নান্টুর মেসঘরটা বেশ বড়। সেখানে নান্টুর জন্যে একটা ডাবল খাট পাতা। খাটের পাশেই একটা সিঙ্গেল চৌকি আছে হঠাৎ চলে আসা গেস্টদের জন্যে। একটা চৌদ্দ ইঞ্চি ব্ল্যাক এণ্ড হোয়াইট টিভি আছে। ভিসিপি আছে। নান্টুর ছবি দেখার বাতিক। ঘুমুতে যাবার আগে হিন্দী ছবির পুরোটা বা সিকিটা না দেখলে তার ঘুম আসে না। ফরহাদ নান্টুর এখানে এলে রাতে থেকে যায়।
গোসল সেরে এসে নান্টু বলল, কি ছবি দেখবি? একশান না সোসাল? কমেডিও আছে। সব রকম এনে রেখেছি। কার্টুনও আছে। অর্ণবের আসার কথা ছিল তার জন্যে টম এন্ড জেরী। বিড়াল আর ইঁদুরের খামচা খামচি।
একটা দেখলেই হয়।
একশান দেখি আয়। সোস্যাল ছবি এখন ভাল লাগবে না। কফি খাবি?
কফির ব্যবস্থা আছে? ইনসটেন্ট কফির একটা কৌটা কিনে রেখেছি—ভাল ছবি দেখার পর হঠাৎ হঠাৎ খেতে ইচ্ছা করে। এই মাসে যদি বেতন হয়—ঠিক করে রেখেছি একটা রকিং চেয়ার কিনব। দোল খেতে খেতে কফি খাওয়া এর মজাটা অন্য রকম তাই না?
হুঁ।
নান্টু কেরোসিনের চুলায় পানি গরম করতে করতে বলল—চাকরির সমস্যা ছাড়াও তোর অন্য কোন সমস্যা আছে। দেখেই বুঝতে পারছি। সমস্যাটা কি খুলে বলতো। ঝেড়ে কাশ। তোর গলায় কফ আটকে আছে।
ফরহাদ ইতস্তত করে বলল, নান্টু ভাই আমার বিয়ে।
নান্টু বিস্মিত হয়ে বলল, বিয়ে মানে? কবে বিয়ে?
শুক্রবারে।
এই শুক্রবারে?
জ্বি।
মেয়েটা কে? ঐ যে অফিসে তোর খুঁজে মাঝে মধ্যে আসে। আসমানী?
জ্বি।
হুট করে বিয়ে করছিস ব্যাপারটা কি?
আসমানীর মামা এসেছেন জাপান থেকে উনি চলে যাবেন। যাবার আগে ভাগ্নির বিয়ে দিয়ে যাবেন।
বিয়ে করতে যাচ্ছিস হাতে টাকা পয়সা আছে?
না।
না-মানে? একটা ফকির কখন ফকিরনীকে বিয়ে করে তারও হাজার তিনেক টাকা খরচ হয়—তোর হাতে এখন নেট কত টাকা আছে?
বারশ চল্লিশ।
বলিস কি? শুক্রবার মেয়ের বাড়িতে গিয়ে বিয়ে পড়ানো হবে?
সে রকমই জানি।
হেঁটে হেঁটে তো আর বিয়ে করতে যাওয়া যায় না–মাইক্রোবাস ভাড়া করতে হবে। ঘণ্টায় দুশ টাকা হলে চার ঘণ্টায় লাগবে আটশ। বিয়ের পর বউ নিয়ে বাসায় আসবি না-কি ওরা বউ পরে উঠিয়ে দেবে?
কিছুই জানি না।
তুইতো মহাগাধা দেখি টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলি পরিষ্কার করে রাখবি না। হাতেতো সময়ও নাই। দেখি কাল সন্ধ্যায় আমাকে ঐ বাড়িতে নিয়ে যা—।
আচ্ছা।
ঝামেলা যখন শুরু হয় একসঙ্গে শুরু হয়। যাই হোক যত মুশকিল তত আসান। চিন্তা করিস না। বউয়ের মেজাজ মর্জি দেখে চলবি। আমি যে সব ভুল করেছি সেইসব ভুল করবি না। যেমন ধর রাত বিরাতে বাড়ি ফেরা। অবশ্যই সন্ধ্যার পর ঘরে থাকবি। টাকা পয়সার সমস্যা যদিও হয় বউকে জানতে দিবি না। নিজের মধ্যে হজম করে রাখবি।
ফরহাদ বলল, ভাবীর সঙ্গে আপনার সমস্যা কি মিটিছে?
