বাবা পান খাবে?
জোবেদ আলি আনন্দিত চোখে মেয়েকে দেখলেন। তিনি পান খান না। তারপরেও আগ্রহের সঙ্গে পান নিতে নিতে বললেন মা শোন আমাকে সামান্য কিছু টাকা ধার দিতে পারবি?
কত টাকা?
আড়াইশ। চারা কিনব, দুশ টাকা দাম। টবের মাটি তৈরির কিছু খরচ আছে। কয়েক পদের সার দিতে হবে, পটাশ, ইউরিয়া। ক্যামিকেল পটাশ দিব না। হাড়ের গুড়া পাওয়া যায়। তাই দেব। নার্সারীতে আসা যাওয়ার রিকশা ভাড়া আছে। সেটা ধরছি না। কারণ আমি রিকশায় উঠি না বললেই হয়। হাঁটি, এতে টাকা বাঁচে আবার ব্যায়ামও হয়। আমার যে বয়স এতে ব্যায়ামটা খুবই দরকার। এই বয়সে কুন্তীর আখড়ায় ভর্তি হওয়াতে সম্ভব না। হাঁটাহাঁটিটা সম্ভব। সেটাই করি। হা হা হা।
জাহানারা বিস্মিত হয়ে বাবাকে দেখছে। তার কাছে মনে হচ্ছে মা যে একটু আগে বলেছেন মানুষটার মাথা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে সেটা খুবই সত্যি।
বাবা টাকাটা কি তোমার এখনই দরকার?
না এখন দরকার নেই। সকালে দিলেও হবে। আর মা শোন আরেকটা কথা। জামাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে দেখিস তো—তাদের এত বড় বাড়ি, পেছনে এত জায়গা খামাখা পড়ে আছে।
তুমি বাগান করবে?
কোনো অসুবিধা নেই—আমার একটা কোদাল লাগবে, একটা খুরপাই, পানি দেয়ার জন্যে ঝাঝড়ি। দামটা হিসাব করি—একটা কোদাল একশ টাকা, খুরপাই পঁচিশ, ঝাঝড়ি একশ। মাত্র দুই আড়াইশ টাকার মামলা। চারা কিনতে হবে। সেটার খরচ আলাদা। নার্সারীওয়ালাদের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। নাম মাত্র মূল্যে চারা এনে দিব। বাড়ির সামনে ফুলের বাগান। পিছনে ফলের। তবে বাড়ির সামনে কিছু নারিকেল গাছ লাগিয়ে দেব। এই ধর পঞ্চাশটা নারিকেল গাছ। নিউনেশান নার্সারীতে কেরালা থেকে নারিকেল চারা এসেছে। গাছ বেশি বড় হয়
তবে দুই বছরে ফল দিবে। বছরে একেকটা গাছ থেকে তুই খুব কম করে হলেও দুশ নারিকেল পাবি। একেকটা নারিকেল পঞ্চাশ টাকা করে ধরলে কত হয়? চট করে হিসাব করে বল তো- দুশ গুণন পঞ্চাশ। কত হয়? আজকাল আর বড় বড় হিসাব কাগজ কলম ছাড়া করতে পারি না।
জোবেদ আলি উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করছেন। জাহানারা ভাবছে আর দেরী করা ঠিক হবে না। তার বাবাকে অতি দ্রুত কোনো ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে।
রাহেলাকে দেখে মনে হবে তিনি গভীর আগ্রহে আক্তারী বেগমের কথা শুনছেন। আসলে তা না। ঘুমের অষুধ খাবার কারণে ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। তিনি চেষ্টা করছেন জেগে থাকতে। যে ঘরে বসেছেন—সেই ঘরের দরজা জানালা বন্ধ। আগরবাতি জ্বলছে। আগরবাতি ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। জাহানারার শাশুড়ি আবার ঘরে ঢুকা মাত্র হাতের চেটোয় আতর ঘসে দিয়েছেন। আতরের কড়া গন্ধও শরীর যেন কেমন করছে। ঘরটা ছোট সেই তুলনায় অনেক মহিলা বসে আছেন। শুধু যে এ বাড়ির মহিলারাই আছেন তা না, মনে হয় বাইরে থেকেও কেউ কেউ এসেছেন।
