–না। রিস্ক নেয়ার প্রয়োজন কি? বাংলাদেশে কি মেয়ের অভাব হয়েছে। খুঁজলে অরুনার চেয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়ে পাওয়া যাবে।
নায়লা সাড়ে সাতশ টাকা দিয়ে সিল্কের একটা পাঞ্জাবী কিনল। এক সঙ্গে এতগুলি টাকা চলে গেল কিন্তু তার তেমন খারাপ লাগল না। বরং পাঞ্জাবীটা কিনে ভাল লাগল। মনে হল আলমের ঋণ সে খানিকটা শোধ করেছে।
জামান শুনলে রাগ করবে কি? না রাগ করবে না। নায়লার ধারণা জামান খুশিই হবে। বেচারার বন্ধু বান্ধব একেবারেই নেই। একটি মাত্র বন্ধু–তাকে সে খুব পছন্দ করে।
আলম দরজা খুলে অবাক হয়ে বলল, আরে তুমি। বিগ সারপ্রাইজ। আমি তোমাদের এখানেই যাচ্ছিলাম।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। এই দেখ জামা কাপড় পরে তৈরী হয়ে আছি। সঙ্গে পেষ্ট্রির প্যাকেট। তোমার রাগ ভাঙ্গানোর জন্যে পেস্ট্রি নিয়ে যাচ্ছিলাম।
আমি কি রাগ করেছি যে রাগ ভাঙ্গাবেন?
অবশ্যই রাগ করেছ। কেন করেছ সেটাই বুঝতে পারছি না। ঐ দিন তোমার ছেলের জম্মদিনে গিয়ে লক্ষ করলাম তুমি ভীষণ রেগে আছ। কাজেই তোমাকে না ঘটিয়ে ফষ্টি নষ্টি করলাম অরুনা মেয়েটার সঙ্গে।
অরুনাকে আপনার খুব পছন্দ হয়েছে তাই না?
খুব না। তবে অপছন্দ হয় নি।
অরুনাকে বিয়ে করবেন?
ও রাজি থাকলে আমার আপত্তি নেই।
অরুনা খুব রাজি হবে।
আলম বলল, এখন বল, তুমি ঠিক সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় কোথেকে উপস্থিত হলে? নায়লা বলল, আপনার এখানে কি সন্ধ্যাবেলো আসা নিষেধ?
না নিষেধ না। তুমি এসেছ আমি ভয়ংকর খুশি হয়েছি। আমরা এক ঘণ্টা ম্যারাথন গল্প করব।
পাগল হয়েছেন? আমি এক্ষুণী বিদায় হব। আপনার জন্যে সামান্য উপহার এনেছি। উপহারটা দিয়েই বিদেয় হব।
আমার জন্যে উপহার?
হুঁ। আমি আপনার জন্য একটা পাঞ্জাবী এনেছি।
আশ্চর্য। এত প্রথম কেউ আমাকে উপহার দিল। বিশ্বাস কর নায়লা। আমি বানিয়ে বলছি না, বা মিথ্যেও বলছি না। আমি কারো কাছ থেকে কোন উপহার পাইনি।
নায়লা বলল, আমি উঠি?
অসম্ভব তোমাকে উঠতে দেয়া হবে না। তুমি চুপচাপ বসো। আমি পাঞ্জাবীটা পরে আসি। তারপর পাঞ্জাবী পরে আমরা দুজন লাউঞ্জ খাব–চা খাব। গল্প করব।
না না আমি এক্ষুণী যাব। এক্ষুণী।
আলম গম্ভীর মুখে বলল, বেশ যাও।
আপনি রাগ করবেন না। আমাকে এক্ষুণী যেতে হবে।
আমি রাগ করছি না। তোমার এক্ষুণী যেতে হলে তুমি যাবে।
আপনি রাগ করছেন।
আমি তাহলে যাচ্ছি।
আচ্ছা।
ঘরের বাইরে এসেই নায়লার মনে হল সে এরকম ছেলেমানুষী কেন করল। ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে আসার মত কি কারণ ঘটেছে? মাত্র সন্ধ্যা হয়েছে। সেতো কিছুক্ষণ থাকতেই পারতো? যে জন্যে সে এসেছে সেটাতে হয় নি–অরুনার বড় মামা যে পাগল এই কাটাতো বলা হয়নি। সে-কি আবার ফিরে যাবে? ফিরে যেতে লজ্জা লাগবে। কিন্তু লজ্জা লাগারই বা কি আছে? সে দরজার বেল টিপবে–আলম দরজা খুলবে। সে বলবে, যে কথাটা বলার জন্যে এসেছিলাম সেটাই বলতে ভুলে গেছি … আলম বলবে, ভেতরে এসে বল। সে বলবে, না যা বলার এখানে দাড়িয়ে বলে চলে যাব। আলম বলবে, কি ছেলেমানুষী করছ? দরজায় দাড়িয়ে আবার কথা কি? ভেতরে আস। সে ভেতরে যাবে তবে খুব অল্প সময়ের জন্যে …।
নায়লা করিডোরে সঁড়িয়ে আছে। সে মন ঠিক করতে পারছে না–কি করবে। পেতলের বোতামদেয়া নীল কোট পরে হোটেলের এক কর্মচারী নায়লার কাছে এগিয়ে এসে বলল, আপনি কার কাছে যাবেন।
নায়লা খতমত খেয়ে বলল, কারো কাছে যাব না। হোটেল থেকে বেরুব।
ম্যাডাম লিফট ডান দিকে।
থ্যাংক য়্যু।
নায়লা যন্ত্রের মত লিফটের দিকে এগুচ্ছে। তার এখন আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করছে না। একা একা শহরে কিছুক্ষণ ঘুরতে ইচ্ছা করছে। ভাড়ায় টেক্সি যে সব পাওয়া যায় তার একটা ঘণ্টাখানিকের জন্যে ভাড়া করে শহরে ঘুরলে কেমন হয়? ঐ সব টেক্সির ভাড়া কত?
ঘন হয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। নায়লা ফুটপাথ ধরে হাটছে। সে যাচ্ছে ফার্মগেটের দিকে। ফার্মগেটে তার পরিচিত কেউ থাকে না। তবু সে ঐ দিকে কেন যাচ্ছে নিজেও জানে না।
রাত দশটার মত বাজে। নায়লা এখনো বাসায় ফিরেনি। জামান খুবই দুঃশ্চিন্তায় পড়েছে। শীতের সময় রাত দশটা অনেক রাত। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় রাত আটটার মধ্যে তারপরেও এত রাত পর্যন্ত নায়লা বাইরে কি করছে? কোন বিপদ আপদ হয়নিতো? হয়তো কোন এক্সিডেন্ট করেছে কিংবা কোন বদলেকের পাল্লায় পড়েছে।
বাবু খুব কান্নাকাটি করছে। কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে কিছুক্ষণ আগে একগাদা বমি করেছে। বমি করে এখন প্রায় নেতিয়ে পড়েছে। মাম্রাট মান্নাট বলে–এখন সে আর কাদছে না, তবে চোখ বড় বড় করে চারদিকে দেখছে হয়ত আশা করছে যে কোন মুহূর্তে মাকে সে দেখতে পাবে।
ফিরুর মা।
জি ভাইজান?
কি করি বলতো? নায়লাতো এখনো অসিছে না।
ভাইজান চিন্তা কইরেন না। আইস্যা পড়ব।
তুমি কি একটু বাবুকে রাখবে আমি খুঁজে আসি।
কই খুঁজবেন ভাইজান ঢাকা শহরতো আফনের ছোড মোড় জাগা না।
খুবই সত্যি কথা। জামনি কোথায় খুঁজবে? না খুঁজে ঘরেই বা বসে থাকে কি ভাবে?
ভাইজান।
হুঁ।
আম্মারে আফনে ভাল ডাক্তার কবিরাজ দেখান। আম্মার ভাবগতিকে ভাল ঠেকে না।
কেন?
আম্মা রাইত ঘুমায় না।
কি বল তুমি?
কাইল শেষ রাইত দেখছি বসার ঘরে চিয়ারে চুপচাপ বসা। তার আগের রাইতেও দেখছি।
তুমি একটু বাবুকে রাখতো আমি দেখি খোঁজ নিয়ে।
বাবু ফিরুর মার কাছে যেতে তেমন আপত্তি করল না। মনে হচ্ছে সে বুঝতে পারছে তার বাবা যাচ্ছে মাআঁটকে আনতে।
জামান এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের গেটের কাছে আসতেই নায়লার দেখা পাওয়া গেল। সে বেবীটেক্সির ভাড়া মেটাচ্ছে। জামান বলল, এত দেরি?