নান্টু বলল, প্রায় মিটেছে। তবে এখনো রাগ দেখাচ্ছে। দেখাক রাগ। উপরে উপরে রাগ ভেতরে অভিমান।
এটাতো ভালই।
ভাল কি-না জানি না, তবে খুবই যন্ত্রণা দায়ক। একটা জিনিস তুই খেয়াল রাখবি—মেয়েরা পুরুষ মানুষের মত না। তারা আলাদা। সম্পূর্ণ আলাদা। তোর ভাবীর কথাই ধর—বাপের বাড়িতে থাকছে। ডিভোর্সের কথা মাঝে মধ্যে বলছে। আমাকে রাগানোর জন্যেই বলছে। অন্য কিছু না। কিন্তু আজ কি হয়েছে শোন। অতিরিক্ত পান খাবার জন্যে আমার দাঁত লাল হয়েছে—এই নিয়ে তোর ভাবী যা শুরু করল বলার মত না। রাগারাগি, চিৎকার–কেন পান খেয়ে দাঁত নষ্ট করছ। তুমি পেয়েছটা কি? নিজের দিকে লক্ষ্য রাখবে না?
যে মেয়ে ডিভোর্স চায় সেকি কখনো এমন কথা বলবে?
না তা বলবে না।
তোর ভাবী জানে ডিভোর্সের কথা উঠলে আমি মন খারাপ করি এই জন্যেই বার বার কথা তুলে। মেয়েরা খুবই আজব জাত। যাকে তারা পছন্দ করে তাকে কষ্ট দিয়ে খুবই মজা পায়। তুইতো বিয়ে করছিস নিজেই বুঝবি। তিন মাসের মাথায় দেখবি হাসতে হাসতে তোর বউ এমন সব কথা বলবে যে রাগে মাথার তালু জ্বলে যাবে। চুল খাড়া হয়ে যাবে। এইসব কথাকে মোটেই গুরুত্ব দিবি না। এইসব মনের কথা না।
আচ্ছা।
তোর বউ কি পছন্দ করে না করে সে দিকেও নজর রাখবি। ধর সে রসমালাই খেতে পছন্দ করে। তুই করবি কি প্রায়ই রসমালাই এক হাড়ি কিনে বাসায় ফিরবি। তোর বউ জানবে সে কি পছন্দ অপছন্দ তা তুই জানিস।
ফরহাদ হাসল। নান্টু বিরক্ত গলায় বলল, হাসির কথা না। আমি খুব টেকনিক্যাল কথা বলছি। বউ কখন রেগে যাচ্ছে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সেই মত ব্যবস্থা নিবি। কোন কোন মেয়ে আছে রাগলে তাদের নাক ফুলে যায়। ৩খন খেয়াল রাখতে হবে বউ-এর নাকের দিকে। একে বলে লক্ষণ বিচার। বিয়েতে সুখ যেমন আছে যন্ত্রণাও আছে। দুইই সমান সমান।
নান্টু ভিসিআর ছেড়ে দিল। ফরহাদ বলল—আপনার মাথা ধরেছে আজ ছবি না হয় না দেখলাম।
নান্টু বলল থাক বাদ দে। শুয়ে পরবি?
হ্যাঁ।
মশারি খাটানোর দরকার নেই। মশা কম। মশারি খাটালে ফ্যানের বাতাস পাবি না।
ফরহাদ শুয়ে পড়ল। হঠাৎ করে তার খুব ঘুম পাচ্ছে। চোখ জড়িয়ে আসছে। মনে হচ্ছে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়বে। এরকম প্রচণ্ড ঘুম খুবই ভয়াবহ–বিছানায় যাওয়া মাত্র ও জাতীয় ঘুম কেটে যায়। ফরহাদের ধারণা পৃথিবীতে তিন রকমের ঘুম আছে—চলন্ত ঘুম। ট্রেন বা গাড়ি যখন চলে তখন এই ঘুম আসে। গাড়ি থেমে গেলেই ঘুম কেটে যায়। বসন্ত ঘুম—বসা অবস্থায় এই ঘুম আসে। বিছানায় শুলেই ঘুম নেই। আর একটা ঘুম হল—বিছানা ঘুম। এই ঘুম। বিছানায় আসে—আসল ঘুম।