আক্তারী বেগম মহিলাদের মধ্যে বসে থাকলেও বোরকা পরে আছেন। কালো বোরকার ভেতর থেকে তার চোখ শুধু দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটা বড় বড় এবং শান্ত। তিনি মিষ্টি গলায় কবরের আজাবের কথা বলছেন। বেনামাজীর কি শাস্তি কবরে হবে তার বর্ণনা।
কবরে বেনামাজীর কি শাস্তি জানেন? সুজা আকরার সঙ্গে বেনামাজীর দেখা হবে কবরে। সুজা আকরা কে জানেন? সুজা আকরা একটা সাপের নাম। অজগর সাপ। সেই সাপ মানুষের মতো কথা বলবে। সাপটা পৃথিবীর সাপের মতো না। অন্য রকম। এই সাপের নখ আছে। কত বড় নখ শুনবেন? একজন মানুষ একদিনে যত পথে হাঁটতে পারে তত বড়। অর্থাৎ প্রায় চল্লিশ মাইল। এই সাপ বেনামাজীর গায়ে নখ দিয়ে আঘাত করবে। এক একটা আঘাতে বেনামাজী মাটির নিচে পঞ্চাশ গজ ডেবে যাবে। বুঝেন অবস্থা।
শাস্তি আরো আছে—কবর আপনি যত বড় করেই বানান-বেনামাজীর কবর ছোট হতে থাকে। কবর শরীরের উপর চাপ দেয়। কেমন সেই চাপ? এমন চাপ যে পাজরের বাম দিকের হাড় চলে আসে ডানদিকে। আর ডানদিকের হাড় চলে যায় বাম দিকে।…
রাহেলা বেগম ঘুম কাটানোর অনেক চেষ্টা করছেন। ধর্মীয় আসরের মাঝখানে ঘুমিয়ে পড়া খুবই অন্যায় হবে। এই আসর কখন ভাঙ্গবে কে জানে। সুজা আকরা নামের সাপটা নিয়ে তিনি এই মুহূর্তে কোনো চিন্তা করছে না। সময় আসুক তখন দেখা যাবে। আপাতত যে কাজটা করতে হবে তা হচ্ছে জেগে থাকা…।
রানী মেয়েটাও সুজা আকরা সাপের কথা শুনছে। তবে মাঝেমধ্যে ফিক ফিক করে হাসছে। মেয়েটা তার দেয়া শাড়িটা পরল না কেন? রঙ পছন্দ হয়নি? না-কি মেয়েটা তাকে বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছে—খাতির করতে এসো না।
রাণী মন খারাপ করে ঘুমুতে গেছে
রাণী মন খারাপ করে ঘুমুতে গেছে। ঘুমুতে যাবার আগে সবার সঙ্গে কিছুক্ষণ রাগারাগি করেছে। সবচে বেশি করেছে তার ভাবীর সঙ্গে। রাণীর একটা সুবিধা আছে যার সঙ্গে সে রাগারাগি করে সে সেটা বুঝতে পারে না। সে ভাবে নিতান্তই স্বাভাবিক ভাবে কিছু কথা বলা হল। কারণ ঝগড়া করার সময় রাণীর মুখ হাসিখুশি থাকে। এ রকম স্বভাব তার আগে ছিল না। আগে রাগারাগির সময় তার মুখ লাল হয়ে যেত। হাত পা কাঁপতে থাকত। কলেজে ভর্তি হবার পর হঠাৎ একদিন মনে হল, আচ্ছা রাগারাগি হাসিমুখে করা যায় না। কঠিন কঠিন কথা হেসে গড়িয়ে পড়তে পড়তে বললে কেমন হয়? সেই থেকে সে নতুন পদ্ধতি চেষ্টা করে যাচ্ছে। শুরুতে পদ্ধতিটা ঠিকমত প্রয়োগ করা যেত না। এখন যায়। রাণী নিজেই নিজের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়। আজও হয়েছে। জাহানারাকে সে হাসতে হাসতে কঠিন কিছু কথা বলেছে। এই কথাগুলিই না হেসে সে যদি শুধু স্বাভাবিক গলায় বলতো তা হলে জাহানারা নিশ্চয়ই কেঁদে ফেলত।