নায়লা হাসল। প্রাণহীন হাসি জামান বলল, আমি যে কি রকম দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম … তুমি আরেকটু দেরি করলে আমার হার্ট এ্যাটাক হয়ে যেত। নায়লা কিছু বলল না। তার হাতে বাবুর লাল বল। বেবীটেক্সিতে করে সে একটা ফুলের টবও এনেছে। ঢাকা কলেজের সামনে থেকে কিনেছে। রাবার গাছের চারা।
জামান আবার বলল, তুমি কোথায় ছিলে?
নায়লা বলল, রাস্তায়।
নায়লা লিফটের দিকে এগুচ্ছে। জামান বলল, তোমাকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হবে। লিফট আজ সন্ধ্যা থেকে নষ্ট।
নায়লা নিঃশব্দে সিড়ি ভাঙ্গছে। জামানের কাছে খুব অবাক লাগছে যে নায়লা এখনো জিজ্ঞেস করছে না–বাবু কেমন ছিল? কেন সে জানতে চাচ্ছে না? এ রকম করছে কেন শায়লা?
বাসার দরজার কাছে এসে নায়লা থমকে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল–বাবু কান্না কাটি করেছিল?
জামান মিখ্যা করে বলল, অল্প তেমন না।
বাবু ঘুমুচ্ছে। তার গাল ভেজা। নায়লা ছেলেকে দেখল কিন্তু আদর করল না। বাবুর গালে মশা বসেছে, নায়লা মশাটাকেও মারল না।
ফিরুর মা গোসলের পানি দাও তো?
আফনে ছিলেন কই আম্মা। চিন্তায় চিন্তায় ভাইজানের মুখ শুকাইয়া বস্টি হইয়া গেছে।
তোমাকে গোসলের পানি দিতে বলছি পানি দাও। বাবুর উপর মশারি খাঁটিয়ে দিয়ে যাও।
জামান লক্ষ্য করল নায়লা তার চোখে চোখে তাকাচ্ছে না। এমন ভাব করছে যেন ঘরে দ্বিতীয় প্রাণী নেই। জামনি বলল, কেনাকাটা কি করেছ?
কিছু করি নি।
জামান বলল, তুমি কিছুদিন তোমার বাবা-মার সঙ্গে থাক।
কেন?
এতে তোমার অস্থির ভাবটা দূর হবে।
আমার অস্থির ভাব তোমাকে কে বলল?
কেউ বলেনি–দেখতে পাচ্ছি।
বেশি দেখতে যেও না। বেশি দেখা ভাল না। বেশি দেখতে গেলে আফসোসের সীমা থাকবে না। এক সময় চিৎকার করে বলবে, হায় হায় কেন বেশি দেখতে গেলাম…
তোমার কথাবার্তা বুঝতে পারছি না।
না বোঝাই ভাল।
তুমি কদিন তোমার বাবা মার সঙ্গে থাকলে আমার সুবিধা হয়। দেশের বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে পারি। অনেক দিন যাওয়া হয় না। যাওয়াও দরকার …।
যাওয়া দরকার হলে যাও। আমাকে নিয়ে এত চিন্তার কিছু নেই। আমি কোথাও যাব না। এই এখানেই থাকব। তুমি যা ভাবছে তা হবে না।
আমি কি ভাবছি?
নায়লা কঠিণ গলায় বলল, তুমি ভাবছ–তুমি দেশের বাড়িতে চলে যাবে। খালি ফ্ল্যাট পরে থাকবে–রোজ আলম আসবে। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করবে। কোন কোন বার রাত এত বেশি হবে যে সে হোটেলে ফিরবে না। থেকেই যাবে।
জামান অবাক হয়ে বলল, আমি কখনো এরকম কিছু মনে করিনি। কখনো না।
সাধু সাজতে যেও না। আমার কাছে সাধু সেজে পার পাবে না। আমার দেরি দেখে তুমি যে অস্থির হয়েছ, কি জন্যে অস্থির হয়েছ তুকি মনে করেছ আমি জানি না? খুব ভাল করে জানি। তুমি ভেবেছ আমি তোমার বন্ধুর হোটেলে বসে আছি।
আমি এরকম কিছু ভাবি নি নায়লা।
তোমার বন্ধুর সঙ্গে আমার অবশ্যি দেখা হয়েছে। তাকে একটা জিনিস দিতে গিয়েছিলাম। এত কোথায় ছিলাম তাও বলি–খানিকক্ষণ রাস্তায় ঘুরেছি তারপর অরুনার বাসায় গিয়েছিলাম। এখন তুমি কি আমাকে জেরা করতে চাও? জেরা করতে চাইলে জেরা কর।
জামান তাকিয়ে আছে। ফিরুর মা বাথরুমে পানি দিয়ে এসে খবর দিল। নায়লা শান্তভঙ্গিতে বাথরুমে ঢুকল। সারাগায়ে সাবান মেখে আজ সে অনেকক্ষণ গোসল করবে। গোসল করে সে ছাদে বসে গরম এক কাপ কফি খাবে। ইনস্ট্যান্ট কফির একটা কৌটা সে কিনে এনেছে। কফি খেতে ভাল লাগে না, কিন্তু কফির গন্ধটা সুন্দর!
জামান বাবুর পাশে শুয়েছিল। তার চোখ বন্ধ কিন্তু নায়লা বুঝতে পারছে সে জেগে আছে। নায়লা চুল আঁচড়াল। কাজলদানী থেকে কাজল দিল। কি মনে করে ঠোটে লিপিস্টিক দিল। আয়নায় নিজেকে খানিকক্ষণ দেখল। তারপর রান্নাঘরে ঢুকল কফি বানাতে। ফিরুর মা ভাত তরকারী গরম করছে। ফিরুর মা বলল, ভাত খাইবেন না আম্মা?
না। তোমার ভাই খেয়েছে?
না ভাইজানও খায় নাই। ভাইজান সন্ধ্যাকালেই বলছে ভাত খাইব না–তার শইল খারাপ।
তুমি ভাত খেয়ে শুয়ে পর।
আমি ভাত কোন কালেই খাইছি। আমরা হইলাম গরীব মানুষ, ভাত না খাইলে আমরার পুষে না। ধনীর উল্টা নিয়ম ভাতের বদলে চা খাইলেও পুষে।
ফিরুর মা, তুমি যেমন গরীব আমরাও সে রকম গরীব। ধনী কাকে বলে তুমি জান না।
না জানাই ভাল আম্মা।
এটা ঠিক বলেছ না জানাই ভাল। ফিরুর মা ছাদে পাঠি টা পেতে দিয়ে এসে তো।
ও আল্লা এই শীতে ছাদে বইবেন? মাথার উপরে তো আম্মা উস পড়ব।
পড়ুক। আর শোন এই দুটা কাপ ছাদে রেখে এসো।
বড়লোকের কাজ কারবার বোঝা বড় দায় তো আম্মা। বড়লোক হইল আম্মা আল্লাপাকের এক আজব জীব।
হয়েছে কথা বন্ধু।
নায়লা জামানের গায়ে হাত রেখে নরম গলায় বলল, এই আস তো।
জামান উঠে বসল। নায়লা কোমল গলায় বলল, এক টিন কফি কিনেছি। এসে বড়লোকদের মত কফি খাই।
নায়লা হাত ধরে জামানকে নামাল। জামানের বিস্ময়ের সীমা রইল না। নায়লার ব্যাপারটি। সে এরকম করছে কেন? নায়লা বলল, আমার কথাবার্তা শুনে তোমার আক্কেল গুড়ুম হয়েছে তাই না? রাগ করো না। হাত জোড় করে ক্ষমা চাচ্ছি। এই দেখ তোমাকে ভুলানোর জন্যে রাত দুপুরে সেজেছি।
আমাকে ভুলানোর কোন দরকার নেই।
দরকার আছে। স্ত্রীর উচিত স্বামীকে ভুলানোর চেষ্টা করা আবার স্বামীর উচিত স্ত্রীকে ভুলানো! তুমি আমাকে ভুলানোর জন্যে কখনোই কিছু কর না। আমি কিন্তু করি।
জামান কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, তোমাকে ভুলানোর জন্যে আমি কখনো কিছু করি না–কারণ আমি জানি তোমাকে ভুলানোর কোন দরকার নেই।
এটা কিন্তু ভুল। খুব ভুল।
না ভূল না। তা ছাড়া নায়লা ভূলানোর কায়দা কানুনও আমি জানি না।
মেয়েদের বিশেষ করে স্ত্রীদের ভুলানো অসম্ভব সহজ। মন্ত্রীরা যে সব জিনিস পছন্দ করে–মাঝে মধ্যে সেই সব করবে।
জামান হালকা গলায় বলল, তুমি বেড়াতে পছন্দ কর। টাকা পয়সা খরচ করতে পছন্দ কর। আমি সেই সব পছন্দ মেটাব কি করে বল।
থাক তোমাকে মেটাতে হবে না। মাঝে মাঝে আমাকে তুমি গয়নার দোকানের সামনে দিয়ে ঘুরিয়ে আনবে। না-কি সেটাও পারবে না?
পারব।
শুধু শুধু চা খাচ্ছ যে তোমার সিগারেট নেই?
না।
আমার কাছে চাচ্ছ না কেন?
আছে তোমার কাছে?
অবশ্যই আছে। আজ নিউ মার্কেটে গিয়ে প্রথম যে জিনিসটা কিনেছি সেটা হচ্ছে এক প্যাকেট সিগারেট। রাস্তায় দাড়িয়ে যে সিগারেট বিক্রি করে ওদের বললাম, সবচে দামী সিগারেট এক প্যাকেট দিন তো। সেই এই সিগারেট দিল। খেয়ে দেখতে কেমন?
দাম কত?
দাম শুনলে তো তুমি আর খেতে পারবে না। কাশতে থাকবে। একশ কুড়ি টাকা দাম।
সর্বনাশ। তোমার সাহসের তো নায়লা সীমা পরিসীমা নেই–একশ কুড়ি টাকা দিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট কিনলে? একটা শলার দাল ছ টাকা।
এত দাম হিসাব করতে হবে না। খাও তো। আর শোন আমিও কিন্তু একটা টান দেব। তুমি হাসতে পারবে না। দামী সিগারেটে একটা টান দিয়ে দেখি কেমন লাগে।
সত্যি টান দেবে?
হুঁ।
নায়লা সিগারেটে টান দিয়ে খুকখুক করে কাশতে লাগল। তার চোখে পানি এসে গেছে। সে চোখ মুছতে মুছতে বলল–সর্বনাশ।
জামান হাসছে।
নায়লা বলল, শখ করে কেউ এই জিনিস খায়?
জামান বলল, ঠাণ্ডা লাগছে চল ভেতরে যাই।
নায়লা বলল, আর একটু বস পাঁচ মিনিট।
দুজন চুপচাপ বসে আছে। জামান তাকিয়ে আছে নায়লার দিকে। নক্ষত্রের আলোয় কি সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে।
জামান বলল, তোমার মনে কি অনেক কষ্ট নায়লা?
নায়লা সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ্যাঁ।
কেন বলতো?
কি হবে বলে।
একেকজন মানুষের একেক রকম কষ্ট। তোমার কষ্টটা কি রকম শুনে দেখি।
নায়লা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল–ছোটবেলা থেকে আমার খুব গানের শখ ছিল। আমি অন্যের কাছে শুনে শুনে গান তুলতাম। সবাই বলতে এত ভাল গলা। এত ভাল গলা। ক্লাস ফাইভে যখন পড়ি তখন আমাদের স্কুলের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে খুব বড় একটা ফাংশান হয়েছিল। শিক্ষামন্ত্রী এসেছিলেন। সেখানে আমি একটা গান গয়েছিলাম। উনি আমাকে কোলে নিয়ে বলেছিলেন — এই মেয়ে গান গেয়ে একদিন ভুবন বিখ্যাত হবে। আজ তো তুমি দেখছই ভুবন বিখ্যাতের নমুনা। চল ঘুমুতে যাই। আসলেই ঠাণ্ডা লাগছে।
তোমার বাবা গান শেখার কোন ব্যবস্থা করে দেন নি?
কোত্থেকে দেবেন? ভাত খাবার পয়সা নেই। আমাদের স্কুলের গানের অপা আমাকে একটা হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছিলেন। বাবা সেই হরিমোনিয়াম রাখেন নি ফেরত পাঠিয়েছিলেন।
কেন?
জানি না কেন? আমি শুধু কেঁদেছি–বাবাকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। মানুষের সব দুঃখ একসময় কমে যায়। আমার গান শিখতে না পারার দুঃখ কোনদিন কমবে না। যখন কোন সুন্দর গান শুনি তখনই মনে হয়–আমিতো এরচে সুন্দর গাইতে পারতাম। চল ঘুমুতে যাই। ও আচ্ছা তোমাকে কিন্তু আরেকটা কথা বলা হয়নি। আমি তোমার বন্ধুকে একটা পাঞ্জাবী কিনে দিয়েছি। উনি এত উপহার দিয়েছিল আমার লজ্জা লাগছিল।
পাঞ্জাবী দিয়েছ ভাল করেছ।
নায়লা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
দুটা স্যুটকেস, একটা বড় ঝুড়ি
দুটা স্যুটকেস, একটা বড় ঝুড়ি ভর্তি বাবুর জিনিসপত্র নিয়ে নায়লা তার মার বাসায় উপস্থিত হল। ফিরুর মা সঙ্গে এসেছে। বাবু তার কোলে বসে আছে। জামান আসেনি। সে ১০ টার ট্রেনে দেশের বাড়িতে চলে যাবে।
মোর্তজা সাহেব মেয়েকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, ব্যাপার কি কে?
নায়লা বলল, কোন ব্যাপার না। তোমাদের দেখতে এলাম। তোমরা কেমন আছ বাবা?
আমি ভালই আছি। শুধু তোর মার অবস্থা কাহিল। দাঁত ব্যথা।
দাঁত ব্যথাতো অনেক আগেই শুনেছি। এখনো সারে নি?
একটা সেরেছে আরেকটা শুরু হয়েছে সারাজীবন আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে এখন শোধ বোধ হচ্ছে। আল্লাহ কাউকে ছাড়েন না। শোধ বোধ করে দেন।
কি যে তুমি কল বাবা।
সত্যি কথা বলি। তোর ব্যাপারটা কি? কথা বালিশ নিয়ে উঠে এসেছিস। জামানের সঙ্গে ঝগড়া।
না ঝগড়া টগড়া না। আমি তোমাদের সঙ্গে কিছুদিন থাকতে এসেছি। নিজের মত করে থাকব।
জামান একা থাকবে?
দু একদিন থাকবে এক।
খাবে কি?
বিয়ের আগেতো একা থাকতো। তখন ভাত খেতো না? একটা ব্যবস্থা করে নেবে।
তোদের ঝগড়া কি নিয়ে?
বললাম তো ঝগড়া না।
মোর্তজা সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন–যা তুই তোর মার সঙ্গে কথা বল। ফিরুর মা, তুমি থাক। তোমার সঙ্গে কথা আছে। এটাকে কোলে নিয়ে ঘুরছ কেন? নামিয়ে দাও। কোলে নিলেই বাচ্চা কাচ্চা নষ্ট হয়। এখন বল–ওদের ঝগড়া কি নিয়ে?
ঝগড়া হয় নাই।
ঝগড়া হয় নি?
জে না। ভাইজান ঝগড়ার মানুষ না।
বিনা ঝগড়ায় জামানকে ফেলে নায়লা চলে এসেছে। এটাতো অবিশ্বাশ্য ব্যাপার। যাই হোক তুমি চা বানাতে পার?
পারি।
যাও আমার জন্য চা বানাও। চিনি কম, দুধ কম।
মোতৰ্জা সাহেব চিন্তিত মুখে তার ইজিচেয়ারে বসলেন।
জাহানারার দাঁত ব্যথা কাল রাত পর্যন্তও প্রচণ্ড ছিল। সারারাত ঘুমুতে পারেন নি। এখন একটু কম। লবন পানি দিয়ে অনেকক্ষণ গার্গল করায় ব্যথা সহনীয় পর্যায়ে এসেছে। তবে গাল ফুলে বিশ্রী হয়ে আছে।
নায়লা বলল, ডাক্তারের কাছে যাওনি মা?
কে নিয়ে যাবে ডাক্তারের কাছে? তোর বাবা নিবে না। নুরুর তো কোন খোঁজ নেই। ফেরে রাত বারটা একটায়। আমি কি একা ডাক্তারের কাছে যাব?
দরকার হলে যাবে।
জাহানারা আহত গলায় বললেন, আমি ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছি–তোর বাবা খুশি। আমি সারাজীবন তার সঙ্গে যে খারাপ ব্যবহার করেছি এটা নাকি তার শাস্তি। আমি ককে খারাপ ব্যবহার করলাম এটাইতো জানি না।
নায়লা বিরক্ত গলায় বলল, বুড়ো হলে মানুষের মতিভ্রম হয়। বাবার হয়েছে। তোমাকে আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব মা। তুমি চিন্তা করো না।
জামান কখন আসবে?
ও আসবে না। আমি একা একা কয়েকদিন থাকব।
কেন?
মাঝে মাঝে পুরানো দিনের মত থাকতে ইচ্ছা করে না? আমার ইচ্ছা ছিল বাবুকেও তার বাবার ঘাড়ে ফেলে একা এসে তোমাদের সঙ্গে থাকব।
জাহানারা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে শংকিত গলায় বললেন, তোদের কি কোন সমস্যা হয়েছে। সত্যি কথা বল। আমার দিকে তাকিয়ে বল।
কোন সমস্যা হয় নি।
তুই সত্যি কথা বলছিস না।
আমি সত্যি কথাই বলছি। আমাদের কোন সমস্য নেই শুধু …
শুধু কি?
ওকে আমার এখন আর সহ্য হচ্ছে না।
এর মানে কি?
জানি না ওর মানে কি। দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকলে এটা বোধহয় একঘেয়ে লাগে।
তুই পাগলের মত কথা বলছিস কেন? একঘেয়ে লাগার কি আছে? আমি আর তোর বাবা যে এতদিন একসঙ্গে আছি আমাদের কি ঘেয়ে লাগছে।
অবশ্যই লাগছে। লাগছে বলেই তোমার বাত ব্যথা হলে বাবা এখুশি হয়।
তোর বাবার মাখাটা একটু খারাপ এই জন্যেই সে এরকম বলে–এটা তার মনের কথা না।
বাবার যেমন মাথা খারাপ, আমারো তেমন মাথা খারাপ। আমিতো বাবারই মেয়ে। এইসব নিয়ে তুমি চিন্তা করবে নাতো মা।
আমি চিন্তা করবনাতো কে চিন্তা করবে?
তুমি তোমাকে নিয়ে চিন্তা করবে। আমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করব। মা আমি কোন ঘরে থাকব।
জাহানারা চিন্তিত গলায় বললেন, তুই কি অনেক দিনের জন্যে এসেছিস?
জানি না। আমার জিনিসপত্র কোন ঘরে তুলক সেটা বল। আমি অমাির আগের ঘরটায় থাকব না।
ঐ খানে তো নুরু থাকে।
এখন থাকবে না?
ও খুব হৈচৈ করবে।
ও হৈ চৈ করলে আমিও হৈ চৈ করব। মেয়ে হয়েছি বলে আমি হৈ চৈ কম জানি তোমাকে কে বলল?
জাহানারার দাঁত ব্যথা পুরোপুরি সেরেই গিয়েছিল। মেয়ের কান্ড কারখানায় জন্যেই হয়ত সেই ব্যথা আবারো শুরু হল। অসহ্য ব্যথা। তিনি চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলেন।
নায়লা।
কি মা?
জামানতো অসম্ভব ভাল একটা ছেলে–ওর সঙ্গে কি নিয়ে তুই লাগলি?
এক কথা কতবার বলব?
খুব চিন্তা লাগছেরে মা।
চিন্তার কিছু নেই। জামানের সঙ্গে আমার কোন ঝামেলা হয় নি। ও দেশের বাড়িতে গেছে। কদেকদিন থাকবে। তারপর চলে আসবে।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
জাহানারার দাঁতের ব্যথা আবারো কিছুটা কমল।
নুরু বাসায় ফিরে তার নির্বাসিত অবস্থায় রাগ করল না, বরং বোন কে দেখে আনন্দিত হল বলেই মনে হল। নায়লা বলল, আমার শাড়ি কোথায়? টাকা নিয়ে যে গেলি শাড়ি কোথায়?
আর বল কেন আপা। হারামজাদাতে আমার টাকা মেরে দিয়েছে। আমি জান। দিয়ে তার শাড়ি বেচলাম। তোর শাড়িটার জন্যে টাকা দিলাম। বলল, দুপুরে এসে নিয়ে যেতে তখনই সন্দেহ করা উচিত ছিল যে সামথিং ইজ রং। কিছু বুঝতে পারি নি। মর্থন বুঝতে পেরেছি তখন ইট ইজ টু লেট।
আমার এক হাজার টাকা গেল?
পাগল হয়েছে। তোমার টাকা বাবে যানে–টাকা না দিয়ে ব্যাটা যাবে কোথায়? আমি শুওরের বাচ্চার কানে ধরে সারা শহর চক্কর দেওয়াবো না? আমার টাকা হজম করবে এমন মানুষ এখনো পয়দা হয় নি।
নায়লা গম্ভীর গলায় বলল, আমার মনে হয় তুই মিথ্যা কথা বলছিস। সবার সঙ্গে ফটকাবাজি করে করে তোর এমন অভ্যাস হয়েছে–বাবা মা, ভাই বোন সবার সঙ্গেই ফটকাবাজী শুরু করেছিস।
আমার সম্পর্কে তোর এই ধারণা অত্যন্ত নির্ম।
কঠিণ কঠিণ বাংলা আমাকে বলার দরকার নেই। তোর দুলাভাই নিতান্তই গরীব মানুষ। তার খুব কষ্টের টাকা।
বললামতো তোর টাকা তুই পেয়ে যাবি। খুব বেশি হলে এক সপ্তাহ। শুধু যে টাকা পাবি তাই না। শাড়িও পাবি। শাড়িটা ফাউ!
নায়লা কঠিণ চোখে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে নুরু শীষ দিতে দিতে বারান্দায় চলে এল। বারান্দায় বাবু খেলছে। বাবাকে ছেড়ে এ বাড়িতে এসে শুরুতে তার মনটা খারাপ ছিল। এখন মন খারাপ ভাব নেই। ছোট মামার সঙ্গে তার বেশ ভাব হয়েছে। ছোটমামা একটা ইঁদুর মেরে ইঁদুরের লেজে সুতা বেঁধে তার হাতে দিয়ে দিয়েছে। বাবু সেই সুতা বাধা ইঁদুর নিয়ে মহানন্দে ঘুরছে।
বাবু ছোটমামাকে দেখে আনন্দিত গলায় বলল, মামা ইন্দুল।
নুরু উদাস গলায় বলল, হ্যাঁ বাবা ইল। ইঙ্গুল দিয়ে আপাতত খেল। দেখি যদি পারা যায় একটা বিড়াল মেরে গলায় দড়ি বেঁধে হাতে দিয়ে দেব। এতে আরো মজা পাবে।
বাবু হাসল। মামার কথাতেই সে মজা পাচ্ছে।
নায়লার অস্থির ভাবটা কেটে গেছে। মার বাড়িতে থাকতে তার ভালই লাগছে।
একজন বিবাহিত মেয়ে কোনদিনই কুমারী জীবনে ফিরে যেতে পারে না, কিন্তু কাছাকাছি হয়ত যাওয়া যায়। চেষ্টা করলেই যাওয়া যায়। নায়লা সেই চেষ্টা প্রাণপন করছে। দিনের বেলা সে সেজেগুজে ঘুরতে বের হয়।
এই সময় তার খুব ব্যস্ত ভঙ্গি থাকে। যেন জরুরি কোন কাজে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই।
একদিন সাভার স্মৃতিসৌধ (থকে একা একা ঘুরে এল। একগাদা মাটির খেলনা নিয়ে এল। চীন মৈত্রী সেতুও দেখা হল। সুন্দর বানিয়েছে। জোছনা রাতে এই সেতুর উপর হাঁটাহাটি করতে নিশ্চয়ই ভাল লাগবে। ছেলে হয়ে জন্মালে এই কাজটা করা যেত। আচ্ছা, চুল ছোট করে কেটে শার্ট-প্যান্ট পরে ছেলে সাজলে কেমন হয়? তাহলে নিশ্চিন্ত মনে ঘোরাঘুরি করা যায়। মেয়েরা এতদিন ধরে পুরুষের পাশাপাশি রাস্তায় হাঁটছে। তারপরেও পুরুষরা অভ্যস্ত হচ্ছে না কেন? এখনো কেন মেয়ে দেখামাত্র আড়চোখে তাকিয়ে থাকতে হবে?
অরুনার অফিসে এক সকালে নায়লা গিয়ে উপস্থিত। প্লন-প্রোগ্রাম করে যে যাওয়া ত্যা না। রিকশা করে মতিঝিলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল–হঠাৎ মনে হল, আরে এইখানেই তো অরুনার অফিস। নায়লা রিকশাওয়ালাকে বলল, ভাই থামুন তো। থামুন।
অরুনা খুশি-খুশি গলায় বলল, আরে তুই! ব্যাপার কি?
তোকে দেখতে এলাম। তুই ব্যস্ত না কি?
অসম্ভব ব্যস্ত। দেখছিস না তিনটা টেলিফোন সাজিয়ে বসে আছি। তুই কি কোন কাজে এসেছিস, না এম্নি এসেছিস?
এম্নি এসেছি।
তাহলে এই চেয়ারে চুপ করে বসে থাক। দশ মিনিটের মধ্যে আমাদের লাঞ্চ ব্রেক হবে–তখন তোকে নিয়ে লাঞ্চ করব। দশ মিনিট চুপচাপ বসে থাকতে পারবি?
পারব মনে হয়।
নায়লা চুপচাপ বসে রইল। অরুনা আসলেই ব্যস্ত। এই টেলিফোন বাজাছ। লোক আসছে। তাকে ডেস্ক ছেড়ে দোতলায় যেতে হচ্ছে, আবার নামতে হচ্ছে। দশ মিনিটের জায়গায় পুরোপুরি চল্লিশ মিনিট পার করে শাড়ির আঁচলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে অরুনা বলল, চল যাই।
কোথায় যাব? কোন একটা চাইনীজে ঢুকে দুপুরের খাওয়া খাই–তারপর চুটিয়ে আড্ডা। আমাকে আর অফিসে যেতে হচ্ছে না। ছুটি নিয়েছি আড্ডা দেবার জন্যে। অনেক সিরিয়াস ধরনের কথা আছে তোর সঙ্গে। আজ তোর সঙ্গে দেখা না হলে বিকেলে তোর বাসায় যেতাম।
কেন মিথ্যা কথা বলছিস?
অরুনা হাসল। তার কাধের ঝুলানো ব্যাগ খুলে এপয়েন্টমেন্ট বুক বের করে দেখাল যে, আজকের তারিখে লেখা আছে–নায়লার বাসা।
বিশ্বাস হল?
হুঁ।
অরুনা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আজকাল কেউ মুখের কথা বিশ্বাস করতে চায় না। সবাই চায় ভকুমেন্টস। কিছুদিন পর দেখবি মানুষ কথা বলা ভুলে গেছে, সবাই শুধু লেখা চালাচালি করছে। ফ্যাক্স পাঠাচ্ছে, নোট পাঠাচ্ছে।
তারা বসেছে একটা মিনি চাইনীজ। মিনি চাইনীজ মানে সেখানে একজন-দুজনের খাবার অর্ডার দেয়া যায়। চাইনীজের সঙ্গে ফাস্ট ফুড আছে। কেউ দুটা সিঙ্গারা, এক কাপ চা খেতে চাইলে সেই ব্যবস্থাও আছে। অরুনা বলল, নায়লা, তুই কি খাবি বল?
তুই যা খাবি আমিও তাই খাব।
আমি খাব একবাটি স্যুপ। দুপুরে আমি এর বেশি কিছু খাই না। যদি মোটা হয়ে যাই! এম্নিতেই বিয়ে হচ্ছে না, মোটা হলে কি আর উপায় আছে? একবার বিয়েটা শুধু হোক, তারপর দেখবি দিনরাত খাব। খেতে খেতে গ্যাস বেলুনের মত ফুলব।
তখন অসুবিধা হবে না?
না। বিয়ের আগে ছেলেরা চায় দুবলা-পাতলা মেয়ে। বিয়ের পর চায় স্বাস্থ্যবতী স্ত্রী। বল তুই কি খাবি?
আমি স্যুপ খাব।
না, স্যুপ-টুপ না আয় আজ আমরা ফুল কোর্স লাঞ্চ করি। তোর সঙ্গে অনেক কখা আছে। ধীরে ধীরে খাব আর কথা বলব।
কি কথা?
বলছি, দাঁড়া। আগে অর্ডার দিয়ে নেই।
খাবারের অর্ডার দিয়ে অরুনা একটু ঝুঁকে এল নায়লার দিকে। গলার স্বর খানিকটা নামিয়ে বলল, তোর স্বামীর বন্ধু ঐ যে আলম সাহেব, উনার খবরটা কি বল তো?
কি খবর?
মানুষটার ভাবভঙ্গি কিছু বুঝতে পারছি না। ঐদিন তোর বাসায় দেখা হল। তার হাবভাব দেখে মনে হল আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। যাবার সময় আমার টেলিফোন নাম্বার নিলেন। বাসার মেইলিং এড্রেস লিখে রাখলেন। তারপর আর খোঁজ নেই। শেষে লজ্জার মাথা খেয়ে আমি টেলিফোন করলাম। টেলিফোন করে ধাক্কা খেলাম।
কেন?
উনি আমাকে চিনতে পারছেন না। বললেন, কোন অরুনা, শেষে বললাম, নায়লার বান্ধবী।
তখন চিনতে পারলেন?
হ্যাঁ তখন চিনলেন। অনেকক্ষণ গল্পও করলেন।
কি নিয়ে গল্প?
কি নিয়ে গল্প সেটা বলার জন্যেই তোকে এখানে নিয়ে এসেছি। সব গল্প তোকে নিয়ে।
নায়লার হাত-পা শিরশির করতে লাগল। অরুনা ছোট্ট করে হাসল। হাসিমুখে কলল, নায়লা শোন–আমি তো ঘরবন্দি কোন মেয়ে না। পুরুষের সমান তালে বাস করে এমন একটি মেয়ে। রিসিপসনিস্টের কাজ করি। প্রতিদিন কম করে হলেও একশ পুরুষের সঙ্গে মিশতে হয়। বেদে যেমন সাপের হাঁচি চেনে, আমিও তেমন পুরুষের হাচি চিনি। ঐ লোকের সঙ্গে তোর সম্পর্ক কোন পর্যায়ে?
তার মানে?
তার মানে হচ্ছে তোরা এই সম্পর্ক কোন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিস? কথাবার্তা, হাত ধরাধরি এই স্তরে রেখেছিস, না শরীরের স্তরে নেমে গেছিস?
নায়লা চোখ মুখ লাল করে বলল, তুই অত্যন্ত আপত্তিজনক কথা বলছিস।
আমি কোনই আপত্তিজনক কথা বলছি না। সরাসরি কথা বলছি। পর্দার আড়ালে কথা চালচিালি আমার পছন্দ না। তুই যাসনি ভদ্রলোকের হোটেলে?
হ্যাঁ গিয়েছি।
একজন সুপুরুষ মানুষ দামী একটা হোটেলে একা একা ঘর ভাড়া করে আছে–সুন্দরী এক তরুণী অসময়ে সেই ঘরে উপস্থিত হল। মানুষটা হোটেলের দরজা টেনে বন্ধ করে দিল–তখন কি হয় বল তো?
আমি জানি না কি হয়।
আমি খুব ভাল করে জানি কি হয়! দরজা বন্ধ করা মাত্রই দুটি মানুষ সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তারা হয়ে যায় পৃথিবীর একমাত্র মানব-মানবী। আর কেউ নেই। আর কারোর অস্তিত্ব নেই। শরীর তখন মনের কথা মানে না। শরীর তখন তার নিজের ভাষায় কথা বলতে চায়।
নায়লা কঠিন গলায় বলল, তুই নিজেকে দিয়ে সবাইকে বিচার করবি?
হ্যাঁ করব। কারণ আমি আলাদা কেউ না। আমি অন্য সবারই অংশ।
নায়লা কিছু খাচ্ছে না। হাত গুটিয়ে বসে আছে। অরুনা কাঁটা চামচে নির্বিকার ভঙ্গিতে খেয়ে যাচ্ছে–আরেকজন যে বসে আছে চুপচাপ সে দিকে তার দৃষ্টি নেই।
নায়লা!
বল।
তুই কি সাহসী মেয়ে?
সাহসী মেয়ে হলে আমাকে কি করতে হবে?
সাহসী মেয়ে হলে বাস্তবকে স্বীকার করতে হবে। নিজে চোখ বন্ধ করে থাকবি এবং ভাববি, সমস্ত পৃথিবী চোখ বন্ধ করে আছে তা তো হয় না। ঐ লোক তোর সম্পর্কে কি ভাবছে না ভাবছে সেটা বাদ দে। তুই নিজে কি ভাবছিস?
আমি কি ভাবছি সেটা জানার তোর কি দরকার?
দরকার আছে। তাদের এই ব্যক্তিগত ঝামেলায় তুই আমাকে এনে ফেলেছিস। আমার এখানে জড়িয়ে পড়ার কথা ছিল না। আমি জড়িয়ে গেছি। মানুষটাকে আমার পছন্দ হয়েছে। বিদেশে যারা থাকে তারা চালবাজ ধরনের হয়। দেশে এসে বড় বড় চাল দিতে চেষ্টা করে। এই লোক তেমন না।
কি করে বুঝলি?
আমি খুব প্রাকটিক্যাল মেয়ে নায়লা। আমি ভাববাচ্যে চলি না, অনুমানের উপরও চলি না। আমি খোঁজ-খবর করি। নিউ জার্সিতে আমার যে চাচা আছেন আমি তাকে টেলিফোন করে বলেছিলাম ভদ্রলোক সম্পর্কে খোঁজ নিতে। খুব ভাল করে খোঁজ নিতে। উনি খোঁজ নিয়ে জানিয়েছেন।
কি জানা গেল?
জানা গেল যে, ভদ্রলোক শুরুতে আমেরিকা এসে পেট্রোল পাম্পে পেট্রোল ঢালার কাজ করতেন। তারপর ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা শুরু করেন। তাঁকে শুরু করতে হয় একেবারে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট থেকে। তিনি অসাধারণ ভাল রেজাল্ট করেন। পাশ করার পর চাকরি নেন ইউনিয়ন কার্বাইডে। ইউনিভার্সিটিতে কাজের উপর তার তিনটি পেটেন্ট ছিল। সেই তিনটি পেটেন্ট বিক্রি করে এক মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পেয়ে যান। বুঝতে পারছিস কিছু?
বোঝার চেষ্টা করছি।
অগা-মগা-বগা জাতীয় কেউ হলে তার প্রেমে পড়া দোষণীয় হত। এই লোকের প্রেমে পড়ে তুই কোন অন্যায় করিসনি।
নায়লা উঠে দাঁড়াল। এই জাতীয় কথা শোনার তার আর ধৈর্য নেই। অরুন সহজ গলায় বলল, চলে যাচ্ছিস?
হ্যাঁ
এতক্ষণ যা বলেছি সব নকল কথা। আসল কথা বলিনি।
কোন কথাই শুনতে চাচ্ছি না।
ভাল। শুনতে না চাইলে শুনবি না–তবে আমার কিছু কথা আছে, তা তোর নিজের স্বার্থেই শোনা উচিত।
তোকে আমার স্বার্থ দেখতে হবে না।
আলম সাহেব হোটেলে থাকেন না। হোটেল ছেড়ে দিয়ে এ্যাপার্টমেন্টে উঠে গেছেন। সেই ঠিকানা আমি ছাড়া কেউ জানে না। তুই আমার সাহায্য ছাড়া তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবি না।
তার সঙ্গে যোগাযোগের আমার দরকার কি?
দরকার না থাকলে খুবই ভাল। তোর জন্যেও ভাল, আমার জন্যেও ভাল। আমি তখন নিশ্চিন্ত মনে বিয়ে করে হানিমুন করবার জন্যে সুইজারল্যান্ড যেতে পারি।
নায়লা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তুই আমার সঙ্গে এরকম করছিস কেন? অরুনা বলল, নায়লা বোস। সহজ হয়ে বোস। তোর মনের ভিতর কি আছে বল। একজন কাউকে তো মনের কথা বলতে হবে। বলতে না পারলে তুই তো মরে যাবি! তুই কি আজকাল আয়নায় নিজেকে দেখেছিস? তোকে দেখাচ্ছে পেত্নীর মত। করাত ধরে তোর ঘুম হচ্ছে না ঠিকমত বল তো?
নায়লা বসল। তার কান্না পাচ্ছে। অদ্ভুত ধরনের কান্না। সমস্ত শরীর ভেঙে আসছে। গলায় কান্না জমাট বেঁধে আটকে আছে। কিন্তু চোখ শুকনো!
লায়লা।
হুঁ।
হাত না দেখে আমি বলে দেই তোর কি হবে। ভয়ংকর কিছু তোর জীবনে ঘটতে যাচ্ছে। তোর ছিল সুখী সংসার। হঠাৎ একদিন তুই টের পেলি এটা আসলে সুখী সংসার না। মেকি সংসার। স্বামীকে সহ্য হচ্ছে না–আবার ফেলতেও পারছিস না। ভালবাসার কথা কাউকে বলতে পারছিস না, আবার গোপন রাখতে পারছিস না। বার বার মানুষটার কাছে ছুটে যাচ্ছিস। আবার ঘরে ফিরে চিৎকার করে নিজেকে জিজ্ঞেস করছিস–আমি কি করছি? আমি কি করছি? তোর স্নায়ু চুড়ান্ত রকমের উত্তেজিত। তোর ঘুম হচ্ছে না। তুই অস্বাভাবিক আচরণ করছিস–কিন্তু আচরণগুলি যে অস্বাভাবিক ত্যও ধরতে পারছিস না। এক সময় অস্বাভাবিকতা চূড়ান্ত পর্যায়ে যাবে। তুই সেই লোকের কাছে যাবি এবং বিশ্রী কিছু কাণ্ড করবি। বাসায় এসে তোর স্বামীর কাছে, তোর ছেলের কাছে যখন পাঁড়াবি তখন মনে হবে–আমি কি করেছি। আমি কি করেছি! বুঝলি নায়লা, এই পর্যায়ে মানুষ পাগল হয়, এই পর্যায়ে মানুষ ছাদ থেকে লাফিয়ে পাড়, ছুটে গিয়ে চলন্ত ট্রাকের সামনে দাঁড়ায়। তোর কি এই অবস্থা যাচ্ছে না?
নায়লা কিচ্ছু বলল না। শাড়ির আঁচলে চোখ চেপে ধরল।
অরুনা বেয়াবাকে ডেকে দুকাপ চা দিতে বলল। নায়লার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই যে ভাবে কাদছিস–লোকজন সব দেখছে।
দেখুক।
অরুনা হাসল। মনে হচ্ছে সে খুব মজা পাচ্ছে।
নায়লা।
উঁ।
তুই তো কখনো বোকা ছিলি না। এরকম বোকার মত কাজ কি করে করলি?
আমি বোকার মত কিছুই করিনি।
যে ধাক্কা আসবে সেটা সামলাতে পারবি?
কি ধাক্কা আসবে?
তুই আলম সাহেবের কাছে গিয়ে বলতে পারবি–আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচব। আমার বাকি জীবন আমি আপনার সঙ্গে কাটাতে চাই। এই কথাটা বলার বা এই জাতীয় পরিকল্পনা নেয়ার সাহস কি তোর আছে? না-কি তোর সব সাহস গোপনে ঐ লোকের সঙ্গে রাত্রি যাপনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ?
তুই যা ভাবছিস এরকম কিছু হয়নি।
হয়নি, কিন্তু হাবে। খুব শিগগীরই হবে। হয়ত আজই হবে–আমার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে তুই ভদ্রলোকের কাছে ছুটে যাবি এবং …
প্লীজ চুপ।
আচ্ছা যা, চুপ করলাম। চা খা চা ঠাণ্ডা হচ্ছে।
নায়লা ছোট্ট করে কাপে চুমুক দিল। চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আমার জায়গায় তুই থাকলে তুই কি করতি?
আমি যা করতাম সেটা তুই করতে পারবি না। একেক মানুষ একেক রকম। তোর সিদ্ধান্ত তোকেই নিতে হবে।
নায়লা অস্পষ্ট স্বরে বলল, আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি।
অরুনা বলল, পৃথিবীতে কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়। কষ্ট যেমন চিরস্থায়ী নয় আবার সুখও চিরস্থায়ী না। আলম সাহেবকে না পাবার কষ্ট যত তীব্রই হোক সেটা চিরস্থায়ী না। আবার তোর স্বামী-সন্তানকে হারাবার কষ্টও যত তীব্ৰই হোক—চিরস্থায়ী না। তোর জন্যে সব পথ খোলা। চল্ উঠা যাক।
নায়লা বলল, উনার এপার্টমেন্টের এড্রেসটা কি?
অরুনা বেশ কিছুক্ষণ নিঃশব্দে নায়লার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, উনি আগের ঠিকানাতেই আছেন। তোকে আটকাবার জন্যে মিথ্যা বলেছিলাম।
রাস্তায় এসে অরুনা বলল, তুই ঠিকমত হাঁটতে পর্যন্ত পারছিস না। আয় তো তোকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।
আমাকে পৌঁছে দিতে হবে না। আমি একাই যাব।
বাসায় পৌঁছে নায়লার সঙ্গে প্রথম দেখা
বাসায় পৌঁছে নায়লার সঙ্গে প্রথম দেখা হল বাবুর। এই শীতের মধ্যে তার গায়ে পাতলা একটা গেঞ্জি। তার বগলে একটা কুকুরছানা ঘেউ ঘেউ করছে। মানুষের ভালবাসার অত্যাচারের কষ্টে তার জীবন বের হবার জোগাড়।
বাবু বলল, মাম্মাট কুকুল।
নায়লা বিরক্ত গলায় বলল, কুকুর কে দিয়েছে?
ছোটমামা।
ফেলো কুকুর। ফেলো বলছি।
না।
না কিরে বাঁদর ছেলে–ফেলো।
বাবু আকাশ ফাটিয়ে বলল, না। না। ঘর থেকে নুরু বের হয়ে বিরক্ত মুখে বলল, কুকুর ফেলতে বলছিস ক্যান রে আপা? ইন্টারেস্টিং একটা প্রাণী। কত খুঁজে পেতে আনলাম।
তুই যত নোংরামি শিখাচ্ছিস।
আমি পশুপ্রেম শেখাচ্ছি। পুশপ্রেমে নোংরামি কোথায়?
নায়লা বাবুর কোল থেকে কুকুরছানা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল। আশ্চর্যের ব্যাপার, বাচ্চাটা খানিকক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে আবার রওনা হয়েছে বাবুর দিকে।
নুরু আনন্দের সঙ্গে বলল, মালিক চিনে গেছে। সে চিনে গেছে কে তার প্রভু।
নায়লা কঠিন গলায় বলল, বাবু, কুকুর ধরবে না।
বাবু ঠিক মার মত গলায় বলল–আমি কুকুল ধলব।
নুরু বলল, গুড বয়। এই ছেলে মামার নাম রাখবে। আপ্য, তুই এরকম আগুন দৃষ্টিতে তাকাবি না। তোর জন্যে গুড নিউজ আছে। তুই বাবুকে তার মত ছেড়ে দে–আমি তার বদলে তোকে গুড নিউজ দিচ্ছি। গুড নিউজ হচ্ছে–তার শাড়ি চলে এসেছে। তাকে এখন শুধু খ্ৰী হানড্রেড এক্সট্রা দিতে হবে।
দরকার নেই আমার শাড়ির।
অবশ্যই দরকার আছে। শাড়িটা একবার হাতে নিয়ে দেখ। ধবধবে শাদা। পরলে মনে হবে আকাশের শাদা মেঘ গায়ে জড়িয়ে রেখেছিস।
শাদা শাড়ি?
এই শাড়িকে শাদা বললে শাদা রঙকে অপমান করা হয়। এই রঙের নাম তুষারশুভ্র।
শাড়ি দেখে নায়লার মন ভাল হয়ে গেল। আশ্চর্য, এত সুন্দর!
নুরু বলল, তোর কি এখনো ধারণা আমি ফটকাবাজ?
নায়লা কিছু বলল না। সে শাড়ি থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। নুরু বলল, আমি ফটকাবাজ না। আসল ফটকাবাজ হচ্ছে আমার দুলাভাই। ফটকাবাজ দি গ্রেট। চাকরি-বাকরি চলে গেছে, কাউকে কিছু বলেনি। গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বসে আছে।
নায়লা বিরক্ত হয়ে বলল, তুই এইসব কি বলছিস?
একশ ভাগ খাঁটি কথা বলছি। দুলাভাই দুটা চিঠি পাঠিয়েছে–একটা মার কাছে, একটা তোমার কাছে। মার চিঠিতেই জানা গেল দুলাভাই বরখাস্ত হয়েছেন। তোমাকেও নিশ্চয়ই লিখেছেন। চিঠি পড়ে সব জানতে পারবে। তবে মা যেমন আয়োজন করে কান্নাকাটি শুরু করেছেন–তুমি দয়া করে তা করতে যেও না। শাড়ি কি পছন্দ হয়েছে আপা?
হুঁ।
তিনশটা টাকা দিয়ে দিও। আছে তো? না কি তুমি পথের ফকিরণী?
নায়লা ভাইকে তিনশ টাকা দিল। মার কাছ থেকে জামানের চিঠি এনে পড়তে শুরু করল। কি সাধারণ সাদামাটা ভঙ্গিতে চিঠি শুরু হয়েছে। কোন প্রিয় সম্বােধন নেই, কিছু নেই-–
নায়লা,
একটা দুঃসংবাদ শুরুতে দিচ্ছি। আমার চাকরি নেই। বেশ কিছুদিন ধরেই নেই। তোমাকে বলতে পারছিলাম না। বলতে লজ্জা পাচ্ছিলাম বলেই যে বলিনি, তা কিন্তু না। তুমি কষ্ট পাবে সে জন্যেই বলতে পারিনি।
আমি কাউকে কষ্ট দিতে চাই না। কিন্তু কেন জানি আমার কারণে মানুষ সবচে বেশি কষ্ট পায়। আমার বাবা ছিলেন স্কুলের অংক শিক্ষক। তাঁর মত অংক-জানা লোক গোটা ময়মনসিংহ জেলায় নেই এমন একটা প্রবাদ প্রচলিত ছিল। মেট্রিক পরীক্ষার সময় তিনি কত যত্ন করে যে আমাকে অংক শেখালেন! সেই আমি অংকে ফেল করলাম। অন্যসব সাবজেক্টে ভাল নাম্বার, শুধু অংকে একুশ। প্রথমবার আমি মেট্রিক পাশ করতে পারিনি শুধু অংকের কারণে। রেজাল্ট হবার পর, বাবা সারাদিন বারান্দায় মাথা নিচু করে বসে রইলেন। আর দু মাসের মাথায় বাবার মৃত্যু হল। আমি পরের বছর অংকে লেটার নাম্বার নিয়ে পাশ করলাম। বাবা তা দেখে গেলেন না।
আমার মা সাদাসিধা মানুষ ছিলেন। তিনি শুধু চেয়েছিলেন–আমি একটা চাকরি করি এটা দেখে যেতে। মা দেখে যেতে পারেননি। তিনি শুধু দেখেছেন আমি পাগলের মত চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছি। মা তখন খুব অসুস্থ। মৃত্যুশয্যা পেতেছেন। রোজ দুপুরে একবার জিজ্ঞেস করেন, ও খোকন, পিওন কি এসেছে?
আমি বলি, হ্যাঁ।
চাকরির কোন খবর আছে বাবা?
না, কোন খবর নেই।
আমার ফুপু আমাকে বললেন, খোকন, তুই মিথ্যা করে বল চাকরি পেয়েছিস। দেখছিস না তোর মার অবস্থা?
আমি ফুপুকে বললাম, একজন মানুষ মরে যাচ্ছে, তাকে ভুলাবার জুন্যে আমি মিথ্যা কথা বলব না।
ফুপু কঠিন গলায় বললেন, তোর কপালে দুঃখ আছে। তুই মানুষ, তুই নিতান্তই গরু।
ফুপু মাকে গিয়ে বললেন, খুব ভাল সাদ। খোকনের চাকরি হয়েছে। চিঠি এসেছে।
মা আগ্রহের সঙ্গে বললেন, কই, কই! চিঠি কই?
ফুপু মার হাতে কি একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন। মা পড়তে জানতেন না। সেই তুচ্ছ কাগজ বুকে জড়িয়ে তিনি অনেকক্ষণ। কাঁদলেন–তোর বাবা বেঁচে থাকলে আজ কত খুশি হত? কই খোকন, আমাকে সালাম কর। এত ভাল সংবাদ এসেছে, মাকে সালাম করে দোয়া মিবি না?
আমি মাকে সালাম করলাম না। ভ্রান্তিকে প্রশ্রয় দিলাম না। ফুপু মাকে বললেন, খোকন লজ্জা পাচ্ছে। সালাম করবে না। তুমি বিনা সালামেই ছেলের জন্যে দোয়া কর।
মা আমার জন্যে দোয়া করলেন। নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে অসীম শোকরিয়া জানিয়ে তৃতীয় দিনের দিন মারা গেলেন। মৃত্যুর সময়ও সেই তুচ্ছ কাগজ ছিল তাঁর হাতে।
কিছু কিছু মানুষ বিচিত্র ভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে আসে। আমার ভাগ্য হচ্ছে, আমি কখনো প্রিয়জনদের প্রত্যাশা পুরণ করতে পারব না।
তোমার চেয়ে প্রিয়জন আমার কে আছে? তোমার প্রত্যাশী যে আমি পুরণ করতে পারব না তা আমি ধরে নিয়েই জীবন শুরু করেছি।
তুমি সম্প্রতি যে অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি–সেই অস্থিরতা এবং সেই অস্থিরতার কারণ আমার অজানা নয়। তোমার এই প্রচণ্ড দুঃসময়ে আমি তোমার পাশে দাঁড়াতে পারছি না, কারণ কিছু কিছু যন্ত্রণা আছে যা একা বহন করতে হয়, এবং যন্ত্রণা জয়ের পথ বের করতে হয়।
নায়লা, আমার একমাত্র শুভ কামনা তুমি তোমার যন্ত্রণমুক্তির পথ নিজেই বের করবে। তোমাকে শুধু এই আশ্বাস দিতে চাচ্ছি–তুমি যে পথই বেছে নাও–আমার তাতে সমর্থন থাকবে। সেই পথ যদি আমার জন্যে তীব্র কষ্ট ও গ্লানির হয়–তাতেও ক্ষতি নেই। শুধু তুমি ভাল থেকো তুমি কষ্ট পেও না।
আমি এখানে ভালই আছি। বাবা যে স্কুলে চাকরি করতেন, আমি সেখানেই চাকরি পেয়েছি। বেতন সামান্য। তবে এতেই চলে যাবে। পৃথিবীর কাছে আমার দাবি সামান্যই।
নায়লা, আমি আর শহরে ফিরে যাব না। এখানেই থাকব। আমার জন্যে এই ভাল। অফিস-উফিসের চাকরি আমাকে দিয়ে হবে না।
ঐ রাতে গান শিখতে না পারার যে কষ্টের কথা তুমি বলেছ তাতে আমিও খুব কষ্ট পেয়েছি। তোমার অপূর্ব গানের গলার কথা আমি যে জানি না তা না। বাবুকে ঘুম পাড়ানোর জন্যে তুমি গুন গুন করে গান করতে, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। এই সুরের পেছনে দুঃখজনক ব্যাপারটা জানতাম না। নায়লা, তুমি দুঃখ করো না–তোমার গলায় যে সুর আছে তা পরম করুণাময় দিয়ে পাঠিয়েছেন। এটা তাঁর উপহার। কাজেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি এই সুত্ব রক্ষা করবেন। এটা রক্ষা করার দায়িত্ব তারই।
তুমি ভাল থেকো।
পুনশ্চ : আমি কি চিঠিটা গুছিয়ে লিখতে পারলাম? তুমি বোধহয় জান না–আলম রেশমার কাছে যে কটি চিঠি লিখেছে তার সবই আমার লেখা। ও শুধু কপি করেছে। এটাও একটা মজার কোইনসিডেন্স।
নায়লা সারা বিকেল শুয়ে রইল। সন্ধ্যার আগে আগে পানি গরম করে গোসল করল। তার নতুন ফ্রেঞ্চ শিফন পরতে ইচ্ছা করছে।
জাহানারা বলেন, সন্ধ্যাবেলা এত সাজগোজ করছিস কেন রে?
নায়লা বলল, সাজগোজের কি দেখলে? শাড়িটা বদলাচ্ছি।
সন্ধ্যাবেলা শাড়ি বদলাবি কেন? সন্ধ্যাবেলা শাড়ি বদলানো খুব অলক্ষণ।
হোক অলক্ষণ।
নায়লা শাড়ি বদলাল। বিয়েতে সে রূপার একসেট গয়ন! পেয়েছিল। না ব্যবহারে সেই গয়নায় কালো কালো ছোপ পড়েছে। নায়লা সেই গয়না বের করে তেল দিয়ে ঘসে ঘসে দাগ তুলল। শাদা শাড়ির সঙ্গে রূপার গয়না খুব মানাবে। কাজলদানি ফেলে এসেছে। চোখে কাজল তো দিতেই হবে–কাঠালের পাতা পাওয়া গেলে কাঁঠাল পাতার উল্টো দিকে তেল মাখিয়ে কাজল বানানো যেত।
জাহানারা বললেন, নায়লা, তুই কি কোথাও যাচ্ছিস?
হুঁ।
কোথায়?
হোটেল শেরাটনে। তুমি আমাকে কাজল বানিয়ে দাও তো মা, কাজল পরব।
তোর ভঙ্গি যেন কেমন কেমন লাগছে! ভর সন্ধ্যায় তুই কোথায় যাবি?
নায়লা হাসল।
মায়াময় কোন ছায়াবীথির দিকে
আলম অবাক হয়ে বলল, আরে তুমি! নায়লা হাসতে হাসতে বলল, আমাকে কেমন লাগছে আগে বলুন।
সুন্দর! অসম্ভব সুন্দর!
শাদী শাড়ি পরে আছি, বিধবার মত লাগছে না তো?
তোমাকে শ্বেতপরীর মত লাগছে। এত সুন্দর সাজ করা কোন মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি।
আর কোনদিন দেখবেনও না। আমি চলে যাচ্ছি।
কোথায় চলে যাচ্ছ?
আপনার বন্ধুর কাছে। চাকরি-টাকরি গিয়ে ওর একাকার অবস্থা। দেশের বাড়ি চলে গেছে। ওখানে গ্রামের স্কুলে মাস্টারি করবে।
আলম বিস্মিত হয়ে বলল, তুমি সেখানে যাচ্ছ?
হুঁ।
জঙ্গলে পড়ে থাকবে?
নায়লা হাসতে হাসতে বলল, কি আর করা আমি আপনার কাছে বিশেষ কাজে এসেছি।
কাজটা কি?
আপনি আমাকে ঢাকা রেল স্টেশনে পৌঁছে দেবেন এবং একটা ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কেটে দেবেন। আমার কাছে টাকা নেই।
তুমি একা একা যাবে?
হ্যাঁ, একা একা যাব এবং শেষ রাতে আপনার বন্ধুকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে চমকে দেব।
বল কি?
আপনাকে আরেকটা কাজ করতে হবে। আমার মার বাসায় গিয়ে আমি যে নেত্রকোনা যাচ্ছি এই খবরটা দিতে হবে। মা কিছু জানেন না।
অবশ্যই উনাকে আমি খবর দেব।
আর নুরুকে বলবেন সে যেন বাবুকে এবং আমাদের জিনিসপত্র নেত্রকোনায় পৌঁছে দেয়।
আচ্ছা। আর কি আদেশ?
আদেশ হচ্ছে, দেরি না করে অরুনাকে বিয়ে করুন। এরকম মেয়ে পাবেন না।
আদেশ পালিত হবে।
তাহলে চলুন রওনা হওয়া যাক। ট্রেনের বেশি দেরি নেই।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। প্রথম শ্রেণীর একটা কামরায় নায়লা একা। সে জানালা দিয়ে মুখ বের করে আছে।
আলম বলল, একা একা যেক্তে ভয় লাগছে না তো?
নায়লা বলল, একা কোথায়? ট্রেন ভরতি যাত্রি।
নায়লা হাসল। আলম চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে আসছে। এক সময় সে থমকে পঁড়িয়ে গিয়ে বলল, নায়ল! ভাবী, তুমি ভাল থেকো।
অনেক দিন পর আলম তাকে ভাবী ডাক। নায়লা হাত নাড়ছে। তার শাদা শাড়ি উড়ছে পত পত করে।
নায়লার মনে হচ্ছে, সমস্ত দুঃসময়, সমস্তু গ্লানি ও হতাশা পেছনে ফেলে এই ট্রেন তাকে নতুন কোথাও নিয়ে যাচ্ছে–ট্রেন যেন এগুচ্ছে মায়াময় কোন ছায়াবীথির দিকে।